২০০৭ সালে অ্যাপলের আইফোন বাজারে আসার পর থেকে স্মার্টফোন আমাদের ব্যক্তিগত প্রযুক্তির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং অন্যান্য গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমানে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের প্রায় ৯৫% স্মার্টফোন ব্যবহার করে, এবং প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা তারা পর্দার সামনে কাটায়। এই প্রযুক্তি তাদের পড়াশোনা ও তথ্য পাওয়ার সুযোগ করে দিলেও, এর অতিরিক্ত ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এখন প্রশ্ন হলো, স্মার্টফোন কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের জীবনকে প্রভাবিত করছে? এই ডিজিটাল যুগে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক সুস্থতার ওপর এর কী প্রভাব? আর কীভাবে আমরা এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, যাতে এটি তাদের ক্ষতির কারণ না হয়?
স্মার্টফোনের নেতিবাচক প্রভাব: গবেষণা কী বলছে?
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ভিক্টোরিয়া গুডইয়ারের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে। আমেরিকায় ১২-১৫ বছর বয়সী ১,২০০ জনেরও বেশি কিশোর-কিশোরীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় কাটানো তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, পড়াশোনায় খারাপ ফল, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং ঘুমের সমস্যার সঙ্গে জড়িত।
এছাড়াও, স্নায়ুবিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে, অতিরিক্ত ডিজিটাল ব্যবহার "ব্রেন রট"-এর মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ২০২৩ সালে টেলর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, এর ফলে মস্তিষ্কের স্নায়ুপথ বা নিউরাল পাথওয়েজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও সৃজনশীলতা কমে যায়।
ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে থাকা তুলনামূলক চাপের কারণে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মমর্যাদা কমে যাওয়া এবং উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। ২০১৭ সালে টুইঞ্জের গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য যারা বেশি সময় পর্দায় কাটায়, তাদের ৩০% উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভোগে। রাতের বেলায় স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা কিশোর-কিশোরীদের ঘুমের চক্রে ব্যাঘাত ঘটায় এবং মানসিক ক্লান্তি বাড়ায়। কার্টার ও অন্যান্যদের গবেষণা তা পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছে।
স্মার্টফোন গেমিং এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত আসক্তি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও একাকীত্বের অনুভূতি বাড়িয়ে দেয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৫ ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিষণ্ণতার হার ২৫% বেশি। এই তথ্য ২০১৭ সালে প্রজিবিলস্কি ও ওয়েনস্টাইন দিয়েছেন। এছাড়া, স্থির জীবনযাপন এবং ব্যায়ামের অভাবে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মোটা হওয়া ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা যায়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কেন স্মার্টফোন এত আকর্ষণীয়?
স্মার্টফোন ব্যবহারের পেছনে রয়েছে "মনোযোগ অর্থনীতি" বা এটেনশন ইকোনমি -এর ধারণা। এখানে মানুষের মনোযোগকে একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দেখা হয়। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো কিশোর-কিশোরীদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে, যা প্রায়শই তাদের সুস্থতার চেয়ে মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দেয়। টিম উ তাঁর ২০১৬ সালে প্রকাশিত "The Attention Merchants" গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে এই প্ল্যাটফর্মগুলো বিজ্ঞাপন ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেয়। মূলত কিশোর-কিশোরীরাই এই প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রধান লক্ষ্য, কারণ তাদের আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এখনও পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। ১৯৭৭ সালে আলবার্ট বান্দুরার দেওয়া "সামাজিক শিক্ষা তত্ত্ব" এখানে প্রযোজ্য—তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধু বা সেলিব্রিটিদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং অনুকরণ করে। ফলে, অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার তাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অভ্যাসে পরিণত হয়, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নিষেধাজ্ঞা কি সমস্যার সমাধান?
গুডইয়ারের গবেষণা দেখায় যে, বিদ্যালয়ে ফোন নিষিদ্ধ করা কিশোর-কিশোরীদের মোট ফোন ব্যবহারের সময় কমাতে খুব একটা কার্যকর নয়। বিদ্যালয়ে ফোন ব্যবহার দিনে গড়ে ৪০ মিনিট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ৩০ মিনিট কমলেও, বিদ্যালয়ের বাইরে তারা ঠিকই চার থেকে ছয় ঘণ্টা ফোনে এবং দুই থেকে চার ঘণ্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটায়।
এটি "আচরণ অর্থনীতি" বা বিহেবিহারাল ইকোনমিক্স -এর "বর্তমান পক্ষপাত" ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। ড্যান এরিয়েলির গবেষণা, যা তাঁর ২০০৮ সালে প্রকাশিত "Predictably Irrational" এবং ২০১০ সালের "The Upside of Irrationality" বইগুলোতে উঠে এসেছে, সে অনুযায়ী মানুষ তাৎক্ষণিক আনন্দের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়, এমনকি যদি তা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হয়। কিশোর-কিশোরীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক বা নোটিফিকেশনের তাৎক্ষণিক আনন্দ পছন্দ করে, কিন্তু ঘুমের অভাব বা পড়াশোনায় অমনোযোগের মতো দীর্ঘমেয়াদী পরিণতিগুলো তারা প্রায়শই উপেক্ষা করে।
এই সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব?
এই সমস্যার সমাধানে জ্ঞানীয় আচরণ থেরাপি (কোগনিটিভ বেহেভিওরাল থেরাপি বা সিবিটি) একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। ১৯৭৯ সালে অ্যারন বেকের তত্ত্ব অনুসারে, 'সিবিটি' কিশোর-কিশোরীদের তাদের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। যেমন, "নোটিফিকেশন না দেখলে আমি পিছিয়ে যাব" - এমন চিন্তাভাবনাগুলো চিহ্নিত করে 'সিবিটি' তাদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এটি স্ক্রিন টাইমের সীমা নির্ধারণ বা বিকল্প ইতিবাচক কার্যকলাপে যুক্ত হওয়ার মতো বাস্তব পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের আচরণ পরিবর্তন করে।
তবে, শুধু ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীর ডেটা পদচিহ্ন (ডাটা ফুটপ্রিন্ট) সংগ্রহ করে, যা গোপনীয়তার জন্য হুমকি এবং আসক্তি বাড়ায়। ২০২৩ সালে কুমার এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন এবং তার গবেষণাতেও এই বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই, এই সমস্যার সমাধানে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও জরুরি।
সরকারি হস্তক্ষেপ কতটা কার্যকর?
অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলো কিশোর-কিশোরীদের ডিজিটাল ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অস্ট্রেলিয়ায় ১৬ বছরের কম বয়সীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার সীমিত করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার "সিন্ডেরেল্লা ল" মধ্যরাতের পর গেমিং নিষিদ্ধ করেছে। এই পদক্ষেপগুলো কিশোর-কিশোরীদের ঘুম ও পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করছে।
তবে, ১৯৯৯ সালে অমর্ত্য সেনের "নৈতিক অর্থনীতি"-এর তত্ত্ব অনুসারে, প্রযুক্তি সংস্থাগুলোরও সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাদের এমন ডিজিটাল পরিবেশ তৈরি করা উচিত যা কিশোর-কিশোরীদের সৃজনশীলতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি করে, ক্ষতি না করে।
স্মার্টফোনের যুগে কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা
অমর্ত্য সেনের গবেষণার ফল থেকে বলাই যায় স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহার অনেক কিশোর-কিশোরীদের অনেক সুফল দিতে । অর্থাৎ , অতিরিক্ত স্মার্টফোনের ব্যবহার উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করছে এটা ঠিক। কিন্তু, একটি সুষম ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এটি শিক্ষা ও সামাজিক সংযোগের এক দারুণ মাধ্যম হতে পারে।
আজকের কিশোর-কিশোরীরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করে যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়া তাদের শেখার, যোগাযোগের এবং বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এই প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে, যদি না তারা সঠিক উপায়ে এটি ব্যবহার করতে শেখে।
নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সুষম ব্যবহারের শিক্ষা
তাই এর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে সুষম ব্যবহারের শিক্ষা প্রদান করা জরুরি। সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং প্রযুক্তির ইতিবাচক দিককে উৎসাহিত করা মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা রক্ষায় সহায়ক হবে। এখানে শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, বরং শিক্ষা, সচেতনতা এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর নৈতিক দায়বদ্ধতার সমন্বয় প্রয়োজন।
ব্রাউনের ফলিত মনোবিজ্ঞানের ২০২২ সালের গবেষণা স্পষ্টভাবে বলছে যে, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতন দিকনির্দেশনাই কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যকর ডিজিটাল অভ্যাস গড়তে সাহায্য করতে পারে। এর অর্থ হলো, একটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা তাদের প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করতে এবং একই সাথে তাদের সুস্থতা রক্ষায় সাহায্য করতে পারি।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের সম্মিলিত ভূমিকা
অভিভাবক এবং শিক্ষকরা একসাথে কাজ করলে তাঁরা যৌথভাবে কিশোর কিশোরীদের শেখাতে পারবেন, কীভাবে প্রযুক্তির সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের উন্নতি করা যায় , একই সাথে ডিজিটাল দুনিয়ার সম্ভাব্য বিপদগুলো থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখা যায়। এর ফলে কিশোর-কিশোরীরা প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করতে পারবে এবং একটি সুস্থ, ভারসাম্যপূর্ণ ডিজিটাল জীবনযাপন করতে শিখবে।