বিগত কয়েক বছর ধরে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির দৃশ্যমানতা খানিক বেড়েছিল বাজারের সৌজন্যেই। অতিমারির কারনে গত দুই ঈদের চেনা দৃশ্য একেবারে নেই। ঈদকে কেন্দ্র করে শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিছু আর্থিক কর্মকাণ্ড থাকে, এই সময়ের আয়ের উপর নির্ভর করে বছরের অন্য কয়েক মাসের আয় নিশ্চত হয়ে থাকে। এবার সব হিসাবে নিকাশ পালটে গেছে। ঈদ মানে উৎসব। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কি এবারের এই উৎসবে যোগ দিতে পারবে?
সরকারি তথ্য অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশ (২৭ শতাংশ) মুসলমান, অথচ মাত্র ১৭ শতাংশ শহরবাসী।পশ্চিমবঙ্গের নগরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার শতকরা ১২, মুসলমানদের মধ্যে দারিদ্র্য অবশ্য এর চেয়ে ঢের বেশী- ২৭ ভাগ।
মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই স্ব-নিযুক্ত। অর্থাৎ, তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে থাকেন, সুযোগের অভাব বা সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে। কলকাতা শহরের মুসলিম জনগোষ্ঠীর এক বৃহদংশ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন – দর্জি, রাজমিস্ত্রি, বই-বাঁধাই, চামড়ার ছোট ছোট কারখানায় কাজ, ইত্যাদি।অনেকেই ফেরি করেন।
ঈদ। কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত - খিদিরপুর, একবালপুর, মোমিনপুর, পার্ক সার্কাস, রাজা বাজার, জাকারিয়া স্ট্রিট, মেটিয়াব্রুজ- প্রভৃতি এলাকাগুলিতে ঈদের খুশির জোয়ার। খুশির কারণ শুধু মাত্র ঈদ নয় ,অর্থনীতিও।এক মাস রোজাকে কেন্দ্র করে, ঈদকে সামনে রেখে, মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে এক সাধারণ আর্থনীতিক ক্রিয়াকলাপের বাইরে এক বিকল্প অর্থনীতির উদ্ভব হয়, যা স্ব-নিযুক্ত ও বেকার যুবকদের কিছুটা কর্মসংস্থান করে। ঈদের কয়েক মাস আগে থেকেই যে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়, তাদের মধ্যে পোষাক শিল্পীদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। হাজার হাজার ছেলে মেয়ে খিদিরপুর , মোমিনপুর, ও মেটিয়াবুরুজের ছোট - বড় –মাঝারি পোষাক কারখানায় দিন রাত কাজ করে পরের কয়েক মাসের জন্য আয় করে রাখে। এই সহ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাঁদের আয় অনেকটাই কমছে।
ঈদ উপলক্ষে, রোজার মাসের প্রথম দিন থেকেই, এই এলাকাগুলিতে এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত এতদিন। পাড়ায় পাড়ায় রমজান উপলক্ষে, অস্থায়ীভাবে চিনি, ছোলার ডাল, চাল, খেজুর, তেলেভাজা ও ইফতারির জন্য বিভিন্ন ফলের বিপুল আয়োজন ।এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায় কলকাতার গৃহহীনদের অর্ধেকের বেশিই হচ্ছেন মুসলমান। ঈদের আগে দিন-মজুরদেরও নানান কর্মসংস্থান হয়। ঈদের দিনের খাবারের মধ্যে লাচ্ছা ও সিমুই সর্বাধিক প্রচলিত। লাচ্ছা ও সিমুইএর যোগান দিতে প্রচুর অস্থায়ী শ্রমিকের প্রয়োজন হত।বছর –চার পাঁচেক ধরে দেখা যাচ্ছে জাতীয় স্তরের জেল খাটা এক ব্যবসায়ী এই ব্যাবসায় থাবা বসিয়েছে।এদের দৌলতেই লাচ্ছা প্যাকেট বন্দি হয়ে মেটিয়াব্রুজ থেকে মেমারি পর্যন্ত পান দোকানে পাওয়া যাচ্ছে।চকচকে মোড়কের আড়ালে ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে ধংস্ব করার সর্বগ্রাসী চেষ্টা। ঈদের বাজারের এই বানিজ্যিকীকরণের ফলে গরিব মুসলমান দিন মুজরদের রুটি-রুজিতে টান পড়েছে।
মুসলমান মেয়েদের মধ্যে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা বেশ করুণ। অধিকাংশ মহিলার কর্মস্থল মালিকের বাড়ি, অর্থাৎ হয় গৃহপরিচারিকা অথবা রান্নার কাজ করেন। লিখিত চুক্তি-তো দূর, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতাতেও পড়ে্ন না।
পিছিয়ে পড়া মানুষদের সম আসনে বসাতে, ইসলামে দান অপরিহার্য। ঈদ-উল-ফিতর দানের উৎসব, অর্থশালীর জন্য দান বাধ্যতামূলক।জাকাত - বিষয় সম্পত্তি ও ব্যবসার অর্থপরিমান থেকে হিসাব করে যে বাধ্যতামূলক দান - দরিদ্র, সহায়সম্বলহীন, গৃহহীন মানুষদের মুখে সাময়িক হাসি ফোটানোর কাজ করে। মুসলমান এলাকাগুলিতে, অবস্থাপন্ন পরিবারদের বাড়ির সামনে, রমজানের মাসে জাকাতের আশায়, গ্রাম অঞ্চল থেকে আসা বহু দরিদ্র পরিবার হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। আর্থিকভাবে একেবারে নিঃস্ব মানুষের ঈদের সময় হাতে পয়সা ও ভাল মন্দ খাবারের সুযোগ গড়ে। এই রাজ্যে একেবারে নিঃস্ব ও ভিক্ষাবৃত্তির উপর ভরসা করে থাকা ৭৫ হাজার মানুষের মধ্যে ৪২ শতাংশই মুসলমান। জাতীয় নমুনা সমীক্ষাতেও আমরা একই ধরণের ছবি দেখতে পাই। অতিমারির কারনে কাজ হারানো এই প্রান্তিক জন গোষ্ঠীর খানিকটা অন্যের দান ও দয়ার উপর নির্ভর করে হচ্ছে।
এ মাসের অন্য একটা অঙ্গীকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রতিবেশীকে সাহায্য করা; অভুক্ত প্রতিবেশী এ মাসের কল্যাণেই সারা মাস ভালো করে পেট ভরে খেতে পারে। রোজার মাসে আরেকটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ‘জাকাত’, ব্যক্তির আয় ও সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তির উপর হিসাব করে একটা নির্দিষ্ট অংশ প্রতিবেশী অথবা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া সহ নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ থাকে। এছাড়া এই অর্থ একত্রে জমা করে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজেও ব্যয় করার রীতি ইসলামের শুরু থেকে প্রচলিত।‘দান’ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তবে এ ব্যাপারে একটা সতর্কবাণী, “তোমার ডান হাত দান করলে বাঁ হাত যেন জানতে না পারে”। আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা সহ নাগরিক প্রতিবেশীর আত্ম মর্যাদা ও সম্মান রাখার দায়িত্ব যে দাতার – এই এই নীতি বাক্য সে কথায় স্মরণ করিয়ে দেয়।প্রচার সর্বস্ব যুগে এই নীতিবাক্যের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
ঈদের যোগ ধার্মিকতার সঙ্গে যতটা, ততখানিই এর সর্বজনীন সামাজিক আবেদনঃ ঈদ সমতার, ঈদ খুশির, ঈদ বিদ্বেষ বিনাশের, মহামিলনের উৎসব। ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিটি মানুষ,পরিবার, ধনী-দরিদ্র খুশিতে মেতে ওঠেন।ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে ঈদের আনন্দ সামাজিক সন্তোষে রূপান্তরিত হয়।এর প্রতিফলন দেখা যায় ঈদের নামাজের ময়দানে, সামাজিক- রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভেদাভেদ যেখানে অপ্রাসঙ্গিক। ঈদের জামায়তে ছোট-বড়, ধনী-গরীব সবাই হাত ধরাধরি করে শরিক হয়।