গতকালের উদ্বেগ ও বর্তমানের সমস্যায় সাধারণত সে জর্জরিত হয়ে থাকে। তাই বিছানা থেকে নিজেকে বেশ কষ্ট করে টেনে-হিঁচড়ে তুলতে হয়। জীবনের যাবতীয় সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সংহত করতে হয় সমস্ত শক্তি। তবে আজ সে প্রশ্নাতীতভাবে সুখী। সুখ যেন উপছে পড়ছে। এই অনুভূতি এত স্পষ্ট ও তীব্র তা যেন ওর মন ও অনুভূতির উপর বেশ করে চেপে বসেছে। হ্যাঁ, ও সুখী। এ যদি সুখ না হয়, তাহলে কী? ওর মনে হল যে শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে অপরের সঙ্গে শুধু নয় বাকি পৃথিবীর সঙ্গেও এক সুরে নেচে চলেছে। শরীরের ভেতরে এখন এক অফুরান প্রাণশক্তি। আত্মবিশ্বাস ও অপরিসীম দক্ষতার সঙ্গে যে কোন কিছু অর্জন করার এক প্রচন্ড ক্ষমতা যেন করায়ত্ত। মানুষ, জীবজন্তু ও অন্য নানান বিষয়ে ভালবাসায় ওর হৃদয় কানায় কানায় ভরপুর। ভয়, উদ্বেগ, অসুস্থতা বা মৃত্যু এইসব কিছুর ঊর্ধ্বে। সর্বোপরি এক দুর্বোধ্য অনুভূতি ওর শরীরে। সেখানে নিরন্তর বেজে চলেছে আনন্দ, তৃপ্তি ও শান্তির এক রম্য সুর।
সেই আনন্দে মাতাল হয়ে ও সময়টাকে বেশ তারিয়ে তারিয়ে আরাম করে উপভোগ করলো। তবে এই আনন্দের উৎস নিয়ে এক গভীর বিস্ময় ওর মধ্যে কাজ করছিলো। অতীতে এমন কিছু ঘটেনি যা থেকে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ভবিষ্যতেও এর কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কিনা জানা নেই। কীভাবে যে এটা হল? কতদিন থাকবে এই আনন্দ? না, এই মেজাজ হয়তো নেহাতই ক্ষণস্থায়ী। কখনই তা স্থায়ী হতে পারে না। যদি তা চিরস্থায়ী হতো, মানুষ আর মানুষ থাকতো না, ফেরেস্তা হয়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য কোথাও চলে যেতো। এখন শুধু এই আনন্দ উপভোগের সময়, এই আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার সময়, এই আনন্দ সঞ্চয় করে রাখার সময়। আবছা হয়ে দূর আকাশে তা যেন মিলিয়ে না যায়।
একপেট খিদে নিয়ে ও জলখাবার খেলো। খেতে খেতে বেশ কয়েকবার পরিবেশক আম বশির-এর দিকে তাকালো। ঝকঝকে মুখে হাসির কোন অভাব ছিল না। বৃদ্ধ বশির বেশ অবাক হলো, মুখে উদ্বেগের চিহ্ন। খেতে বসে মনিব সচরাচর তাঁর দিকে তাকায় না। শুধু হুকুম করে বা প্রয়োজনে প্রশ্ন।
তারপর বশিরকে বললো:
“বলো দেখি, আমি কি একজন সুখী মানুষ?”
বশির একটু বিব্রত বোধ করলো। মনিব আজ প্রথম ওকে একজন সাথীর মত মনে করেছে।
কয়েক মুহূর্তের অস্বস্তিকর এক নীরবতার পর, সে উত্তর দিলো:
“ভগবানের উপহার ও আশীর্বাদে আমার মনিব অবশ্যই একজন সুখী মানুষ।“
“তুমি কি বলতে চাও আমার এই উঁচু পদ, সুন্দর বাসা আর নীরোগ স্বাস্থ্য নিয়ে আমার সুখী থাকা উচিত? তাইতো, নাকি? কিন্তু সত্যিই কি তুমি আমায় সুখী মনে করো?”
“আমার মনিব ক্ষমতার বাইরে গিয়ে নিজেকে কাজে লাগান। তবে অন্যদের সঙ্গে উত্তপ্ত তর্কবিতর্কে প্রায়ই রেগে যেতে দেখি।“
সজোরে হেসে উঠে ও বশিরকে থামিয়ে দিয়ে বললো:
“তোমার কথা বলো। তোমার মনে কি কোন উদ্বেগ নেই?”
“অবশ্যই আছে। উদ্বেগ ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না।“
“তাহলে বলছো যে যথার্থ সুখ বলে কিছু হয় না।“
“হ্যাঁ, এটাই জীবনের ধর্ম।“
বশির বা অন্য কেউ তার এই বিস্ময়কর সুখের কথা কল্পনাতেও আনতে পারবে না।
এ এক বিস্ময়কর ও অনন্য গোপনকথা যা এই পৃথিবীতে একান্তই ওর নিজের।
খবরের কাগজের অফিসে সম্মেলন কক্ষে গিয়ে ওর চোখ পড়লো এই পৃথিবীতে ওর চরম প্রতিদ্বন্দীর দিকে। কী নিশ্চিন্তে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছে! ও আসছে বুঝতে পেরেও লোকটা চোখ তুলে তাকালো না একবার। তবে ও যে একঝলক তাকিয়েছিল এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর নিজের মানসিক শান্তির জন্য এখন এই উপেক্ষার মনোভাব। আলোচনায় বসে নানা সময় উগ্ৰভাবেওদের মতের অমিল হয়েছে। আর রূঢ় বাক্যবিনিময় শেষ অবধি হাতাহাতি পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই তো গত সপ্তাহে ইউনিয়নের নির্বাচনে ও প্রতিদ্বন্দীর কাছে গোহারা হেরেছে। গর্বে আঘাত লেগেছে খুব। মনটা বেশ তেতো হয়ে গেছে। দৃ'চোখে একরাশ অন্ধকার। কিন্তু এখানে সে প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিশুদ্ধ, উদ্বেগহীন মনে। সেই বিস্ময়কর সুখে এখনও সে মাতাল। সহিষ্ণুতা আর ক্ষমার প্লাবন জেগেছে ওর মনে। সে এখন এক অন্য লোক। নতুন বন্ধুত্বের অঙ্গীকার বয়ে নিয়ে এসেছে আজ। একটুও বিব্রত না হয়ে ও হাসিমুখে সম্ভাষণ জানালো ওর চরম প্রতিদ্বন্দ্বীকে।
একটু অবাক হয়ে ও চোখ তুলে তাকালো। নিজেকে সংহত করতে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো। তারপর সংক্ষেপে সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর দিলো। নিজের চোখ-কানকে ও যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলো না।
ও কাছে এসে বসলো, বললো:
“কী সুন্দর আবহাওয়া!”
“ও, হ্যাঁ।“
“এরকম আবহাওয়ায় অপার আনন্দে মন ভরে যায়।“
প্রতিদ্বন্দ্বী সাবধানে কিন্তু মন দিয়ে ওকে দেখলো। তারপর বিড়বিড় করে বললো:
“তোমার সুখে আমি খুশি।“
একটু হেসে ও বললো:
“বোধাতীত এই সুখ।“
প্রতিদ্বন্দ্বী একটু দ্বিধাভরে উত্তর দিলো:
“আশা রাখতে পারি যে আজ সম্পাদকীয় বোর্ডের আলোচনাসভায় আমার কথায় তুমি মেজাজ হারাবেনা।“
“কখনোই না।আমার মত সবাই জানে। তবে তোমার কথায় ওরা সায় দিলে দেবে।“
“রাতারাতি তুমি বেশ বদলে গেছো।“
“আসলে আমার এই সুখ এখন সবার বোধের বাইরে।“
“বাজি রেখে বলতে পারি তোমার ছেলে পাকাপাকিভাবে কানাডায় থাকার ব্যাপারে ওর মত বদলেছে।“
মৃদু হেসে ও বললো:
“বন্ধু, না, ও মত বদলায়নি।“
“কিন্তু ওটাই তো ছিল তোমার সবচেয়ে দুঃখের কারণ।“
“হ্যাঁ, আমি বারবার ওকে অনুরোধ করেছি ফিরে আয়। আমার একাকীত্ব কাটবে, দেশের উপকার হবে। কিন্তু ও একজন কানাডাবাসীর সঙ্গে যৌথভাবে একটি কারিগরি ব্যবসায় নামার কথা ভেবেছে। এমনকি আমাকে সেই ব্যবসায় যোগ দেওয়ার কথাও বলেছে। থাক সে কথা, ওর যেখানে থাকার ইচ্ছে থাকুক। আমি এখানে… দেখতেই পাচ্ছ তুমি… সুখী, অবিশ্বাস্য রকমের সুখী।“
“সত্যি, বলিহারি তোমার সাহস!”
“সেটা ঠিককী আমি না বুঝলেও আক্ষরিক অর্থেই আমি সুখী।“
হ্যাঁ, এটাই সেই সুখ, মূল্যবান এবং স্পর্শযোগ্য, চরম ক্ষমতার মত মজবুত, বাতাসের মত স্বাধীন, অগ্নিশিখার মত প্রবল, পুষ্পসুবাসের মত আকর্ষণীয়। কিন্ত্ত এই অস্বাভাবিক অনুভূতি চিরস্থায়ী নয়।
অন্য লোকটি ওর সহৃদয় মনোভাবে আকর্ষিত হয়ে বন্ধুভাবে বললো:
“সত্যি কথা বলতে কি আমি সবসময় তোমায় একজন উগ্ৰপ্রকৃতির মানুষ বলে ভেবেছিলাম। আর সেই স্বভাবের জন্য বেশ ভুগতে হয়েছে তোমায়।“
“সত্যি!”
“আসলে সমঝোতা কথার অর্থ তোমার জানা নেই। তোমার অনুভূতি নিয়ে, সমস্ত সত্তা নিয়ে বড় তীব্র যাপন তোমার। যে কোন সমস্যাকে জীবনমরণ ভেবে নিয়ে তুমি সবসময় এগিয়ে চলো।“
সে সহিষ্ণু মনে এই সমালোচনা মেনে নিলো। যেন ওর অনন্ত সুখের সাগরে হালকা এক ঢেউ। হাসিমুখে বললো:
“তুমি কি মনে করো যে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু সামঞ্জস্য আনা দরকার?”
“নিশ্চয়। যেমন ধরো, গতকাল জাতপাত নিয়ে আমাদের আলোচনা। আমরা একমত পোষণ করেছি। উদ্দীপক আলোচনা একসময়ে ক্রোধের উদ্রেক করে। তবে কীরকম ক্রোধ? এক বিশুদ্ধ বৌদ্ধিক ক্রোধ। এমন রাগ নয় যা স্নায়ুকে উত্যক্ত করে, হজমে ব্যাঘাত ঘটায় বা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ঠিক আছে?”
“আমার কাছে বিষয়টা এখন খুব পরিষ্কার।“
হৃদয় থেকে একবিন্দু আনন্দও ও উপছে পড়তে দেবে না। জাতপাত, অ্যাঙ্গোলা, ভিয়েতনাম,প্যালেস্টাইন …কোন সমস্যাই এখন ওর হৃদয়দুর্গে আক্রমণ হানতে পারবে না। কোন সমস্যার কথা মনে হলেই ওর হৃদয় এখন মুচকি হাসি হেসে ওঠে। বিরাট এই খুশি যে কোন রকম দুর্দশার প্রতি নিতান্ত উদাসীন, দুঃখের মুখোমুখি হয়েও শুধু হেসে যায়। ওর খুব ইচ্ছে হল হেসে, নেচে, গেয়ে সারা বিশ্বের যাবতীয় সমস্যা এই অসীম আনন্দ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার। হঠাৎ যেন মনে হল অফিসের পরিসরটা ওর পক্ষে বড় ছোট; কাজের আকাঙ্ক্ষা কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে। রোজকার কাজের কথা ভাবলেই এক চরম ঔদাসীন্য আর ঘৃণাবোধ ওকে ঘিরে ধরে। সুখের স্বর্গ থেকে মনটাকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনতে ও সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
এই আতঙ্কময় সুখে মাতাল হয়ে কী করে সে লিখবে নীলনদে ট্রলিবাস ডুবে যাওয়ার কথা? হ্যাঁ, আতঙ্কজনক তো বটে।কোথায় যে এই সুখের উৎস? আসছে যখন প্রবলভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। অবশ করে দিচ্ছে ইচ্ছাশক্তিকে। এইদিন দুপুরেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে ওকে। আদৌ কমার কোন লক্ষণ নেই। কাগজপত্র ডেস্কের ওপর ফেলে রেখে ও দ্রুত ঘরের দিকে পা বাড়ালো,হাসিমুখে, তুড়ি মারতে মারতে।
ওর মধ্যে যে মুহূর্তের উদ্বেগ ছিল তা এখনও মনের গভীরে থিতিয়ে যায়নি। এক বিমূর্ত ভাবনা হয়ে ভেসে উঠেছিল ওপরে। ওর মনে হল জীবনের বিয়োগান্ত পর্বগুলোকে ভেবে দেখি তো একবার বর্তমান মেজাজের ওপর তা কেমন প্রভাব ফেলে। এই আশায় যে তা ওর জীবনে আবার কিছুটা স্থৈর্য ফিরিয়ে আনবে। অন্তত তাকে আশ্বস্ত করবে যে এই সুখ শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে যাবে একদিন। স্ত্রীর মৃত্যু ও তৎকালীন পরিস্থিতি সে মনে মনে ভেবে দেখার চেষ্টা করলো। না, সে যেন কিছু অর্থহীন, ফলহীন ঘটনাক্রমের সঞ্চরণমাত্র। সেই নারী যেন অন্য কেউ, অন্য কারও বধূ, দূর ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে তাকে। এই স্মৃতিচারণার ফল হলো বেশ মধুর। ও আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। ছেলের কাছ থেকে ও যখন প্রথম চিঠি পেয়েছিল একই ঘটনা ঘটেছিল। ছেলে লিখেছিলো যে ও কানাডায় শেকড় গাড়তে চায়।
এইবার সে মনে মনে পৃথিবীর রক্তাক্ত বিয়োগান্তক ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু এমন হাসি পেলো ওর যে আশপাশের অন্য সব অফিস এমনকি রাস্তা থেকেও তা শোনা গেলো। কোন কিছুই ওর সুখাবেশকে স্পর্শ করতে পারলো না। দুঃখের সব স্মৃতি শান্ত ঢেউয়ের মত ভেসে শুধু বালিয়াড়ি ছুঁয়ে গেলো। তারপর সে শুধু অফিস নয় অফিসভবন থেকেই বেরিয়ে পড়লো। সম্পাদকীয় আলোচনায় যোগ দিতে পারবে না সেই মর্মে দুঃখপ্রকাশ করে কোন চিঠি লিখে যাওয়ার ফুরসতও হলোনা ওর। মধ্যাহ্নভোজনের পর একটা ভাতঘুম দিতে গিয়ে দেখলো যে ঘুম আসছে না। এই উজ্জ্বল, আনন্দোচ্ছ্বল পৃথিবীতে ঘুমের কোন দেখা নেই, ও জেগে। একটু ঘুম, শান্তি, আলস্যযাপন আর স্নায়বিক অবশতা ওর চাই। কিন্তু কীভাবে? শেষপর্যন্ত ও বিছানা ছেড়ে উঠেই পড়লো। গুনগুনিয়ে হাঁটতে লাগলো ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। তারপর একসময় স্বগতোক্তি করলো মন ও অনুভূতি যদি বেশিদিন এরকম থাকে তবে না হবে তার ঘুম, কাজ বা কষ্ট। এখন ওর ক্লাবে যাওয়ার সময়। কিন্তু কোন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার একটুও ইচ্ছে হলোনা ওর। সেখানে বসে বিষয় অন্যের হোক বা ব্যক্তিগত তা নিয়ে অন্তহীন আলোচনার বিন্দুমাত্র অর্থ নেই।
বিভিন্ন গুরুতর বিষয়ে ওকে হাসতে দেখলে ওর বন্ধুরা ওকে নিয়ে কী ভাববে। না ওর কাউকে প্রয়োজন নেই, কারোর সঙ্গে কথা বলারও প্রয়োজন নেই। ওর এখন যা প্রয়োজন তা হলো একা বসে থাকা। নয়তো এই প্রবল শক্তির খানিকটা ক্ষয় করার জন্য কয়েক মাইল হেঁটে আসা। ওর মধ্যে কী পরিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে ওকে বেশ ভাবতে হবে। এই প্রবল সুখ ওকে কীভাবে আবিষ্ট করছে? আর কতদিন সে এই অসহ্য বোঝা বয়ে বেড়াবে? এই সুখানুভূতি কি চিরকালের জন্য ওকে কাজ এবং বন্ধুসঙ্গ থেকে বঞ্চিত করবে? কেড়ে নেবে ঘুম আর মানসিক শান্তি? ও কী হার মেনে নিয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেবে? নাকি মনের জোর, কঠোর পরিশ্রম আর পেশাদারি পরামর্শে অন্য পথ খুঁজে নেবে?
এই বিবশ করা সুখের সাহচর্যে সে বেশ একা বোধ করতে লাগলো। সাহায্য করার জন্য না ছিল কোন বন্ধু না কোন পথপ্রদর্শক।
হঠাৎ ওর মনে পড়লো যে রাস্তার অন্যদিকে একজন মনস্তত্ত্ববিদের অফিস আছে। তবে এইসব ডাক্তারদের ওপর ওর কোন বিশ্বাস নেই।
কারণ ও বেশ ভালোমতই জানে যে ওদের চিকিৎসা দীর্ঘদিন ধরে চলে। আর রোগীদের জীবনে ওরা নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে। অবচেতনে যে স্নায়বিক ক্রিয়া নিহিত আছে তা মেলে ধরার জন্য ওদের অবাধ সংযোগের পদ্ধতি মনে পড়তে ও হেসে উঠলো। পা ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলেও হাসির দমক ওকে টেনে ধরছিলো। বিশেষ করে ওর মনে হচ্ছিল সুখের এই আজব সমস্যার কথা ডাক্তারকে বললে ওর মুখের চেহারাটা না জানি কেমন হবে। ডাক্তার তো রোগীদের কাছে সাধারণত হিস্টিরিয়া, মানসিক অবসাদ ও উদ্বেগ, সিজোফ্রেনিয়া এইসব সমস্যার কথা শুনতেই অভ্যস্ত।
“সত্যি কথা বলতে কি ডাক্তার আমি তোমার কাছে এই কারণে এসেছি যে আমি বোধাতীতভাবে সুখী।“
আর ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে ও প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো।
ডাক্তার শান্তভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
ও রোগের কথা বলা শুরু করতেই ডাক্তার হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো:
“এটা কি হতবুদ্ধি করে, অদ্ভুত, শক্তিহীন করে দেওয়া কোন সুখ?”
ও ডাক্তারের দিকে অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলো। আর কিছু বলে ওঠার আগেই ডাক্তার বলা শুরু করলো:
“এই সুখ তোমায় কোন কাজ করতে দেবে না, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে চলে যাবে, শুলেও ঘুম আসবে না। কোন কষ্টের মুখোমুখি হলেই তোমার হাসি পাবে।“
“মন পড়তে পারো নাকি?”
“না না, সেরকম কিছু না। তবে এরকম কেস সপ্তাহে একবার আমায় দেখতে হয়।
“এটা কি মহামারী কোনো?”
“সেকথা আমি বলিনি। আমি এমন দাবিও করছি না যে এখনও পর্যন্ত একটা কেসেওআমি মূল কারণ খুঁজে বার করতে পেরেছি।“
“কিন্তু… এটা… এটা তো একটা রোগ।“
“হ্যাঁ, সমস্ত রোগীর এখনও চিকিৎসা চলছে।“
“কিন্তু তুমি কি বিশ্বাস করো এই রোগীরা সকলেই অস্বাভাবিক?”
“হ্যাঁ, আমাদের পেশায় এটা একটা আবশ্যক অনুমান।“
বেশ উদ্বেগের সঙ্গে ওর জিজ্ঞাসা:
“ওদের কারোর মধ্যে কি কোন পাগলামি বা আবেগময় উত্তেজনা তোমার চোখে পড়েছে?”
ভয়ে ও নিজের মাথার দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো।
কিন্তু ডাক্তার নিশ্চয়তার সঙ্গে বললেন:
“না। আক্ষরিক অর্থে ওরা সকলেই প্রকৃতিস্থ। কিন্তু সপ্তাহে দু'দিন তোমায় নিয়ে বসতে হবে।
তুমি উদ্বিগ্ন হয়োনা বা ভয় পেয়োনা।“
“উদ্বেগ? দুঃখ?”, ও হেসে উঠলো।
সেই হাসি ক্রমশ চওড়া হলো ওর মুখে। তারপর একসময় ও হাসিতে ফেটে পড়লো। তারপর পুরোপুরি ভেঙে পড়লো ওর সমস্ত প্রতিরোধ। হাউহাউ করে ও কাঁদতে লাগলো।
(“মডার্ন ইজিপ্সিয়ান শর্ট স্টোরিজ” থেকে গৃহীত এই গল্প আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সাদ এল গাবালাওয়ি)
নাগিব মেহফুজ
(১৯৮৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী)
ভাষান্তর: গৌতম চক্রবর্তী