পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিদায় ইরফান খান

  • 01 May, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2083 view(s)
  • লিখেছেন : মানস ঘোষ
বেশ কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছিলেন ইরফান খান তাঁর অভিনেতা জীবনে, তার মধ্যে আং লি'র লাইফ অফ পাই বা ড্যানি বয়েলের স্লামডগ মিলিয়নেয়ার তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছে, তবু ইরফান খান বলতেই আমার মনে ভেসে ওঠে বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল মিয়া'র চেহারা।

ইরফান খান চলে গেলেন। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকেই চিকিৎসকরা আর কোনো আশার কথা শোনাচ্ছিলেন না। অসম যুদ্ধ, তবু লড়াই চলছিল। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। সে দিনটা এল অবশেষে।

শিহরণ-জাগানো নক্ষত্র ছিলেননা তিনি, যিনি পর্দায় অসম্ভবকে সম্ভব করেন। তবু এত শোকগাথা খুব কম অভিনেতার জন্যই রচিত হয়েছে। হৃদয়ের এত কাছে ছিলেন তিনি এতো মানুষের, এ বড় কম কথা নয়! লকডাউনের যাবতীয় বিষাদ যেন সোশাল মিডিয়ার পাতায় এলেজি হয়ে উপচে পড়ল ইরফান খানের বিদায়ে। তার থেকে ঝলমলে অভিনেতাও কেউ কেউ চলে গেলেন এই সময়ে। সব মৃত্যুই দুঃখজনক, তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে। সব মরণ নয় সমান।

বেশ কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছিলেন ইরফান খান তাঁর অভিনেতা জীবনে, তার মধ্যে আং লি'র লাইফ অফ পাই বা ড্যানি বয়েলের স্লামডগ মিলিয়নেয়ার তাঁকে আন্তর্জাতিক পরিচিতি দিয়েছে, তবু ইরফান খান বলতেই আমার মনে ভেসে ওঠে বিশাল ভরদ্বাজের মকবুল মিয়া'র চেহারা। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের আড়ালে কি এক বিষাদ আর একাকিত্ব ঘিরে ছিল তাকে। যে কথা গডফাদারের মার্লন ব্রান্ডোকে দেখলেও মনে হয়। এ পৃথিবীর রণ, রক্ত, সফলতার আড়ালে যে একটা বিষাদ-প্রতিমা লুকিয়ে থাকে, যা ছিল সেক্সপিয়েরেরও প্রধান প্রতিপাদ্য, তা ইরফানের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, মুখের প্রতিটা পেশীর সঞ্চালন, শরীরি ভাষা আর সংলাপে রূপ পায়। মকবুল মিয়া'র একই শরীরে ক্ষমতার মোহ আর নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছার বিপরীতে বাস করে বিষাদ-সিন্ধু -- স্তানিস্লোভস্কি এই দ্বান্দ্বিক অভিনয়ের কথাই বোধহয় বলেছিলেন।

এপিক অভিনয়ের পাশেই লাঞ্চবক্স-এর মত ছবিতেও অবলীলায় মহানগরের জনস্রোতের মধ্যবয়স্ক একজন হয়ে যেতেও অসুবিধা হয়না ইরফানের। অথবা নেমসেক-এর সংসারী পুরুষ। এগুলো তিনি সহজেই করে ফেলেন। ন্যাশন্যাল স্কুল অব ড্রামার একজন পরিশ্রমী, চিন্তাশীল, নিষ্ঠাবান প্রাক্তনীর কাছে অভিনেতা হিসেবে এই কাজগুলো কঠিন হলেও অসাধ্য নয় মোটেই। কিন্তু পান সিং তোমর বা রুহদার কেবল ভালো ছাত্রের কাজ নয়। সেখানে অভিনেতাকে অনেকখানি বোঝাপড়া করতে হয়।

পান সিং তোমর -- সুবেদার থেকে বাগী। প্রথম থেকেই ইরফানের অভিনয়ে পান সিং-এর মধ্যে সাফল্যের ইচ্ছা আর নিরাসক্তি পাশাপাশি চলতে থাকে। যখন সুবেদার থেকে বাগী বনে যায় ইরফানের অভিনয়ে সে হয়ে ওঠে আরো বেশি অন্তর্মুখী, আরো অভিব্যক্তিহীন, আরো নির্লিপ্ত। তার এই নির্লিপ্তির মধ্যে ফুটে ওঠে একপ্রকার 'এগসিস্টেন্সিয়াল আংস্ট' আর একাকিত্ব। যেমনটা হাম্ফ্রে বোগার্টের অভিব্যক্তিতে খুজে পেয়েছিলেন চলচ্চিত্র বোদ্ধা আন্দ্রে বাজাঁ। '...The final expression of a melancholy man who would fade away with a smile. That is indeed the smile of death.' বোগার্ট বিষয়ে বাজাঁর কথাগুলো ইরফান সম্পর্কেও বলা যায়।

ইরফানের অভিব্যক্তিতে মিশে থাকে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা। যে বিষণ্ণতা আমরা পরাজিত মানুষের মুখে দেখি, যে বিষণ্ণতা আমরা ক্লান্ত চ্যাপলিনের মুখে দেখি, যে বিষণ্ণতা আমরা দেখি হেমিংওয়ের শ্রান্ত গোধূলিতে। বিজয়ী নয়, সফল নয়, যে ব্যর্থ আর ক্লান্ত মানুষের স্রোত চলেছে প্রতিদিন আমাদের গ্রাম-শহরে তাদের বিষণ্ণতার দিনলিপি লেখা থাকে ইরফানের মুখচ্ছবিতে। তাই তাঁকে অসময়ে বিদায় জানানো আমাদের পক্ষে সহজ নয়!

0 Comments

Post Comment