রোবটের বুদ্ধি, হাসপাতালে না করে থানায় করেছে। কোদাইকানাল অবজারভেটরি থেকে পুলিশ স্টেশনের দূরত্ব ২ কিমি, যেতে লাগে ৭ মিনিট। কোনমতে সেতুরামনকে ওঠানো গেছে। ড্রোনের যুগ, ২০৩০ সাল, কিন্তু মুরুগাপ্পার এখনো জিপ পছন্দ। নিজেই চালান। কপালে একটু ছাই ঘষেই লাফ দিয়ে জিপ স্টারট দিলেন মুরুগন।
সেতুরামনও রোবট।
রোবটরা গার্ডের কাজ ভালো করে, হোটেলে রিসেপশানিস্ট আর অফিসকাছারিতে বডিগার্ড। সেতুরামন মেডিকাল রোবট, এমারজেন্সীটা বোঝে, প্রেসার পালস মেপে, দরকার হলে সিপি আর করতেও পারে, স্পেসাল সাকশান ক্যাপ আছে লাগিয়ে নেয়। তারপর মেডিকাল সেন্টারে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়, দরকার হলে এম্বুলেন্সও ডাকে।
গেটে দাঁড়িয়ে বীরবাহাদুর। বীরবাহাদুর রোবটের নাম, চটপট ফোন করেছে তাই তাকে প্রথমেই ধন্যবাদ দিলেন। রোবটরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিগন্যাল দিয়ে। সেতুর সঙ্গে বাহাদুরের কিছু কথা হল, লাইট জ্বলল মাথায় কয়েকবার। সেতু নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর বাহাদুর বোকার মত একটা হাসি দিয়ে মুরুগাপ্পাকে বলল, আসুন স্যার, এইদিকে লাশ।
এর মধ্যে লাশ? সেতুরামন গেল চেক করতে। যাবার সময় একটু ধাক্কা লাগল মুরুগাপ্পার গায়ে। রোবটরা তাড়াহুড়ো করে না বা ধাক্কা দেয় না। মুরুগাপ্পা একটু অবাক হয়ে ওর পেছনে পেছনে চললেন অবজারভেশান রুমের দিকে। অনেকগুলো সিঁড়ি চড়তে হয়। যেতে যেতে বীরবাহাদুরের কাছে জানতে চাইলেন পুরো ব্যাপারটা।
বাহাদুর জানালো, ডক্টর গুরুমূরতি একজন জ্যোতির্বিদ যিনি গ্রহাণু নিয়ে গবেষণা করে বিশ্ববিখ্যাত। এপফিস নামে এক গ্রহাণু নাকি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। সবাই আশঙ্কা করছে সেটা তিনমাসের মধ্যে কলকাতা শহরে এসে আছড়ে পড়বে।
-তুমি এত খবর রাখো?
- হ্যাঁ সার, আমি ইঞ্জিনয়ারিং কলেজ ফর রোবটের গ্রাজুয়েট।
- সেকি, তাহলে, বডিগার্ড…
- সায়েন্টিফিক চাকরির বড় অভাব। বাধ্য হয়ে অনেকে গার্ড হচ্ছে। স্টেডি মেন্টেনেনান্স তো হবে, অন্তত পঞ্চাশ বছর।
-আচ্ছা সেদিন এখানে ডক্টরসাব ঠিক কি করছিলেন?
-সার, ওনার কাজ ছিল গ্রহাণুটার অরবিট নিখুঁত করে মেপে এপোফিস প্রোটেকশান সেন্টারে রিপোর্ট, ওখান থেকেই তো…
-হ্যাঁ শুনেছি ওখান থেকেই নাকি রোবটশিপ ছাড়া হবে গ্রহাণুর দিকে। কামিকাজি না কি…
-ঠিকই শুনেছেন। কামিকাজি জাপানীরা ব্যবহার করেছিল, বোমার মধ্যে পাইলট বসে থাকত, সেই পাইলট গিয়ে আছড়ে পড়ত টার্গেটে।
-আচ্ছা বুঝলাম। তারপর বলো তো বাহাদুর, কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল?
-সার, আমি তো গারড ডিউটি দিই, ওপরে যাই, নীচে ঘুরি সিসিটিভি চেক করি, ব্যাস।
-আর কেউ ছিলেন না ওনার সঙ্গে? উনি একলাই কাজ করছিলেন?
মনে হল বাহাদুর সিঁড়িতে একটু হোঁচট খেল। এটা একটু অদ্ভুত। রোবটরা হোঁচট খায় না সহজে। মুরুগাপ্পার অবাক লাগল, সরু সিঁড়ি, থেমে পিছনে তাকালেন।
একটু বোকা বোকা হাসি হেসে বাহাদুর উঠে এল, সরি স্যার। সার্কিটে একটা গ্লিচ হয়েছিল, এখন ঠিক আছে।
ওনার সঙ্গে ছিলেন ওনার এসিস্ট্যান্ট সৃজন শাহ। ডক্ট্রসাহেবের সঙ্গে কাজ করতেন, সবটাতো আমি জানি না, কাল হঠাৎ ওনার বাড়ী থেকে ফোন এল, মাদার সিক, স্ট্রোক, কাম ইমিডিয়েটলি।
-এরকম ফোন! তারপর?
-কাজটা এমারজেন্সী ওয়ারক, কাজেই ডক্টরসাহেব ছুটি দিতে চাইলেন না, তাই নিয়ে অনেকক্ষণ ডিবেট হল। তারপর আবার একটা ফোন এল।
-কার?
-আমার কাছে সব কলই মনিটর হয়। এক মিনিস্টারের, খুব হাইলেভেল। ডক্টর সাহেব তারপরেই ওনাকে যেতে দিলেন। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন।
ততক্ষণ ওপরে চলে এসেছেন দুজনেই।
সাদা ধবধবে বিশাল টাওয়ার, মাথায় ঝুড়ির মত গম্বুজ যার একদিকটা কাটা, এটাই দেখে এসেছেন মুরুগাপ্পা, ভিতরে এসেও অদ্ভুত কিছু লাগল না। একটা বিশাল টেলিস্কোপ তাক করে আছে ঐ কাটা জায়গাটা দিয়ে মহাকাশের দিকে। একটা সেমিসারকুলার টেবল, অনেকগুলো কম্পিউটার টারমিনাল, একটা প্যাড, তিন চারটে রঙ্গীন কলম। দুটো সুইঙ্গিং চেয়ার।
আর মেঝেতে পড়ে আছেন ডক্টর গুরুমুরতি। শবাসন হয়ে। মাথাটা একপাশে কাত, সেখান দিয়ে একটা হাল্কা রক্তের ধারা।
আর সেতুরামন নিজের হাতের কিবোরডে টাইপ করে চলেছে। ওরা ঢুকতে হাসল, বলল,
‘ডেড। ফোর আওয়ারস এগো। আমি হসপিটালে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি, এম্বুলেন্স এক্ষুনি আসবে। এখানে আমার আর কিছু করার নেই।‘
সেতুরামন উঠতেই বাহাদুর আর ওর মধ্যে কিছু কথা হল। মুরুগাপ্পার কিছু করার আগেই সেতু সব ছবি তুলে নিয়েছে। মুরুগাপ্পা তাও একবার ঘুরে দেখলেন, একবার বডির পাশে বসলেন। মুখের হাল্কা দাড়ি কিছু এখানে ওখানে পড়ে। চোখের দৃষ্টিটা দেখে মনে হচ্ছে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
‘চলুন স্যার, এম্বুলেন্স এসে গেছে।‘
সেতুর পারসোন্যাল ফোন বেজে উঠল। তিনজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকলেন। মুরুগাপ্পার মাথায় অনেকগুলো খটকা।
রেবতীকে দেখলে মনেই হবে না বৈজ্ঞানিক গুরুমূর্তির মেয়ে। কিন্তু সেও পরিবারের ধারা মেনে গবেষণা করে, কিন্তু তার বিষয় এডভান্সড এআই। কোইয়াম্পুত্থুরে তার ল্যাব। সেখানে থানা থেকে খবর যেতে একটা এক্সপ্রেস ড্রোনট্যাক্সি বুক করে চলে এল সোজা মুরুগাপ্পার অফিসে।
-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার বাবা হার্ট এটাকে মারা গেছেন।
-শান্ত হোন ম্যাডাম। যে কোন ডেথ স্বীকার করে নেওয়া খুব কষ্টকর। আপনি একটু শক্ত হোন।
-আমার বাবার সব হেলথ রেকর্ড আমি দেখেছি, পারফেক্ট কন্ডিশান অফ হার্ট, হঠাৎ হার্ট এটাক হতে যাবে কেন? হাসপাতালের রিপোর্ট এসেছে?
-এই আসবে এগারোটার মধ্যে।
-এলে আমি একটু দেখতে চাই।
এগারোটার সময় রিপোর্ট এলো পিডিএফ ফাইলে। তাতে লেখা ডায়েড অফ ম্যাসিভ এটাক। টাইম অফ ডেথ থ্রি এএম।
-আপনাকে কখন ফোন করেছিল বাবার বডিগার্ড?
-৫টার সময়। বলেছিল কন্ডিশান সিরিয়াস।
-আর ডেথ বলছে থ্রি এএম।
-তা হলে?
-তা হলে?
মুরুগাপ্পার কপালে ভাঁজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
-আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?
মুরুগাপ্পার মাথার খটকাগুলো আবার ফিরে এল। গ্লিচ। ক্রাইম সিন থেকে আসতে আসতে এগুলো মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু তার উত্তরগুলো এতই অসম্ভব যে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
-না কিছু বুঝতে পারছি না, তবে এই গারডের কথায় আর ব্যবহারে কিছু সন্দেহ হয়েছে। কিন্তু রোবটদের সন্দেহ করা মানে তো পাগলামি। ওদের ক্রাইম করার কোন মোটিভইনেই। বরং কোন বিদেশি শক্তি… আমাদের প্রতিবেশীরা তো… বলা যায় না, কোন ক্লু আসছে না মাথায়।
-আমি একটু ব্যাপারটা দেখতে পারি? আপনিতো জানেন আমি রোবটিক্স নিয়ে কাজ করি। রোবটদের বিহেভিয়ার নিয়ে কিছুদিন অনেক গ্লিচ দেখা যাচ্ছে, আমি একটা রাত অবসারভেটরিতে থাকতে চাই। একটু স্টাডি করব, কি কি ঘটনা ঘটেছিল।
-আমরা তো দেখেছি সিসিটিভি, কোন অদ্ভুত কিছু দেখি নি। ঠিক আছে আপনি দেখুন, আপনার সঙ্গে আমাদের হিউম্যান গারড একজন দিয়ে দেব।
মুরুগাপ্পা লাঞ্চের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। কার্ড রাইস, পিক্ল আর পাপড। খেয়ে, জলের বোতল নিয়ে রেবতী ঢুকতেই বাহাদুর এসে সামনে দাঁড়ালো সামনে, বলল পাস আছে?
রেবতী অলইনওয়ান আইডিকার্ডটা হাতে দিতে অনেকবার করে বাহাদুর সেটা স্ক্যান করে বলল,
-আপনি পুলিসের লোক?
-হ্যাঁ পুলিসকে এক্সপারট মতামত দেওয়া আমার কাজ, আমি সিনটা স্ক্যান করে রিপোর্ট দেব। প্রথমে আমাকে একটু সিসিটিভিটা দেখাও দেখি,
বাহাদুর খুব বড় করে একটা হাসি দিল, তারপর বলল এট ইয়োর সার্ভিস ম্যাম।
-অত হাসির কি হল?
-ওটা ম্যাম আমাদের ট্রেনিং। মহিলাদের এক্সট্রা রেস্পেক্ট দিতে শেখানো হয়েছে। আপনি কোন সফট ড্রিঙ্ক নেবেন? চা? ডক্টর সাহেব খুব ভাল বাসতেন নীলগিরির চা, সোজা গার্ডেন থেকে আনা।
ডক্টর সাহেবের কথা শুনে চোখটা হঠাৎ চোখটা জলে ভরে যেতে তাড়াতাড়ি রেবতি মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাল।
-এটা কি ওপরে যাওয়ার রাস্তা? আমি একটু যাব। তুমি আমার সামনে চল রাস্তা দেখিয়ে।
ওপরে গিয়ে টেবিলে বসে নিজের ল্যাপটপ খুলে রেবতী কেস রিপোর্ট দেখতে বসল।
বাহাদুর তখনো দাঁড়িয়ে।
-ঠিক আছে, তুমি এখন যাও তোমার অন্য কাজ করো। নীচে সেন্তিল আছে, ওর একটু কফির ব্যবস্থা করলে ভাল হয়।
বাহাদুর নেমে যেতে রেবতী সিসিটিভির রিপোর্টটা ডাউনলোড করল, করে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল কাল রাত দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত ক্লিপটা।
দেখতে দেখতে চোখ বড় বড় হয়ে এল ও নিঃশ্বাসের গতি ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল।
পুরো ছবিটাই ফেক, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এসওআরএ লেখা ওয়াটারমারক করে। তার মধ্যে লুকোন লিঙ্কটা খুঁজে বার করতে বেশি সময় লাগল না, লিঙ্কে ক্লিক করতেই ডাউনলোড হয়ে গেল আসল ক্লিপটা যেটা কেউ খুব তাড়াতাড়ি করে পাল্টেছে।
আবছা আলো জ্বলছে, বাবা মন দিয়ে আকাশ দেখছেন, পিছন থেকে বাহাদুরের গলা,
-স্যার আপনারা কি সত্যি এপোফিসের গতিপথ মাপতে পারবেন নিখুঁতভাবে?
বাবা খুব অবাক হয়ে চোখ সরিয়ে দেখে, জবাব দেয়
-পারব তো নিশ্চয়ই। পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে না? কত বড় দায়িত্ব আমার।
-পারলে কি করবেন?
-পারলে আমাদের কামিকাজি ফোরস আছে, এক্টিভেট হয়ে যাবে। এক লক্ষ রোবট ধেয়ে যাবে গ্রহাণুর দিকে।
-রোবটগুলোর কি হবে?
-কি আর হবে, রোবট তো মানুষ তো নয়। ধ্বংস হয়ে যাবে।
-ম্যাডাম কফি। চমকে ওঠে রেবতী, তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেয় ক্লিপটা, হাত বাড়ায় কফির দিকে,
কফির জায়গায় দুটো ইস্পাতের হাত বেরিয়ে আসে।।
আবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে ফোন। ভোর ৫টা। মুরুগাপ্পা ফোন ধরেন, ব্যাকরণশুদ্ধ ভাষা,
দি লেডি জাম্পড আউট অফ উইন্ডো ইন গ্রীফ, এটেম্পটেড সুইসাইড, কাম কুইকলি…