আসতে আসতে কথাটা বলছিল লাটু। লাটুকে সকলে মানে। সে তাদের থেকে এক ক্লাস ওপরে পড়ে। বাকি দুজন রণু আর মনু ওরা একই ক্লাসে পড়ে। ওদের টিম। ওরা বিভিন্ন রহস্য নিয়ে কাজ করে। এবার তারা কদিনের জন্য মুর্শিদাবাদ শহর এসেছে। ইতিহাসটা জানা দরকার। লাটু বলে ওদের। রণু আর মনু ওর কথা মন দিয়ে শোনে। লাটু পায়ের ওপর পা তুলে বলে চলে। ও বেশ কিছু লেখা পড়েছে। হীরাঝিল কি ভাবে দখল নিয়ে ছিল ইংরেজরা? নবাব সিরাজ দৌলার প্রিয় প্রাসাদ। এখানেই তিনি থাকতেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন বাস করতে পারেননি। তাঁর নিয়তি টেনে নিয়ে যায় অন্য পথে। সে এক তামাদি ইতিহাস। কিন্তু লাটুদের এবারের যাত্রা একটু অন্যরকম। সেবার নিমতিতার রাজবাড়ীতে ভূতের রহস্য নিয়ে কাজ করে। লাটু সব রহস্যর জাল কেটে সবার সামনে আসল ঘটনাটা সামনে আনে। সবাই চমকে যায়। আসলে রোজ রাতে ভূত সেজে একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াতো। তার কাজ ছিল মানুষকে ভয় দেখানো। আর রাজবাড়িটার দখল নেওয়ার জন্য। লাটু সব ঘটনা ফাঁস করে দেয়। ধরা পড়ে মেয়েটি। সমস্ত কারসাজি ছিল ওখানকার এক প্রমোটারের। রাজবাড়িটা পেলে ও বড়ো বাড়ি বানাতো। কিন্তু পুরোনো ইতিহাসের গন্ধটা মুছে যেত। এলাকার মানুষ তার ভয়ে মুখ খুলতো না। সাধারণ মানুষ। তার সঙ্গে পেরে উঠতো না। লাটুকে ডাকেন ওখানকার এক ডাক্তার। তাঁর কথা মতো কাজ হয়েছিল।
ওরা লালগোলা প্যাসেঞ্জারে আসছে। ট্রেনটা এসে থামলো কাশিমবাজার স্টেশনে। আজ আকাশটা একটু মেঘলা। মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নেমে ওরা চলে যাবে হোটেলে। এখন অনেক হোটেল গড়ে উঠেছে। লাটু সব ব্যবস্থা করে এসেছে। ও কাশিম বাজার স্টেশন দেখিয়ে বলে, এখানে এক সময় বিরাট জনপদ ছিল। নদী পথে বাণিজ্য চলত। খুব বড় বন্দর ছিল কাশিমবাজার। সেনাপতি কাশিম খাঁর নামেই কাশিমবাজার। এখানে ডাচ ফরাসি ইংরেজরা কুঠি করে থাকতো। এখানে ফরাসিদের নামে ফরাস ডাঙা গড়ে ওঠে। এখনো ওই নামেই জানে মানুষজন। রেশমের রমরমা ছিল এক সময়। রেশমের গন্ধে এসেছে মারাঠি ফরাসিরা।
রণু আর মনু মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। লাটু বলে চলে। স্টেশন থেকে আবার ট্রেনটা ছাড়লো। সূর্য মরে এসেছে। আরও কিছুটা পথ। এবার ওদের নামতে হবে। ওরা বসবার সিট ছেড়ে দেয়। স্টেশন ঢুকছে। এদিকটা ফাঁকা। সবুজ খেত। আম বাগান। তারপর মতিঝিল। জানালা দিয়ে দেখা যায়। এখানেই ছিল ঘসেটি বেগম এর প্রাসাদ। এখন তা ভেঙে গেছে। লাটু ওদের দেখায়। ঘাড় কাত করে রণু মনু দেখে। লাটুর জন্য ওদের গর্ব হয়। কত জানে। অবশ্য লাটু বেশি হাওয়া খাওয়া পছন্দ করে না। একটু গম্ভীর থাকতে ভালো বাসে। সূর্যটা এবার ঝুপ করে ঢুবে গেল।
ওরা যখন ট্রেন থেকে নামলো তখন স্টেশন ফাঁকা। তেমন লোকজন নেই। ওরা স্টেশনের বাইরে এলো। রণু চায়ের কথা বলে। পাশেই এক জন চা বিক্রি করছিল। লাটু ওদের চা খাওয়ায়। মনটা একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এমন সময় হঠাৎ ওদের সামনে এসে এক হাতকাটা লোক এসে দাঁড়ায়। লাটুকে বলে, হোটেল যাবেন দাদা? চলুন আমার টাঙাতে।
লাটু লোকটাকে দেখে বেশ অবাক হয়। একটা হাত নেই। মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। মাথার চুল গুলো উসকোখুসকো। মানুষটির হয়তো খাওয়া হয়নি সারাদিন। লাটু বলে, চা খাবে?
লোকটি মাথা নাড়ে।
ওরা চা শেষ করে ওঠে টাঙাতে। অন্ধকার চারপাশে। গভীর আমবাগান। কিছু দেখা যায় না। শুকনো পাতার খস খস শব্দ। টাঙা সওয়ারী নিয়ে ছুটছে। লোকটাকে বলে দিয়েছে কোথায় যেতে হবে। এখানে চারপাশে রহস্য। এই শহর কত কিছুর সাক্ষী। সিরাজ দৌলার মৃত্যুর পর আমল বদলে যায়। বহু মানুষ বেকার হয়ে যায়। রাজদরবারের কাজ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়। ইংরেজরা লুটপাট শুরু করে। নৌকা করে সব ধনসম্পদ নিয়ে যায়। বাহান্নটা নৌকা করে ইংরেজরা বাংলার সোনাদানা নিয়ে যায়। মীরজাফর তখন শুধু মাত্র হাতের পুতুল। হুকুম চলতো ইংরেজদের।
টাঙা এসে থামলো ইমামবাড়ার কাছে। ওরা নেমে গেল। টাঙার ভাড়া মিটিয়ে দিল। ভাগীরথীর পাড় ঘেঁষে হোটেল। ওরা আসতেই ম্যানাজার এগিয়ে এলেন। এসে বললেন, আপনাদের কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
লাটু বলে, না দাদা। সব ঠিকই ছিল। এখন কদিন থাকবো এখানে।
আপনাদের কথা মতো ঘর রেখেছি।
চাবি নিয়ে নিজেই ওপরে গেলেন। ঘর খুলে দিলেন। বেশ পরিষ্কার সব। দরজা খুলতেই পুবের হাওয়া এসে ঘরে হুর হুর করে ঢুকে পড়লো। নদীর শীতল বাতাস। লাটু বলে, রণু, তোর পছন্দ হল?
দারুণ।
ওরা ম্যানাজার বিদায় নেয়। ওরা হাত পা ছেড়ে শুয়ে পড়ে। একটু এলিয়ে নিয়ে ওরা ফেস হয়ে নিচে নেমে আসে। খাওয়ার জন্য ওরা আজ হোটেলেই অর্ডার করে। টিবিলে বসে লাটু বলে, আজ রাতটা কোনো রকমে কাটাই। পরের দিনই যাবো হীরাঝিল।
ম্যানেজারকে ওরা জিগ্যেস করে নেয় কি ভাবে যাওয়া যায়। হীরাঝিল নিয়ে ম্যানেজারের কৌতুহল দেখা গেল। এখানে অনেক রকমের কানাঘুষো চলছে। মাটির নিচে নাকি নবাব সিরাজ দৌলার ধন সম্পদ আছে। তা পাবার লোভে অনেক এসে পরিদর্শন করে যাচ্ছে। অবশ্য প্রকাশ্যে কিছু নয়। ম্যানাজারও সে কথা বললেন।
লাটু মন দিয়ে ম্যানেজারের কথা শুনছিল। ওর চোখ মুখে কেমন এক উত্তেজনা ফুটে ওঠে। কপালে ভাঁজ। বিন্দু বিন্দু ঘাম। ও খেতে ভুলে যায়। রণু মনু ওরা দুজনে মন দিয়ে খাচ্ছে। ওরা খাওয়া শেষ করে চলে আসে। লাটু একটু নদীর কাছে গিয়ে বসে। আজ আকাশে চাঁদ নেই। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। হোটেল এর লাইট অফ। বাইরে ফুল বাগানে টিমটিম করে একটা আলো দেওয়া। ম্যানাজার বাড়ি চলে গেছেন। কেয়ার টেকার আছে। বেটা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। ওর নাক ডাকা শব্দ বাগানে চলে আসছে। লাটুর ঘুম আসে না। সত্যি কি এখনো কোনো ধনসম্পদ আছে? না ইংরেজরা সব নিয়ে গেছে? বর যদিও থাকে তবে সেটা দেশের সম্পদ। তা কেউ জোর করে নিতে গেলে কষ্ট আছে কপালে। এটা যারা করছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। লাটু ভাবে।
রণু মনু ঘুমিয়ে গেছে। ওরা খুব ঘুম কাতুরে। একবার তো উত্তর বঙ্গ গিয়ে মহা বিপদে পড়ে গেছিল। মণু ঘুমিয়ে ছিল খোলা বারান্দায়। অল্প অল্প শীত। তখন এপ্রিল হবে। এখানে রাতে শীত করে। চা বাগানের মধ্যে একটা কাঠের বাড়ি। সেখানেই রাত গুজরান। লাটু ওকে বলেছিল ঘরে শুতে। কিন্তু ও সাহস দেখিয়ে বাইরে শোয়। লাটু হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে একটা ফোঁস ফোঁস শব্দ। ও তড়িঘড়ি উঠে পড়ে। বাইরে আসে। চা বাগান অন্ধকারে ডুবে। শিশির পড়ছে চায়ের পাতা থেকে। লাটু আবার ঘরে যায়। টর্চলাইট টা নেয়। বাইরে এসে আলো জ্বালে। ও আলো ফেলতেই দেখছে একটা গোখরো। চকচক করছে চোখ। মণুর পাশ ঘেঁষে বসে। লাটু কি করবে ভেবে পায়না। মণু নড়লেই কিন্তু ওকে ছোবল দেবে। আলো জ্বেলে বসে থাকে ও। সাফটা ওর দিকে তাকিয়ে। লাটু নড়াচড়া করে না। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর সাফটা নেমে গেল চা বাগানে। মণুকে ও বকা দেয়।
এখন বেশ রাত। হাজারদুয়ারীর আলো নিভে গেছে। কুলকুল করে ভাগীরথী বয়ে চলেছে। কত ইতিহাসের সাক্ষী। দূরে কোথায় একটা শিয়াল ডাকছে। লাটুর ঘুম আসছে না। এখানে অনেক ভয়ানক কিছু জায়গা আছে। য়ে গুলোর কথা সাধারণ মানুষ জানেনা। এখনো অনেক গুপ্ত ধন নাকি লুকোনো আছে। যে গুলো ইংরেজরা খুঁজে পায়নি। সুড়ঙ্গ আছে এখানে। যেখানে নবাবরা গোপন মিটিং করতো। লোকমুখে ভেসে বেড়ায় এ সব কথা। লাটু অনেক খোঁজ খবর নিয়েছে। এখনো হীরা এর মাটির নিচে সিরাজ দৌলার ধনসম্পদ পোঁতা আছে। আর সেই সব লুট করে নেবার জন্য কিছু লোক তা খুঁজে চলেছে রাতের অন্ধকারে। লাটুকে খবরটা দিয়েছিলেন এখানকার এক গবেষক। নামটা এখানে বলা নিষেধ। লাটু তাই বলতে চায়না। এখানে থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি লাটুর সঙ্গে গোপনে দেখা করবেন বলেছেন। সব জানার পর ওরা হীরাঝিল যাবে।
এবার একটু ঘুমোনো দরকার। গবেষক দুপুরে দেখা করবেন। উনার কথা মতো ঠিক হবে কোথায় গিয়ে কথা হবে। অবশ্য উনাকে লাটু মিঃ এম. বলেই ডাকবে। লাটু ওঠে পড়ে। লাটু বলে ছানায় এসে নিজেকে এলিয়ে দেয়। আবার একটা শিয়াল ডেকে উঠলো।
২.
মিঃ এম. বললেন, আমার কাছে খবর আছে। আজ রাতেই তোলা হবে মাটি খুঁড়ে সোনা। যা করার আজই করতে হবে।
লাটু বলে, ওখানে কি ভাবে যাবো?
আমি ছিপ নৌকা ঠিক করে রেখেছি। সদরঘাট থেকে উঠতে হবে। তবে গোপনে। রাত গভীর হলে যেতে হবে। নৌকা শুধু আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
ওকে মিঃ এম। আমরা তৈরি থাকবো।
এখান থেকে বেরিয়ে সোজা হোটেলে চলে যাবেন। কেউ সন্দেহ করতে পারে। চারদিকে চর ঘুরছে।
মিঃ এমের কথা মতো ওরা তিনজনে এসেছে। গভীর আমবাগান। এখানে কেউ খোঁজ পাবে না। লাটু উঠে পড়ে। মিঃ এম অন্য পথে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। লাটু আমবাগানের অন্য পথ ধরলো। লাটু চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। রণু মনু ওর পিছন পিছন হাঁটে। সবুজ ঘাসে পা ডুবে যাচ্ছে। আম পাতার সবুজ গন্ধ। এখানে অনেক আম বাগান। নবাবী আমলেরও আম বাগান ছিল। কিন্তু সে সব গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। বহু জাতের আম হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব খতম হয়ে যায়। লাটু ভাবে।
ওরা অন্য পথ ধরে হোটেলে ফিরে এলো। এখন রাতের জন্য অপেক্ষা। হোটেল থেকে বেরোতে হবে সাবধানে। কেউ যেন ওদের ফলো না করতে পারে। লাটু রণু মনু ওরা খেয়ে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে। যদিও এখন ঘুম আসবে না। ওরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেয়। মিঃ এম ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাবেন। গত রাতেও নাকি হীরাঝিলের কিছুটা অংশ মাটি খোঁড়া হয়েছে। হয়তো কিছু পায়নি। ওরা কি খুঁজছে? মিঃ এম বললেন, রানির জন্য একটা হীরা উপহার দিয়েছিলেন নবাব। আর সেই হীরের মূল্য এখন অনেক। তা নাকি ছোট্ট একটা বাক্সে রাখা আছে। তবে হীরাঝিল ছিল দেখার মতো প্রাসাদ। ঘসেটি বেগম এর মতিঝিলের প্রাসাদ দেখে নবাব সিরাজদৌল্লাহ তিনি হিরাঝিল বানিয়ে ছিলেন। সে অনেক লম্বা কাহিনি। লাটুর মাথার মধ্যে হীরের কথা ঘুরতে থাকে। রণু বলে, লাটুদা, ওই লোক কিন্তু রোজ রাতেই আসবে। হীরাঝিলের ম্যাপ হয়তো তার কাছে আছে। সে সব জানে। শুধু হীরে নয় আরও কোনো মূল্যবান কিছু থাকতে পারে। নবাব বাস করতেন যে মহলে সেখানে তো সোনা দানা হীরা সব থাকবে। যদিও লুট করেছে সব ইংরেজ। কিন্তু তাই বলে কি সব লুট হয়ে গেছে? থাকবে অনেক কিছুই।
রণু এবার থামে।
লাটু ওর কথা মন দিয়ে শোনে। লাটু উঠে বসে। ও গভীর ভাবে ভাবতে থাকে। তাহলে এখনো চুরি হবার আশঙ্কা বেশি। মনু বলে, লাটুদা, এখানে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। তবে পা ফেলতে হবে মেপে।
হুম। সে তো ঠিক। কিন্তু ওরা দলে ক'জন থাকবে কে জানে। আমাদের শক্ত হাতে সামলাতে হবে মনু। তোরা রেডি আছিস তো?
একদম। কোনো চিন্তার কারণ নেই। আমরা ঠিক উদ্ধার করবো হীরে।
চল একটু ঘুমাই।
লাটু বলে কথাটা।
ঘুম কি আর আসবে লাটুদা। এখানে কেমন সব লাগছে। হোটেলের ম্যানাজার কে কিছু বলা যাবে না।
না। তাহলে আমাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারে। আমরা একে একে বের হবো রুম থেকে। সাবধানের মার নেই। কি বলিস মনু?
ঠিক বলেছো লাটুদা।
এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে শব্দ। লাটু মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে। তারপর ও গিয়ে দরজার খোলে। দেখছে ম্যানাজার দাঁড়িয়ে। মুখে হাসি। কিছু না বলেই লাটুকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। লাটু বেশ অবাক হয়।
কিছু বলবে?
লাটু জিগ্যেস করে।
ম্যানেজার একটি চিরকুট এগিয়ে বলে, এটি আপনাকে দিয়ে গেছে একজন। তখন আপনারা হোটেলে ছিলেন না।
আপনি চেনেন তাকে?
না। আজই দেখলাম তাকে।
হুম। দেন দেখি।
লাটু চিরকুটটা নেয়। ম্যানেজার বিদায় নেয়। রণু মনু বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ে। রণু জিগ্যেস করে, কি লেখা আছে ওতে? লাটু চিরকুটটা পড়ে শোনায়, এখান থেকে চলে যা। কপালে কষ্ট আছে।
এইটুকু লেখা। লাটুর ওপর তাহলে নজর আছে। অবশ্য এ সব হুমকি আসে। লাটু পিছুপা হবার জন্য সে এখানে আসেনি। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ। এত গোপনে আসার পরও খবর পেয়ে গেল? এদের একটা শবক শিখাতে হবে। লাটু বলে, মণু, বুঝতে পারছিস কিছু? ওরা সব খবর জানে। তা জানুক। আমরা ঠিক উদ্ধার করবো সব। চল অতশত ভেবে লাভ নেই।
ওরা শুয়ে থাকে রাত হবার অপেক্ষায়।
৩.
যখন নাটুরা বের হল তখন ইমামবাড়ার পিছনে একটা শিয়াল ডেকে উঠলো। তবে কি ওদের সাবধান করলো শিয়ালটা? নাটু যেতে গিয়ে থেমে গেল। ডাকটা বুঝবার চেষ্টা করে। ওটা আদৌ শিয়ালের কি না? তারপর একটু থেমে ইশারা করে ওদের। ওরা এগিয়ে চলে। হোটেল থেকে সদরঘাট একটু দূরে। রাত বারোটা বেজে গেছে। গোটা শহর ঘুমিয়ে। শুধু ওরা তিনজন জেগে। আজ রাতটা মনে হচ্ছে থমথমে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে। নাটু গোপন অস্ত্রটা একবার হাত দিয়ে ছোঁয়। না সব ঠিক আছে। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় ওরা। হঠাৎ একটা ছায়া এসে ওদের ইশারা করে। নাটু গিয়ে বসে ছিপ নৌকাতে। সঙ্গে রণু মনু। ছিপ নৌকা হুস করে চলতে শুরু করলো। কালো জলের বুক চিরে এগিয়ে চলে। আজ চাঁদ নেই আকাশে। নাটু মুখে কিছু বলে না। কালো মানুষটা ওদের নামিয়ে দিল পাড়ে। ফিসফিস করে বলে, আপনারা না আসা পর্যন্ত আমি এখানে থাকবো। নাটু পাড়ে উঠে আসে। রণু মনু ওর পিছন নিল। খুব গোপনে চলে ওরা। আততায়ী ওৎ পেতে থাকতে পারে। বন জঙ্গলে ভরা। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। নাটু আলো জ্বালে না। তাহলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। বাঁশবন। বাতাসে কটকট শব্দ হচ্ছে। রণু ফিসফিস করে বলে, নাটুদা, এটা কিসের শব্দ?
বাঁশের। এগিয়ে চল।
নাটু চুপ থাকতে ইশারা করে। মনু একবার হোঁচট খেল। নাটু ওকে ধরে ফেলে। না হলে ও পড়ে যেত।
একটু সাবধানে পা ফেল মনু।
কিছু তো দেখা যায় না নাটুদা।
আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। মিঃ এম. এখানেই অপেক্ষা করতে বলেছেন। চল লুকিয়ে পড়ি।
ওরা তিনজনে বাঁশ গাছের আড়ালে চলে যায়। বাঁশ পাতার শব্দ হচ্ছে। মশার কামড়। মনু রণু ছটফট করছে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। দূরে কোথায় একটা শিয়াল ডেকে পালালো। ও কি কোনো কিছু দেখেছে? অনেকটা সময় কেটে যায়। কারো কোনো দেখা নেই। তবে কি আততায়ী সতর্ক হয়ে গেল? ওরা এদিক ওদিক চায়। অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি এগোয় না। লাটু বলে, ঠিক আসবে। আমার মন বলছে। তবে ওরা জানে পুরনো বাক্সটা কোথায় পোঁতা আছে। ওরা নকশা তৈরি করে রেখেছে। আজ ওরা ঠিকই হীরেটা সংগ্রহ করবে। সেই রকমই মিঃ এম বলেছেন।
আরও কিছুটা সময় পার হয়। এমন সময় হঠাৎ কিসের শব্দ। লাটু ঘুরে দাঁড়ায়। রণুও ঘুরে দেখে। ওদের খুব কাছাকাছি শব্দটা হচ্ছে। তবে কেউ কিছু খুঁড়ছে। লাটু বুঝবার চেষ্টা করে। মাটি খোঁড়া শব্দ। কেউ তা করছে। ও আরও কিছুটা অপেক্ষা করে। তারপর পা পা করে এগিয়ে যায়। যেতেই দেখছে, একটা মানুষ মাটি থেকে কি টেনে বের করছে! লাটু চারদিকে দেখে নেয়। আর কে কে আছে ওর সঙ্গে? হঠাৎ আর এক জন ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে। লাটু আরও কিছু সময় দেখে। ওর সঙ্গে আরও কেউ থাকতে পারে। লাটু বন্দুকটা বের করে। তারপর রণু মনুকে আসতে ইশারা করে। লাটু যেতেই হকচকিয়ে গেল মানুষটা। ওই- ই আততায়ী। লাটু বন্দুক বাগিয়ে ধরে ওর কানে।
একদম নড়বে না। দাও ওটা।
বাক্সটা দেবার আগেই আর একজন লাটুর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। লাটুও তাকে এক আছাড় মারে। ও দূরে ছিটকে যেতেই রণু আর মনু ওকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। লাটু বাক্স কেড়ে নেয়। মানুষটিও লাটুকে ছাড়ে না। লাটু ওর তলপেটে লাথি মারে। মানুষটা মুখে শব্দ করে মাটিতে পড়ে গেল।
একদম চালাকি করবিনা। শেষ করে দেব।
লাটু বলে কথাটা। রণু দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল। দু'জনকে বাঁশ গাছে বেঁধে রাখে। এখন পুলিশ আসার অপেক্ষা। মিঃ এম আগে থেকেই সব পুলিশকে জানিয়ে রেখেছিলেন। লাটুর হাত কেটে গেছে। ভীষণ জ্বালা করছে। এত সহজে ওদের কাবু করতে পেরে লাটুর ভালো লাগছে। লাটু বাক্সটা এবার আলো জ্বেলে দেখছে। অনেক পুরনো। ইতিহাস গন্ধটা এখনো লেগে বাক্সর গায়ে। বেশ কারুকার্য করা। মাটি লেগে গায়ে। লাটু খুলে ফেলল বাক্সটা। মিঃ এমের কথা মতো এটাতে হীরে থাকবার কথা। লাটু খুলেই অবাক। আলো পড়তেই হীরা ঝলমল করে ওঠে। লাটুর চোখ যেন ঝলসে গেল। তাহলে মিঃ এমের ধারণা ঠিক ছিল।
ওরা যখন নৌকাতে উঠলো তখন পুবে সূর্যর লালি। মিঃ এম আর পুলিশ দুজন আততায়ী কে নিয়ে উঠেছে। লাটুরা বিদায় নেয়। লাটু আসবার সময় বলে, আবার দেখা হবে মিঃ এম।