পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাংলাদেশের হৃদয় হতে….

  • 06 December, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 456 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক অধিকারী
বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদ আর আমার ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুত্ববাদের দর্শন নিয়ে যতই আলোচনা থাক সব আলোচনা এসে থামে সমানাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রশ্নে। উভয় দেশেই সার্বিক ক্ষতির মুখে পড়ে ও পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। দুদেশের সম্পর্ক,বানিজ্যিক আদান প্রদান ও সহমর্মিতা যত দ্রুত মেরামত হবে ততই মঙ্গল।

১৯৭১-র ৬ ডিসেম্বর। ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী লোকসভার সকালের অধিবেশনে একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন,“আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে,একই আদর্শ ও ত্যাগে অনুপ্রাণিত ভারত ও বাংলাদেশের সরকার এবং জনসাধারণ পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রসংহতি বজায় রাখা, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা,সমান অধিকার এবং পারস্পরিক সুযোগ-সুবিধা ও উপকারের ভিত্তিতে এক্ দৃঢ় মধুর সম্পর্ক গঠন করবে। এইভাবে একত্রে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে আমরা সৎ-প্রতিবেশী হয়ে বাস করার এমন এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরব যাতে এই অঞ্চলে শান্তি,শৃঙ্খলা এবং প্রগতি চিরস্থায়ী হয়।”একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অশনি,স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং শ্রীমতি গান্ধীর স্পষ্ট ও ওজনদার ভাষণের পর আমরা কাটিয়ে এসেছি তিপ্পান্নটি বছর।আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে দুই দেশের রাষ্ট্র সংহতি ও সার্বভৌমত্বের উপর একটি প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে! বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় ওপারের দিকে তাকিয়ে দেখছে সেখানের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় যে বিপদের মধ্যে রয়েছে তার থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে পারস্পরিক দুই দেশের মধ্যে ডায়ালগ ওপেন করা।দোষারোপ নয় বরং আলোচনাই হতে পারে একমাত্র পথ।একই ভাষা ও সংস্কৃতির আদান প্রদান যেখানে সহজাত সেখানে দুদেশের মধ্যকার আবেগের অপমৃত্যু এভাবে ঘটতে পারে না।কিন্তু এ কথাও তো সত্যি,যেদিন গত জুলাইয়ের অশান্ত বাংলাদেশে আমরা দেখলাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের মাথার উপর চেপে বসে একশ্রেণির দুবৃত্ত হাতুড়ির আঘাতে ভাঙছে বঙ্গবন্ধুর মাথা,তাঁর শরীরে লাগানো হচ্ছে বিষ্ঠা,দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে তাঁর মূর্তি ঢাকার রাস্তায় তখন যে মূর্ত  ইতিহাসকে ধ্বংস করছে আজকের প্রজন্ম,যাদের বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ইতিহাস মননে নেই তখন একদিকে যেমন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনার ওপর সে দেশের বিপুল অংশের মানুষের অনাস্থা প্রকট হয়ে উঠেছিল তেমনই মূল্যবোধহীন অবক্ষয়ের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ।তাই বর্তমান অশান্তির দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপর যে অনেকটা বর্তাবে না তা অস্বীকার করার উপায় নেই।মানবিক দিক থেকে একটি দেশ এত সহজে যে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে তা ভেবে ওঠাও বেশ কষ্টের। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যখন ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননা হয়, সে দেশের জাতীয় সংগীত বিশ্বকবির ‘আমার সোনার বাংলা….’পাল্টানোর দাবি ওঠে ও জাতীয় নেতারা তদারকি প্রধান ইউনুস সহ সবাই তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন ও দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক তুলে যান তখন নজরুল আমাদের চেতনায় বলে যান,“কান্ডারী বলো, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।”

      শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশে লিখছেন “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি।  একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালি- দের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালো- বাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।” দেশ ও জাতিসত্তার গভীরে যে মানুষটির সন্ধান পাওয়া যায় উক্ত কথনে তা অনুধাবন করার পর বাঙালি হিসেবে যে আত্মবিশ্বাস মনের মধ্যে লালিত হয় তা দিয়ে এক দূরদূরাশ্চয় আলোক রেখা  অভিসারী বীক্ষণে সযত্নে প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে এই বলে যে, তুমি বঙ্গবন্ধু শুধু একটি প্রদেশের অভিমান নও। তুমি সর্বকালের, সর্বজন-মন ও মননের  আন্তর্জাতিক আলোকদিশা। একজন প্রাতিষ্ঠানিক বিপ্লবী পুরুষ। বঙ্গবন্ধুর এই যে বাঙালি বাঙালির আত্মশ্লাঘা তা বেশিদিন টিকল না কেন! তাঁর মৃত্যুরও তো পঞ্চাশ বছর ছুঁতে চলেছে।বাংলাদেশের যে স্বাধীনতা তাঁর হাত ধরে এল তারও রূপ রস গন্ধ স্পর্শ তিনি বেশিদিন উপভোগ করতে পারেন নি। মৌলবাদী শক্তি কি তখনও ছিল না বাংলাদেশে। ছিল- কিন্তু তারা স্বাধীনতার পর কিয়ৎদিন পিছু হঠে ছিল সত্য তারপর শেখ হাসিনার আমলে তাদের চুপিসারে বৃদ্ধি ঘটেছে। নইলে মুক্তমনা ব্লগারদের একের পর এক হত্যা সংঘটিত হতে পারত না। বর্তমান ঘটনার যা গতি প্রকৃতি তাতে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক যে ইন্দিরা গান্ধীর সময় যদি তৎপরতার সঙ্গে পাকিস্তানের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল এখন নরেন্দ্র মোদী কেন সেই তৎপরতা দেখাচ্ছেন না; যদিও বিদেশ সচিবকে তিনি ওপার বাংলায় পাঠাচ্ছেন আগামী হপ্তায় আমাদের রাজ্য সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থেকে নিজের দায় সারছেন। রাস্তায় তাঁরা নেই, বিবৃতি ট্যুইটারে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন, বিতাড়ন যথারীতি চলছে। মন্দির পুড়ছে। চুরি,ডাকাতি গবাদি পশু নিয়ে যাওয়া চলছে। হিন্দু চাষীর ফলানো ফসলের ওপর অধিকার কায়েম হচ্ছে। অসহায় হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের ফতোয়া মেনে একঘরে হয়ে থাকতে হচ্ছে। সংগঠিত অপরাধ বাড়ছে। যদিও প্রচুর মিথ্যে তথ্য, ভারতের প্রচারমাধ্যমে দেখানো হচ্ছে, কিন্তু যা রটে, তার কিছুটা তো বটেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অদ্ভুত নীরবতায় আচ্ছন্ন। যদিও সংসদের উভয় কক্ষে সরকার পক্ষ ও বিরোধী পক্ষের বাংলাদেশ ইস্যুতে এক রা শোনা গেছে। প্রতিবাদের রাস্তায় মানুষও নেমেছে। কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার দরজা যতদিন না খুলছে ততদিন আমাদের চায়ের টেবিল গুলো উত্তপ্ত হবে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। অন্যদিকে ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কিছু বিবৃতি পাশ করলেও শেখ হাসিনাও দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন না। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মোহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সম্প্রতি যে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে (বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, আওয়ামি লীগ ও এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়া) সেই বৈঠকে বাম ও গণতান্ত্রিক জোটের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, ৫আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুল্থানের পর ফ্যাসিস্ত ও উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্তে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন নেমে এসেছে তাতে তাঁরা উদ্বিগ্ন। সেইসঙ্গে ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননা নিয়েও সরকারকে সতর্ক থাকার কথা জানিয়েছে জোট। জামাতের পক্ষে আমির শফিকুর রহমান যতই বলুন,“যে রূপ নিয়েই আসুক, সকল রূপের চরমপন্থাকে ঘৃণা করব, প্রশ্রয় দেব না। এ ব্যাপারে একমত হয়েছি”, ততই কানে বাজে তাঁর অন্য কথাটি যেখানে তিনি বলছেন, মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশকে কলুষিত করার জন্য এই সরকার (ভারত) এবং জনগণকে ব্যর্থ করার জন্য তাঁরা সারা দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন এবং অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমরা এগুলোর নিন্দা জানিয়েছি”(প্রথম আলো)। তাছাড়া ভারতের পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশের মিত্রদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি, ভারতের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করে মন্তব্য করা হয়েছে যা যথেষ্ট উদ্বেগপূর্ণ। ড.ইউনুসের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকের যে নির্যাস-১) ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যাবতীয় ক্ষতিকর(!) চুক্তি বাতিল করা।২) বৈদেশিক সম্পর্ক দৃঢ় করার লক্ষ্যে বন্ধু দেশের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বাড়ানো। ৩)ভারতে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচার ও তৎপরতা, আগরতলার বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা,বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মতামত প্রদান ইত্যাদির বিরুদ্ধে সমবেত নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।কিন্তু এসবের বাইরে যখন বাংলাদেশের রাস্তায় ঘোষণার মৌত শোনা যায় যে, মেয়েদের বাজারে আসা বারণ, ইসকনকে নিষিদ্ধ করতে হবে এই কারণে যে, এরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছে ও ইসকন একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তাই এদের কাউকে এদেশে ঢুকতে দেওয়া যাবে না তখনই সব রহস্যের কিনারা হয়ে যায়। শুধু হিন্দুত্ববাদী ভাবনা নয় মেয়েদের ঠিক তালিবানি কায়দায় পর্দানসীন করে রাখার কাজ সেখানে শুরু হয়েছে। নইলে মেয়েদের কেন বাজারে আসা বারণ! ইসকনের চিন্ময় উপলক্ষ মাত্র, লক্ষ্য একটাই তথাকথিত মৌলবাদী রাষ্ট্র গঠনের ইঙ্গিত যেন মিলছে। আমরা ইরান বা আফগানিস্তানে দেখেছি ধর্ম সেখানে একনায়কতন্ত্রের হাতিয়ার।বিপন্ন মানুষের অধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিসর।

    বাংলাদেশের জনসংখ্যার যে নিরিখ তাতে দেখা যাচ্ছে এখানে মুসলিম ৯১.০৮ শতাংশ, হিন্দু ৭.৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতবর্ষে হিন্দু শতাংশ ৭৯.৮শতাংশ এবং মুসলিম ১৪.২শতাংশ। দুই দেশের যে চিত্র তাতে ওপারে যেমন হিন্দুরা সংখ্যালঘু তেমনই এপারে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। ভারতেও মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ নজরে কম আসে না। খাওয়া-পরার ভিত্তিতে ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন এখানেও চলে কিন্তু সমান আদরে মানুষ এখানে উদাত্ত কন্ঠে রবীন্দ্র নজরুল আওড়াতে পারে। তবুও ৬ ডিসেম্বর আসে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অশনি নিয়ে। বিলকিসদের কান্নায় থাকে ইনসাফের লড়াই। এ দেশেই তো সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতান্ত্রিক শব্দ তুলে দেওয়া নিয়ে মামলা হয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদ আর আমার ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দুত্ববাদের দর্শন নিয়ে যতই আলোচনা থাক সব আলোচনা এসে থামে সমানাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রশ্নে। উভয় দেশেই সার্বিক ক্ষতির মুখে পড়ে ও পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। দুদেশের সম্পর্ক,বানিজ্যিক আদান প্রদান ও সহমর্মিতা যত দ্রুত মেরামত হবে ততই মঙ্গল। নৈরাজ্যের বাংলাদেশ আমাদের অভিপ্রায় নয়। ‘মুক্ত করো ভয়।’

    

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment