পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আগামী বিধানসভা নির্বাচন- কিছু ভাবনা

  • 24 March, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 558 view(s)
  • লিখেছেন : সৌম্য মণ্ডল
একদিকে সাম্প্রদায়িক বিজেপির ফ্যাসিবাদী উত্থানকে ঠেকাতে ভোটারদের একাংশ তৃণমূলের দিকে গেছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে তৃণমূলের লুম্পেনরাজকে ঠেকাতে ভোটারদের একাংশ গেছে বিজেপির দিকে। তৃণমূলের আঞ্চলিক লুম্পেনরাজের বিরুদ্ধে জনমতকে মুসলিম বিরোধী জনমতে পরিবর্তিত করতে বিজেপি সচেষ্ট। এখন তাহলে কী উপায়? সন্ধান করলেন সৌম্য মণ্ডল

“রোহিঙ্গাদের ফুফু, পাকিস্তানের খালা” বলে প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল প্রার্থী মমতা ব্যানার্জিকে আক্রমণ করেছিলেন বিজেপি প্রার্থী  শুভেন্দু অধিকারী। মমতা তার উপর ওঠা মুসলিম তোষণের অভিযোগ ঝেড়ে ফেলতে চন্ডি পাঠ করেছিলান নির্বাচনী প্রচার মঞ্চে, তার জবাবে শুভেন্দু বলেছিলেন “চন্ডির পিন্ডি চটকে দিয়েছে”... ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ছিলো গত বিধানসভায় নন্দীগ্রাম কেন্দ্রে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর নির্বাচনী বিতর্কের বিষয়।

যে নন্দীগ্রাম ভারত ছাড়ো, তেভাগা বা জমী অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে কৃষক ঐক্য দেখিয়েছিলো, সেই কেন্দ্রে নির্বাচনে কৃষক সমস্যার জায়গায় ইস্যু হল- কে আসল ব্রাহ্মণ! এবং ২৬% মুসলিম ভোটারের কেন্দ্রে এই ফর্মুলায় সাফল্যও পেলো বিজেপি। যদিও শেষ মুহূর্তে পাওয়ার কাটের ফাইনাল টাচ দিতে হয়েছিলো। তবুও মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী মমতা ব্যানার্জির ঘারে নিশ্বাস ফেলা কম কথা নয়। নন্দীগ্রামের সেই নির্বাচনে হেরে যাওয়া ব্রাহ্মণ মুখ্যমন্ত্রী হলেন এবং জিতে যাওয়া ব্রাহ্মণ হলেন বিরোধী দল নেতা!

পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয় সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ। মুসলিম ভোটারের নিরিখে জম্মু-কাশ্মীরে ৬৮%, আসামে ৩৪% এর পরেই স্থান পশ্চিমবঙ্গের, এখানে ২৭% ভোটার মুসলিম। এই রাজ্যে। ২০% এর বেশি মুসলিম ভোটার আছে এমন বিধানসভা আসন ১৪৯টি। ম্যাজিক ফিগার ১৪৮ টি আসন। সুতরাং এই সমীকরণকে পরাজিত করতে হলে প্রয়োজন ধর্মীয় মেরুকরণ, এমন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে ২৭% মুসলিম ভোট বাদ রেখে বেশিরভাগ হিন্দু ভোটই পড়ে বিজেপির ঝুলিতে।

২০২১ সালের নির্বাচনের পর গত চার বছরে শুভেন্দু বা তার দল বিজেপি তৃণমূলের প্রধান বিরোধী হিসেবে অপদার্থতার নজির সৃষ্টি করেছে। অন্তত এই রাজ্যের সাপেক্ষে। এই রাজ্য কংগ্রেসের শাসনামলে বিরোধী বামেদের দেখেছে। বামেদের শাসনামলে মমতা ব্যানার্জির বিরোধী হিসেবে ভূমিকা দেখেছে। সেই তুলনায় বিরোধী হিসবে বিজেপির ভূমিকা তথৈবচ।  


শিক্ষা দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন হোক বা সন্দেশখালি: তৃণমূল সরকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন হয় মূলত বিভিন্ন ছোট বড় বাম দল গুলোর উদ্যোগে, বিজেপি হাজির হয় ফেউ এর ভূমিকায়। বিজেপির ভূমিকা শুধুমাত্র টিভি চ্যানেলে চটকদার কথা এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে রাজ্য গুলোর নির্বাচিত সরকারকে চাপে রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তৃণমূল সরকারকে চাপে রাখতে বিজেপির এই জনবিচ্ছিন্ন প্রশাসনিক পদ্ধতি উলটে তৃণমূলের পক্ষে রাজ্যের স্বাতন্ত্রতা এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতন মানুষদের একাট্টা করে দেয়। আরজি কর আন্দোলনে বিজেপি জনতার দ্বারাই অপ্রত্যাখ্যাত। গত ১ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রী ব্রাত্য বসু এবং তৃণমূল নেতারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার পর রাজ্যে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দূরের কথা বিজেপি আন্দালন শুরু করেছে ছাত্রদেরই বিরুদ্ধে!


একদিকে কেন্দ্র সরকার ভুয়ো জব কার্ডের অভিযোগে রাজ্যের ১০০ দিনের কাজের টাকা আটকে দিয়েছে। যেখানে খোদ কেন্দ্র সরকারের হিসেবে বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশে ভুয়ো জব কার্ডের সংখ্যা ৩,৬৪,৪০১টি। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের ভুয়ো জব কার্ড মাত্র ৫,৬৫১টি! যদিও উত্তর প্রদেশের টাকা না আটকালেও আটকানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের। প্রথম UPA সরকারের আমলে বাম সাংসদরা যে সাংবিধানিক কাজের অধিকার ছিনিয়ে এনেছিলো ১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে, তার থেকে বাংলার গরীব বঞ্চিত। হেল দোল নেই রাজু বিজেপির।

উলটে বাংলাদেশ প্রশ্নে উগ্রতা ছড়িয়ে বাংলার বেসরকারি হাসপাতাল, পর্যটন, হোটেল, আমদানি রফতানি অর্থনীতিকে সঙ্কটের মুখে ফেলে দিয়েছে বাংলার বিধানসভার  প্রধান বিরোধী দলটি। এ হ্যান বিরোধী হিসেবে গুড ফর নাথিং বিজেপির ভোট জেতার জন্য একমাত্র ইস্যু করেছে ধর্মীয় বিভাজনকে। বেলাডাঙার দাঙ্গার মূল চক্রান্তকারী হিসেবে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদী কার্তিক মহারাজকে দেওয়া হল পদ্মশ্রী। মুসলিম যুবকদের ভারতের মূল ধারা থেকে মানসিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই কী কার্তিক মহারাজকে মমতা শঙ্কর বা অভিজিৎ সিং এর মত শিল্পীদের সাথে এক আসনে বসিয়ে পুরস্কৃত করা হল?

সম্প্রতি শুভেন্দু দাবি করেছেন ২৬ সালে ক্ষমতায় এসে মুসলিম বিধায়কদের তিনি চ্যাংদোলা করে বিধানসভার বাইরের রাস্তায় ফেলে দেবেন। ভারতের সংবিধানে বিরোধী বিধায়লদের চ্যাংদোলা করে ফেলে দেওয়ার কোনো বিধান আছে বলে জানা নেই। বিজেপি সংবিধান সংশোধন করে চ্যাংদোলা বিধান ঢোকাবার জন্য বিল এনেছে বলেও জানা যায়নি। তবে সাংবিধানিক হোক বা সংবিধান অবজ্ঞা করে হোক মুসলিম বিধায়কদের সত্যি কী বিজেপি চ্যাংদোলা করে লোকসভা বা বিধানসভার বাইরে ফেলতে চায়? নাকি লোকসভা বিধানসভাকে  হিন্দু জন প্রতিনিধি এবং মুসলিম জনপ্রতিনিধিতে ভাগ করে দেওয়াই আসল উদেশ্য?  যেখানে ৭৯% হিন্দুর দেশে কখনোই “হিন্দুর প্রতিনিধি” বিজেপি হারবে না এবং ১৪% মুসলিমের প্রতিনিধি হয়ে কোনো ইসলামি দলকে বিরোধী আসনে বসে থাকতে হবে!

বিজেপি- উলটো দিকে তৃণমূল নেতাদের ভূমিকা দেখলে মনে হতে পারে যেন নিখুঁত চিত্র নাট্যের অভিনয় চলছে! সংখ্যা তাত্বিকরা যখন “ভারতে মুসলিমরা সংখ্যা গুরু হয়ে যাবে” বিজেপির এই ভুয়ো প্রচারকে যুক্তি তথ্য দিয়ে নাকচ করে দিচ্ছে, তখন কোনো যুক্তি তথ্য ছাড়াই তৃণমূল নেতা এবং কলকাতার মেয়র ববি হাকিম প্রকাশ্যেই মন্তব্য করছেন যে, বাংলায় মুসলিমরা সংখ্যা গুরু হয়ে যাবে! তিনি প্রকাশ্যে বাংলার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করতে বলছেন! (পরে অবশ্য তিনি বলেছেন, তাঁর কথার মানে বদলানো হয়েছে) বেলডাঙা দাঙ্গার সময় তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবির ঘোষণা করে দিলেন যে ২০২৫ সালের ৬ই ডিসেম্বর নাকি বেলডাঙাতে বাবরি মসজিদের শিলান্যাশ হবে!  শুভেন্দুর চ্যাংদোলা মন্তব্যের জবাবে পালটা হুমকি দিলেন হুমায়ুন শুধু তাই নয়, মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের অলস বলে দাবি করে সাম্প্রদায়িক চর্চার আগুনে ঘী ঢাললেন!

লাগাতার এই সমস্ত মন্তব্য পোরখাওয়া তৃণমূল নেতাদের নির্বুদ্ধিতারা পরিচয় নাকি সু-চিন্তিত পরিকল্পনার অংশ তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। তৃণমূল কংগ্রেসের ভেতরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ সক্রিয় বলে বার বার অভিযোগ উঠেছে, এমনকি বেশ কিছু গর্বিত সঙ্ঘীকে গত বিধানসভায় প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তাছাড়া বিভিন্ন দুর্নীতি মামলায় তাদের টিকি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা গুলোর হাতে।

বাংলার উদার বাম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ফলে সাম্প্রদায়িকতার হালকা ডোজে এখানে মেরুকরণ সম্ভব নয়, আবার অতিরিক্ত কড়া ডোজ হলে ফল হিতে বিপরীত হতে পারে বিজেপির জন্য। অন্যদিকে তৃণমূল জানে ২৭ % মুসলিম নিশ্চিত করতে পারলে, উদার বাম হিন্দু ভোট কখনোই বিজেপির দিকে যাবে না। এই মেরুকরণে ভোটে যেই জিতুক লাভবান হবে সঙ্ঘ পরিবারের ধর্মীয় বিদ্বেষের রাজনীতি।

একদিকে সাম্প্রদায়িক বিজেপির ফ্যাসিবাদী উত্থানকে ঠেকাতে ভোটারদের একাংশ তৃণমূলের দিকে গেছে, অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে তৃণমূলের লুম্পেনরাজকে ঠেকাতে ভোটারদের একাংশ গেছে বিজেপির দিকে। তৃণমূলের আঞ্চলিক লুম্পেনরাজের বিরুদ্ধে জনমতকে মুসলিম বিরোধী জনমতে পরিবর্তিত করতে বিজেপি সচেষ্ট।

ফলত এই বিধানসভায় নির্বাচনে বামপন্থীদের প্রধান চ্যালেঞ্জ সাম্প্রদায়িক বাচালতার বাইরে মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যাগুলোকে নির্বাচনী চর্চার কেন্দ্রে নিয়ে আসা শুধু তাই নয় সামগ্রিক ভাবে বাম শিবিরের চ্যালেঞ্জ সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ঘৃণা রাজনীতির বিপরীতে সমাজে সম্প্রীতি এবং শ্রেণী সংহতির বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্টা করা। বলাবাহুল্য বিভিন্ন ধারার বামেদের মধ্যে ঐক্য তৈরি না হলে মূল ধারার বাম বা তার বাইরে বাম দল গুলো জনতাকে আত্মবিশ্বাস যোগাতে পারবে না। যার ফলে ক্ষতির মুখে পড়বে সবাই।

0 Comments

Post Comment