১০২ বছরের চন্দ্রধর দাস, ডি ভোটারের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে শিলচর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁর বাড়ি গিয়ে শেষ শান্তির নিশ্বাস ফেলার অনুমতি নেই, পক্ষঘাতগ্রস্ত ৬৫ বছরের কানুরঞ্জন পাল, ডি ভোটারের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের পাশে গার্ড রুমে রেখে কলেজ কর্তৃপক্ষ তথাকথিত চিকিৎসা করছেন।
রসময় পালের পুত্র হাইলাকান্দির কাটলিছড়ার কাছে কারিছড়া গ্রামের আদিবাসিন্দা। প্রয়াত পিতা রসময় বাবুর ১৯৬৫ সালের সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেটে রয়েছে, তাঁর ৬৫ বছরের পুত্র কানুরঞ্জন পালকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। হতদরিদ্র কানুরঞ্জনের কাছ থেকে উকিলবাবু প্রায় ৮০ হাজার টাকা আইনি খরচ নিয়েছেন বলে পরিবারের মানুষ অভিযোগ করেছে। ছোটভাই প্রদীপ পাল দাদার বসত বাড়ি দেখার শেষ ইচ্ছা পুরণ করতে পারবেন কিনা জানেন না। কারণ গুরুতর অসুস্থ হলেও কানুরঞ্জন যে বিজেপি সরকারের তথাকথিত ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি। বাড়ির তুলসী তলায় প্রণাম করার অধিকার নেই তাঁর। ঢেকিয়াজুলির দুলালচন্দ্র পাল, নলবাড়ির ফালু দাস ডিটেনশন ক্যাম্প বন্দি অবস্থায় বিনা চিকিৎসা মৃত্যুর পর তাঁদের মৃতদেহ গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজের মর্গে পচেছিল। অসমে জন্ম প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক বাবাকে মিথ্যা অভিযোগে বিদেশি সাজানো ছেলেরা মেনে নিতে পারেনি। ভারতীয় ঘোষণা না করা পর্যন্ত মৃতদেহ গ্রহণ করতে রাজি হয়নি ছেলেরা। বিজেপি সরকারের দালাল বাঙলি সংগঠন এবং এক পেড সাংবাদিককে কাজে লাগিয়ে তাঁদের মৃতদেহ জোর করে গ্রামে নিয়ে গিয়ে দাহ করে দেয়।
গোয়ালপাড়ার সুব্রত দে, হাইলাকান্দির সুন্দর মনি রায় ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি অবস্থায় বিনা চিকিৎসায় অনাদরে অবহেলায় মারা গিয়েছেন। সাংবাদিক মনিন্দ্র রায় অসমের আদি বাসিন্দা। উপযুক্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁর নাম এনআরসি-তে তোলা হয়নি। অবসাদে ভুগে, দুশ্চিন্তায়, মানসিক যন্ত্রনায় হঠাৎ গুয়াহাটিতে মারা যান। মেয়েরা জানিয়েছিলেন, প্রায় ৬৫ বছরের মনিন্দ্রবাবু এনআরসি-তে নাম তোলার জন্যে আলমারি খুলে পাগলের মতো নথিপত্র খুঁজছিলেন। ডি ভোটার, আর ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি অধিকাংশ সংখ্যালঘু হিন্দু মুসলিম মানুষ অত্যন্ত গরিব। তাঁদের মামলা লড়ার আর্থিক সামর্থ নেই। আইনজীবীরা লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েছেন অথচ কোনো কাজ করেননি বলে বহু অভিযোগ উঠেছে। লামডিঙের রেলওয়ে কলোনির মেয়ে ছন্দা পালকে শিশু পুত্র, স্বামী ছাড়া তেজপুর ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে দেওয়া হয়েছে, শঙ্করদেব নগর আদালতের উকিলবাবুদের কয়েক হাজার টাকা দেওয়ার পরেও তাঁকে দুই পুত্রকে বাড়িতে রেখে জেল খাটতে হচ্ছে। গরিবের সংসার ভেসে গেলেও কল্যাণকামী সরকারের মাথা ব্যাথা নেই। কারণ ডি ভোটার কিংবা এনআরসি ছুটদের ভোটাধিকার নেই। তাই এনআরসি ছুট ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন মানুষের জন্য সরকারের মাথা ব্যাথা নেই।
ওই ১৯ লক্ষের মধ্যে অধিকাংশ বাঙলি হিন্দু। গত ৩১ আগস্ট তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। তালিকায় নাম না থাকা মানুষগুলো প্রায় ছয় মাস ধরে মানসিক যন্ত্রনায় ভুগে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন, যা হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায় আবার বলেছেন, দেশে কোন ডিটেনশন ক্যাম্প নেই, হোল্ডিং সেন্টার আছে। অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প নেই! বিগত কংগ্রেস সরকার, বর্তমান বিজেপি সরকার ২০১৫ সালের জোড়া বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরেও তা কার্যকর করছে না। সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইন এবং ১৯৪৬ সালের বিদেশি আইনের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হবে। তিন বছর অতিক্রান্ত তবু প্রায় তিন শতাধিক বন্দিকে সুপ্রিমকোর্টের ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশও কার্যকর হচ্ছে না। যাঁদের ঘরে কানাকড়ি পর্যন্ত নেই, যাঁদের অধিকাংশকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে চোর ডাকাত, খুনিদের সঙ্গে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাদের বলা হচ্ছে, দু লক্ষ টাকার জামানত ও দুজন জামিনদার জোগার করতে। তারপর মুক্ত সে আকাশের তলায় দাঁড়াতে পারবে। তা কি কোনোদিন সম্ভব? তার চেয়ে দুলালচন্দ্র পাল, ফালু দাসের মতো একেবারে চলে গেলে তো গরিব সংসারগুলো অন্তত বাঁচবে। বরাকের কানুরঞ্জন পাল, চন্দ্রধর দাসও কি সেই পরিণতির দিকেই এগচ্ছেন?