পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ঘৃণা

  • 07 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 825 view(s)
  • লিখেছেন : পূর্বা কুমার
এক বেল বাজাতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নেয় কাবেরী। “ছক্কা আ আ আ “ উল্লসিত চিৎকার অর্কর, “আমার সব ঘুঁটি বেরিয়ে গেল,তুমি এখন ঘরে বসে বসে পচে মর’।” “বাবু, তুমি কিন্তু চোট্টামি করছ। তখন পষ্ট দেখেছি, তোমার দুই পড়েছে। তুমি তিন বলে চালিয়ে দিলে আর আমার পাকা ঘুঁটিটা কেটে দিলে।“ প্রাণপনে প্রতিবাদ করে বকুল। বকুল, মানে অর্কর ‘আটাপিসি’।

“অমনি বললেই হল, আমার তিনই পড়েছিল। আমি কেন চোট্টামি করব? দ্যাখ না, এই আবার ছক্কা ফেলব।“ ব’লে খটখট করে দান চালতে থাকে অর্ক।

“পু উ উ ট! বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম তেমন ফল।“ হাততালি দেয় বকুল।

লুডোয় মশগুল দুজনে। উফফ্, বকুলটা পারেও বটে! নিজের মনেই হেসে ফেলে কাবেরী। আটাপিসিকে পেলে অর্কর আর মায়ের দরকার পড়ে না। বলতে গেলে জন্ম থেকে বকুলের কাছেই তো মানুষ হচ্ছে অর্ক। কাবেরী সময় পায় কোথায়! কত দূরে স্কুল! সকাল আটটায় বেরিয়ে যায়, ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে সাতটা সাড়ে সাতটা। আর সুগতর উপর তো কোন ভরসা করাই যায় না। মাসের অর্ধেক দিন অফিস ট্যুরে হিল্লীদিল্লী করেই কাটে। তবে সে নিশ্চিন্ত। বকুল অর্কের যত্নের কোন ত্রুটি রাখে না। সব ঝক্কি অনায়াসে সামলায়, এতটুকু বিরক্তি নেই। সবসময় ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি ঝুলছে। আর অর্ক! তার রাগ, বায়না,আবদার,অত্যাচার,সব আটাপিসি। আটাপিসি নামটা অর্করই সৃষ্টি। আটা মাখলেই একদলা লেচি অর্ককে উপহার দিত বয়োকুল। অর্ক তখন ছোট, বড়জোর আড়াই কি তিন বছরের। কী খুশি! কীখুশি! ছেলে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে। হিলিবিলি সাপ বানাত,গাড়ি বানাত, দেওয়ালে, খাটে জল দিয়ে মেখে মহানন্দে থ্যাবড়া থ্যাবড়া করে লাগাত। অর্ক ঘুমিয়ে পড়লে ও সব পরিষ্কার করে দিত। এত আস্কারা পেলে কোন বাচ্চা না ভালবাসবে! অর্কও বকুলকে নিজের মনের মত ‘আটাপিসি’ করে নিয়েছে। একদিন কোন কারনে বকুল কামাই করলে কাবেরীকে ছুটি নিতে হত। কিন্তু ছেলেকে সামলাতে তার নাভিশ্বাস উঠে যায়।

কাবেরী বেল বাজায়। বকুল দরজা খুলে দেয়।

অর্ক লুডোর দান চালছে।। “পাঁ আ আ আ চ…… পাঁচে কাটা।“ চেঁচিয়ে ওঠে অর্ক।

“না, আমি দেখিনি। আমি তো দরজা খুলতে গেলাম। হবে না, খেলব না,আবার দান চাল।“

“আটাপিসি, আমার কিন্তু পাঁচই পড়েছে। তোমার ঘুঁটি কাটা…”

মা এল কী গেল ছেলের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা ব্যথা চিনচিন করে। নিজের ছেলে অথচ যেন নিজের নয়। বোধ হয়, চাকরি আর সংসার দুটো একসঙ্গে করার সাজা। কাবেরী দ্রুতপদে বাথরুমে ঢুকে যায়।

বকুলের বাড়ি উল্টোদিকের বস্তিতে। বাড়িতে আছে শুধু এক পঙ্গু ভাই। বাবা-মা মারা গেছে অনেক আগে। ভাইকে দেখাশোনা করার জন্য বিয়ে থা করেনি। পাঁচ বাড়ি বাসন মাজা ঘর মোছার কাজ করত। কাবেরীর বাড়িতেও করত। এখন কাবেরীর অনুরোধে সব কাজ ছেড়ে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অর্ককে দেখাশোনা করে। অবশ্য টাকা পয়সার দিক দিয়ে কাবেরী পুষিয়ে দেয়। বকুল এখন ঘরের লোক। কথায় কথায় একদিন একটা গোপন কথা বলে ফেলে কাবেরীর কাছে। তার আসল নাম জাহানারা,  বকুল নয়। ওর ভাইয়ের নাম সেলিম। হিন্দুবাড়িতে কাজ পেতে অসুবিধে হচ্ছিল শুধু এই নামের জন্য। তাই নাম বদলে নিয়েছে। “বলুন তো বৌদি, ভাইটাকে নিয়ে কি না খেয়ে মরব? তাই……” কাবেরী অবাক হয়ে যায়। একটু চুপ করে থেকে নিচুস্বরে আবার বলে, “তোমায় বলে ফেললাম বৌদি, কাউকে যেন বলে দিও না। তাহলে আবার…” কাবেরী কথা বলতে ভুলে যায়। এটা নাকি সংস্কৃতির শহর? আলোর শহর? শিক্ষা,দীক্ষা, আভিজাত্য… নাকি গর্ব করার মত? সে তো তেমনই শুনে এসেছে বরাবর। এই তার নমুনা? আলোর পরতে পরতে এত অন্ধকার? কাবেরীরা এই শহরে বছর পাঁচেক এসেছে। সবার কাছে হাঁকডাক করে গর্ব করে এই শহরের ইতিহাস নিয়ে,গৌরব নিয়ে। কিন্তু আজ, এই মুহূর্তে কে যেন এক বালতি দুধে এক ছটাক লেবুর রস ফেলে দিল। আজন্ম গ্রামে বড় হয়ে ওঠা মনে যে নাগরিক গরিমা  ধীরে ধীরে ঘন হচ্ছিল তা এক লহমায় ছানা কেটে গেল।

 দুই

 আজ ঈদ। বকুল ছুটি নিয়েছে। কাবেরীরও ছুটি। সুগতও আজ বাড়িতে। তাই অসুবিধে নেই। বকুল নেমন্তন্ন করে গেছে, “বৌদি, কাল রান্না করবে না। দাদারও তো ছুটি। দুপুরে তুমি আর দাদা বাবুকে নিয়ে গিয়ে আমাদের বাড়ি খাবে।“ এতদিন কাজ করেছে কোনদিন ঈদে ছুটি নেয়নি। এই প্রথম। কাবেরীর কাছে তো এখন আর লুকোবার কিছু নেই।

অর্ক সকাল দশটা থেকেই পাগল করে দিচ্ছে।“মা, খিদে পেয়ে গেছে,ঈদ খাব, কখন যাবে আটাপিসিদের বাড়ি।“

“ঈদ খাবি কী রে? ঈদ কি খাবার জিনিস? ওটা তো একটা উৎসব দুর্গা পুজোর মত।“

কাবেরী ছেলের কথায় হাসে। অন্যদিন যে ছেলেকে খাওয়া নিয়ে সাধ্যি সাধনা করতে হয়, তার আজ ভরপেট জলখাবার পরও পাঁচ মিনিট অন্তর খিদে পেয়ে যাচ্ছে। নাঃ! ছেলেটা বকুলের বড্ড ন্যাওটা। আদর করে ছেলের মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দেয় কাবেরী। অর্ক দৌড়ে বাবার কাছে যায়,”আজ আটাপিসির বাড়ি নেমন্তন্ন। কখন যাবে? চল না, আমার খিদে পেয়ে গেছে।“ সুগত ল্যাপটপে বিভোর। কোন উত্তর দেয় না। অর্ক এবার বাবার জামা ধরে টানাটানি করে, “ বাবা,ও বাবা,তাড়াতাড়ি চল, ঈদ শেষ হয়ে যাবে যে!” সুগত ল্যাপটপ থেকে মুখ না সরিয়েই ধমক দেয়, “দেখতে পাচ্ছিস না, আমি কাজ করছি, কেন বিরক্ত করছিস? আমি যাব না।“ অপ্রত্যাশিত বকুনিতে দপ করে নিভে গেল অর্ক। কে যেন ওর মুখে এক আঁজলা কালি ঢেলে দিল। চোখে টলটল করছে জল।  মাসে আর ক’টা দিন বাবাকে কাছে পায় ছেলেটা!  তার উপর এমন অকারণ ধমক ধামক…

বারোটার সময় সেজেগুজে অর্ককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কাবেরী। একটা টোটো নিয়ে বকুলদের বস্তির গলির মুখে নেমে পড়ে। সরু গলি। জায়গাটার নাম হাকিমজির বাগান। নাম বাগান হলে কী হবে, গাছপালার চিহ্ন নেই। গলির ভেতর গলি, তার ভেতর গলি। একেবারে ভুলভুলাইয়া। গলির রাস্তায় এক এক জায়গায় জল জমে প্যাচপ্যাচে কাদা। পাশে খোলা নর্দমা। একটা ভ্যাপসা দমবন্ধ করা গন্ধ। লোকজন তেমন দেখা যাচ্ছে না। কে বলবে যে এই পাড়ায় আজ উৎসব। এত গলিঘুঁজি টপকে উৎসবের রোশনাই হয়ত এখানে ঠিকঠাক পৌঁছোতে পারে না। অর্কর হাত ধরে কাবেরী হাঁটতে থাকে। বকুল পথনির্দেশ দিয়েছিল কিন্তু এই গলিতে ঢুকে কাবেরীর সব গুলিয়ে যায়। একবার কি ফোন করবে বকুলকে? একটা কুড়ি একুশ বছরের ছেলে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে হেঁটে আসছিল। কাবেরী ছেলেটাকে দাঁড় করায়।

“ভাই, আমাকে বকুলদের বাড়িটা একটু দেখিয়ে দেবে?”

“বকুল! কে বকুল?” ছেলেটা বেশ অবাক হয়।

“সরি সরি, জাহানারা, সেলিম এদের বাড়ি,” কাবেরী তাড়াতাড়ি শুধরে নেয়।

“ও, তাই বলুন। এই তোঁ এই দুটো বাড়ি পর… দরজায় হলুদ পর্দা… ওই বাড়িটা।“

সেদিন অর্ক চালগুঁড়ির রুটি, মাংস,সিমুই চেটেপুটে খেয়েছিল। লম্ফঝম্ফ করে লন্ডভন্ড করেছে আটাপিসির ঘরদোর। সেলিমের গলা জড়িয়ে বেহেস্তের হুরের গল্প শুনেছে। একটুও জড়তা নেই, যেন নিজের বাড়ি।

তিন

চোখটা সবে একটু লেগেছিল, আচমকা ধড়াম! ধড়াস করে বুকটা কেঁপে ওঠে কাবেরীর। বকু উ উ ল! কী হল রে?  ধড়মড় করে উঠে বসে কাবেরী।

“কিছু নয় বৌদি। বাবু এল।“

“শব্দটা কীসের হল?”

“বাবু নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করল।“

অর্কর আচার আচরণ এখন এরকমই হয়েছে। একটা ডেসপারেট ভাব। কলকাতার একটার নামী কলেজে পড়ে। কলেজে ঢুকেই কী একটা ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে। মিটিং, মিছিল, ঘেরাও… এসব লেগেই আছে। ছেলের সাজগোজ দেখলে আজকাল গা রি রি করে ওঠে কাবেরীর। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। হাতের কবজিতে একটা মোটা তাগা। জামা বা গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে ঘাড়ের কাছে সর্বক্ষণ উঁকি দেয় একটা মালা। ছোট্ট ছোট্ট রুদ্রাক্ষের মত দেখতে পুঁতি দিয়ে বানানো। বিকট দেখায়। কলেজ থেকে মাঝে মাঝে কপালে টিকা এঁকে ফেরে। বছরখানেক হল এইসব শুরু করেছে। বাড়িতে ভাল করে কারও সঙ্গে ভাল করে কথা বলে না। মা’কে না হলেও চলত, কিন্তু যে আটাপিসিকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলত না, তার সঙ্গেও কথা বলে না। কাবেরী ভাবে এসব হয়ত বয়ঃসন্ধির উপসর্গ। নিয়ম অনুসারে নাইনটিনে টিন এজ শেষ হয়ে যাবার কথা।। অর্কর কুড়ি হল। হয়তো এখনও রেশটুকু রয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর নির্ঘাৎ কেটে যাবে। মনকে সান্ত্বণা দেয় সে। এ নিয়ে ছেলেকে কিছু বলাও যাবে না। মেজাজ সবসময় টং। নরমসরম মুখটায় রুক্ষ্মতার প্রকোপ। সেই ছোট্ট অর্ককে  মাঝে মাঝে বড় অচেনা লাগে।

শীত শীত করছে। কাবেরীর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উত্তরের জানালাটা খোলা। এ কী! সন্ধে হয়ে গেল! ইসস্‌, এতটা ঘুমিয়ে পড়েছিল!  বকুল বাড়ি চলে গেছে। ও ঘুমোচ্ছে দেখে নিশ্চয় ডাকেনি। তাড়াতাড়ি উঠে জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি। গা শিরশিরে ঠান্ডা। কাবেরী বারান্দায় আলো জ্বালে। “অর্ক… এই অর্ক… তোর ঘরের জানালা বন্ধ করেছিস?” অর্ক সাড়া দেয় না।“কী রে, শুনতে পাচ্ছিস না?” এবারেও কোন উত্তর নেই। “মায়ের কথার উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করিস না আজকাল?” গজগজ করতে করতে কাবেরী দরজা ঠেলে ছেলের ঘরে ঢোকে।

অর্ক খাটের উপর চিত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বুকের উপর একটা বই খোলা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে। কাবেরী জানালাগুলো বন্ধ করে দেয়। উফফ্‌, ঘরটার ডামাডোল অবস্থা। বড় হয়েছে, নিজের ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। বকুলকে তো নয়ই। পড়ার টেবিলের পাশের দেওয়ালে একটা বড় ম্যাপ আঠা দিয়ে সাঁটানো। মাথায় লেখা, ‘অখন্ড দেশ’। পাগল আর কাকে বলে! পদার্থবিদ্যার ছাত্র কে বলবে!  কাবেরী বুক থেকে বইটা সরিয়ে দেয়। বন্ধ করে টেবিলে রাখে। কী বই পড়ছে এটা? ‘প্রকৃত দেশভক্ত কাকে বলে?’ ফিজিক্স বাদ দিয়ে এসব কী পড়ছে? কেন পড়ছে? কাবেরীর খটকা লাগে। কে জানে কেন, একটা আশঙ্কা ভেতরে গুড়গুড় করে ওঠে।

চার

 

কাবেরী মাধ্যমিক টেস্টের খাতা দেখতে বসেছে। ঠান্ডাটাও এবারে জব্বর। ইদানীং এরকমই হয়।  গ্রীষ্মে প্রচন্ড গরম আর শীতে প্রচন্ড ঠান্ডা। পৃথিবীটাও দিনকে দিন কেমন রুক্ষ্ম হয়ে উঠছে। নরমপন্থী থেকে চরমপন্থী হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। কাবেরী চাদরটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। তিনমাস পর মাধ্যমিক। ছেলেমেয়েগুলো কী করবে কে জানে! খাতায় তো কিছুই লিখতে পারেনি। শুধু প্রশ্নগুলো টুকে দিয়েছে। করোনা করোনা করে প্রায় দু’আড়াই বছর স্কুল বন্ধ থাকায় ওদের যে কী ক্ষতি হয়ে গেল!

কাবেরী ঘড়ির দিকে তাকায়। প্রায় ন’টা বাজে। ছেলেটা এখনও ফিরল না। দুবার ফোন করেছে। ফোন সুইচড্‌ অফ। ছেলের চালচলন চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। সুগতর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, কোন হেলদোল নেই, নির্বিকার, নির্বিকল্প। নিজেকে নিয়েই নিজে ব্যস্ত। অবশ্য কবেই বা অন্যের দিকে নজর দিয়েছে! কাবেরীর আজকাল একটুতেই বড় ক্লান্তি লাগে। সংসারটা বোঝা মনে হয়।

ডোরবেল বাজছে। ঐ বোধ হয় অর্ক এল! কাবেরী দরজা খুলতে যায়।

“মা, দেখ, কে এসেছে আমার সঙ্গে!” দরজা খুলতেই হাসিমুখে বলে অর্ক।

একটা সুদর্শন ছেলে অর্কর পাশে দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা, ফর্সা। কপালে লম্বা করে টানা টিকা। হাতে অর্করই মত তাগা। অর্কর থেকে বয়সে বড়ই হবে।

“আমি কাজল।“ হেঁট হয়ে কাবেরীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।

“থাক্‌ থাক্‌, এস, ভিতরে এস।“

“মা, কাজলদা খুব ভাল ছেলে। আরামবাগে বাড়ি। আমাদের ইউনিয়নের সেক্রেটারি। মাস্টার্স করছে।“ অর্কর কথায় যেন অতিমাত্রায় উৎসাহ।

“ও আচ্ছা।”

“কাকিমা, আসলে আমাদের একটা মিটিং ছিল। শেষ হতে দেরি হয়ে গেল। আমাদের লাইনের লাস্ট বাসটা মিস করলাম। অর্ক আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চলে এল।“

“খুব ভাল করেছে। যাও, ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হও। আমি তোমাদের জন্য চা বানাচ্ছি।“

কাবেরীর ছেলেটাকে ভালই লাগে। ঝকঝকে, সপ্রতিভ। কিন্তু ঐ কপালে টিকা, হাতে তাগা… মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করে… কোত্থাও কিচ্ছু নেই, আচমকা দেশভক্তি দেশভক্তি করে মাথাখারাপ করে ফেলছে… বলতে যাও, অমনি বিজ্ঞের মত আমেরিকা,চীন, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এইসব নিয়ে বড় বড় লেকচার শুনিয়ে দেবে। আরে বাবা, কেরিয়ারে মন দে। মধ্যবিত্ত ছাপোষা ঘরের ছেলে সব, চাকরি বাকরি না পেলে কে তোদের পাত্তা দেবে বলতো? চা করতে করতে কাবেরী আপনমনেই গজগজ করে। তারপর তরকারির ঢাকনা খুলে দেখে। নাঃ, কুলিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। অর্কও হয়েছে তেমন, একবার ফোন করে দিবি তো! তাহলে একটু ভাল কিছু রান্না করে রাখা যেত। অবশ্য মাছ, মাংস সবই রান্না করা আছে। তেমন অসুবিধে হবে না। তাছাড়া কাল সবেবরাতে বকুল আসবে না ব’লে কালকের রান্নাটাও করে ফ্রিজে গুছিয়ে রেখে গেছে। মাংসটা বের করে গরম করে নিলেই হবে। কাবেরীর সংসারের দায়িত্ব বকুল কবে যে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

টেবিলে চা দিয়ে ওদের ডাকে। অর্ক আর কাজল বসলে ওদের মুখোমুখি কাবেরীও বসে পড়ে।কাজলের সঙ্গে টুকটাক গল্প করে। বাড়ির কথা, বাবামায়ের কথা, গ্রামের কথা, পড়াশোনার কথা হতে হতে চলে আসে ইউনিয়নের প্রসঙ্গ। অর্কর কাছে বহুবার এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছে কিন্তু ও কখনই ঠিকঠাক উত্তর দেয়নি। দিলেও বিরক্তির সঙ্গে ভাসা ভাসা।

“কাজল, ছাত্র ইউনিয়ন আমি কোনদিনই পছন্দ করি না। তোমরা করছ, ভাল কথা। নিশ্চয়ই তোমাদের একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা কী?” আচমকা প্রশ্ন করে বসে কাবেরী।

কাজল একবার অর্কর মুখের দিকে তাকায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে,”কাকিমা, আমরা অখন্ড মাতৃভূমির স্বপ্ন দেখি। প্রকৃত দেশভক্ত হতে চাই।“

“প্রকৃত দেশভক্ত? সেটা আবার কী বস্তু?”

“দেশের সুখে সুখী, দেশের দুঃখে দুঃখী।“

“দেশের সুখে সুখ আর দেশের দুঃখে দুঃখ কার হয় না? এর জন্য কষ্ট করে, কসরত করে দেশভিক্ত হতে হবে কেন? আচ্ছা কাজল, বলতো দেশ মানে কী?”

“দেশ মানে আমাদের সেই প্রাচীন আসমুদ্রহিমাচল অখন্ড পবিত্র ভূমি।“

“সে কী! দেশ মানে দেশের মানুষ নয়? দেশের সুখ দুঃখ মানে তো দেশের মানুষের ভাল থাকা বা না থাকা। এক টুকরো ভূমির কি কোন সুখ দুঃখ থা্কে কাজল? মানুষ ছাড়া সে ভূমির কী মূল্য?”

“আপনি জানেন না কাকিমা, দেশের আনাচে কানাচে জঙ্গিবাদ কীভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। দেশটাকে ভাঙার চক্রান্ত চলছে। দেশের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে হবে।“ কাজলের গলায় বেশ ঝাঁঝ।

“তার জন্য দেশভক্তি আমদানি করে আনতে হবে?” কাবেরী বিদ্রূপ করেই বলে ফেলে।

“মা, এসব কী হচ্ছে কী? তুমি কি এটা তোমার ক্লাস পেয়ে গেছ?” আচমকা ধমকে ওঠে অর্ক।

কাজল কী একটা বলতে যাচ্ছিল, অর্ক ওকে হাত তুলে থামিয়ে দেয়। তারপর বলে, “কিছু মাইন্ড ক’র না দাদা। মা এরকমই। মাস্টারি করতে পেলে আর কিছু চায় না। চল, ঘরে চল।“ অর্ক মায়ের দিকে একটা কড়া ভ্রূকূটি হেনে চলে গেল।

রাতে খাবার টেবিলে অর্ক চুপচাপ খাবার বেড়ে দেয়। অর্ক মাংস খেতে ভালবাসে। কিন্তু রাতে ওদের মাংস প্রায় হয়ই না। মাংস দেখে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে অর্ক,”উরিব্বাস! মাংস! মা, তুমি এখন করলে!” কী রাগ করবে এই ছেলের উপর! একটূ আগে মাকে চোখ রাঙিয়ে গেল, আবার এর মধ্যেই ভুলে গিয়ে মাংস দেখে লাফিয়ে উঠল। চেহারাতেই বড় হয়েছে, ছেলেমানুষি এখনও যায়নি। কাবেরী হেসে ফেলে।

“না রে, কাল তো সবেবরাত, বকুল ছুটি নিয়েছে। মাংসটা কাল দুপুরের জন্য রান্না করে রেখে গেছে। আমি শুধু গরম করে দিলাম।“

“সবেবরাত!” অদ্ভূত বিস্ময়সূচক চোখে কাবেরীর দিকে তাকায় কাজল। রাস্তায় চলতে চলতে আচমকা গোবর মাড়িয়ে ফেললে মুখের যেরকম অবস্থা হয়, কাজলের মুখটা এই মুহূর্তে ঠিক সেই রকম ঘিনঘিনে দেখাচ্ছে। হঠাৎ টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। তারপর বলল, “কাকিমা, আমি  এইসব খাব না। আমার খিদে নেই। মুড়ি টুড়ি থাকলে আমাকে একটু দিন, ওতেই আমার হয়ে যাবে।“ কাজল কথাগুলো যখন বলছিল ওর কন্ঠস্বরে ফুটে উঠছিল একধরনের নৃশংস শীতলতা। কাবেরী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। উত্তর দিতে ভুলে গেল। মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।

পরদিন সকালে বেরোবার সময় অর্ক বলে গেল, “মা, রান্নার লোক বদলাও।“

অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে কাবেরী। এত ঘৃণা! এদের রক্তকণিকায় এত বিষ কীভাবে ঢুকছে? কারা ঢোকাচ্ছে? একটা তীব্র মনখারাপে কাবেরী যেন অসাড় হয়ে গেল। সকালের নরম আলোয় ফুটে ওঠা টাটকা ফুলের রঙিন পাপড়িগুলো যদি চোখের সামনে বিষাক্ত পোকায় কাটে, সে দৃশ্য কি খুব সুখপ্রদ? ফুল থেকে পাতা, পাতা থেকে ডাল, ডাল থেকে শিকড়…… একসময় পুরো গাছটাকেই তো ধ্বংস করে দেবে। কতক্ষণ এভাবে বসে ছিল খেয়াল নেই। ডোরবেলের আওয়াজে সম্বিত ফেরে। এসময় আবার কে!

দরজা খুলে দেখে বকুল দাঁড়িয়ে। হাতে টিফিন কৌটো। একগাল হেসে বলে,”বৌদি, সিমুইয়ের পায়েস। বাবুর জন্য আনলাম।  ও এটা খুব ভালবাসে।“

কাবেরী কথা বলতে পারে না। গলার কাছে কি একটা দলা পাকায়। বকুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তারপর হু হু করে কেঁদে ফেলে। চোখ থেকে গরম জল টপ টপ করে পড়তে থাকে বকুলের মাথায়, বুকে, পিঠে…

 

0 Comments

Post Comment