পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এথেন্স থেকে বাগদাদ হয়ে রোম

  • 07 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1653 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
আরব সাম্রাজ্যে অষ্টম শতকে উম্মাইদ শাসনাকালে জ্ঞান-চর্চা শুরু হয়েছিল পারসিক ভাষায় রচিত জ্যোতির্বিদ্যার বই আরবি ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে। অবশ্য অনুবাদের কর্মকাণ্ড গতি পায় আব্বাসিদ খলিফা আল মনসুর ও খলিফা হারুন আল রশিদের শাসনকালে। এরপর খলিফা আল মামুনের আমলে অনুবাদের কর্মকাণ্ডে জোয়ার আসে। শুধু পারসিক ভাষার নয়, গ্রীক ভাষায় রচিত দর্শন ও বিজ্ঞানের বইগুলি বেশি গুরুত্ব দিয়ে আরবিতে অনুবাদ করা হয়েছিল।

ইউরোপীয় রেনেসাঁ সম্পর্কে বাঙালির আসক্তি আছে। কেননা বাংলারও রেনেসাঁ আছে; রেনেসাঁয় ইউরোপ-যোগ আছে। সার কথা, বাংলার রেনেসাঁ নিয়ে স্মরণে-মননে ইউরোপই জাঁকিয়ে আছে। ইতিহাসে জানা যায়, প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের মণি-মুক্তা কালের আবর্তে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসবের অনেক কিছুই আরবি ভাষায় অনূদিত হয়ে আরবদের হাতে ছিল। ইউরোপীয় পণ্ডিতরা সেইসব উদ্ধার করে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা শুরু করেন। এরই সার্থক পরিণাম হল ইউরোপীয় রেনেসাঁ। ইউরোপীয় রেনেসাঁ নিয়ে চর্চায় গ্রীক সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞান প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু মাঝখানের যোগসূত্র ইসলামীয় সভ্যতার কথা আসেই না প্রায়। সেখানে ইসলামীয় বিশ্বের ভূমিকা অনেকটা ‘রানারের’ মতো। প্রায় হাজার বছর পরে ইউরোপের হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়া। জ্ঞানবিজ্ঞানের আকাঙ্ক্ষায় ফিরে পাওয়া। পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে ইসলামীয় সাম্রাজ্যে সেসব সুরক্ষিত ছিল। তখন এখানেও জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?
আরব সাম্রাজ্যে অষ্টম শতকে উম্মাইদ শাসনাকালে জ্ঞান-চর্চা শুরু হয়েছিল পারসিক ভাষায় রচিত জ্যোতির্বিদ্যার বই আরবি ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে। অবশ্য অনুবাদের কর্মকাণ্ড গতি পায় আব্বাসিদ খলিফা আল মনসুর ও খলিফা হারুন আল রশিদের শাসনকালে। এরপর খলিফা আল মামুনের আমলে অনুবাদের কর্মকাণ্ডে জোয়ার আসে। শুধু পারসিক ভাষার নয়, গ্রীক ভাষায় রচিত দর্শন ও বিজ্ঞানের বইগুলি বেশি গুরুত্ব দিয়ে আরবিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। ভারতের কয়েকটি সংস্কৃত রচনাও আরবিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। খলিফাদের জ্ঞানানুরাগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞান-চর্চা এই উচ্চতায় পৌঁছতে পেরেছিল। আরব সাম্রাজ্যের পাশাপাশি তখনও টিকে থাকা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে গ্রীক জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা কিছু ছিল। চর্চা খুবই সীমিত হওয়ায় সেসব বইপত্র ছিল দুষ্প্রাপ্য। সেখানে ও দূর-দূরান্তে অনেক খোঁজখবর করে বইপত্র সংগ্রহ করতে খলিফাদের ছিল বিশেষ আগ্রহ। শুধু অনুবাদেই বিদ্যাচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল না। আরব ও সংশ্লিষ্ট ইসলামীয় সাম্রাজ্যের পণ্ডিতরা অর্জিত জ্ঞানকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিকশিত করেছিলেন। তাঁরা দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে উন্নততর অবদান রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আগ্রগণ্য হলেন আল খোয়ারিজমি, হুনায়ন ইবন ইশাক, আল কিন্দি, আল ফারাবি, আল রাজি, ইবন সিনা, আল বিরুনি, ইবন রুশদ, থাবিট ইবন কুরা, আল হায়থাম প্রমুখ। তাঁদের প্রায় সকলেই একাধিক বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় মুসলিম প্রাধান্য থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান ও ইহুদি পণ্ডিতরাও অবদান রেখেছিলেন। রাজ-আনুকূল্য, মনীষা ও অধ্যবসায়ের ফলশ্রুতিতে ইসলামীয় সভ্যতায় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক হয়ে উঠেছিল জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ।
সেই যুগে ইসলামীয় বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ কোন্ উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেই ছবিটা আর সব দিক বাদ দিয়ে শুধু সেখানকার গ্রন্থাগারের তথ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন, দশম শতকে মিশরের কায়রোর প্রধান গ্রন্থাগারে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বই-ই ছিল ১৮ হাজার। ত্রয়োদশ শতকে মিশরের মার্ভ শহরে দশটি গ্রন্থাগার ছিল। দশম শতকে আন্দালুসিয়ার (স্পেন) কর্দোবা শহরে প্রধান গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৬ লক্ষ। এই ছবির পাশে যদি ইউরোপের ছবিটা রাখা হয়, তা হলে নৈরাশ্যই চোখে পড়বে। যেমন, ত্রয়োদশ শতকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা ছিল ২ হাজার। ভ্যাটিক্যান সিটিতে ২২৫৭টি। বাস্তবিক, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পঞ্চম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত সময়কাল হল ইউরোপের অন্ধকার যুগ। ইসলামীয় সভ্যতায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ ছিল প্রায় পাঁচশো বছরের পরিক্রমা। এরপর তার বিশ্বকে দেওয়ার মতো যৌথ প্রজ্ঞা আর রইল না। কিছু চর্চা হয়েছিল আরও কিছু সময়। কিন্তু তা ছিল বিক্ষিপ্ত প্রকৃতির। সভ্যতায় কোনো কৃতকর্মই বৃথা যায় না। সভ্যতার নিজস্ব তাগিদে তা কালের প্রবাহে বাহিত। তেমনি ইসলামীয় সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের মণি-মুক্তা ইউরোপে বাহিত হয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের নতুন যুগের গোড়াপত্তনে নিয়োজিত হল। একাদশ শতক থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেই সময় থেকে ইসলামীয় সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের সমস্ত শাখার গ্রন্থগুলি, আরবিতে অনূদিত ও মৌলিক সৃষ্টি সবই, মূলত ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনায় ইসলামীয় সভ্যতা যেখানে থমকে গেল সেখান থেকে শুরু করে ইউরোপ অন্তত পাঁচশো বছর এগিয়ে গেল। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ ইউরোপকে ধাপে ধাপে রেনেসাঁর যুগে পৌঁছে দিল। শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ইউরোপই পেল।
ইসলামীয় সভ্যতার এই স্খলনের জন্য সাধারণত মোঙ্গল জাতির ধ্বংসাত্মক অভিযানকে দায়ী করা হয়। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র বাগদাদে ব্যাপক হত্যা, লুঠতরাজ, গ্রন্থাগার সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ধ্বংস করা হয়েছিল, বলা হয়। কিন্তু প্রথমত, এটা ইতিহাস যে, আরবের অন্যান্য শহরের মতো বাগদাদে ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, বাগদাদে জ্ঞানবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলিতে মোঙ্গলদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বিষয়টা অতিরঞ্জিত। বাগদাদে মোঙ্গলদের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল ত্রয়োদশ শতকে। তখন কিন্তু বাগদাদ জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল না। নবম শতকের পর সেখানে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রতিকূল পরিবেশের কারণে তার ভরকেন্দ্র সরে যায় মিশরের কায়রোতে। অন্যদিকে অষ্টম শতকের মাঝামাঝি আন্দালুসিয়ায় উম্মাইদ শাসক আব্দুর আল রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হলে ধাপে ধাপে জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষতার অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে এই সাম্রাজ্য। আন্দালুসিয়ার কর্দোবা, টলেডো ও আরও কিছু শহর এজন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। দশম থেকে দ্বাদশ শতকে ইসলামীয় সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল কায়রো ও কর্দোবা। মোঙ্গলরা এই অঞ্চলে কখনো পৌঁছতে পারেনি। তথাপি দ্বাদশ শতকের পরে এইসব স্থানেও অবক্ষয় নেমে আসে। জ্ঞানের জগতের রহস্যময়তা এমন যে, ত্রয়োদশ শতকে বাগদাদ ও আরবের আরও কিছু শহরে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালিয়েছিলেন যিনি, সেই মোঙ্গল অধিপতি হুলাগু খান ইসলামীয় সভ্যতায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তাঁর শাসনাধীন পারস্য সাম্রাজ্যে জ্যোতির্বিদ আল তুসি’কে বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা নিযুক্ত করেছিলেন। হুলাগু খান মারাঘায় গ্রহ-নক্ষত্র নিরীক্ষণের জন্য বড় মানমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে বিখ্যাত গ্রন্থাগারও তাঁর তৈরি। আল তুসির তত্ত্বাবধানে জ্যোতির্বিদ্যার ওপর গবেষণা করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম আল উরদি। কোপার্নিকাসের সূর্য-কেন্দ্রিক সৌরজগতের তত্ত্বে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কিত ‘তুসি-কাপল’ ও ‘উরদি-লেমা’র প্রভাব রয়েছে। কোপার্নিকাসের এই তত্ত্বই আধুনিক বিজ্ঞানের একেবারে গোড়ার কথা, তা ওয়াকিবহাল সকলেই মানেন।
ইসলামীয় সভ্যতায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ব্যর্থতার জন্য কেউ কেউ ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের গোঁড়ামি ও বিজ্ঞান-বিমুখ ভূমিকাকে দায়ী করেন। এই যদি সঠিক হয়, তা হলে ইউরোপ প্রায় হাজার বছরের অজ্ঞানতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি অতিক্রম করে রেনেসাঁর ধাত্রী হল কী করে ? ইউরোপে এমনকি ষোড়শ শতকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওর্দানো ব্রুনো গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত তত্ত্ব প্রচার করায় তাঁকে যাজকদের বিধানে আট বছর যন্ত্রণাদায়ক বন্দিজীবন কাটানোর পর আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ প্রমাণের সম্ভার সাজিয়েও গ্যালিলিও গ্যালিলেই পোপের রোষ থেকে রেহাই পাননি। পোপ নিযুক্ত ইনক্যুইজিশন-এর বিধানে বয়ঃবৃদ্ধ গ্যালিলিওকে জীবনের শেষ আট বছর কারান্তরালে কাটাতে হয়েছিল। আরব বা সংশ্লিষ্ট ইসলামীয় সাম্রাজ্যে বিজ্ঞানীদের এই রকম শাস্তির মুখে অন্তত পড়তে হয়নি। ইসলামীয় সভ্যতায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ব্যর্থতার কারণ নিশ্চয় অভ্যন্তরীণ, এবং ধর্মীয় কট্টরতা সেখানে আনুষঙ্গিক কারণ হতে পারে; কিন্তু মূল রয়েছে আরও গভীরে। তার অনুসন্ধানে ইসলামীয় সাম্রাজ্যের রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজের মধ্যেকার সম্পৃক্তির দিকে দৃক্পাত করা প্রয়োজন। এই বাংলাতেও রেনেসাঁ সম্পর্কে চর্চায় ইসলামীয় সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞান প্রসঙ্গ উপেক্ষিত। রেনেসাঁ ও আবদ্ধ জ্ঞান ব্যাপারটা কিন্তু মেলে না। বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে এই চর্চা একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। ইসলামীয় সভ্যতার জ্ঞানবিজ্ঞানের দূরবীনে রেনেসাঁর ইউরোপকে দেখা —মুসলমান সমাজে সেটা নিজেদের নতুন করে প্রকাশ করার বিষয় হয়ে উঠতে পারে।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার :

১) আরব জাতির ইতিহাস— (আদি মল্লিক ব্রাদার্স)

২) দ্য স্পিরিট অফ ইসলাম – সৈয়দ আমীর আলি (মল্লিক ব্রাদার্স),

৩) অন্য এক রেনেসাঁস – সুমিতা দাস (পিপলস বুক সোসাইটি)

৪) প্রমিথিউসের পথে (উৎস মানুষ সংকলন)।

0 Comments

Post Comment