মনে আছে, অতীতেও বার বার দিল্লী বাংলা দখল করার চেষ্টা করেছে এবং প্রায়শই ব্যর্থ হয়েছে। মোগলমারী নামে এক জায়গায় মোগলদের পরাজিত করেছিল স্বাধীন সুলতানের নেতৃত্বে বাংলার বীর সেনারা। এই তো কিছুদিন আগেই দিল্লী বাংলাকে খাদের কিনারে এনে ফেলেছিল। রাজ্য নির্বাচনে ২০০ আসন জিতলেই তারা আমাদের গিরিখাতের তলায় ফেলে দিত। ভয়ে, আতঙ্কে বাঙালি ছিল দিশেহারা। কারা বাঁচালো? ইতিহাসের পরিষ্কার লিখন ছিল দখলদারির বিরুদ্ধে। তিনটে জোট হয়েছিল জনগণের স্তরে, বাঙালি মুসলমান প্রায় একজোট হয়ে সিদ্ধান্ত নিল তাদের ভোট ভাগ হবার বিপক্ষে। দ্বিতীয় জোট ছিল নারীদের, তারাও দিল্লী-কেন্দ্রিক পার্টির বিরুদ্ধে চলে গেছে অন্যদের চেয়ে ১৫% বেশি ।আর অন্তত ৫% গণতান্ত্রিক শহুরে মানুষ, এই কাতারে যোগ দিয়েছে। তারা দখলদারদের প্রত্যাখ্যান করাই প্রধান কাজ মনে করেছে। বিপুল জনাদেশ বিকল্প না থাকায় ঘুরপথে ভোট পেয়ে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল সরকার গড়ল। তার পর দিনই সিবিআই নারদ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত অভিযোগে রাজ্যের শাসকদলের শীর্ষ নেতাদের ধরল।তুলকালাম শুরু হয়ে গেল কলকাতায়। সেই পর্ব ছিল স্বল্প স্থায়ী। দিল্লী তারপর বুঝেছে রণকৌশল বদলাতে হবে। গত ১১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গেজেট বিএসএফ আইন ১৯৬৮ সংশোধনী প্রস্তাব এনেছে। বিএসএফের এলাকা বৃদ্ধি হয়েছে সীমান্তের পনেরো কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত। আগে সীমান্তে ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ভারী বুটের আওয়াজ শোনা যেত এখন বাড়িয়ে ৫০ কিমি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত,সংসদের নয়।
এই অংশের মধ্যে ‘জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে’ বিএসএফ যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে, দেহ তল্লাশি করতে পারে এবং তার জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারে, রাজ্যের পুলিশের তোয়াক্কা না করে। অনেকটা উত্তরপূর্বের আর্মড ফোরসেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের মত, যার প্রত্যাহারের জন্য নয় বছর ধরে মনিপুরের ইরম শর্মিলা চানু অনশন করে গেছেন।
আবার সেই দখলদারীর অব্যহত হিংস্র নাটক চলেছে। বিএসএফ আইনের সংশোধনী গৃহীত হলে পশ্চিম বাংলার এক তৃতীয়াংশ অধিক্ষেত্র কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় চলে যাবে। উত্তর বাংলার অধিকাংশ স্থান ভূ-রাজনৈতিক ভাবে হবে সংবেদনশীল। সাংসদ জন বার্লা এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক দুজনেই উত্তর বাংলার। ইতিমধ্যে নানা ভাবে সেখানে পৃথক রাজ্যের দাবিতে তাঁরা অত্যন্ত সরব। বিভিন্ন ভাবে পশ্চিম বাংলা আক্রান্ত।আক্রান্ত ন্যূনতম যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। উত্তর বাংলার শিলিগুড়ি ,পশ্চিম বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর শুধু নয় উত্তরপূর্ব ভারত ,ভূটান এবং নেপালের সদর দরজা ।তার শাসন ভার সরাসরি চলে যাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অমিত শাহ্র অধীনে । আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রশ্নে পশ্চিম বাংলার অংশ সর্বাধিক, কারণ দেশভাগ মানেই দুটি প্রদেশ, বাংলা ও পাঞ্জাব। ২২০০ কিমির বেশি সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। উত্তর বাংলার কার্শিয়াং থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে যাচ্ছে দিল্লীর সাম্রাজ্য। সাধারণ হিসাবে, ৫০ কিমি গুণিতক ২২০০ কিমি অর্থাৎ প্রায় এক লক্ষ দশ হাজার বর্গ কিমি জমির কর্তৃত্ব চলে যাবে দিল্লীর অধীনে। অন্যদিকে বাংলার চাষীরা জমি হারিয়ে বিশাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি হবার এক সপ্তাহের মধ্যে প্রথম ফেডারাল বিরোধিতা দেখা দিল পাঞ্জাবে।মুখ্যমন্ত্রী চরঞ্জিত চান্নি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত তাঁরা মানতে বাধ্য নন। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের কাছে দাবি করে এরকম সংবেদনশীল ইস্যুতে মানুষের মনে যে ভয় ভীতি সৃষ্টি হয়েছে তাকে শান্ত হয়ে দূর করতে হবে। ক্যাবিনেটে আলোচনার মাধ্যমে প্রসূত রণনীতি গ্রহণ করা কাম্য । সর্বদলীয় মিটিঙে যদি দাবিগুলি চিহ্নিত না হয়, তাহলে বিধান সভার অধিবেশন ডেকে বিষয়টির নিস্পত্তি করতে হবে। সময় নষ্ট না করে ইতিমধ্যেই তারা মন্ত্রিসভায় বিষয়টি আলোচনা করে বিধান সভা অধিবেশনে দাবিগুলিকে স্পষ্ট করতে চলেছেন। বিএস এফ আইন সংশোধন স্বৈরতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে চান্নি পরিষ্কার ভাষায় কেন্দ্রর রাজ্যের নিজস্ব ক্ষমতা অপহরণ করার নাছোড় বান্দা মনোভাবের তীব্র নিন্দা করেছেন। রাজ্য সরকার নিজের পুলিশ শক্তির উপর নির্ভর করেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম বলে তিনি দাবি করেন। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারে, কেন্দ্রর কোন অধিকার নেই জোর করে খবরদারী চাপিয়ে দেবার। অর্ধেক পাঞ্জাব চোখের সামনে তাদের দখলের বাইরে চলে যাবে এটা তারা মেনে নিতে পারেন না। চান্নির গত এক মাসের ব্যালান্স শিট নিলে দেখা যাবে, তিনি বহুস্তরে আলোচনার কথা বলেছেন।এমন কি সেখানে আলোচনার সাধারণ সূত্র না বে্রোলে বিধান সভার কথা বলেছেন। এবং তাঁরা মামলা পর্যন্ত করেছেন।
অথচ পশ্চিম বাংলায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ কিন্তু প্রায় দায়সারা গোছের মনোভাব নিয়ে ১৬ নভেম্বর বিধান সভার অধিবেশন ডাকা হল । কিছু কিছু টিমটিমে প্রতিবাদ এখানে সেখানে হল। সিতাই শিতলখুচির আওয়াজ তো গুলি না চললে কাগজে আসেই না। কুচবিহার জেলা বলতে তো কিছুই থাকবে না। পঞ্চাশ কিমি বিস্তৃত জলপাইগুড়ির উত্তর দিকে সামান্য একটু অংশ ছাড়া বাকিটা সব কেন্দ্রীয়্ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে । আর উত্তর দিনাজপুর জেলার কোন অংশই ৫০ কিমির বাইরে নয়। নদীয়ায় বল্লভপাড়া থেকে হৃদয়পুর ৫০ কিমি সোজা লাইন। উত্তর চব্বিশ পরগনার বড় শহর হাবরা ,অশোকনগর, বসিরহাট সব চলে যাবে । আমাদের রাজ্য সরকার সম্প্রতি সুপ্রীম কো্র্ট কে জানিয়েছে সিবিআই রাজ্য সরকারের অনুমতি না নিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষদের বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে মামলা দিচ্ছে। এছাড়া এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট,সিবি আই, এন আইএ দিয়ে তো রাজনৈতিক বিরোধীদের ভয় দেখানো ও অত্যাচার হয়েই চলেছে। এদের সঙ্গে বড় বিএসএফ এলে তো সোনায় সোহাগা। ড্রাগ, অন্য মাদক দ্রব্য ,গরু পাচার এসব তো ছিলই ১৫ কিমির সময়। নিয়মিত কাঁটাতার এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ ও নানাবিধ অত্যাচার, হয়রানি লেগেই আছে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত বিএসএফকে তুষ্ট করে সেখানে চলতে হয়। তারা স্থানীয় অনেক নারীদের যৌন কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। বাঁধা পেলে শুরু হয় নির্যাতন যা নিয়ে কাঁটাতে হয় তাঁদের গ্লানিময় জীবন।শিশুদের ক্ষেত্রে অজস্র পোষ্ট- ট্রমাটিক ক্ষতের বর্ণনা দিয়ে বিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী মোহিত রণদীপ গত দশ বছর আগে ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে আহরণ করে বললেন ওখানে থেকে বাহিনী যাকে এখন সীমান্ত থেকে বারাসত পর্যন্ত আসতে দিতে হচ্ছে? আরএসপির মনোজ ভট্যাচার্য প্রশ্ন তুললেন কাদের পক্ষে আমরা দাঁড়াবো? যারা বাংলার নাগরিকদের চোরাচালানের কথা বলে অপমান করছে? না যারা রাজ্যের মধ্যে রাজ্য গড়ছে? নাকি যারা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সীমান্তের স্বাভাবিক জীবন ধ্বংস করছে? সম্মেলনে উত্তর, সীমান্তবাসীদের পক্ষে। বিশিষ্ট অভিনেত্রী অভিনেত্রী অপর্ণা সেন ১৫ নভেম্বর শিউরে ওঠার তাঁর অভিজ্ঞতা বললেন সীমান্তের অধিবাসী এক গর্ভবতী মহিলার কাঁটাতারের পাশে প্রসববেদনার নিরসন হয়।সেখানে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তাঁর নাড়ি কাটা হয়। তাঁরা যেন কোন দেশেরই নাগরিক নন। সবাই ভোটার কার্ড পেয়েছেন কিন্তু নাগরিক কার্ড নেই। তিনি রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেন কাঁটাতারের ভেতরের মানুষেরা যেন নাগরিক সুব্যবস্থা অবিলম্বে পান। পশ্চিম বাংলায় দ্বৈত শাসন চলছে। পুলিশ- বিএসএফ দ্বন্দ্ব এখনই তীব্র লেগে আছে, ৫০ কিমি হলে কি হবে ভাবাই যাচ্ছে না। নেই কৃষকের। মইনুল হাসান মনে করেন প্রতিবাদকে প্রতিরোধে নিয়ে যেতে হবে ।ভারতের সংবিধানে সর্বত্র চলাফেরা করার অধিকার আছে। এখানে নিজের জমিতে ইচ্ছেমত যাবার অধিকার নেই।
বর্তমান লেখক ফেলানি হত্যার সময় চৌধুরীহাট সীমান্তে খিতাবের কুঠি গ্রামে সরেজমিন তদন্তে থেকে ফিরে এসে প্রিয় গায়ক কবীর সুমনকে সবিস্তারে বলার পর তিনি গান বাঁধলেন;
শোনো হে বিএসএফ, শোন হে ভারত, কাঁটাতারে গুনগুন
একটি দোয়েল বসেছে যেখানে ফেলানি হয়েছে খুন।
রাইফেল তাক করো হে রক্ষী ,দোয়েলেরও ভিসা নেই,
তোমার গুলিতে বাংলার পাখি কাঁটাতারে ঝুলবেই।
সীমান্ত সড়ক থেকে এখানকার গ্রামগুলি শহুরে মানুষ যদি দেখেন তাহলে হতাশায় মুহ্যমান হওয়া ছাড়া গতি নেই। তারকাঁটার ওপারে কুপি-লন্ঠন নিয়ে বাচ্চাকোলে মেয়ে-বউরা সন্ত্রস্ত চোখে উঁকি মেরে দেখছে টহলদারি বিএসএফকে। যেন অন্ধকার চিড়িয়াখানায় বন্দী মানবশিশু অসহায় বোবা কান্নায় থমকে দাঁড়িয়ে আছে। সব তৃতীয় শ্রেণীর ভোটাররা। তাদের দীর্ঘশ্বাস কোনোদিন কোলকাতায় পৌঁছবে না দিল্লী তে তো নয়ই। কাঁটাতারের ওপারে বিজলি নেই, রাস্তাঘাট নেই, পানীয় জল নেই, আনন্দ নেই, সমাজ নেই,উৎসব নেই, স্কুল নেই, চাষ নেই। আছে এক অন্ধকার জীবন। বিচারপতি মলয় সে্নগুপ্ত মনে করেন বিএসএফের সাথে বাংলার সংস্কৃতির কোন মিল নেই। এমন কোন জায়গা আপনারা কোথাও দেখেছেন যে নিজের জায়গায় যেতে পাসপোর্ট লাগে? তিনি আহবান করলেন মানুষের দুর্দশা হঠাও , বিএসএফ সরাও।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কোন আলোচনা না করেই কেন্দ্রীয় স্বরাস্ট্রমন্ত্রক বিএস এফের আরও ক্ষমতায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা বস্তুত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে পরিহাসে পরিণত করেছে। একই সাথে, সীমান্তের বাঙালি জাতি, বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়কে বিএসএফ এর দ্বারা নিগৃহীত । সীমান্ত এলাকায় মাসুম নামে মানবাধিকার সংগঠন থেকে সম্পাদক কিরীটী যে অসম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করেছে, তার বিচার বহির্ভূত হত্যার অংশে ৯৮% মুসলমান , নানাবিধ অত্যাচারের ৮৫% , জবরদস্তি অন্তর্ধান ৯৩% অংশ মানুষ মুসলিম নাম। যে কেউ পরীক্ষা করতে পারেন। অর্থাৎ বলার কথা হল এই যে আক্রমনের শিকার মুসলমান হওয়াতে মিডিয়াতে তাদের স্থান নেই। মাসুম সম্পাদক কিরীটী রায়ের দীর্ঘদিন লাগাতার পরিশ্রমের ফলে আমরা জানতে পেরেছি। এখন নাগরিক সমাজকে মমতা সরকারের উপর পাঞ্জাবের মত চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে দায়সারা গোছের বিধান সভার প্রস্তাব পাশ করেই তারা ক্ষান্ত না হয়।বিএস এফের কাজ সীমান্ত পাহাড়া দেওয়া নাগরিকের শান্তিপূর্ণ কাজে নাক গলান নয়।অথচ কাঁটাতারের দুপারেই মানুষের জীবন-জীবিকা,শিক্ষা-চিকিৎসা সবকিছুই অনিশ্চিত এবং বিএসএফের দয়ায় নির্ভরশীল । প্রাক্তন সাংসদ মইনুল হাসানের কাছে শোনা গেল তিনি অনেকবার সংসদে নোটিশ দিয়ে তুলতে পারেন নি। পরে তিনি জানতে পেরেছেন বিএসএফ নিয়ে কোন আলোচনা সংসদে চলবে না। বর্তমান লেখকের মতে ছাত্র-যুব দের মধ্যে ছোট ছোট গ্রুপে কর্মশালা প্রচার অভিযান চালিয়ে সীমান্ত গ্রামে মানুষের মধ্যে সাহসের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয় কাজ হবে গ্রামসভাগুলির পর্যাপ্ত সশক্তিকরণ। কাঁটা তারের ওপারের মানুষদের বিদ্যুৎ নেই, জল নেই, শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই। গ্রাম সভাকে সশক্ত করে এই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত করতে হবে। স্লোগান উঠুক বিএসএফ তুমি গ্রামে নয়, সীমান্তে যাও। মানুষের দুর্দশা কমাও, বিএসএফ সরাও। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত বাতিল কর।