দু'বছর হয়েছে জিনা মাহসা আমিনিকে হত্যা করেছে ইরানের কট্টরপন্থী ইসলামিক রাষ্ট্র। তারপর থেকে শুরু হয়েছে 'নারী, জীবন, স্বাধীনতা' আন্দোলন ইরানে। খোমেইনির চালিত শাসনযন্ত্র ক্রমাগত আরো ভয়ঙ্কর দমনপীড়ন নামিয়ে আনছে তথাকথিত অবাধ্য নারীদের উপর, নারী-অধিকার, মানবাধিকার কর্মীদের উপর।
১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২২-এ জিনা মাহসাকে বাধ্যতামূলক হিজাব না-পরার দায়ে গ্রেপ্তার করেছিল ইরানীয় নীতিপুলিশ। হেফাজতেই মৃত্যু ঘটে তাঁর। ১৯৭৯-এর অত্যাচারী শাহ শাসন শেষ করার যে অভ্যুত্থান তা ছিনিয়ে নিয়েছিল খোমেইনির নেতৃত্বে কট্টর ইসলামীরা। বিপ্লব, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল নতুন শাসক হয়ে। তারাই বাধ্যতামূলক করেছে হিজাবকে। নারীর শিক্ষা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা, কর্মসংস্থান, জনসমক্ষে উপস্থিত হওয়া ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই হিজাব বাধ্যতামূলক। না-হলেই শাস্তি। জিনা মাহসা আমিনি হিজাব-বিরোধী আন্দোলনের অনেক যোদ্ধার মধ্যে একজন ছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০২২-এর ১৩ই সেপ্টেম্বর। উত্তাল হয়ে ওঠে ইরান এবং তার নারীসমাজ। সরকার হত্যা করে শত শত জনকে। যথেচ্ছাচারে বন্দী করে দশ সহস্রের উপর মানুষকে। অনেকে যাকে ইরানের প্রথম নারীবাদী অভ্যুত্থান বলেন তা ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় দমন করা হয়।
জিনার মতই একদা বন্দী করা হয়েছিল বাহারে হেদায়েতকে। জিনার সময়কালেরও আগে ২০০৬ সালে ইরানে শুরু হওয়া নারী-অধিকার আন্দোলনের স্বপক্ষে দশ লক্ষ সই সংগ্রহের প্রচারণা, যা ওয়ান মিলিয়ন ক্যাম্পেন বলে পরিচিত, তার অন্যতম স্থাপিকা ছিলেন তিনি। আহমেদনিজাদ সরকার, সেই সময়েই কঠোর দমন-পীড়ন এবং বিপুল গ্রেপ্তারির মধ্যে দিয়ে এই আন্দোলন দমন করার কাজ করে। এত ভয় পেয়েছিল তারা। ২০০৭ এবং ২০০৮-এ দু' দু'বার বন্দী করা হয় বাহারেকে। ২০০৯-এ সাড়ে নয় বছরের জন্য জেল হয় তাঁর। ইরানীয় রেভোলিউশনারি গার্ড বলে পরিচিত বাহিনীর ইউক্রেনিয় আন্তর্জাতিক বিমান ধ্বংস করার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছিলেন ২০২০-তে। আবার গ্রেপ্তার। জেলমেয়াদ হয় তাঁর। একইভাবে মাহসা আমিনি হত্যাকাণ্ডের সময়ও ২০২২-এর অক্টোবরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আরেকটু পিছনের দিকে গেলে আমরা পাব ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ভিডা মোবাহেদের প্রতিবাদ। হিজাব না-পরার অধিকারকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন তিনি একটি শান্ত প্রতিবাদে, যা ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল শাসকের। ইরানের তথাকথিত বিপ্লবী রাস্তা বলে পরিচিত তেহরানের কেন্দ্রীয় রাস্তা এনঘেলাব স্ট্রিটে, একটি ধাতুর বাক্সের উপর হিজাব না-পরে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বাতাসে লাঠির আগায় বেঁধে একটি সাদা স্কার্ফ দোলাচ্ছিলেন। গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ অবাধ্যতা থামেনি। আরো নারী, যুবতী থেকে বৃদ্ধা, এমনকী পুরুষও - এই প্রতিবাদে একইভাবে অংশগ্রহণ করেন দিনের পর দিন। এবং গ্রেপ্তার হ'ন। একই সময় ইরানি রাষ্ট্রপতি একটি তিনবছর ব্যাপী সমীক্ষা প্রকাশ করেন, যাতে আদ্ধেক নারীরা মনে করছেন, হিজাব বাধ্যতামূলক থাকা উচিত নয়। এমনকি কিছু ধর্মীয় নেতারাও সংস্কারের দাবী তুলতে শুরু করেন।
তথাপি পরিস্থিত পাল্টায়নি। এতক্ষণে অনেকেই জেনে গেছেন আহু দেরা-র কথা। তেহরানের ঐসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীটি হিজাব পরেননি। আধাসামরিক বাসিজ বাহিনী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে টেনে নিয়ে যেতে যায় একটি ঘরে। মেয়েটি বাধা দেয়। তার মাথার স্কার্ফ খুলে ফেলা হয়, খুলে নেওয়া হয় তার উর্ধাঙ্গের বহির্বাস। শুধু অন্তর্বাস থেকে যায়। তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরার দাবীতে আহু তাঁর প্যান্টটিও খুলে ফেলেন। অন্তর্বাসে ঘুরে বেড়াতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সংলগ্ন রাস্তাতে একসময় চলে যান। সেখানে সাদা পোশাকের কিছু লোক তাকে একটি গাড়িতে জবরদস্তি তুলে নিয়ে চলে যায় অজ্ঞাত গন্তব্যে।
কী হবে তাঁর পরিণতি? মাহসা আমিনির মত হত্যা করবে তাকে ইরানী সরকার? নাকি সেপিদে র্যাশনোর মত হবে? সেপিদেকে বাস থেকে হিজাব না-পরার জন্য জোর করে গ্রেপ্তার করেছিল ইরানী পুলিশ। তারপরে মাসখানেক চলে যায়। তাঁকে ক্যামেরার সামনে হাজির করা হয় ক্ষমা চাওয়ার জন্য। চোখের নীচে কালো দাগ, শুকোনো চেহারা। এই ছবি ইরানী বিকল্প মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে আরো ক্রোধ বাড়ে নারী-অধিকার কর্মী এবং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ কর্মীদের মধ্যে। ইরানি সরকার আন্তর্জালকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রণ করলেও বহু ইরানি এখন ভিপিএন ব্যবহার করে আন্তর্জাল ব্যবহার করে তাঁদের কথা ছড়িয়ে দিয়ে থাকেন। প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা সেই সময়েও।
হিজাব না-পরার অর্থ কী ইরানে? শুধুই শারিয়া অনুযায়ী পোশাক না-পরা? নারীর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা পোশাকের ক্ষেত্রে? নাকি তার থেকেও বেশী কিছু? দশ লক্ষ সই সংগ্রহের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার কতকগুলি দাবীর কথা জানালেই বোঝা যাবে হিজাব পরা বা না-পরার বাইরে আসলে এই আন্দোলনের কী ব্যঞ্জনা। কী চেয়েছিলেন বাহারে হেদায়েতরা? তাঁরা কতকগুলি সংস্কার চেয়েছিলেন। হিজাব শুধু পিতৃতন্ত্রের প্রতীক নয়। হিজাব এখানে নারীর 'পছন্দ' নয়। বরং সর্বত্র তার অধীনতার প্রতীক। ইরানে নারী এমনিও অনেক অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত। যেমন, অপরাধী চিহ্নিত হবার বয়সের ক্ষেত্রে, সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে, বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে, বিবাহবিচ্ছিন্ন হলে সন্তানের দেখভালের অধিকার লাভ করার ক্ষেত্রে এবং অন্যান্য। অর্থাৎ হিজাব এখানে ঐসলামিক ইরানী রাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী পিতৃতন্ত্রের অস্ত্র, সেজন্যই আবার প্রতিবাদীদের নিশানায়।
প্রতিবাদীরা চেয়েছেন বিবাহে এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমানাধিকার। চেয়েছিলেন পুরুষের বহুগামীতা বন্ধ করা হোক। তথাকথিত পারিবারিক সম্মানহানির নানে নারী-হত্যা বা অনার কিলিং বন্ধ করা হোক। নারীর ক্ষেত্রে গৃহহিংসা থেকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ইত্যাদির বিরুদ্ধে কড়া আইন আসুক। সর্বোপরি হিজাব এবং তাকে ঘিরে রাষ্ট্রের এই পিতৃতন্ত্র - সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নামে চালিয়ে যাওয়া বন্ধ হোক। আন্দোলনকারীরা বারংবার একথাও বলেছেন, ইসলামের ভাবনার সঙ্গে তাঁদের ভাবনার বিরোধ হয় না এই দাবীগুলি তুললে।
কিন্তু মাহসা আমিনি হত্যার দু'বছর পর এই ২০২৪-এ আমরা কী দেখছি? ইরান রাষ্ট্র, প্রথমে খানিক পিছিয়েছিল। শহরে শহরে নীতিপুলিশের সংখ্যা কম করেছিল। কিন্তু এবারে আবার নতুন উদ্যমে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। 'নুর' বা 'আলো' পরিকল্পনা নিয়েছে। রাষ্ট্রটির আইন বলবৎকরণ কেন্দ্র (ল এনফোর্সমেন্ট কমান্ড বা এল-ই-সি) ২০২৩ থেকে আরো কড়া হয়েছে বাধ্যতামূলক হিজাবের ক্ষেত্রে। আরো কড়া আইন 'হিজাব এবং কৌমার্য্য' ইরানের সংসদের পাশ হয়ে, কেমন করে প্রযুক্ত হবে তার বিচারের জন্য ইরানের অভিভাবক পরিষদে আটকে আছে। যে-কোনো মুহূর্তে তার প্রয়োগ শুরু হবে। এই নুর প্রকল্পের অর্থ হল হিজাব না-মানলে শারীরিক নিগ্রহ থেকে বন্দী যা-খুশী করার অধিকার নীতিপুলিশ এবং প্রাশাসনিক পুলিশ বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া। নিত্যদিন জানা যাচ্ছে অসংখ্য নারীকে শারীরিক নিগ্রহ করছে নীতিপুলিশ এবং তাদের ছবি তুলে রাখছে সতর্কীকরণের এবং নজরদারীর জন্য।
কেন আবার দাঁত-নখ বের করেছে ইরানী শাসকেরা? কারণ বিপুল মূদ্রাস্ফীতি, দারিদ্র বাড়া, গত নির্বাচন বয়কটের ডাক আসা, ইস্রায়েলের আগ্রাসনকে রুখতে ব্যর্থ হওয়া, এই সব তাদের পেছনের পায়ে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানীতে ঠেকছে। তাই নিজেদের সমর্থক কট্টর অংশকে আবার এককাট্টা করে তোলার জন্য নারীদের উপর দমন-পীড়ন চালু হয়েছে আবার। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাড়া, তারাই তো অন্যতম নরম অংশ, এমন শত্রুতার জন্য।
হিজাবের প্রতি আনুগত্য মানে সংসারের পিতৃতান্ত্রিকতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি আনুগত্য, রাষ্ট্রের ইসলামের নামে চালানো আইন-কানুনের প্রতি আনুগত্য। অথচ পার্লামেন্টারি কমিটির সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে ইরানে ৭০% নারীই হিজাব সংক্রান্ত বিষয় সরকারের সঙ্গে একমত নয়। এমনকী যে সেপিদেকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হয়েছিল, তিনি জানিয়েছিলেন, যখন বন্দী ছিলেন তখন তাঁর বাবা এবং ভাই তাঁর দাবীর সঙ্গে সহমত হয়েছিলেন। অর্থাৎ সংসারের মধ্যেও নারীর অস্তিত্বের সংলাপ জায়গা করে নিচ্ছে। এটা শাসকেরা বরদাস্ত করতে পারছে না, আর পাঁচরকম ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতন। কিন্তু ধীরে ধীরে নারীরা, নারী অধিকার, মানবাধিকার, রাজনৈতিক অধিকার কর্মীরা সংগঠিত হচ্ছেন। আরো বেশী বেশী করে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করছেন। এই ইরানী রাষ্ট্রব্যবস্থা যাতে নিপাত যায় তার সময় এগিয়ে আনছেন। আহু-র প্রতিবাদ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং ছড়িয়ে যাওয়া আগুনের চিহ্ন।