বিগত ২৩ জুন ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিবস। এর প্রাককালে আবার শ্যামাপ্রসাদের বিষয়ে বাঙালির আবেগ সঞ্চারের প্রয়াস শুরু হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের তরফ থেকে তো বটেই, এমনকি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এর স্বপক্ষতা প্রচার করতে নেমে পড়েছিল না-পড়লে-পিছিয়ে-পড়তে-হয় শিরোপা ভূষিত ‘সর্বাধিক’ প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্রটিও। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে এই সংবাদপত্রটি আজ থেকে সাতষট্টি বছর আগে (জুন ২৪, ১৯৫৩) লিখেছিল : ‘বিদ্রোহী বাঙ্গলার ঐতিহ্যবাহক প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর নেতার জন্মভূমি হইতে বহুদূরে কাশ্মীরে নির্বাসনকালে মৃত্যু হইয়াছে এই দুঃসহ অনুভূতি বিমানঘাটিতে উপস্থিত জনসমুদ্রকে অধিকতর বিচলিত করিয়া তোলে।’ দীর্ঘ সাড়ে ছয় দশক আগে এই সংবাদপত্রটি শ্যামাপ্রসাদকে অভিহিত করেছিল বিদ্রোহী বাঙ্গলার ঐতিহ্যবাহক প্রাণাধিক প্রিয়তর নেতা বলে ! বিদ্রোহী বাংলা কেন বলা হয়েছিল তার অবশ্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। অথচ ঠিক এর পাশাপাশি সেদিনের দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে যা লেখা হয়েছিল তা পূর্বোক্ত সংবাদের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করেনা। দ্য স্টেটসম্যান তার পৃষ্ঠায় অকাল প্রয়াণ শিরোনামায় যা লিখেছিল তার অন্তঃসার : শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুসংবাদ অত্যন্ত দুঃখের এবং আমরাও এই দুঃখের অংশভাগী। পশ্চিমবাংলার জনমানসে এই মৃত্যুসংবাদ এক শোকের আবহের জন্ম দিয়েছে। যারা তাঁর মত ও পথের শরিক নন, তাঁরাও তাঁকে সুবক্তা এবং বিশিষ্ট পার্লিয়ামেন্টারিয়ান বলে সম্মান করে থাকেন। —ব্যস এইটুকুই।
সেদিনের আনন্দবাজার পত্রিকার সেই ভূমিকার সূত্রেই গত ২৩ জুন ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাজনীতির এই অতিপ্রসারতার দিনে সেই পত্রিকাটিই বাংলায় পা রাখার জায়গা সন্ধান করতে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ ছাড়া যে আর কোনও ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি ভদ্রলোক নেতার ঠিকানা পাওয়া বিজেপি নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব নয় তা সযুক্তি বোঝাবার প্রয়াস পেয়েছে! প্রশ্ন ওঠে : ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এমন বাঙালিই কি বাঙালি মননের প্রার্থীত নায়ক ?
প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক নরেন্দ্র মোদি কলকাতা বন্দরের নাম শ্যামাপ্রসাদের নামে নামান্তরিত করার কথা ঘোষণা করেছেন । কেন করেছেন ? তাও তো তাঁর কোনও নির্ভেজাল নির্দোষ মননগত অভিব্যক্তি নয়। সমসময়ে শ্যামাপ্রসাদ সুভাষচন্দ্র বসুকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর বিভেদকামী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শরিক করে তুলতে। কিন্তু তাঁর এই প্রয়াস চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। বরং তরুণ নেতা সুভাষচন্দ্রের অসাম্প্রদায়িক ও ভেদবুদ্ধির বিপরীতমুখীন রাজনীতি শ্যামাপ্রসাদের প্রতিপক্ষতা করেছিল সক্রিয়ভাবেই। সুভাষচন্দ্রের অনুগামিদের হাতে শ্যামাপ্রসাদকে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে যখন সরাসরি বলেন, ‘আর এস এস হিন্দু মহাসভা দেশের সবচেয়ে বড় গদ্দার, এদের কাজ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বিদেশি শক্তিকে মদত যোগানো’ তখন হিন্দুত্ববাদিরা চরম হতাশ হন। এখবর তো উত্তরকালে নরেন্দ্র মোদি জেনেছেন। স্বভাবতই বাংলাদেশে বিশেষত এই বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলায় চূড়ান্ত জনপ্রিয় বাঙালি নেতা সুভাষচন্দ্রের প্রতিপক্ষে যদি শ্যামাপ্রসাদকে গ্রাহ্যনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করা যায় তাহলে সুভাষপন্থিদের দ্বারা শ্যামাপ্রসাদের নিগ্রহের প্রতিশোধ আর কীভাবে নেওয়া সম্ভব? মোদির এই পরিকল্পনাকে ভিত্তি প্রদানের লক্ষ্যেই কি উক্ত পত্রিকাটি হঠাৎ ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এমন যোগ্যতাসম্পন্ন বাঙালি নেতার গুণগান গেয়েছেন?
কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদের লক্ষ্যেই শ্যামাপ্রসাদ তাঁর জীবন বলি দিয়েছেন বলে নরেন্দ্র মোদির সাঙ্গপাঙ্গরা দাবি করেছেন। কিন্তু এই দাবি যে ভিত্তিহীন তা তো অপ্রমাণিত নয়। ন্যাশানাল কংগ্রেসের সাংসদ হাসনাইন মাসুদি কিছুকাল আগে দাবি করেছেন যে বিজেপি-র তাত্ত্বিক গুরু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কাশ্মিরে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ৩৭০ ধারা কায়েমের ক্যাবিনেট সিদ্ধান্তের শরিক ছিলেন। মাসুদি আরও জানিয়েছেন যে শ্যামাপ্রসাদ সেই সময় (অর্থাৎ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে) জহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। স্বভাবতই কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা কায়েমের পক্ষে তিনি জহরলাল মন্ত্রীসভার এই গুরুত্বপূর্ণ ‘যৌথ সিদ্ধান্ত’-এর শরিক ছিলেন। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে শ্যামাপ্রসাদ আইন অমান্য করে কাশ্মিরে প্রবেশ করেছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। আইন অমান্য করায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে শ্রীনগরে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। সেই গৃহবন্দিত্বের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এসব তথ্য তো নতুন নয়।
প্যাটেল অবশ্য কংগ্রেস পার্টি সদস্যদের সঙ্গে কাশ্মিরে এই বিশেষ সুবিধাদানের ব্যাপারে নেহেরু মন্ত্রীসভার দপ্তরহীন মন্ত্রী গোপালস্বামী আয়েঙ্গার-এর বিরোধিতার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সুষ্ঠুভাবে ৩৭০ ধারা প্রয়োগের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এমনকি জম্মু ও কাশ্মিরে বিজেপি-র প্রাক্তন স্পিকার জিতেন্দ্রপ্রসাদ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে শ্যামাপ্রসাদ স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে কাশ্মিরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ৩৭০ ধারা প্রয়োগের পক্ষে পরামর্শ দিয়েছিলেন! প্রবীণ সাংবাদিক বলরাজ পুরি লিখেছেন : জম্মু ও কাশ্মিরে বিশেষ সুবিদাদানের ব্যাপারে নেহেরু এবং শেখ আবদুল্লার সঙ্গে শ্যমাপ্রসাদের ত্রিপাক্ষিক আলাপ আলোচনার কথা সমসময়ের পার্টির তরফে প্রকাশ করা হয়েছিল, আর সেগুলিই হচ্ছে এই সময়ে সাক্ষ্য হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুআরি শ্যামাপ্রসাদ তাঁর এক চিঠিতে নেহেরু এবং শেখ আবদুল্লা-কে লিখেছিলেন : আমরা সহমতের ভিত্ততে শেখ আবদুল্লাকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জম্মু ও কাশ্মিরের প্রধান হিসেবে মান্যতা দিয়ে আশা করছি যে জম্মু এবং লাদাখ অবশ্যই ভারতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যতা রক্ষা করবে।
আজ ৬ জুলাই শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন। বিজেপি শ্যামা-আবেগ সঞ্চারিত করতে পথে নেমে পড়েছে। তবে আর কাকে পাওয়া যায়? ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালি ভদ্রলোক? বিধানচন্দ্র রায়? একে তাই এরা এবার বলেছেন, ‘আমাদের লোক’ এবং ‘বিকাশপুরুষ’! কিন্তু এরা ভুলে গিয়েছে দেশভাগের পর পুব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আগমনকে কেন্দ্র করে কিছু রাজনীতিকরা হৈ চৈ শুরু করে দিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে উদ্যোগী হয়েছে বলে অভিযোগ করেছিলেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র রায়। এই উদ্দিষ্ট রাজনীতিক কারা তা কি ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে? নিছক বাঙালি আবেগ নিয়ে খেলার উদ্দেশ্যেই বিজেপি এবং হিন্দুত্বওআলারা এটাকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আগামি বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন, একথা মাথায় রেখেই মোদি-শাহ-দিলীপরা শ্যামাপ্রসাদকে বাঙালি হিন্দুদের আবেগে সুড়সুড়ি দিতে চাইছেন।
কেন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী কপিবৃন্দ শ্যামাপ্রসাদকেই তাঁদের একমাত্র বাঙালি নেতা হিসেবে ধরতে গেলেন? কারণ, শ্যামাপ্রসাদ সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদিদের দাঙ্গায় ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। তিনিই সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন যে জহরলাল নেহেরুরা ভারত ভাগ করেছেন, তাঁর তিনি এবং তিনিই বাংলাভাগ করেছেন ! চরম রাজনৈতিক সুবিধাবাদী শ্যামাপ্রসাদ তাঁর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্রুড অনুশীলনও করেছেন আবার একইসঙ্গে কংগ্রেসকে হিন্দুস্বার্থবিরোধী বলে প্রচার করেও সেই কংগ্রেসি মন্ত্রীসভায় মন্ত্রীও হয়েছেন !
শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন ছাত্রদের সামরিক ট্রেনিং দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাদিবসে কুচকাওয়াচ প্রদর্শন করার রীতি চালু করা হয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে ছাত্রদের য়ুনিঅন জ্যাক অর্থাৎ ব্রিটিশ পতাকাকে কুচকাওয়াচের সময় কুর্নিশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন! ছাত্ররা উপাচার্যের এই অন্যায় নির্দেশের প্রতিবাদ জানায়। এই প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ায় শ্যামাপ্রসাদ ধরিত্রী মুখোপাধ্যায় এবং উমাপদ মজুমদার নামক দুজন ছাত্রকে এই কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন! উপাচার্যের এই অন্যায় নির্দেশ অমান্য করার জন্যে বিদ্যাসাগর কলেজের এক ছাত্রকে নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। এর প্রতিবাদে কলেজের সমস্ত ছাত্র সম্মিলিতভাবে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল।
হিন্দু কোড বিলের পক্ষে প্রচারের লক্ষ্যে মণিকুন্তলা সেন প্রমুখ য়ুনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুট হলে একটা কনভেনশান ডেকেছিলেন। সেখানে মুখ্য বক্তা ছিলেন সরোজিনী নাইডু। শ্যামাপ্রসাদ সেই সভামঞ্চ দখল করে সেই সভা ভণ্ডুল করার মতো নোংরা কাজের নিদর্শনও রাখতে পিছপা হননি। সরাসরি হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা আগুন নিয়ে খেলতে অভ্যস্ত আর এস এস-বিজেপির নয়নের মনি শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিমবঙ্গে যেকোনও উপায়ে জনগ্রাহ্য করে তোলাই হিন্দুত্ববাদিদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আগামি নির্বাচনের আগে এই লক্ষ্যেই তারা ঝাঁপিয়েছে এটা বলাই বাহুল্য। স্বভাবতই এহেন শ্যামাপ্রসাদকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বাঙালিচিত্তের একমাত্র গ্রাহ্য নায়ক বানাবার হিন্দুত্ববাদী অপপ্রয়াসের তীব্র এবং সক্রিয় বিরোধিতাই কাম্য। দাঙ্গাবাজ হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের এই অপপরিকল্পনাকে সার্থক করতে অনেক হিসেবি বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক-কলমচিরা অচিরেই যেমন সক্রিয় হয়ে এগিয়ে আসবেন, তেমনই বিরোধিতার দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর গড়ে তুলতে সক্রিয়ভাবে পথে নামবেন অজস্র দেশপ্রেমিক জনসাধারণ। বাংলার মাটি অত সহজে দুর্বৃত্তের কবলে যাবে না।
এখন তো সিপিএম এবং কংগ্রেস তাঁদের অতীতের বৈরিতা ভুলে একে অপরের অপরিহার্য বন্ধু হয়ে বাংলার মাটি কাঁপাতে উদ্যোগী হয়েছে। তারা এখন একইসঙ্গে বিধান রায়ের জম্ম-মৃত্যুদিন পালনে ব্রতী হয়েছেন। একসময়ের ‘খুনী বিধান’ এখন গুণী বিধানে রূপান্তরিত হয়েছেন সিপিএম-এর কাছে! দুদুলই শ্যামাপ্রসাদের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়েছে। সিপিএম-এর এক নেতা তো আবেগভরে বলেই ফেলেছেন যে ‘১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রোধ করেছিলেন’! তবে কংগ্রেসের মনে রাখা উচিৎ যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে হিন্দু মহাসভা এবং কংগ্রেস যৌথভাবে সভা করেছিলেন বাঙালি হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার জন্যে ! আর সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার।