পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ছোটবেলার হ্যারি বড় হওয়ার সঙ্গী

  • 28 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1147 view(s)
  • লিখেছেন : স্বাতী বসু
হ্যারি বেলাফন্টে, জন্ম পয়লা মার্চ, ১৯২৭ হারলেম , নিউ ইয়র্ক। মৃত্যু পঁচিশে এপ্রিল, ২০২৩, ম্যানহাটান, নিউ ইয়র্ক। ছিয়ানব্বই বছরের এই মানুষটা ছুঁয়ে গেছে মানুষের জীবন। তিনি পেরেছেন পাল্টে দিতে রাষ্ট্রের রীতি নীতি, লক্ষ মানুষের মন তাদের জীবনবোধ । সারি সারি অট্টালিকার মাঝে তিনি কখনো হারিয়ে যেতে দেননি তার সোনালী বালুচরী নীল সমুদ্র টাকে। আমাদের চির জীবনের বন্ধু বেলাফন্টে তোমাকে সেলাম!

সন্ধ্যেবেলা  এক বন্ধু ফোন করে বললো হ্যারি বেলাফন্টে  'no more ' । বেলাফন্টে তো no more হতে পারেনা তাই না? দেশ, কাল , সীমানার গণ্ডি ছাড়িয়ে হ্যারি আমাদের সকলের বন্ধু।  তার সুরই প্রথম তাকে আমার মত মানুষের কাছে পৌঁছেছে। পরে বুঝছি সে মানুষটার ব্যাপ্তি বহু , বহু দূর।  গলায় ভরা জাদু, এত রকমারি আওয়াজ আর তাতে যেন একটা নাচন আছে! হ্যারির গাওয়া অন্য কোনো গান আমার পক্ষে গাওয়া ছিল অসম্ভব, তাই জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েলই ছিল এক কুমির ছানার মত। ইংরিজির সাথে বাংলা অনুবাদ মিলিয়ে এক সাথে গাইতাম আমরা, শিখিয়ে ছিল এক দাদা, আমাদের প্রকৃতিকে চেনার সেই ছোটবেলার ক্যাম্পে।
সেদিন বেলাফন্টের  চলে যাওয়ার খবরটা  পাওয়ার পর ছোট  কালো একটা চতুর্ভুজ যন্ত্রের ছবি ভেসে উঠলো। এখন যেমন মুঠোয় থাকে গানের ভান্ডার তখনও ছিল । ক্যাসেট নামক বস্তুটি কত গানই না শুনিয়েছে আমাদের।  মধ্যবিত্ত বাঙালি , মা এর রান্না বাটির সংসারে  মধুর ধ্বনি বাজত বৈকি! তবে তার ভাষা বাংলা। মূলত রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় , নজরুল। আবার ওদিকে ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে বা শ্যামল মিত্রের গলায় বাঙালির নেশা ধরানো পুরনো দিনের গান।  এসবের মাঝে বাবা এনে দিয়েছিল হাতে গোনা দুটি হিন্দি ও কয়েকটি ইংরিজি গানের ক্যাসেট।  কর্পেন্টারস, সাইমন- গারফানকেল, জন ডেনভার, হ্যারি বেলাফন্টে, ক্লিফ রিচার্ডস। একটা সাউন্ড অফ মিউজিক এর  ক্যাসেটও ছিল বটে! যখন মন ভালো থাকতো তখনও শুনতাম, আবার খারাপ থাকলে  
' I  simply remembered my favourite ' songs!

 

https://youtu.be/Ch4ckcyjzKE

 

অন্য সুর ,অন্য আনন্দ, অন্য ছন্দ।  বাবার সাথে মজা করে গান শুনতাম, একটু আধটু গলা মেলাতাম । মাঝে মাঝে দুপুরবেলা গানগুলো শুনতাম আর টেপ রেকর্ডের যন্ত্র বন্ধ করে করে ডায়রীতে গান টুকে রাখতাম। কথায় কথায় লিরিক্স পাওয়া যেত না আমাদের সময়ে।
দেখতে পেতাম না লোকগুলোকে, ক্যাসেটের ওপরের ছবিই ভরসা । রবি ঠাকুরের ভাষায়  বলি 'এখনও তারে চোখে দেখিনি ' শুধু গান শুনেছি প্রাণ ভরে! হ্যারি বেলাফন্টের গানই  আমার সে ডায়রী তে বেশি লেখা হত কারণ তার কথাগুলো স্পষ্ট বোঝা যেত!

গান জীবনের কথা বলে আর জীবন কত সময় বাঁচে গানের ওপর ভর করে।
প্রেমে পড়া আর তার সাথে স্বপ্নের জাল বোনা, পিছলে পড়ে আছাড় খাওয়া, নতুন করে প্রেমে জড়িয়ে পড়া .. কিন্তু পুরনো প্রেমের প্রতি একটা টানের অনুভূতি এসবই তো পেতাম লোকটার গানে গানে। ফেলে আসা শহর, ফেলে আসা রাস্তা ঘাট, নদী বন্দর, সাগরের নীল জল, সোনালী বালু চর ভেসে বেড়ায় তার গানে গানে,  চোখের পাতায় পাতায়।
মার্কিন মুলুকের চোখ ধাঁধানো প্রতাপ কোনদিন পারেনি হ্যারি কে তার জীবনবোধ থেকে এক চুল নড়াতে। তার শিকড়ের টান তাকে শুধু যে তার নিজের দেশের মানুষের কথা ভাবতে শিখিয়েছে তা নয়, সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের গুণগান গেয়েছেন তিনি।
এই গান শুনতে শুনতে বড় হতে লাগলাম। এল কলেজ জীবন, জুটে গেল কিছু সমমনস্ক বন্ধু আর দেখলাম ওরাও ভালোবাসে বেলাফন্টেকে। আগে একটু জানতাম তখন বেশী করে পরিচিত হলাম পিট সিগারের সাথে। এতদিনে নিজেই ক্যাসেটের ভান্ডার রক্ষা করার দায়িত্ব পেয়ে গেছি, সুতরাং বেড়ে উঠলো আমার গানের রসদ।
বব ডিলান, জিম রিভস এর সাথে প্রথম পরিচয় ঘটলো।  আস্তে আস্তে পুরনো পরিচিত গানগুলো আরো জীবন্ত হতে শুরু করল। চিন্তা প্রবাহে অন্য হাওয়া লাগালো সব পুরনো নতুন গানগুলো, মানুষগুলো! ভালোবাসতে শেখালো নিজের একান্ত সীমানার বাইরের পৃথিবীটাকে। কাছে নিয়ে এলো অজানা, অচেনা নানা জীবনের কথা। বেলাফন্টে, সীগার, ডিলান, লেনন এদিকে আমাদের গণ সঙ্গীত বোঝালো শিল্পকে কেমন করে লড়াইয়ের হাতিয়ার বানানো যেতে পারে!

https://youtu.be/H5dpBWlRANE


যেদিন প্রথম আব্বাস উদ্দিন শুনলাম, মনে হল আরে এ যে হ্যারির সেই বেনানা বোটের কথা বলছে। হ্যারি আমাদের নিয়ে চলে নৌকা চড়িয়ে সেই নদীর বুকে। মাঝি নৌকা বায় তোমার দেশে হ্যারি, তারা নৌকা বোঝাই কলা নিয়ে বাড়ির দিকে চলে  আর আমার দেশেও সেই একই জীবনের স্রোত বয়ে চলেছে, সারা রাত জেগে  ধরা রূপালী মাছে ভরা থাকে তাদের ডিঙি নৌকা। ওদের পালে হওয়া লাগায় গান ,  কথা বলে সুরে সুরে, চাঙ্গা রাখে তাদের,  আর ছন্দ মিলিয়ে হাল ধরে তাদের জীবিকা।
আমার কাছে মিলে যেতে লাগলো  আমার দেশ আর হ্যারির দেশের জীবন।
নতুন করে ভাবলাম , মানে ভাবতে শিখলাম। বেলাফন্টের গান 'কিংস্টন মার্কেট' ক্যারিবিয়ান দ্বীপের গ্রামের হাটের কথা বলে, পসরা নিয়ে বেচে কেনে সে গাঁয়ের মানুষ ।  কি পাওয়া যায় ওদের হাটে, কেমন মানুষ জনের সমাবেশ সে হাটে, জেনে যাই আমরা । আমি আবার মিল খুঁজে পাই আমাদের সেই পদ্মা নদীর পাশে, বকশি গঞ্জের হাটের সাথে! লোক সঙ্গীতের মহিমা বুঝতে সময় লাগে , আমারও লেগেছে! গলা ফাটিয়ে হ্যারি গায় 'কোকোনাট উইম্যান', এক ডাববিক্রেতা মহিলার কথা বলে সে আমাদের। তার সে ডাক সমুদ্র পেরিয়ে পৌঁছে যায় আমাদের কাছে। সে গান শুনলে কেমন নাচন ধরে পায়ে, আজও খুশির অনুভূতি জাগে মনে!
 
হ্যারির গানে কেবল ফিরে ফিরে আসে তার মাটির কথা। যে মানুষ তার দেশকে অমন ভালোবাসতে পারে সেই পারে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে। আর তাই সেই পেরেছে দেশে দেশে মনে শুভ চেতনার জন্ম দিতে।
নিগ্রো ভাই পল রবসন তাকে শিখিয়েছেন মানুষের জন্য লড়াই। রোমান্টিক হ্যারি  হয়ে তাই থেমে থাকে নি সে, তার তীব্র প্রতিবাদের ভাষা নাড়িয়ে দিয়েছে  নিগ্রহের বুনিয়াদ। আমরা চিনেছি অন্য বেলাফন্টে কে। চাবুকের মত ঘা দিয়েছে বর্ন  বিদ্বেষী সাদা মানুষকে কালো মানুষের পক্ষ নিয়ে।  তার গান 'মাম্মা লুক আ বু বু দেয়ার..' ছোটবেলায় দিত শুধুই মজা, পরে শুনে উপলব্ধি হয় কি সহজে বলা হয়েছে সমাজের কদর্য মনোভাবের কথা! একটা কালো মানুষ , সে কুৎসিত, তার সন্তানরাও বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে তাদের বাবা, তাকে দেখতে কোনো কালো জন্তুর মত! এতে যে কত কষ্ট মিশে আছে তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় বেলাফন্টের সেই গান। লুথার কিং এর সাথে সেই দামাল সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষের অধিকার অর্জনে! সু-চেতনার ও সু-মনভাবের বীজ রোপণ করেছে হ্যারি সারাজীবন। শান্তির জন্য লড়াই ছিল তার মন্ত্র।  


কখনো গায়ক, কখন রূপালী পর্দায় নায়ক, কখনো সে বিপ্লবী বীর। খ্যাতির তুঙ্গে হ্যারি বেলাফন্টে, কিন্তু কখনো ছিটকে যায় নি তার জীবনাদর্শের থেকে। নানা হাত ছানির চোরা বালিতে ডুবে যায়নি তার জীবনবোধ। একজন ভালো মনের মানুষ সে, সে শেখায় ভালোবাসতে, ভালো মন নিয়ে বাঁচতে। এই দুর্নীতি ভরা কালের আবর্তে বড় হচ্ছে যে প্রজন্ম তাদের কাছে এসব গান নিয়ে আসুক ভালোবাসা , শান্তি আর আশার আলো, সঞ্চারিত হোক জীবনের জয়গান, রামধনুর সাত রঙের ছোঁয়া লাগুক তাদের প্রাণে, মনে। শুধু নিজে দুধে ভাতে নয়  বাকি সকলকে নিয়ে বাঁচুক, বাঁচতে শিখুক আমাদের সন্তানরা।

এখন শুধু তার গান শুনিনা, তাকে দেখিও।  ধন্যবাদ প্রযুক্তিকে । প্রাণ ঢেলে গাইছে হ্যারি , তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে ভালোবাসা! সে গায়
My Island in the sun .. আমাকে মনে করায় আমার
ধনধান্যে পুষ্পে ভরা দেশের কথা.. যেখানেই থাকি আমার শহর যেমন সব  সময় আমার বাড়ি , সে শহরে আছে ভায়ের মায়ের স্নেহ। তেমনই  সেই সোনার আলোয় মোড়া দ্বীপটা তার বাড়ি, তার পূর্বপুরুষ আর উত্তর পুরুষেরা সেখানে আছে, আর আছে সেই মেয়ে , যে আজও তার পথ চেয়ে আছে, দ্বীপ জ্বেলে,গান গেয়ে!

বেলাফন্টে, আমাদের আজীবনের বন্ধু , তুমি যাও তোমার সেই ভালোবাসার জনের কাছে, সেই যেখানে সূর্য আছে আর আছে নীল জলের অতল সাগর।
You are going back to see her in the land of  the sea and sun....

0 Comments

Post Comment