একদিকে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রচারযন্ত্র, অন্যদিকে স্বাধীন গণমাধ্যম। খোলাচোখে দুটোই মিডিয়া। একজনের কাজ তাঁবেদারি, অন্যজন তথ্য প্রকাশের দায়ে হয়রানির শিকার। শেষতম সংযোজন নিউজক্লিক। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারত ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬১-তে পৌঁছলে একদলের কিছু যায় আসে না, আরেক অংশ মুক্ত সাংবাদিকতার স্বপ্ন দেখে। এখানেই ফ্যাসিজমের সঙ্গে সাংবাদিকতার সংঘাত। গণতন্ত্রের সংঘাত। সেই সাংবাদিকতা, যা গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কতটা জোরালো, - তা জানান দেয় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। প্রশ্ন করার ও শোনার অভ্যাস, তথ্য প্রকাশ ও মতামত জানানোর অধিকার ভারতে যথাযথ? না। সম্প্রতি দিল্লির প্রেসক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় নির্বাচন হয়ে গেল। গোহারা হারলো সরকারপন্থী প্যানেল। জিতল - স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের স্বপ্ন দেখা সাংবাদিকদের প্যানেল। যাঁরা গণতন্ত্র চান, যাঁরা মিডিয়ার স্বাধীনতা সূচকে সামনের দিকে দেখতে চান প্রিয় দেশটিকে। যাঁরা প্রশ্ন করে পুলিশি আক্রমণের শিকার। প্রেসক্লাব অফ ইন্ডিয়ার নির্বাচনে জেতার পর স্তব্ধ হয়েছিল জয়ের রেশ। কারণ, আক্রান্ত হল নিউজক্লিক। একইভাবে, একই পন্থায় কি আক্রান্ত হয়েছিল কলকাতা টিভি?
সুমিত দাস : গৌতমদা, শুরুতেই শুভেচ্ছা জানাই। শেষবার প্রেসক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় যে নির্বাচন হয়েছে, তাতে আপনারা সে অর্থে, - সরকারপন্থী প্যানেলকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসছেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ভোটের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আপনারা জিতেছেন। এই গোটা হার্ডলটা শুনতে চাই।
গৌতম লাহিড়ী : আমাদের প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়াকে আমরা মনে করি, - দিল্লিতে বসবাসকারী সমস্ত সাংবাদিকের দ্বিতীয় বাসস্হান। সেকেন্ড হোম। সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, যা ভারতের সংবিধানে ১৯-এর ১ ও ক ধারায় বর্ণিত আছে, সেটাকে রক্ষা করার জন্য প্রেসক্লাবকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। গড়ে তুলছি। আমাদের পূর্বসূরীরাও সেই চেষ্টা করেছেন। আমরাও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখছি। সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের আলোকবর্তিকা হিসেবে এই জাতীয় প্রেসক্লাব কাজ করছে। এখানে সক্রিয় সদস্যের সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। তাঁরা প্রত্যেকেই সাংবাদিক। এবং, এখানে স্বাভাবিক ভাবেই নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। সৌভাগ্যের বিষয়, - যাদের সরকারপন্থী বলা হয়, তাদের সমস্ত প্যানেলকে হারিয়ে ২১টি পদের ২১টিতেই আমরা জয়লাভ করেছি। জয়ের ব্যবধানও বিপুল। এটা শ্লাঘার বিষয়। কঠিন সময়, যখন একটার পর একটা প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ছে, আমি বলবো - সরকারি কব্জায় চলে যাচ্ছে, সেখানে প্রেসক্লাব অফ ইন্ডিয়া এখনও পর্যন্ত সমস্ত সদস্যদের সহযোগিতায় একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি৷ সেই আদর্শ নিয়েই আগামীতে কাজ করতে চাই। আমাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে তাই-ই উল্লেখ করেছিলাম। একই সঙ্গে আমাদের উদ্দেশ্য, - ভারতের সমস্ত প্রেসক্লাবকে একটা ছাতার তলায় নিয়ে আসা। যাতে, মিডিয়ার ওপর চলতে থাকা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জাতীয় স্তরে, বা রাষ্ট্রীয় স্তরে দেশজুড়ে আন্দোলনের চাপ তৈরি করতে পারি। সরকার যাতে আক্রমণের আগে দ্বিতীয়বার ভাবনাচিন্তা করে।
সুমিত : সরকারি প্যানেলকে হারালেন, কঠিন সময়ে দায়িত্ব নিলেন। আপনারা জিতলেন, পরের পরের সপ্তাহে নিউজ ক্লিকের কর্মীদের ওপর রেইড হয়ে গেল। অজস্র পুলিশ তাঁদের ঘিরে ধরলো। তাঁরা কোথায় থাকেন - খুঁজে বের করলো। ল্যাপটপ, মোবাইল বাজেয়াপ্ত হল। কোথাও কি ইন্টার লিংকড?
গৌতম : সময়টা তাৎপর্যপূর্ণ। কাকতালীয় ভাবে, নির্বাচনের পর আমরা একটা উৎসব পালন করি, এবার উৎসব পালনের সুযোগ ঘটেনি। এর ৪৮ ঘন্টা আগে খবর পেলাম, - নিউজ ক্লিকের ওপর, এমনকি যারা সেখানে নিয়মিত লেখেন, কিন্তু কর্মী নন, সকলেই প্রথিতযশা প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক, প্রত্যেক বাড়িতে ভোররাতে একসঙ্গে পুলিশ হানা দিলো। দিল্লি ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় প্রায় চার হাজার পুলিশ তল্লাশি চালালো। যেন পুলিশি-রাষ্ট্র! এর মধ্যে উনচল্লিশ জন পুরুষ সাংবাদিক, সাতজন মহিলা সাংবাদিক। মহিলাদের মধ্যে একজন কনিষ্ঠতম সাংবাদিক। তাঁকে পুলিশ জেরা করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। বাকিদের বাড়িতেই জেরা করেছে। পুরুষদের থানায় হাজিরা দিতে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। তীব্রতা একটু কমেছে।
নিউজ ক্লিকের ঘটনার পর, প্রেসক্লাবে জরুরি বৈঠক ডাকি। সিদ্ধান্ত নিই, - গণতান্ত্রিক উপায়ে আমাদের দ্বারা যতটা সম্ভব - প্রতিবাদ করবো। সৌভাগ্যের বিষয়, - মিডিয়ার সমস্ত সংগঠন এতে যোগ দেয়। নিরাপত্তার বেষ্টনী দিয়ে পুলিশ প্রেসক্লাব ঘিরে রেখেছিল। যাতে প্রেসক্লাবের বাইরে কেউ পা না দিতে পারে। ১৪৪ ধারা তো বটেই, 'ভিভিআইপি মুভমেন্ট' বলে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা ট্রাফিক পুলিশ আরোপ করে। একজনও প্রেসক্লাবের বাইরে বের হতে পারছিল না। বাইরে বের হতে না পারলেও, ভিতরে বহু মানুষের জমায়েত হল। অনেক বর্ষীয়ান সাংবাদিক এসেছিলেন। লাঠি হাতে প্রবীনরা এলেন।
সুমিত : গৌতমদা, একটা বিষয় বলুন, - গত দশ বছরে মিডিয়ার যে চলন তৈরি হল, বিশেষ করে দিল্লিতে, তাতে বিকল্প মিডিয়া ও কর্পোরেট মিডিয়া কি আলাদাই হয়ে গেল? বিকল্প মিডিয়া বলছি বটে, মানে যারা সরাসরি ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সাংবাদিকতা করছেন। এবার, সে অর্থে 'বিকল্প' তো হয় না। মিডিয়া, মিডিয়াই। সাংবাদিকতা জারি আছে। সে তো বেসিক কাজই করছে। কোথাও কর্পোরেট মিডিয়া ও বাকিরা শেষমেশ আলাদা হয়ে গেল? প্রেসক্লাবের নির্বাচনের ফলাফলে তারই প্রতিফলন?
গৌতম : নিঃসন্দেহে। আমাদের ইস্তাহারে বলাই ছিল,- 'মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা ব্রতী থাকবো, এবং লড়াই করবো।' এটা ঘটনা যে, মূলধারার মিডিয়া যাদের বলে, তারা কর্পোরেটের হাতে।
সুমিত : আমরা আমাদের কথায় তাদের সরকারপন্থী মিডিয়া বলতেই পারি!
গৌতম : হ্যাঁ পারি। সরকারপন্থী তারা হয়ে গেছে। 'বিকল্প' বলা হচ্ছে মানে, সামাজিক মাধ্যমে নতুন উদয় হল। যারা প্রকৃত তথ্য বলার চেষ্টা করছে। সত্য বলার চেষ্টা করছে। অ্যানালিক্যাল কাজ করছে। মূলস্রোতের মিডিয়া বলতে এতকাল যে কাজ জানতাম, এই তথাকথিত 'বিকল্প মিডিয়া' এক্ষেত্রে মূল মিডিয়া হয়ে উঠেছে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, টিআরপি অ্যানালিসিসের ভিত্তিতে দেখেছি, - টেলিভিশনের দর্শক সংখ্যা অনেক কমেছে। একেকটি ইউটিউব চ্যানেল, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, মানে সামাজিক গণমাধ্যমের ভিউয়ারশিপ প্রচুর। কখনো কখনো লক্ষাধিক মানে - নূন্যতম সংখ্যা। এটা ঘটনা, মানুষ প্রকৃত সত্য শুনতে চাইছেন! মিডিয়ার কাজ সঠিক তথ্য পরিবেশন করা। সরকারের কোনও গাফিলতি থাকলে সামনে আনা।
সুমিত : তথ্যটাই তো অফ করতে চাইছে। যাতে তথ্য নাগরিকের সামনে না আসে। আসলে ডেমোক্রেসির মডেল তো অন্যরকম। সরকারের কাছে নাগরিকের চাওয়া-পাওয়া পৌঁছে দেবে মিডিয়া। ডকুমেন্টেশন করবে। আর, সরকারের অর্গানগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কীনা, সেটা নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেবে। তথ্যের যা গুরুত্ব। ফ্যাসিজমের চরিত্রই কি তাই, যেখানে...
গৌতম : বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্রের যে লক্ষণ দেখেছি, তাতে একতরফা তথ্য পরিবেশন করা হয়। তথ্য যাচাই করার সুযোগ দেওয়া হয় না৷ ভারতের মত এত বড় দেশ, যে দেশে দশ বছর পর জনগণনা করা হয় না। জনগণনায় সঠিক সামাজিক চিত্র প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালের পর ২০২১ সালে সেন্সাসই হয়নি। ফলে সরকারের চরিত্র থেকেই বোঝা যাচ্ছে, - যে সরকার জনগণনা করতে ভয় পায়। কারণ, জনগণনা মানেই প্রচুর তথ্য। কতজন শিক্ষিত, কতজন চাকুরিপ্রার্থী, কজন চাকরি করছেন, বাড়িতে বাড়িতে কত বেকার, হাউজ হোল্ড ইনকাম কত, ইত্যাদি সাধারণ তথ্য আমরা এতকাল পেতাম। সেই তথ্যই বন্ধ। ফলে বোঝাই যাচ্ছে - এই সরকার প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে চায় না।
সুমিত : ২০১৪ সালের পরে যত সংবাদের সংস্হা, মিডিয়া হাউস অ্যাটাকড হয়েছে, - কলকাতার কলকাতা-টিভিও আছে। দিল্লির সরকার এতদূরে এসেও সাংবাদিকদের হ্যারাসড করেছে। এটাও আলোচনা। আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
গৌতম : এক্ষেত্রে আমার দুটো মত। সাংবাদিকরা আইনের বাইরে - এটা আমি মনে করি না। ভারতের আইনের যদি কোনও সাংবাদিক বা প্রতিষ্ঠান ভঙ্গ করে, তাতে আইন অনুযায়ী তদন্ত হওয়া উচিত। তার মানে এই নয় যে, - ভোররাতে হানা দিতে হবে। সাংবাদিককে তো একটা খবর দিয়ে ডেকে পাঠালেও চলে। উল্টে, হানা দিয়ে সাংবাদিকদের যে উপকরণ, কলম থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, মোবাইল নিয়ে যাওয়া। সোজাসুজি বললে, - রাষ্ট্র ভয় পাওয়াতে চায়। যাতে আরো অনেক মিডিয়াকে ভয় দেখানো যায়, তার জন্য সরকারের এটা রণকৌশল। কলকাতা টিভির বিরুদ্ধে কী আর্থিক অভিযোগ আছে, - তা জানি না। সেটা আদালতের বিবেচ্য। নিউজক্লিকের বিরুদ্ধেও যদি তেমন অভিযোগ থাকে, - তার প্রকৃত তদন্ত হোক। তদন্তের অর্থ এই নয় যে, - সাংবাদিকদের হেনস্থা করা হবে।
সুমিত : বোঝাই যাচ্ছে, এখানে হ্যারসড করা হচ্ছে। তদন্তের চেয়ে হ্যারাসমেন্ট অনেক বেশি।
গৌতম : নিউজক্লিকে যা লেখা হয়েছে, তাতে লাগাতার সরকারের বিভিন্ন নীতি, বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা হয়েছে। ফলে, এই পার্সেপশান মিডিয়ার মধ্যে প্রচারিত, যে, - যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নেওয়া হবে। এটা সরকারের ক্লিয়ার করা উচিত। সরকার একটা বিবৃতি দিয়েছিল। যে কারণে আমরা সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চেয়েছি।
সুমিত : গৌতমদা, শেষ প্রসঙ্গে আসবো। আপনার জীবদ্দশায়, প্রবাহমান সময়ে কঠিনতম নির্বাচনটি আসন্ন। টেম্পটেশন ক্রমশ বাড়ছে। গত দশ বছরে সমাজটা অনেক বদলে গেছে। সমাজের ভারসাম্য বদলেছে। নতুন সম্ভাবনাও এসছে। নতুন তথ্যপ্রযুক্তির মিডিয়ায় টেকনিকাল লড়াই, তার সঙ্গে এস্থেটিক্সের লড়াই, বেসিক ডেমোক্রেসির পক্ষে যে জার্নালিজম - সব দিক থেকে সামনের নির্বাচনকে কীভাবে দেখছেন। আপনার বয়সী, আমরা বা সাংবাদিকতার নবীনরা - সবার জন্যই বলছি।
গৌতম : এ বিষয়ে আমরা সমস্ত প্রেসক্লাবের সঙ্গে বসতে চলেছি। আমরা একটা মিডিয়া পলিসি তৈরি করতে চাই। বলতে চাই - 'এমন সরকার চাই, যে সরকার মিডিয়ার স্বাধীনতার সূচক বাড়ানোর পক্ষে থাকবে। ' ১৮০ টা দেশের মধ্যে ১৬১ এখন ভারতের মান! এমন সরকার যেন না হয়, - যাতে এই সূচক খারাপই থাকে! সব রাজনৈতিক দলের কাছেই আবেদন থাকবে, - এমন সরকার চাই, যাতে ভারতের মিডিয়ার স্বাধীনতার সূচক সম্মানজনক হয়।