পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ফ্যাসিস্ত আগ্রাসন ও আঠাশে জুলাই ২০২৪

  • 29 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 685 view(s)
  • লিখেছেন : অশোক চট্টোপাধ্যায়
আজকের ভারতবর্ষে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার সময় এসেছে, সময় এসেছে প্রকৃত ফ্যাসিবিরোধী যুক্তঐক্যে সামিল হওয়া। আর এরই প্রেক্ষিতে কমরেড চারু মজুমদের শহিদ দিবস পালনের সময় তাঁর উপরোক্ত কথাগুলিকে মান্যতা দিয়ে তার সজীব অনুশীলন করার। শুধুমাত্র দিবস পালন নয়, চারু মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর চিন্তাচর্চার নিবিড় অনুশীলন আজ সময়ের দাবি।

আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ত নায়করা ভাষিক সন্ত্রাসের বিস্ফোরণ ঘটাতে সদা-অভ্যস্ত। চব্বিশের নির্বাচনে তাঁরা ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করলেও দুদিকে দুই ক্রাচে ভর করে আছে। এই ক্রাচ-নির্ভরতার পরিণতি কি তা এখনই বলা সম্ভব নয়। এতদসত্ত্বেও তাদের আস্ফালন এতটুকু হ্রাস পায়নি। বরং নির্বাচনে ঈপ্সিত সাফল্য না পাওয়ার ঘটনা তাদের ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারতের ‘জার্গন’-কে, নকশাল-মাওবাদী নির্মূলকরণের অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এখন তারা কংগ্রেস আমলে জারি করা জরুরি অবস্থার দিনটিকে ‘সংবিধান হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের আহ্বান জানিয়েছে (অথচ পঁচাত্তরে আরএসএস নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পর সংঘনেতা মধুকর দত্তাত্রেয় দেওরস সহ অন্যান্য সংঘনেতৃবর্গ তো ইন্দিরা গান্ধির কাছে নতজানু হয়েছিলেন)! যারা নকশালপন্থী-মাওবাদী সহ সমস্ত ধরনের বিরোধী স্বরকে বিনিপাত করতে, মুসলিম-দলিত নিধন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অব্যাহত রাখতে সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের অপকর্মের নিরন্তর অনুশীলন করে চলে এবং দেশের মানুষের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার হরণ করতে ব্যস্ত তারা যখন দেশে সংবিধান হত্যা বিরোধী দিবস পালনের আহ্বান জানায় তখন তা হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠে।

২০২১ সালের শেষাশেষি নাগাদ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত বিজেপি শাসিত ভারতে কারান্তরালে ছিলেন এমন বন্দির সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লক্ষের অধিক। এর মধ্যে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা ৭৭.১ শতাংশ; বিচারালয় কর্তৃক শাস্তিপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ২২.২ শতাংশ। পরের বছর ডিসেম্বরের শেষে এই বন্দির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লক্ষ তিয়াত্তর হাজারেরও বেশি। এরপরেও এই সরকারের প্রধান যখন দেশে সংবিধান হত্যার অভিযোগের কথা বলেন তখন কি তা ঘোড়ার হাসির কারণ হয়ে ওঠে না?

এই সরকারের মূল অ্যাজেন্ডা হচ্ছে আমাদের দেশকে হিন্দুভারতে রূপান্তরিত করে এদেশে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস স্থায়ীভাবে কায়েম করা। তাদের একনায়কত্বাধীনে এই দেশ হয়ে উঠবে ধর্মীয় হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজমের নতুন পরীক্ষাগার। আগামীবছর তো এদের পিতৃপ্রতিম সংগঠন আরএসএস-এর জন্মশতবর্ষ। ফলে আমাদের দেশকে ফ্যাসিস্তরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে সারা পৃথিবীতে এক নতুনতর বার্তা দিতে তারা মরীয়া হয়ে উঠছে। আর আমাদের দেশে ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম যেহেতু মূলগতভাবে সংসদীয় পথের নিয়মতান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে, সেইহেতু এই ফ্যাসিবিরোধী লড়াই পরিস্থিতির কারণেই কঠিন হয়ে উঠছে।

বিজেপি-র অন্যতম নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় কিছুকাল আগে সরাসরি হুমকি দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যারা দেশবিরোধী কথা বলবেন তাঁদের হত্যা করা হবে! দেশবিরোধী বলতে এঁরা বিজেপি বিরোধিতার কথাই বোঝেন। ইন্দিরা গান্ধির আমলে এক সময় আওয়াজ উঠেছিল ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া…’ ইন্দিরাই ভারত, ভারতই ইন্দিরা। অর্থাৎ ইন্দিরা এবং ভারত সমার্থক। ইন্দিরাবিরোধী কিছু বলার অর্থই ভারত তথা দেশবিরোধী কিছু বলে ফেলা! ইতালিতেও একসময় শ্লোগান তোলা হয়েছিল ‘মুসোলিনি ইজ ইতালি, ইতালি মুসোলিনি’, অর্থাৎ ফ্যাসিস্ত নায়ক মুসোলিনি এবং ইতালি সমার্থক। এখন আমাদের দেশের বিজেপি-আরএসএস নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ত নায়করা মোদিবিরোধী কিছু বলা আর দেশবিরোধী কিছু বলাকে সমার্থক গণ্য করে বিরোধীদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়ে চলেছেন। এখনও পর্যন্ত সরাসরি মোদি ইজ ইন্ডিয়া জাতীয় শ্লোগান দেওয়া না হলেও ‘মোদিন্ডিয়া’ শব্দটি চর্চার ক্ষেত্রে চলে এসেছে! বিজেপি নেত্রী মীনাক্ষী লেখি-ও হুমকি দিতে গিয়ে বলেছেন : চুপচাপ সব কিছু মেনে না নিলে ইডি  তার বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বে! ফ্যাসিস্ত জুন্টা বেনিতো মুসোলিনির জমানায় ‘ব্ল্যাক শার্ট’ বাহিনীকে দেশের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষার নামে সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতো। আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ত বিজেপি সরকার ইডি, সিবিআই, এনআইএ প্রমুখ সংগঠিত সংস্থাকে দেশের বিরোধী কণ্ঠস্বরকে প্রতিহত করতে ব্যবহার করে থাকে। ফলে লেখির বক্তব্যের অর্থই হলো : প্রধানমন্ত্রী মোদি বা সরকারবিরোধী কোনরকম কাজ করলে বা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাক শার্ট-এর মতো এইসব বাহিনী অতিসক্রিয়তা দেখাতে যখন তখন তাঁদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়বে! এইভাবে একটা শীতল সন্ত্রাসের আবহাওয়াকে দেশের প্রতিবাদী মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলেছে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা না পাওয়া সত্ত্বেও বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার তার ফ্যাসিস্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখে চলেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যেমন দেশে সংবিধান হত্যা দিবস পালনের আহ্বান রাখছেন, তেমনই তাঁরই পশ্চিমবঙ্গীয় সাগরেদ আহ্বান রেখে এখানে গণতন্ত্র হত্যা দিবস পালনের!

আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে ৪ অগাস্ট রাত ভোর হওয়ার আগেই কবি-সাংবাদিক ও নকশাল আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে প্রকাশ্যে খুন করে তাঁর মুণ্ডুচ্ছেদ করা হয়েছিল যাতে তাঁকে শনাক্ত করা না যায়। তার পরের বছর লালবাজার জেলে পুলিশ হেফাজতে খুন করা হয়েছিল নকশাল আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা চারু মজুমদারকে। এই সংবিধান ও গণতন্ত্রের পূজারীরা সেদিন কোথায় ছিলেন? চুয়াত্তরের বিশে জুলাই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দিবসে কলকাতার কার্জন পার্কে নাট্যামোদী প্রবীর দত্তকে পুলিশ প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। আজ এত বছর পরে এসে নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়ে তাঁরা সহসাই সংবিধান এবং গণতন্ত্রের বিপন্নতার কথা বলে চলেছেন? প্রশাসন-আইন এবং বিচারব্যবস্থার ওপর নিরন্তর নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েম করার প্রক্রিয়ায় তাঁরা তো আদিবাসী-দলিত সহ বিভিন্ন গণবিক্ষোভে সামিল হওয়ায় নকশালপন্থী-মাওবাদী সহ সমস্ত ধরনের প্রতিবাদকারীদের ওপর নির্মম দমন-পীড়ন নামিয়ে এনেছেন, সারা দেশকে একটা জেলখানা বানিয়ে ফেলেছেন। জেলের মধ্যেই তো স্টান স্বামীকে হত্যা করেছেন, পানসারে-দাভালকার-গৌরী লঙ্কেশ প্রমুখ প্রতিবাদীদের প্রকাশ্যে হত্যা করিয়েছেন নিজের অসরকারি বাহিনীর মাধ্যমে। গড়চিরোলি-ছত্তিশগড়-বস্তারের বিভিন্ন এলাকায় মাওবাদী দমনের নামে আকাশ থেকে বোম্বিং করে এই ‘স্বাধীন’ ভারতে এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছেন। গত ১৮ জুলাই প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও প্রায় দু’শর মতো কম্যান্ডো বাহিনী গড়চিরোলির ওয়ানদোলির গভীর জঙ্গলে মাওবাদী নিকেশের নামে দু’হাজার রাউন্ড গুলি চালিয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। দেশের প্রতিবাদী জনসাধারণের বিরুদ্ধে দেশের সরকারই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ এরাই আবার দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যেই সংবিধান এবং গণতন্ত্রের জয়গান গাইছে!। ভুয়ো সংঘর্ষের গল্প বানিয়ে বস্তারে মাওবাদীদের নাম করে শয়ে শয়ে প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হওয়া আদিবাসীদের এরা হত্যা করে চলেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে। এরাই তো লেখক-কবি-সাংবাদিক-আইনজীবী প্রমুখদের মিথ্যে অভিযোগে কুখ্যাত য়ুএপিএ আইনে আটক করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারান্তরালে রেখে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর প্রভুত্বের নজির রেখেছে। চোদ্দ বছর আগে করা মন্তব্যের ভিত্তিতে প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায় এবং কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে তাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে বিরুদ্ধে য়ুএপিএ-র মতো কুখ্যাত ঔপনিবেশিক আইনের ধারা মোতাবেক মামলা জারি করা হয়েছে! এটাই তো বিজেপি সরকারের সংবিধান এবং গণতন্ত্র পুজোর নমুনা! আসলে হত্যাপ্রিয়রাই হত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে কার্যত হত্যাকে বৈধতা দান করে থাকে।

আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রশক্তির এই অতি-আগ্রাসী ভূমিকার প্রেক্ষিতে পালিত হতে চলেছে আগামী ২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের তিপ্পান্নতম শহিদ দিবস।

১৯৬৮-র ১৬ মে ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় কমরেড চারু মজুমদার বলেছিলেন যে পার্টি-বহির্ভূত ‘লক্ষ লক্ষ বিপ্লবী নও-জোয়ানদের’ সম্মিলনেই ‘বিপ্লবী পার্টি’ গঠিত হতে পারে। এর ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় তাঁর ‘যুক্তফ্রন্ট ও বিপ্লবী পার্টি’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছিলেন : ‘যুক্তফ্রন্টের নামে ভারতবর্ষে যা ঘটছে সেগুলি হল কতকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল পার্টির ক্ষমতার জন্য জোটবদ্ধ হওয়া। এই একজোট হওয়ার একটিই লক্ষ্য, তা হল, মন্ত্রিসভা দখল করতে হবে।’ এর সঙ্গে তিনি একথাও নির্দ্বিধায় বলেছিলেন যে সেসময় পশ্চিমবাংলায় এবং কেরলে ‘তথাকথিত বামপন্থী পার্টিগুলোও’ এই একই লক্ষ্যে অভিযোজিত হয়েছিল। কথাগুলো তিনি বলেছিলেন ১৯৬৮-র ৩০ মে তাঁর একটি প্রকাশিত নিবন্ধে। তার সাড়ে পাঁচ দশক অতিক্রান্তির পরেও কি এই কথাগুলোর প্রাসঙ্গিকতা আজও অপ্রতিহত নয়?

আজকের ভারতবর্ষে আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার সময় এসেছে, সময়  এসেছে প্রকৃত ফ্যাসিবিরোধী যুক্তঐক্যে সামিল হওয়া। আর এরই প্রেক্ষিতে  কমরেড চারু মজুমদের শহিদ দিবস পালনের সময় তাঁর  উপরোক্ত কথাগুলিকে মান্যতা দিয়ে তার সজীব অনুশীলন করার।  শুধুমাত্র দিবস পালন নয়, চারু মজুমদারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর চিন্তাচর্চার নিবিড় অনুশীলন আজ সময়ের দাবি।

 

 

 

0 Comments

Post Comment