আমাদের এ অঞ্চলে রক্তপাত হয় না কখনো। আমাদের বাগ্মীতা আমাদের অহংকারী করে। সেই অহংকারে ভর করে আমরা ছোটো-ছোটো বৃত্ত রচনা করি। এই বৃত্তগুলো ফুলের নিজস্ব গন্ধে সুশোভিত। গঙ্গার স্রোতে প্রতিমার সাথে-সাথে যেভাবে মালা ভেসে যায়, তা-ই আমাদের বিস্তার। এই গুণ আমরা প্রথম টের পাই ছেলেবেলায়। যে বছর ইশকুল ছুটি হল অকস্মাৎ, রাস্তা শুনশান, আমাদের জীবনে এল অকালবসন্ত— শুধুই উৎসব। আমরা খিড়কিবাগান পার করে পৌঁছলাম সীমান্তবর্তী খালে, আমরা মন্দিরপুকুরে ডুব দিয়ে আবিষ্কৃত হলাম; মাথায় সবুজ ঝাঁঝি, ভিতরে ঠান্ডা ডিসেম্বর। আমরা থমকে গিয়ে আচমকা চেপে ধরলাম হাত, একে অপরের। তবে গুদামঘরের অন্ধকারে বাদুড়ের ডানার শব্দে নয় বরং সামনে যা রাখা ছিল, তা হল ঘুমন্ত শিশুর মতো নিশ্চুপ—নিঁখুত হাতে বাঁধা সারি সারি পেটো। যার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের শব্দ আমরা টের পাই কোনো এক রাত্রে। পরবর্তী সকালে গিয়ে দেখি, মন্দিরের পিছন দিককার জঙ্গল, ঝোপঝাড় বিলকুল সাফ।
এ সময়কালে কোনো একদিন শ্রী সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সুখ করে লিখেছিলেন, 'বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার গুরুত্বকে আমি কমিয়ে দেখছি না। শুধু বলছি, তার মারাত্মক প্রভাব কলকাতার মনে, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের মনে সেভাবে পড়েনি, যাতে তারা মনে করতে পারে যে, বোধবুদ্ধিহীন নির্বিচারে খুনোখুনিতেই এর সমাধান।'
স্মৃতির যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা হল ময়েশ্চারাইজার ক্রিম, পেন, ছাতা। এই সবই হাতফেরতা এসেছিল আমাদের সান্ধ্য আড্ডায়। কিন্তু যা বন্ধ হয়ে গেছিল, তা 'মামনি স্টোর্স'। ভবি অত সহজে ভোলে না...
উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা আমাদের রসনা গঠন করে। ফলে গবাদির প্রতি আমাদের নজর যায় দশ-বারো ক্লাসে থাকাকালীন। সাহিত্যপাঠ, বামপন্থা থেকে গোরুশুয়োর, সব মিশে যায় আমাদের রক্তে। আমরা ওল্ড মংক শেষে বৃষ্টিতে ভিজি ও পরস্পরের ভাই হয়ে উঠি, সস্তা গদ্যরীতি মেনে।
পরিত্যক্ত দেওয়ালে যেভাবে আগাছা জন্মায়, সেভাবে আনাচেকানাচে গড়ে ওঠে আমাদের আড্ডার ঠেক। নিচুনিচু চায়ের দোকানে সকাল গড়িয়ে যেত দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যার বিড়ির আগুন ঘুরত হাতে হাতে, রেডিয়োয় বেজে উঠত—'প্রেম বড় মধুর, কভু কাছে কভু সুদূর।' ক্রমশ সে আগুন পোড় খেয়ে শ্মশানে জ্বলে উঠত চিতা। শ্মশানযাত্রীদের ভীড় এড়াতে আমরা জড়ো হতাম জেটির অন্ধকারে। জেলেরা নৌকায় মাছ ধরত, দূরে দপদপ করত কুপির আলো। গভীর রাতে গোরুর ট্রাক ঢুকত স্টেশনের রাস্তায়, রাস্তার মোড় ঘুরে অন্ধকার থেকে নেমে আসত ঝুড়ি। যেটুকু পত্রশোভা, তাও অন্ধকার। থমথমে অন্ধকার শাসন করত কবেকার প্রাচীন কবর। কখনোসখনো নদীর ধারে পড়ে থাকত কাটাপশুর রক্ত, শিমুলফুল। আমাদের ছিল না নবান্ন, গণসংগীত। ঈদের সময় মাচায় মাচায় বেজে উঠত রফির গান, আর দুর্গাপুজোর দিনগুলো আমাদের কেটে যেত ঘুপচি অন্ধকারে। অবশ্য প্রত্যেক ভাসানে নাগিন ডান্সের তালেতালে ফুটে উঠত যে ছাতিম, তা ছিল নেশায় চৌচির।
যে কোনো কৌম স্মৃতির শেষে যেভাবে সাজানো থাকে প্রকাণ্ড বাজার, মধুর রস গিয়ে ঠেকে বাৎসল্যে, ঠিক সেই নিয়মেই অধুনা আমরা সকলে দস্তুরমতো গৃহী। পারিবারিক পানাহারের আসরগুলোয় আমাদের সন্তানেরা ঘোরে ফেরে। আমরা সতর্ক থাকি, এইসব আসরে ছেলেমেয়ের সামনে যেন রাজনীতি আলোচিত না হয়। যেন নিউজ চ্যানেল না চলে। ওদের টেকনোপ্রীতি আমাদের মোহিত করে।
গত রথের দিন, সম্ভবত বিকেল নাগাদ আমরা রওনা দিই গঙ্গার ধারের দিকে। জায়গায় জায়গায় কমলা পতাকা, ভীড়ের গালে ও কপালে কমলা রঙ, আমাদের যুগপৎ সন্দিহান ও শংকিত করে তোলে। যদিও কানাঘুষো খবর বহুদিন ধরে ছিল, গঙ্গার ধার বেদখল হয়েছে। নানাবিধ পুছতাছ চলে মুসলিম ছেলেমেয়েদের ঘনিষ্ঠতা দেখলে। বাইক নিয়ে যাওয়া চলে না আর গঙ্গাপারে। গেটের বাইরে তাকে রেখে আসতে হয়। এখন সকালসন্ধ্যা তারস্বরে বাজে ভক্তিগীতি, অনুপ জলোটা। এইসব কথা এলাকার হাওয়ায় ভাসছে, বেশ কিছুদিন। তবু, আমরা আহাম্মকের মতন এগিয়ে চলি গঙ্গার রাস্তায়। রথ নিয়ে আমাদের পূর্বস্মৃতি ভেসে ওঠে, মাঝারি কাঠের রথ, প্রাচীন লতাপাতা, বহুবিধ ছবি। পারিবারিক মালিকানাধীন এই রথ ঘিরে বসত তখন ছোটোখাটো মেলা, মনে আছে, আমরা শখ করে বাড়ি আনতাম মাটির পুতুল।
যতদূর যাচ্ছি, ঘন হয়ে আসছে রাস্তার ভীড়। গমগম করছে ডিজে— 'জয় শ্রীরাম!' আমরা দু'জন, পরস্পরকে দেখে নিয়ে তবু এগিয়ে গেলাম।
সকল জিজ্ঞাসার শেষে থাকে এক বৃহৎ আবিষ্কার, যা প্রায়শই মানুষকে ধ্বস্ত করে। এক বন্ধু আমাকে হোয়াটস্যাপে জানায়, 'বছর ছয় কি সাতের এক ছেলে কোথাও বাইশ হাত কালী দেখেছিল। বাড়ি ফিরে তাকে আঁকে। আঁকে কালীর দীর্ঘ, কুটিল জিভ। যে জিভ ধুলো ছুঁয়েছে। হাত, পা, মুণ্ডমালা সব লুপ্তপ্রায়। বাইশ হাত লকলক করছে একখানা জিভ।' আমাদেরও অবস্থা হয় তথৈবচ। আমাদের কল্পনার পরিধিকে ধ্বস্ত করে দেয় বাইশ হাত রথ। চারপাশের অসংখ্য অচেনা মুখ, হিন্দি বুলি, সস্তা সুর ছাপিয়ে পতপত উড়তে থাকে আকাশচুম্বী গেরুয়া পতাকা।
আমাদের এলাকায় মব লিঞ্চিং হয়নি কখনো। যদিও এই লকডাউনের বাজারে আমাদের এলাকার ছাদে ছাদে বেজে উঠেছে কাঁসরঘন্টা, থালাবাসন। মোমবাতি শুধু নয়, আকাশ চিকচিক করে উঠেছে মোবাইলের সার্চলাইটে। রামমন্দিরের ভূমিপুজোর দিন অনেকেরই ফেসবুক ডিপিতে দেখা যায় পুরুষোত্তম রামের অহংকারী তীর ও ধনুকের স্টিকার৷ তবুও এখনো তো ট্রেন বন্ধ, এখনো তো নীল মাস্ক ঢেকে রাখে আমাদের মুখের অর্ধেক।
তবে যে দিন শেষ ট্রেন চলেছিল, মনে আছে আমরা ফিরছিলাম একসাথে। কামরা থেকে জয় শ্রীরাম ধ্বনি উঠছিল ক্রমাগত। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার স্টেশন এলে 'পাকিস্তান, পাকিস্তান' চিৎকার কানে আসে। ট্রেন থেকে নামার পর, বন্ধুর স্ত্রী বলেছিল, 'আমরা এক এলাকায় বড় হয়েছি, আমাদের মেয়েদের বয়স একই, কিন্তু ভবিষ্যত একরকম হবে না, আর কখনো।'
অথচ আমাদের এ অঞ্চলে রক্তপাত হয় না।