পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাঁধ ভেঙে দাও

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 205 view(s)
  • লিখেছেন : সুপ্রতিম কর্মকার
নদী নিজের গতিতে চললেই মাটি উর্বর হয়। জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে। মাছের দল নদীতে ফেরে। গাছেরা বেঁচে থাকে। আর যখন আমরা তার গলা চেপে ধরি—বাঁধ, স্লুইস গেট, এমব্যাংকমেন্ট নির্মাণ করে;তখন? নদী শ্বাস নিতে পারে না। নদীর বুক শুকিয়ে যায়, চর জন্ম নেয়।জলাশয় হারায় গভীরতা।

নদীকে তুমি বেঁধে রাখতে পারো না। কারণ সে তো জন্ম থেকেই মুক্ত। অনন্তের দিকে বয়ে চলা তার ধর্ম। নদী মানে এক কথায় এক জেদি স্রোত। তবু মানুষ তার পথরোধ করেছে—পাথর, কংক্রিট, লোহা দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে। সঙ্গে জুড়ে যায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ আর চোখ রাঙানি। জলকে আটকে রেখে সভ্যতা ভেবেছে, এ যেন তার জয়ের প্রতীক। রাষ্ট্র নায়কেরা বড় বাঁধকে আধুনিক ভারতের মান মন্দির পর্যন্ত বলেছেন। কিন্তু এই জয়ের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল পরাজয়। একদিন না একদিন, নদী সেই বাঁধ ভাঙবেই। সিকিমে তিস্তার উপরে বাঁধ ভাঙা এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। 

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন বললেন—“বড় নদীর বাঁধ ভেঙে দাও, নদীকে নিজের মতো চলতে দাও”—তখন তাঁর এই কথায় রাজনীতি ছিল। ছিল পরিবেশ-দর্শন-এর গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাও, যদিও সেকথা বিরোধী শিবির স্বীকার করতে রাজি নয়। এটা কেবল প্রশাসনিক নির্দেশ নয়।  প্রধান বিরোধী শিবিরের উপর চাপ বাড়ানোর কৌশল। এটাই ঠিক নদী মানে শুধু জল নয়, সে এক প্রাণপ্রবাহ। নদী এক সভ্যতার ইতিহাস, এক জীবনের ছন্দ।

আমরা ভুলে গেছি, নদী নিজের গতিতে চললেই মাটি উর্বর হয়। জীববৈচিত্র্য টিকে থাকে। মাছের দল নদীতে ফেরে। গাছেরা বেঁচে থাকে। আর যখন আমরা তার গলা চেপে ধরি—বাঁধ, স্লুইস গেট, এমব্যাংকমেন্ট নির্মাণ করে;তখন? নদী শ্বাস নিতে পারে না। নদীর বুক শুকিয়ে যায়, চর জন্ম নেয়।জলাশয় হারায় গভীরতা। জলজ প্রাণীরা বিলীন হয়। অথচ সেই নদীই একদিন হু-হু করে বন্যা হয়ে ফিরে আসে, বাঁধ ভেঙে মানুষের অহংকার ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

নদীর বাঁধ ভাঙার কথা শুনলে ভয় পায় অনেকে।  তাহলে তো গ্রাম ডুবে যাবে, ফসল নষ্ট হবে! কিন্তু সত্যিটা অন্য জায়গায়। বছরের পর বছর নদীকে বেঁধে রাখার ফলে তার স্বাভাবিক পথচলা থেমে গেছে। পলি জমেছে নদীর তলায়। অগভীর হয়েছে নদী খাত। ফলে বন্যার অতিরিক্ত জল ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে না। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নদী উপচে পড়ে,বাঁধ ভাঙে, বন্যা হয়। অথচ যদি তাকে নিজের মতো ছড়াতে দিতাম আমরা, তাহলে কি হত? প্লাবনভূমি জেগে উঠত। মাটি উর্বর হত। নদী আবার নিজের গভীরতা ফিরে পেত। নদীর স্বাস্থ ফেরানোর জন্যপ্রকৃতির নিজের চিকিৎসা। মানুষ যত বাঁধ বেঁধেছে, প্রকৃতি ততবার সেই বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। নদী নিজের পথ জানে, মানুষ জানে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির পর থেকে দেখা গেল মালদহ ও মুর্শিদাবাদ-এর দু'পাড় জুড়ে ভাঙন শুরু হয়। গঙ্গা আসলে ফারাক্কাকে পাশে সরিয়ে রেখে নতুন পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাইছিল। এখনো তাই চাই। তাইতো হাজার চেষ্টা করেও ফারাক্কার উজান ও ভাটিতে ভাঙন আটকানো সম্ভব হয়নি। বুঝতে হবে নদী সময়ের মতো—তাকে থামানো যায় না, কেবল তার সঙ্গী হওয়া যায়।

রাষ্ট্রর প্রতিনিধি যখন বাঁধের বিরোধীতা করে তখন সেখানে নদীর সঙ্গে সহাবস্থানের দর্শন লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যখন এই ঘটনার কিছুদিন আগে বন্যার জন্য বড় বাঁধ নির্মাণের ভাবনাকে প্রকাশ করে, তখন সবটা গুলিয়ে যায়। এটাই তো রাষ্ট্র করে থাকে সব সময়। 

নদী কেবল ভৌগোলিক সত্তা নয়, এক সামাজিক বাস্তবতা। নদীর প্রবাহ থেমে গেলে, থেমে যায় জনজীবনের ছন্দ। মৎস্যজীবীর রুজি, কৃষকের আশীর্বাদ, গ্রামবাংলার সংস্কৃতি- সবটাই জুড়ে থাকে নদী নামক একটা জীবিত সত্তার সঙ্গে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভালো সারা পৃথিবী নদীকে জীবিত সত্তা হিসেবে ভাবলেও ভারতের নদীরা জীবিত সত্তার আইনি স্বীকৃতি পাইনি। গঙ্গা, দামোদর, তোর্ষা, তিস্তা—সব নদীর বুকেই জেগে আছে সেই গল্প। আর যখন বাঁধ ভাঙে, মানুষ ভয় পায়; কিন্তু হয়তো তখনই নদী হাসে—কারণ সে ফিরে পায় তার মুক্তি।

আজকের দিনে মুক্তি কথা বলা মানে, উন্নয়ন-এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। শহরের মানুষ ভাবে, বাঁধ মানেই নিরাপত্তা। কিন্তু নদীর নিরাপত্তা কোথায়? নদী তো কাঁদে—গোপনে, স্রোতের অন্তরালে। বড় নদীর বাঁধ ভাঙা মানে কেবল জল ছাড়ার গল্পকথা নয়; একটা ভাবনার বাঁধ ভাঙা শব্দ নির্মাণ হওয়া । প্রকৃতির পাঠশালাতে ভালো ভাবে থাকতে হলে মানুষকে বুঝতে হব্ব—প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ নয়, সহাবস্থান  টিকে থাকার একমাত্র পথ।

এই সময়ের রাজনীতিতে, যেখানে সব কিছু সংখ্যার খেলা, সেখানে নদী-বক্তব্য এক ধরনের কবিতা। প্রশাসনিক ভাষায় লেখা হলেও, এর মধ্যে আছে এক গভীর মানবিক সুর, যা রাজনৈতিক গন্ধ মাখা। "নদীকে ভালোবাসো, তাকে বাঁচতে দাও, কারণ নদী বাঁচলে তবেই মানুষ বাঁচবে।”-এই ভাবনার বাস্তুতান্ত্রিক দর্শনটাও আমাদের নিত্য দিনের পাঠের মধ্যে আশা প্রয়োজন। ভারতের অন্যান্য আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে নদী আন্দোলন খুবই নতুন। নদী বাঁচাতে এখনো অনেক পথ হাঁটতে হবে।

0 Comments

Post Comment