দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে গতি আনতে এবং মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে জিএসটি কাউন্সিল সম্প্রতি করের হার পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে, নতুন সংস্কারে অধিকাংশ পণ্যের করের হার পুনর্বিন্যাস করে দুটি প্রধান স্ল্যাবে (৫ শতাংশ এবং ১৮ শতাংশ) আনা হয়েছে। সরকার এই সংস্কারকে অর্থনীতির জন্য একটি ‘বুস্টার শট’ হিসেবে দেখছে, এবং তাদের অনুমান এটি দেশের জিডিপিকে ১ থেকে ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। এই পরিবর্তন ভোক্তাদের উপর থেকে করের বোঝা কমিয়ে চাহিদা বাড়াতে সাহায্য করবে। সংস্কারের সময়টিকে উৎসবের মরশুমের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে এর অর্থনৈতিক প্রভাব সর্বাধিক হয়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেছেন জিএসটি কাউন্সিলের এই পদক্ষেপ ভারতকে বিশ্বের দ্রুততম উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে পরিণত করবে। সরকার এই জিএসটি'র হার কমানোর সিদ্ধান্তকে জনগণের জন্য একটি ‘দিওয়ালির উপহার’ হিসেবে প্রচার করছে। এর মাধ্যমে তারা একদিকে জনগণের মন জয় করতে চাইছে, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন থেকে যায়, এটি কি কেবলই অর্থনীতির জন্য একটি ‘বুস্টার শট’, নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে রাজনীতি?
জিএসটি: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
২০১৭ সালের ১ জুলাই ভারতে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) চালু হওয়ার পর থেকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর বিভিন্ন ধরনের কর - এক ছাতার নিচে আসে। যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি জাতীয় বাজার তৈরি করে। জিএসটি চালু হওয়ার পর থেকে রাজস্ব সংগ্রহে একটি ধারাবাহিক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, এথেকে প্রমাণ হয় কর ব্যবস্থা আগের তুলনায় আরও সুসংহত ও স্বচ্ছ হয়েছে। গত পাঁচ বছরে কর আদায় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে জিএসটি রাজস্ব ২২.০৮ লক্ষ কোটি টাকার রেকর্ড ছুঁয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ৯.৪ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যানটি জিএসটি ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান সাফল্যকে তুলে ধরার পাশাপাশি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ককেও প্রমাণ করে। মোট সংগৃহীত রাজস্বের প্রায় ৭০.৫% রাজ্যগুলো ফেরত পাচ্ছে, যা কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোর মধ্যে আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন ভারসাম্য স্থাপন করেছে।
জিএসটি ২.০: অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং কৌশলগত পদক্ষেপ
জিএসটি কাউন্সিলের নতুন সংস্কার, জিএসটি ২.০, আগামী ২২শে সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এই সংস্কার অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে, ‘ভোগ-চালিত বৃদ্ধি’ এবং ‘বাহ্যিক ধাক্কা মোকাবিলা’ নীতিকে হাতিয়ার করেছে। বর্তমানে অর্থনীতিতে “ভোগ-চালিত বৃদ্ধি”-র ধারণাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, যার মূল লক্ষ্য হলো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি করা। এই নীতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে শুরু করে গাড়ি বা বিমার মতো পণ্যের ওপর কর কমানো হয়। ফলে মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ পরিবারগুলোর হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকে। এই অতিরিক্ত অর্থ যখন পণ্য ও পরিষেবা ক্রয়ের জন্য ব্যয় হয়, তখন তা অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি করে। এই বর্ধিত ভোগ গুণক প্রভাব সৃষ্টি করে, যা বাজারে চাহিদা বাড়ায়, উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
যদি মার্কিন শুল্কের কারণে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি কমে যায়, তাহলে জিএসটি কমানোর মাধ্যমে সেই পণ্যের একটি দেশীয় বাজার তৈরি করা সম্ভব। এতে রপ্তানিকারকরা তাদের অতিরিক্ত পণ্য দেশের অভ্যন্তরেই বিক্রি করতে পারবে, যা তাদের ব্যবসা ও কর্মসংস্থানকে সুরক্ষিত রাখবে। জিএসটি ২.০ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নেতিবাচক প্রভাব থেকেও দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করবে। এটি অর্থনীতিকে কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতের উপর নির্ভরশীল না রেখে জনগণের হাতে ক্রয় ক্ষমতা তুলে দেবে, যার ফলে জনগণই বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
জিএসটি ২.০: পণ্যভিত্তিক প্রভাব এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই সংস্কারের ফলে, প্যাকেজড খাদ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যার সামগ্রীর মতো ভোগ-ভিত্তিক পণ্যগুলোতে করের হার ১২-১৮% থেকে কমিয়ে ৫% স্ল্যাবে আনা হয়েছে। এই পণ্যগুলো দারুণভাবে উপকৃত হবে। একইভাবে, ছোট গাড়ি, ৩৮০ সিসির নিচের দুই-চাকার গাড়ি, ফ্রিজ, এসি ও টিভির মতো ইলেকট্রনিক পণ্যগুলোর কর ২৮% থেকে কমিয়ে ১৮% করা হয়েছে, যার ফলে এসব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে। আবাসন ও পরিকাঠামো খাতেও গতি আসবে। একই সাথে, বীমা (জীবন ও স্বাস্থ্য) প্রিমিয়ামকে কর-মুক্ত করা এবং ৩৫-৩৬টি জীবনদায়ী ওষুধকে শূন্য-হারের আওতায় এনে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
অন্যদিকে, এই সংস্কারের ফলে কিছু খাতে উচ্চ করের বোঝা চেপেছে। বিলাসবহুল সামগ্রী যেমন ২,৫০০ টাকার বেশি মূল্যের পোশাক এবং নির্দিষ্ট চিনিযুক্ত পানীয়কে ৪০ % নতুন স্ল্যাবে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন বাইকগুলোর ওপর জিএসটি ৩১% থেকে বেড়ে ৪০% হওয়ায় এগুলোর দাম বাড়বে। এছাড়া, কয়লার ওপর জিএসটি ৫% থেকে বাড়িয়ে ১৮% করা হয়েছে, যা কয়লা-ভিত্তিক শিল্পগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই নীতি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর ভোগকে উৎসাহিত করবে। একই সাথে এই সংস্কার উচ্চবিত্তদের ব্যবহৃত পণ্যের ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের ওপর উচ্চ কর আরোপ করে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবে।
এই অর্থনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি এর গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও বিদ্যমান। সরকার এই সংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে যে তারা গরিব ও মধ্যবিত্তদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য এবং ইলেকট্রনিক সামগ্রীর উপর কর কমানোর ফলে এই শ্রেণির মানুষেরা সরাসরি উপকৃত হবেন, এটিকে প্রচারে এনে আসন্ন নির্বাচনে সরকার ফায়দা তুলতে চাইছে।
পূর্বাভাস এবং সমালোচনা
জিএসটি কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে কর কমানোর এই উদ্যোগের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে নানা মত রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে জিডিপি বৃদ্ধি ০.২% থেকে ১.২% পর্যন্ত হতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব সম্পর্কে বেশিরভাগ বিশ্লেষক একমত যে, যদি কর কমানোর সুবিধা পুরোপুরি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছায়, তাহলে এটি ১.১% পর্যন্ত কমতে পারে।
সরকার জিএসটির এই সংস্কারকে একটি ‘বুস্টার শট’ হিসেবে দেখালেও, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং শিল্প বিশেষজ্ঞরা এর কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। জিএসটি ২.০-এর সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো এর আর্থিক প্রভাব। সরকারের অনুমান অনুযায়ী, এই সংস্কারের ফলে বার্ষিক ৪৮,০০০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে। তবে, বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলো আরও বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছে, যা সম্মিলিতভাবে ১.৫ -২ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এই বিপুল রাজস্ব ক্ষতি দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। জেএম ফিনান্সিয়ালের মতো বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এই রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য যদি সরকার পরিকাঠামোতে মূলধন ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়, তবে তা দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মূল ভিত্তিকেই দুর্বল করে দেবে। এর ফলে স্বল্পমেয়াদী ভোগ বৃদ্ধির লক্ষ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের মধ্যে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, কর কমানোর এই রণনীতি রাজস্ব ঝুঁকির কারণ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দিল্লির RIS-এর অর্থনীতির অধ্যাপক প্রবীর দে বলেন, পরোক্ষ কর ছাড়ের সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছাবে কি না তা নির্ভর করে পণ্যের দাম স্থিতিস্থাপকতার ওপর। নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বা ওষুধের মতো যেসব পণ্যের চাহিদা অস্থিতিস্থাপক, সেসব ক্ষেত্রে বিক্রেতারা কর কমানোর সুবিধাটি নিজেদের মুনাফায় যুক্ত করে নিতে পারেন। এর কারণ হলো, ক্রেতারা সেই পণ্যগুলো কিনতে বাধ্য, তাই দাম কমানোর কোনো প্রয়োজন বিক্রেতার থাকে না। কিন্তু, যদি কোনো পণ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক হয় (যেমন, বিলাসবহুল দ্রব্য) তখন বিক্রেতারা দাম কমাতে বাধ্য হন। কারণ, দাম না কমালে ক্রেতারা সহজেই বিকল্প পণ্যগুলোর দিকে ঝুঁকতে পারেন। তাই, কর কমানোর সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর জন্য পণ্যের বাজারের প্রকৃতি এবং দ্রব্যের দাম স্থিতিস্থাপকতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জিএসটি ২.০ এর বাস্তবায়নে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই কর হ্রাসের সুবিধা পুরোপুরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা কঠিন হতে পারে, কারণ ডিলারদের পুরোনো মজুত পণ্যগুলোর কারণে মূল্য হ্রাস সাময়িকভাবে বিলম্বিত হতে পারে। এছাড়াও, বীমার মতো কিছু খাতকে করমুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে তারা ‘ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট’ দাবি করতে পারবে না। সহজ কথায়, বীমা কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসার জন্য পণ্য বা পরিষেবা কেনার সময় যে কর দেয়, তা ফেরত পাবে না। এর ফলে তাদের সামগ্রিক খরচ বাড়বে। যদিও আপাত দৃষ্টিতে বীমা করমুক্ত বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে পরোক্ষভাবে সেই বাড়তি খরচের বোঝা ভোক্তার উপরই বর্তায়। এটি জিএসটি কাঠামোর একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ করমুক্তির সুবিধা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাছে না-ও পৌঁছতে পারে। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেছেন যে, এই সংস্কারটি দেরিতে এসেছে। এখন মানুষের সঞ্চয় কমেছে এবং ঋণ বেড়েছে, ফলে শুধু দাম কমিয়ে চাহিদা বাড়ানো কঠিন। কারণ মানুষ হয়তো কর ছাড়ের বাড়তি অর্থ ভোগ বাড়ানোর কাজে না লাগিয়ে, বরং ঋণ পরিশোধ বা দৈনন্দিন খরচ মেটাতে ব্যবহার করবে।
পরিশেষে
নিঃসন্দেহে, জিএসটি ২.০ ভারতের পরোক্ষ কর ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি একটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হলেও, এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যাবে। এই সংস্কার একদিকে জনগণের আর্থিক বোঝা কমিয়ে অর্থনৈতিক সুফল বয়ে আনবে, অন্যদিকে, আসন্ন নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের হয়ে সমর্থন জোগাড় করে দেবে। অর্থাৎ এটি শাসক দলের একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠছে। তাই জিএসটি ২.০ - কেবল অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং শাসক দলের একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল।