সে মুখ দিয়ে একটা 'আঁ' টাইপের শব্দ করল। অঙ্কলোজিস্ট বাঁহাত দিয়ে ল্যাম্পের ফোকাস সামান্য সরিয়ে দীপনের মুখগহবরকে আরো দৃশ্যমান করলেন, খানিকক্ষণ নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করতে করতে বললেন , "হুঁ ! ভালো বুঝচিনা, বায়োপসি করতে হবে। "বাজপড়া পাখির মতন নিশ্চল হয়ে বসে বসে দীপন দেখতে লাগল, ডাক্তার হাত থেকে গ্লাভস টেনে খুলে টেবিলের নিচে ডাস্টবিনে ফেললেন প্রথমে, তারপর প্রয়োজন ছিল না, তবু কোণায় রাখা বেসিনে হাত ধুয়ে, ঝোলানো তোয়ালেতে হাত মুছে চেয়ার টেনে বসলেন, তারপর গম্ভীরমুখে প্রেসকৃপশন লিখতে শুরু করলেন। মুখ তুলে জানতে চাইলেন, "কতদিন ধরে দাগটা লক্ষ্য করছেন ?" 'বায়োপসি ' শব্দে অর্ধমৃত দীপন কোন রকমে বলে উঠলো, "ডাক্তারবাবু ! তাহলে আমার পাড়ার জেনারেল ফিজিশিয়ান যা সন্দেহ করছেন, এটা তাই ? আমার লিউকোপ্লেকিয়া রোটাই হয়েছে ? "
— বায়োপসি রিপোর্টটা দেখি আগে। তবে সাবধান, সিগারেট কিন্তু মারাত্মক ! লিখেও দিচ্ছি প্রেসক্রিপশনে। আপনার রোগটি যে একটি প্রি ক্যান্সারাস গ্রোথ আর সেটি জেনেই যখন আমার কাছে এসেছেন, অর্ডিনারি সর্দি-কাশিতে তো আমাদের কাছে কেউ আসে না, তাই সিগারেটের ব্যাপারটা বলার দরকারও ছিল না। তবু বললাম !
দীপন চোখ তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকালো। খুব গরম লাগছে। সিলিং থেকে কোন ফ্যান ঝোলানো নেই কেন? পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল, ও ! এই সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালটি তো পুরোটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। খুব অবসন্ন বলা সে ডাক্তারকে বলল, "ডাক্তারবাবু ! এই লিউকোপ্লেকিয়া কি সিগারেট টানার জন্যই হয় ? আমি তো দিনে দশ–বারোটার বেশি খেতাম না। "
ডাক্তারবাবু হাসলেন সামান্য, কেন হয় সেটা তো বলতে পারব না। তবে স্মোকিং ইজ ওয়ান অফ দা কজেস তো বটেই। এখন থেকে অত ভেঙে পড়ছেন কেন ? "
ধীর পদক্ষেপে চেম্বারের বাইরে এল দীপন, এই ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালটির ভেতরের করিডোর ঝকঝকে উজ্জ্বল, টাইলস বসানো মেঝে ঝকঝকে, দিনরাতের প্রভেদ ঘুচিয়ে দেওয়া আলোকসজ্জা। অলস চোখে বাঁ হাতের ঘড়িতে চোখ রেখে দীপন বুঝলো বাইরে বেরিয়ে অস্তগামী সূর্যকে একবার দেখে নিতে পারবে। প্যান্টের বাঁ পকেটে প্রিয় ব্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেটটির ভেতর চারখানা সিগারেট অবশিষ্ট আছে। ডাক্তার দেখিয়ে বাইরে চা দোকানে এক ভাঁড় চা আর একটি সিগারেট – এইভাবে ছকে রাখা ছিল ! জীবনে আয়েশ বা আরাম বা তাৎক্ষণিক সুখভোগের আর তো কোন ব্যবস্থা বরাদ্দ নেই ! আজ থেকে তাও বন্ধ ওঃ ! বিড়বিড় করতে থাকল সে, " ওরা বলছে মিষ্টান্ন বাদ। ডিম অস্পৃশ্য / মশলা একদম বারণ । / তার মানে, জীবন আস্বাদন করার দিন আমার / ফুরিয়ে গেছে ।…"
হ্যান্ডেল লাগানো কাঁচের দরজার ওপাশে দুজন উর্দিপরা গার্ড, কেউ আসতে যেতে দরজা টেনে প্রবেশ– নির্গমন পথ সুগম করবার জন্য। খুব ক্লান্ত লাগছিল দীপনের, মাথাটা কেমন যেন ভার ভার ! সে বুঝতে পারল, আসন্ন মৃত্যুর চিন্তায় তার শরীর যেন এলিয়ে পড়তে চাইছে। বাইরে বেরোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। টাইলস বসানো ঝকঝকে মেঝেতে গেঁথে রাখা সারি সারি রট আয়রনের চেয়ার, রুগী অথবা রুগীর আত্মীয়রা বসে থাকেন ডাক্তার অথবা ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হওয়ার প্রতীক্ষায়। বসে পড়ল দীপন, একটু জল খেলে কি ভালো লাগবে ?.... নাঃ ! তাহলে যেতে হবে সেই রিসেপশন কাউন্টার অব্দি … গেটের গার্ডের মেলে ধরা দরজা দিয়ে দুজন সুবেশা যুবতী ঢুকলো… কেশবিন্যাস থেকে শুরু করে প্রসাধিত মুখশ্রী হয়ে সুগঠিত বক্ষদেশ …একজনের জিন্স টি –শার্ট , আরেকজনের জিন্স শার্ট… নয়নসুখকর। নিরুদ্দিগ্ন চোখে মুখে তারা পরস্পর কথা বলতে বলতে গটগট করে হেঁটে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে গেল। এরা কি শপিংমলে এসেছে নাকি নার্সিংহোমে ! জিনস টি-শার্টে যুবতীটি তার শারীরিক সম্পদকে দৃশ্যমান করায় অভ্যস্ত, তা তার হাঁটার চটুল ছন্দে বোঝাতে চাইছিল। এই মৃত্যুগন্ধময় হাসপাতালও কেমন যেন যৌবনদীপ্ত হয়ে উঠেছে এদের উপস্থিতিতে ! আহা! এরা চিরকাল যৌবনবতী থাকুক ! রাস্তায়–ঘাটে কত যে পুরুষ মনে মনে এদের নোংরা করে, চেটে খায় তা কি এরা জানে না ? নাকি যৌন উত্তেজনা ছড়ানোটাকেই এরা পছন্দ করে?.... লিউকোপ্লেকিয়া কোন স্টেজে এখন ?... বায়োপসি রিপোর্ট কত দিন বাদে যেন দেয় ? ...দিন পাঁচেক ?.... রেডিওথেরাপিতে কি গালটাই ফুটো হয়ে যাবে ?.... শোভনদার স্ত্রীর ব্রেস্ট ক্যানসার ফার্স্ট স্টেজে ধরা পড়ায় সেরে গেছে ….আক্রান্ত স্তনটিকে কেটে বাদ দিতে হয়েছে … গালের ভেতরটাও কেটে বাদ দেওয়া হবে ? …..কথাবার্তা বলতে পারবো ?... ফুটো গালের মানুষ… কুৎসিত…সবাই মুখ ফিরিয়ে নেবে …. পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস -গন্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম… এমনকি একটু আগেও যে দুটি কামোদ্দীপক যুবতীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম , ভুল…. চোখ থেকে সেই মুগ্ধতাও মুছে যাক… বায়োপসি যদি এই লিউকোপ্লেকিয়াই বলে তাহলে মুম্বাই চলে যাব চলে যাবো… রোগটা কোন স্টেজে তা জানা আর চিকিৎসার জন্য …প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে তিরিশ চল্লিশ হাজারের বেশি লোন পাওয়া যাবে না … অফিস থেকে রেফার করিয়ে কিছুকাল চিকিৎসা করাবো…. অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মা বোনকে রোগটা নিয়ে কেউ কিছুই বলা যাবেনা…. ওঃ ! এ সময়ে আবার কে ফোন করল ?.... তুলেও দেখবো না… পৃথিবীর কারোর সম্পর্কেই কোন আগ্রহ নেই আমার … পরিচিত সমস্ত জনের আর আমার মধ্যেকার সম্পর্কের জানালাগুলো নির্মম হাতে বন্ধ করতে হবে এবার….!
কিন্তু নাঃ ! মোবাইলের ঘ্যানঘ্যানানিও একসময় গর্জনের রূপ নিতে থাকে, আশেপাশের রুগী অথবা রুগীর আত্মীয়রা বিরক্ত হয়ে তাকাতে থাকে, দীপন বাধ্য হয় দূরভাষিত সংলাপ শুনতে, " হ্যাঁ ! কে বলছেন ? "
— বাব্বা : ! কি ব্যাপার ? মোবাইল বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে, তুলছো না ? আমার নামটাও ডিলিট করে দিয়েছো নাকি ? কে ফোন করছে জানতে চাইছো ?
ওঃ ! অর্পিতা ! নাঃ ! "ইয়ে – আসলে বুক পকেটে ফোনটা ছিল না – ইয়ে —"
— তোমার চারপাশে একটা কিরকম যেন নয়েজ শোনা যাচ্ছে ! তুমি কোথায় রয়েছো ?
— ও ! হ্যাঁ – অফিসে । আসলে অফিসে একটা মিটিং চলছে।
— কিন্তু তোমার তো আজ ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার কথা।
— হলো না। কাল অবশ্যই যাবো । — সন্ধ্যেয় কি আমাদের বাড়িতে আসবে ?
— আজ হবে না মনে হচ্ছে, মিটিং শেষ হতে হতে রাত হয়ে যাবে । আসলে ফ্যাক্টরিতে একটা ঝামেলা হয়ে –
— ছ'দিন কিন্তু আমাদের দেখা হয়নি ! তোমার গরজ না থাকতে পারে , আমার তো মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় মুখোমুখি বসে কথা বলি –
— ঠিক আছে । হবে। এখন রাখতে হবে – বাই –
ইংরেজি বিদায়জ্ঞাপক ধ্বনিটিতে অর্পিতা ফোন রাখতে বাধ্য হয় বটে তবে দীপন বুঝতে পারে অর্পিতার কাছ থেকে তা বিদায়গ্রহণ পর্ব সুশৃংখল হবেনা। বস্তুত মা, বোন আর অর্পিতা এই তিন নারীর কাছেই তার যা কিছু গ্রহণযোগ্যতা । অর্পিতা এখনো অনাত্মীয়া তবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও বিশ্বস্ততার সুবাদে এবং পরস্পরকে ভালো করে জানার আগ্রহে অথবা অন্তর্গত যৌনবোধের তাড়নায় তারা শারীরিক উত্তাপ বিনিময়….। হ্যাঁ ! সেই চারটি দুপুরের সুখস্মৃতি এই প্রাক মৃত্যুচেতনাতেও রোমাঞ্চ বয়ে নিয়ে আসছে !
আমার এই উবে যাওয়াটা বোন ঝিমলি আর অর্পিতার কাছে চরম বিপর্যয়কর হবে না…দু চার বছর মাত্র …সময়ের পলি….অন্য কোন যুবকের সাহচর্য…. নতুন গৃহস্থালি….শিশু…মারা গেলে ডিপার্টমেন্টের বস, জিএম সুভাষ জৈন খুশি হবে কি ? " শালে মর গয়া… মুঝে চেতাবনি দেনে আয়া থা…ফির মেরা পসন্দকা সাপ্লায়ারোকা অর্ডার দেনে মে কোই দিককত নেহি হোগা ।" ব্যাটা ইউপির মাল ! এই পশ্চিমবাংলায় এসে ঘুষ খাচ্ছে ! এলেম আছে ! যারা ওকে ঘুষ দিচ্ছে তারা তো ভেবে নিচ্ছে যে ওই ঘুষের টাকার একটা পার্সেন্টেজ যাচ্ছে আমার পকেটে ! পারচেজ ম্যানেজার কি ডেপুটিকে ভাগ না দিয়ে একা খেতে পারে ?... জৈনকে সেই জন্যেই সতর্ক করার দরকার হয়ে পড়েছিল ," ভিজিলেন্স আর এমডিকে জানাতে বাধ্য হবো । "... ডিপার্টমেন্টে যখন শোকসভার আয়োজন করা হবে তখন জৈন কি হাজির থাকবে ! নাকি দুসরা কামের ছুতোয়… অবশ্যম্ভাবী সেই শোকসভাটিতে আমার একটা এনলার্জড পাসপোর্ট সাইজের ফটো ( আছে কি বাড়িতে কোথাও ? মনে পড়ছে না…ঝিমলি ঠিক একখানা খুঁজে পেতে বার করে এনে দেবে কোন কলিগের হাতে ।) মালাটি কি শুরু একগাছি রজনীগন্ধার নাকি একটু মোটা, দৃশ্যটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না দীপন তবে কি আশ্চর্য ! এভাবে ভাবতে পেরে মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। হাসতে হবে ! আগামীকাল কোলকাতা তার পরের সপ্তাহেই হয়তো তাকে মুম্বাই যেতে হবে। সুস্থ থাকতে হবে না ? হাসিটা তাই প্রয়োজন, এবার বাড়ি যাওয়া দরকার । হাসপাতালের বাইরে একটু এগিয়ে বাঁদিকে রাস্তার এক পাশে চায়ের গুমটি । হাসপাতালের ভেতর ওদের নিজস্ব কাফেটেরিয়া আছে বটে তবে সেখানে এক কাপ চা পনেরো টাকা ! হ্যা: ! গলা দিয়ে নামে ? চায়ের গুমটির সামনে একটা বেঞ্চ পাতা। একটা বড় ভাঁড় বাঁ হাতের তালুতে ঠুকে ঠুকে… তারপর মুখের সামনে এনে জোরে ফুঁ… অভ্যেস… উদ্যত কেটলির সামনে দু আঙুলে ভাঁড় পেতে রেখে সতর্ক চোখ….উপচে পড়ে আঙুলে যেন ছ্যাকা না লাগে….চা শেষ হলে ভাঁড় ছুড়ে ফেলে বাঁ পকেটের ভেতরে হাত ঢোকানো…. সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার… অভ্যেস…. এগুলো ছুঁড়ে ফেলা যায় ?...লাইটারটা বাড়ি নিয়ে যাই, ওদের ধূপ টুপ জ্বালানোর কাজে লাগবে …. আচ্ছা চার -পাঁচ টান টেনে যদি ফেলে দিই, তাতে মৃত্যু কি তরান্বিত হবে ? ক'দিন ক 'ঘন্টা এগিয়ে আসবে ? নাঃ ! এভাবে মৃত্যুভয়ে অর্ধ-মৃত হয়ে বেঁচে থাকার কোন অর্থ হয় না…গভীরভাবে ভেবে দেখলে খুব কম মানুষই নিষ্কণ্টক জীবন ভোগ করছে… কেউ অর্থনৈতিক মৃত্যু, কেউ মানসিক, কেউ কেউ শারীরিক মৃত্যুর মুখোমুখি… সুতরাং ক্ষণস্থায়ী জীবনে মুহূর্তগুলি উপভোগ না করে ইচ্ছেমতো না খেয়ে… নাঃ ! প্রতিটি মুহূর্ত ভোগ করব শালা !" যেমন নিয়মিত কামচর্চা না করলে প্রেমিকার ওপর থেকে মন সরে যায়, / তেমনি খাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে আর বাঁচার ইচ্ছে থাকে/ না, খাওয়া যে শুধু খিদে মেটাতে নয়, পেট ভরাতে নয়, পুষ্টি সঞ্চয়/ করতে নয়, এ কথা বুঝতে হবে। /"
আধখাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে লোকটাকে দেখতে পেল দীপন। রং করা ক্যাটক্যাটে লাল চুল আর ঢাউস ফোমের জুতোয় খেঁকুরে মার্কা লম্বাটে লোকটা ভিড়ের মধ্যেও নজরে পড়বে। তার থেকে বছর দশকের বড়ই হবে। পা ফাঁক করে সিগারেট টানছিল লোকটা, দীপনের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে। মনে পড়ে গেল, হাসপাতালে তার উল্টোদিকে চেয়ারে বসেছিল লোকটা। রুগী নয়, তাহলে এরকম আয়েশ করে ধোঁয়া ছাড়তে পারতো না। কোন রুগীর আত্মীয় বা বন্ধু -টন্ধু হবে । এত তাড়াতাড়ি ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেল ? মরুক গে ! বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দেওয়ার আগে একবার আড়চোখে লোকটার দিকে তাকালো দীপন। আশ্চর্য ! লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল ! কে ও ? চেনা ? তার স্মৃতিশক্তি একটু একটু করে দুর্বল হচ্ছিল গত দু এক বছর ধরে সে টের পেয়েছে । রাস্তায় ঘাটে বহু লোক তার সঙ্গে কথা বলেই যায়, "আরে ! দীপন দা যে ! কেমন আছেন ? ইদানিং আর আমাদের ওদিকে আসেন না কেন ? বহুদিন দেখিনা আপনাকে।" কিংবা, "আরে দীপন ! কি ব্যাপার, ভালো তো ? তুমি কি এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছো ? বোনের বিয়ে হয়েছে ? তোমার? তোমার মায়ের শরীর ঠিক আছে তো ?" মুখোমুখি এসে যাওয়া সদ্য যুবা অথবা পৌঢ় ব্যক্তিটি যখন এই সমস্ত অন্তরঙ্গ প্রশ্নমালা তার সামনে পেশ করতে থাকে সে ততক্ষণে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে তার গলার আওয়াজ, ভাবভঙ্গি সমস্ত কিছু একাগ্র মনে শুনতে শুনতে প্রশ্নকর্তার পরিচিতি খুঁজতে চেষ্টা করে, দৈবাৎ একটা আধটা পেয়ে গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কণ্ঠস্বরে পাল্টা উচ্ছ্বাস জাগে না। মুখস্ত করা সংলাপ উড়ে যায়, " এই ভালো। আসলে – ইদানিং অফিসে এত কাজের চাপ বেড়েছে যে আনসোশ্যাল হয়ে পড়ছি বুঝি। যাকগে –তুমি / আপনি কেমন আছো / আছেন ? বোন তো সবে এই থার্ড ইয়ার। একদিন এসো/ আসুন না আমাদের বাড়ি। "দুপক্ষেরই বাক্যগুলি উচ্চারিত হওয়ার সময় সজীব থাকলেও তারা কখনোই শ্রোতার মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছতে পারেনা , দুই কানের মধ্যেকার অদৃশ্য সুড়ঙ্গ পথে যাওয়া আসা করে। ফলত : তারা জন্মানোর অব্যবহিত পরেই নিঃশেষ হয়ে যায় ! এই রহস্যময় লোকটা যদি তার পরিচিতই হবে তাহলে তো সামনে এসে এই স্বল্পায়ু বাক্যগুলির জন্ম দিতে পারতো। দূর থেকে লক্ষ্য রাখছে কেন ? সে তো কোন ফিল্মস্টার বা রোজ রাতে নিউজ চ্যানেলে হাজিরা দেওয়া নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবী বা পলিটিক্যাল খেউড় গায়ক নয়। তার এইচ ও ডি জৈন ঘুষখোরটা কি একে তার ওপরে নজরদারি করতে পাঠিয়েছে ? যদি তাই হয় তাহলে সত্যি সত্যিই সে এবার ওই জৈনের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে নামবে। ভিজিলেন্সকে জানাবে। জৈনকে ঘুষ দেওয়া সাপ্লায়ার দুজনের ডেলিভারি করা কোক কয়লায় এবার অনেক অর্ডিনারি কয়লা মেশানো ছিল ! ব্যাপারটা গ্রুপ ডি স্টাফেরা পর্যন্ত লক্ষ্য করেছে। সে জৈনকে বলেছিল, "ইয়ে তো ইনটেনশনালি মিক্স কিয়া হুয়া হায়! " জৈন ওর কাঁধে চাপড় মেরে বলেছিল, "আরে ইয়ার ! কিতনা নজর রাখখোগে? ছোড়ো ! পেপারমে তো ম্যায় হি সাইন করুঙ্গা !" ফলে যা হবার হয়েছে ! ফার্ণেসে টেম্পারেচার আসতে দেরি, প্রোডাকশন মার খেয়েছে ! প্রচুর ছাই উড়ে প্ল্যান্টের আকাশে কালো ধোঁয়া ! একটা কানাঘুঁসো প্লান্টের ভিতরে সেদিন থেকে শুরু হয়েছে শুনেছে সে। ভিজিল্যান্সকে জানালে এদের জেরা করে ঠিকই আসল তথ্য জেনে নেবে। খালি জানানোর অপেক্ষা। ব্যাটা সাসপেন্ড হয়ে যাবে বলেই জানায়নি সে। খালি জৈনকে শাসিয়েছে, "আহিন্দা অ্যায়সা হরকত কিয়া তো ভুগতনা পড়েগা ইয়াদ রাখনা !" জৈন কি তার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করছে ? নইলে খামোখা একটা লোক তাকে ফলো করছে কেন ? এসব ভাবতে ভাবতেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিল সে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। বাসে চাপার ঠিক আগের মুহূর্তে কি মনে হতে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে তাকালো সে, লোকটা তীক্ষ্ণ চোখে দীপনের বাসে ওঠা লক্ষ্য করছে ! কোন রুটের মিনি সেটা নোট করল ?
প্লাস্টিক প্যাকেটে মুরগির মাংস নিয়ে বাড়ি ঢুকলো দীপন, দরজা খুলে বোন 'মাংস হাতে দীপনের প্রবেশ ' লক্ষ্য করে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "একি ! তুই গেলি ডাক্তার দেখাতে, এলি মাংস নিয়ে ! কি ব্যাপার ? যাস নি ডাক্তারের কাছে? পাছে ধরা পড়ে যায় তার উদ্বেগ, তাই অন্যদিকে তাকিয়ে দীপন বলে, "হাসপাতালটার সামনে থেকে ফিরে এলাম। মনে পড়ে গেল, ওটা তো একটা গলাকাটার জায়গা! গেলেই তো এই টেস্ট, ওই সোনোগ্রাফি এসব চক্করে ফেলে দেবে ডাক্তারগুলো। কাল কলকাতা যাবো। ওখানে এতসব ছ্যাঁচড়ামি নেই। বোন গজগজ করতে শুরু করে , "তুইই তো সেদিন বলেছিলি, এই বড় হাসপাতালটা আর যাই হোক, বাছাই করা ডাক্তারগুলোকে বসাচ্ছে ! তাহলে? ঘরের কাছে সেইসব ডাক্তার ছেড়ে দিয়ে এত দূরে যাওয়ার কি মানে? "
বায়োপসি করাতে যাচ্ছে কিছুতেই বলা যাবে না, বিরক্তির সঙ্গে দীপন বলল, " তোদের বলতে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছিল ! যাকগে – মাংসটা কষে রাঁধতে পারবি কিনা বল ! "
— তার মানে তুই আমার এক ঘন্টা পড়া নষ্ট করে দিলি ! তিন মাস বাদে আমার ফাইনাল, ফেল করলে তো কথা শোনাতে ছাড়বি না ! "
তিন মাস ! ততদিন কি বেঁচে থাকবো ! থাকলেও বোধহয় মুম্বাইয়ের ক্যানসার হাসপাতালে রেডিওথেরাপি অথবা কেমোথেরাপি চলবে তখন! আহা! বেচারা তখন পরীক্ষা দেওয়ার মানসিকতায় থাকবে তো ? নাঃ ! এখন থেকে এসব ভেবে আধমরা হওয়ার কোন মানে হয় না ! ভাববো কেন ? মা আর কদিন বাঁচবে ? বোনের জন্য তো কোন ভাবনা নেই, ডিপেনডেন্ট হিসেবে বোনের নাম লেখানো আছে অফিসের নথিতে …. আমি মারা যাওয়ার ছ সাত মাসের মধ্যেই বোন চাকরিটা পাবে, ধীরে সুস্থে আমার মৃত্যুটাও এদের কাছে সহনীয় হয়ে উঠবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না পেয়ে ঝিমলি দীপনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ । তারপর বলে , "কিরে? কি ভাবছিস? জানি – জানি আমি হয়ে গেছি তোর গলার কাঁটা ! মাকে তো বহুবার বলেছি, তোর বিয়েতে মা কেন সায় দিচ্ছে না কে জানে ! "
বোন এখন আদর, খুনসুটি চাইছে। চাইছে দাদা তার চুলের ঝুঁটি ধরে টানুক। তাহলেই কাঁদো কাঁদো গলায়, "এই দ্যাখো মা ! আমার এক মুঠো চুল ছিঁড়ে মাথায় টাক ফেলে দিয়েছে দাদা ! ", বলে নালিশ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু দীপনের ঠিক মুড আসছে না ! তার মাথায় অন্য প্ল্যান, ঠান্ডা চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল , " বিয়ে? দাঁড়া ! তোর আগে একটা চাকরি হোক, তারপর একটা ভালো পাত্র খুঁজে আনি। তারপর না হয় মায়ের দেখাশোনা করার জন্যে — " মলিন মুখে বোন বলে, " চাকরি ? হিস্ট্রি অনার্স গ্রাজুয়েটকে কে চাকরি দেবে দাদা ? "
— দেখা যাক ! হয়তো আমাদের অফিসেই তোর একটা চাকরি হতে পারে !
ঝিমলি আগ্রহী, কিন্তু সন্দিগ্ধ চোখে মুখে বলে, "এই কোয়ালিফিকেশনে চাকরি ? তোদের অফিসে কোনো পিওনের পোস্ট খালি হয়েছে নাকি? তোর সুপারিশে হয়ে যেতে পারে, তবে তোর পেস্টিজে লাগবে না? স্টোরের ডেপুটি ম্যানেজারের বোন পিওন ! মানাবে ?"
দীপন হাসে। তার কাজ ছিল বীজটা রোপন করা ! তার মৃত্যুটাকে সহ্য করার প্রাণশক্তি যোগাবে তো ওই চাকরি। দীপন হেসেই বলে , "চাকরি হলেই দেখবি আমাকে আর পাত্র খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে না ! পাত্ররাই লাইন দেবে আমাদের বাড়ির দরজায় !" বোন ভ্রূভঙ্গি করে মাংসের থলেটা নিয়ে চলে যায় , মায়ের কাছে গিয়ে গজর গজর করতে শুরু করে। আজ দাদার বিরুদ্ধে নালিশ করার মতন কিছু নেই , তবে এখন তাকে পড়া ফেলে টানা একঘন্টা ধরে অখাদ্য রাঁধতে হবে যেটা তার প্রিয় মা ছোঁয় না। কম ঝামেলার ! জামাকাপড় ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরের সামনে মায়ের মুখোমুখি হয় দীপন। মা বলে , "হ্যাঁরে ! ঝিমলি বলছে, তুই নাকি কোলকাতা যাবি ডাক্তার দেখাতে? কেন?" মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটি নিতে নিতে একটু ভাববার সময় পেয়ে যায় দীপন। চায়ে চুমুক দিয়ে বলে , "এখানের ডাক্তারদের ঠিক ভরসা হচ্ছে না। রোগটা সামান্য, স্কিনের রোগ, কিন্তু কুচিকিৎসায় যদি বড় রোগে দাঁড়িয়ে যায় ! তাই কলকাতার বড় ডাক্তারের কাছেই যাই –" সাজানো যুক্তিজাল মেলে ধরতে যাচ্ছিল দীপন, হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল এই ভদ্রমহিলার কাছে আজ পর্যন্ত সে কোন কৌশল করেও সে জিততে পারেনি। তাই সে স্ট্রেট ব্যাটে বলটা খেলল, " ওঃ ! তোমরা না ! কোন চর্চা নেই তো, তাই একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়েও ভাববার সময় পেয়ে যাও। কলকাতায় আমাদের হেড অফিসে আমাকে একবার যেতে হবে অফিসের কাজে, ডাক্তারটাও তাই ওখানেই এক ফাঁকে দেখিয়ে নেব। রথ দেখা আর কলা বেচা দুটোই হবে। কোলকাতার ডাক্তার মানে বেশি রুগি ঘেঁটেছে , তার মানে বেশি অভিজ্ঞ, ঠিক কি না?"
"আজকাল যে কত রকমের রোগ বেরিয়েছে বাবা", একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বাক্যটি উচ্চারণ করে মা রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো। চা খেয়ে সিগারেট ধরানোর ইচ্ছাটা প্রবল হলেও প্রাণপণে দমন করে দীপন। পেচ্ছাপ পেতে সে বাথরুমে গেল। খালি গায়েই ছিল সে। পাজামা নামিয়ে পেচ্ছাপ করতে করতে দীপন নিজের অর্ধ উত্থিত লিঙ্গের দিকে তাকায়। ক্রমে তার জঙ্ঘা থেকে নাভিদেশ হয়ে মেদহীন পেট, বুক পর্যন্ত চোখ বোলায়…. অভ্যেস… বুক চওড়া, বাহু দুটি মজবুত, বুকের মাঝখানে কালো চুলের হালকা আচ্ছাদন এমনকি তার দুই বাহুসন্ধি ও নিম্ননাভির ঘন কালো যৌনকেশ তথা অর্ধ উত্থিত লিঙ্গ তার মনের মধ্যে একটা আসক্তি তৈরি করে এবং সে উপলব্ধি করে যে নগ্নতাও সুন্দর ও যৌবনের প্রতীক। যৌনবোধ জাগ্রত হওয়ার পর থেকে চারপাশে সিনেমা হল, রাস্তাঘাট থেকে প্রাপ্ত সুলভ যৌন হাতছানির বিরুদ্ধে তার অর্জিত সংযমের দ্বৈরথে সে শান্ত প্রতীক্ষায় আছে, একদিন সময় হলেই…. হঠাৎ খেলা শেষের বাঁশি বেজে গেছে ! ' বৃষ্টির জন্য ম্যাচ পরিত্যক্ত। ' প্যাড পরে প্যাভিলিয়নে বসে থাকাই সার, মাঠে নেমে আর ব্যাট করা হল না! মূত্রধারা ক্ষীণ হতে হতে বিন্দু বিন্দু আকার নিতে থাকায় সে বুঝতে পারে মূত্রথলি খালি, সংবৃত পোশাকে বেরোনো যেতে পারে এবার ! পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে সে বিড়বিড় করে, "এত যদি ব্যুহ, চক্র, তীর, তীরন্দাজ/ তবে কেন শরীর দিয়েছো শুধু/ বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে?" দীর্ঘশ্বাস আর উদ্গত কান্নাকে গিলে ফেলে সে বাথরুম থেকে বেরোয়।
প্যান্ট শার্ট পড়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তার অর্পিতার কথা মনে হল। গত সপ্তাহেই তার বাহুলগ্না অবস্থায় চুলে বিলি কাটতে কাটতে অর্পিতা বলেছিল, " সেলুনে যাওয়ার কথা মনে পড়ে না নাকি ? এবার তো তোমাকে রাবণের মতো দেখতে লাগবে ! " রাবণ কেমন দেখতে ছিলেন সেটা দেখা হয়নি , আর সেলুনে যাওয়াও হয়নি। এখন মনের যা অবস্থা তাতে আর …! নাঃ ! সব ছেড়ে চলে যাবার আগে, এমনকি সকলের মধ্যে জানাজানি হওয়ার আগেই নিজেকে অর্পিতার কাছে মূল্যহীন এবং একটা ঘৃণ্যলোক প্রমাণ করে যেতে হবে। কিভাবে তা করা যায়? সেটা করতে গেলে তো আবার অন্য আরেকজনের প্রতি অন্যায় করতে হয় ! তবে তার আগে একটা নির্জন জায়গা থেকে তরুণেশদার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা বলে নিতে হবে।
এস্টাবলিশমেন্টের তরুণেশদার সঙ্গে দীপনের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব । তরুণেশদা তার সাহিত্যবোধের প্রশংসা করে খুব, দীপনও জানে, তরুণেশদা একজন বড় মাপের কথাকার। আফশোষের বিষয় তাদের ফ্যাক্টরিতে এসব কথা অন্য কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। জনমত অনেকটা এরকম –"তাই ? বলচ বড় লেখক ? বেশ ! তা কোতায় কোতায় তোমার এই তরুণেশদার লেকা ছাপা হয়েচে ? দেশ ? সানন্দা ? আনন্দবাজারের রোববারের পাতাতেও নয়চ? যাঃ বাব্বা ! তাহলে কি 'নব কল্লোল '? তাও নয় ? তাহলে ? কোথাও ছাপা হয়নিকো অথচ বলচ বড় লেখক ? বেশ ! তাই হল না হয় ! আমাদের আশেপাশে একজন বড় লেখক থাকলে ক্ষতি কি ? যাকগে – তোমার এই বড় লেখকটির লেখা একদিন পড়িও তো ! আমরা তো বিমল মিত্তির, আশাপুন্না পড়ে পড়ে বড় হয়েচি। আরো একজন বড় লেখকের লেকা না হয় পড়ব'খন ।" ফোনের ওপ্রান্তে তরুণেশদার সাড়া পেয়ে শশব্যস্ত দীপন উঠলো , " হ্যাঁ ! তরুণেশদা ! ব্যস্ত নাকি ? একটু মন দিয়ে শুনবে যে কথাগুলো বলছি – দ্যাখো দাদা, তোমাকে এতোটাই বিশ্বাস করি যে ভরসা আছে যে প্লিজ কাউকে বলবেনা যা বলছি ! হ্যাঁ ! শুনলেই বুঝতে পারবে যে কেন কাউকে বলা যায় না ! বলছি – কাল এখানের বড় হাসপাতালটাতে গেসলাম । আমার গালের ভেতরের দাগটা তোমাকে গত মাসে দেখালাম না ? আমাদের পাড়ার ডাক্তার তো গত মাসেই বায়োপসি করাতে বলেছিল ! এতদিন ধরে ভাবতে ভাবতে শেষমেষ আজ একজন অঙ্কলোজিস্টের কাছে গেসলাম । ইনিও সন্দেহ করছেন যে আমার লিউকোপ্লেকিয়া হয়েছে ! বায়োপসি করাতে কাল কলকাতায় যাচ্ছি। হ্যাঁ ! বলছি – শোনো ! লি-উ -কো -প্লে- কিয়া। শুনতে পেয়েছো ? এটা একটা প্রি ক্যানসারাস গ্রোথ অব ওরাল এরিয়া। বুঝতেই পারছো নিশ্চয়ই যে কেন আমি চাইছি যাতে ব্যাপারটা আমার মা-বোনের কানে যেন না যায়! এখন যে কারণে তোমাকে ফোনটা করছি – মুম্বাইয়ের ক্যানসার হাসপাতালে আমার চিকিৎসার করানোর খরচ আমাদের কোম্পানি দেবে তো ? বেশ ! আমি কাগজপত্র সব তোমাকে দিয়ে দেব, তুমি রেফার-টেফার কিভাবে করাতে হয় করিয়ে দিও দাদা ! আঃ ! বাঁচলাম ! খরচার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। না, কাল তো আমি কলকাতা যাচ্ছি বায়োপসি করাতে। না রে বাবা ! আমি একাই যেতে পারবো। তুমি আমার সঙ্গে কি করতে যাবে ? আমার শরীর তো ঠিক আছে ! যাক – এবার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, চাকরিতে জয়েন করার পরই আমার ডিপেনডেন্ট হিসেবে আমার বোনের নামটা লিখেছিলাম কোন ডকুমেন্টে মনে আছে। আমরা মারা গেলে তো মাস ছয়েকের মধ্যে ডিপেন্ডেন্টরা চাকরি পেয়ে যায় দেখেছি। আমার বোনের চাকরিটা যাতে তাড়াতাড়ি হয়ে যায় তুমি দেখবে তো ? কথা দাও আমাকে ! আঃ ! থ্যাংক ইউ ! আর -আর - ইয়ে – মায়ের শ্মশানযাত্রার সুষ্ঠু ব্যবস্থা থেকে — আমি তো থাকছি না —সেজন্য– তোমার পক্ষে যতটা সম্ভব –! কথা শেষ করতে পারে না দীপন। ফোনের ওপ্রান্তে তরুণেশ নামক এক গল্পকারকে বিমূঢ় করে রেখে এ প্রান্তে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরিবেশ পরিস্থিতি ভুলে পার্কের বেঞ্চটিতে উপুড় হয়ে কাঁদতে থাকে দীপন !
।। দুই ।।
কলিকাতা নগরীর উপকণ্ঠে অজানা এক স্থানে রাজপথের উপর আসিয়া একটি স্বত:চলযান সহসা স্তব্ধ হইল। আরোহী দীপনকে চালক কহিল, "অবতরণ করিতে আজ্ঞা হউক ! এই স্থল হইতে আপনার গন্তব্যে পৌঁছিতে এইবার আপনাকে কিয়দ্দূর পদব্রজে যাইতে হইবে !''
দীপন কিঞ্চিৎ বিপন্নমুখে কহিল , "কিন্তু আপনার যানটিতে আরোহণের পূর্বেই কহিয়াছিলাম , আমি কর্কট ব্যাধি নিরাময় কেন্দ্রটিতে যাইতে অভিলাষী।"
চালক তাহার দক্ষিণপার্শ্বদিকে হস্ত উত্তোলন পূর্বক কহিল, "এই পথে অনতিদূরেই আপনার গন্তব্য । পদব্রজেই যাইতে হইবে। নূতন প্রবর্তিত বিধি অনুসারে আমরা অত্রস্থলের অধিক অগ্রসর হইতে পারিনা। পথিপার্শ্বদেশে যে সুরম্য বিপণিগুলি দেখিতেছেন, সেইগুলি এবং তাহাদের কার্যবিধি আপনার দৃষ্টিগোচর ও কর্ণগোচর হউক ! ইহাই নববিধান প্রণেতাগণের উদ্দেশ্য। "
দীপন মাত্রাতিরিক্ত বিস্মিত হইল এবং চতু:পার্শ্বদেশে অবলোকনপূর্বক কহিল , "আমাকে গ্রাম্য ব্যক্তি বিবেচনা করিয়া ' ঢপ ' প্রদান করিতেছেন ? প্রবর্তিত নববিধি আবার কি বস্তু ? কেই বা প্রবর্তন করিল ? "চালক কহিল , "কিয়দ্দূর পদব্রজে গমন করলেই আপনি স্বয়ং ইহা উপলব্ধি করিতে *পারিবেন । "
* * * * * * *
সারারাত একরকম এপাশ ওপাশ করে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তরুণেশ। দীপনের ক্যানসার হয়েছে ! ওঃ ! যেন ফার্স্ট স্টেজে থাকে রোগটা ! মনের বোঝা যদি স্ত্রীর কাছে নামিয়ে একটু হালকা হওয়া যেত ! নাঃ ! দীপনের বারণ আছে। তাছাড়া বলা যায় না, হয়তো…. ঘুম ভাঙতে সামান্য দেরী হোল। প্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করলেন তা হল , " আজ অফিস যাব না।" তরুণেশের স্ত্রী এই ঘোষণা শুনে মোটেই বিস্মিত হলেন না, অফিসে গরহাজিরা দেওয়ায় তরুণেশ খ্যাতিমান। চা পান –ধূমপান – হেডলাইনে চোখ বোলানো পর্ব শেষ হতে সকাল ন'টা বাজলো – মোবাইল বের করে দীপনের নাম্বারে ফোন করল, তাঁর মোবাইল জানালো, 'পৌঁছানো যাচ্ছে না। ' সাড়ে নটাতেও একই উত্তর আশায় তিনি বিরক্ত হলেন, যাঃ বাবা ! এতক্ষণ ধরে নেটওয়ার্ক থাকবে না? দশটার সময় মোবাইলে রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর জানালো, "যে নম্বরটিতে তুমি কল করেছ সেটি এখন সুইচ বন্ধ করা আছে।" তরুণেশ ভাবলো, ট্রেনে যেতে যেতে সিটে বসে সুইচ বন্ধ রেখে ঘুমোচ্ছে বেচারা ! হয়তো সারারাত টেনশনে ঘুমোয় নি। আহা ! ঘুমোক ! দুপুর দেড়টাতেও সুইচ বন্ধ শুনতে পেয়ে বেশ অবাক হয়ে অফিসে ফোন করলেন, নাঃ ! অফিসেও যায়নি ! তাহলে ? কি ব্যাপার ? ওর বাড়ির কোন টেলিফোন নম্বর সেভ করে রাখার প্রয়োজন হয়নি, তাছাড়া নাম্বার জানা থাকলেও এখন কি ফোন করা উচিত ! বাইক চালিয়ে ওর বাড়ি এল, দরজা খুললেন মাসিমা। তরুণেশকে দেখে ভীষণ অবাক ! "কি হয়েছে বাবা ! কোন বিপদ আপদ ? অসময়ে বাড়িতে চলে এলে ? " মাসিমাকে আশ্বস্ত করতে অভিনয় করেন তরুণেশ, সজোরে হেসে উঠে বলল, " মাসীমা ! ঘাবড়াবেন না, দীপন অফিস যায়নি দেখে ওর মোবাইলে ফোন করলাম, এখনো সুইচ অফ করা আছে। ও কোথায় ? "
— ও তো কলকাতায় গেছে, ডাক্তার দেখাতে। এতক্ষণ ধরে একবারও ফোন করেনি বাড়িতে ! এমন তো কোনদিনই হয় না ! ঠিকঠাক পৌঁছেছে কিনা খবর দেয়, কারণে অকারণে ফোন করে। কি করে ওর খোঁজ পাওয়া যাবে বাবা ? ঝিমলি বহুবার ওকে ফোন করার চেষ্টা করেছে, পায়নি ! আমার তো চিন্তায় পেটের ভেতরে হাত-পা সেঁধিয়ে যাওয়ার যোগাড় !
" মাসিমা ! আপনি অকারণ চিন্তা করছেন ! আমার মনে হচ্ছে ওর মোবাইলটি চুরি গেছে বা হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে এত ব্যস্ত। আপনি চিন্তা না করে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমোন তো! এই কার্ডটিতে আমার ফোন নম্বর লেখা আছে। ঝিমলিকে বলবেন, দীপন বাড়িতে ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে যেন আমাকে জানায়। আপনাদের বাড়ির টেলিফোন নাম্বারটি বলুন তো ওটা আমি জানিনা। " মাসিমা নম্বরটি জানালে তরুণেশ তার মোবাইলে লিখে নিল, বিদায় নেবার আগে আবার বলল, " খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিন ! ও সন্ধ্যের আগে চলে আসবে অথবা ফোন করবে । আমি চললাম মাসিমা !
* * * * * * *
বাধ্যতাবশত : দুইচারি কদম অগ্রসর হইতে না হইতেই পথিপার্শ্বস্থিত একটি সুসজ্জিত বিপণি হইতে এক পরমাসুন্দরী যুবতী আসিয়া তাহার পথ অবরোধ করিয়া দাঁড়াইল। স্মিতমুখে যুবতী কহিল, " পথিক ! তুমি কর্কটব্যাধি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে অত্রস্থলে আসিয়াছ?" দীপন প্রত্যুত্তর পরিবার পূর্বেই সে পুনরায় কহিল , "আমরা সুলভে এই ব্যাধির চিকিৎসা করিয়া থাকি। আমাদের এই সংস্থাটি সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত কর্কট চিকিৎসা কেন্দ্র, 'কারসিকিওর' সংস্থার সহিত গ্রন্থিবদ্ধ। আমাদের উন্নতমানের যন্ত্রপাতি এবং অতিশয় খ্যাতিমান চিকিৎসক ও শল্যবিদগণ এই ব্যাধির অন্তিম দশাতেও সাফল্য অর্জনে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। এমন কি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও আমাদের সংস্থাকে শংসাপত্র প্রদান করিয়াছে ! "
বিড়ম্বিত দীপন কহিল, " মাফ করবেন ! আমি বিখ্যাত সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা করাতে এসেছি। কোন প্রাইভেট কোম্পানি বা নার্সিংহোমের খপ্পরে পড়ার ইচ্ছা আমার নেই।" যুবতীর হাসি নয়নলোভন এবং আকর্ষক। দীপনের অজ্ঞতাকে উপেক্ষা করিবার ভঙ্গিতে রহিল, "আপনি অন্তত দুই যুগ পূর্বেকার কথা কহিতেছেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পরিষেবা প্রদান কেন্দ্রিক মানসিকতায় পিছাইয়া পড়িয়াছে, ফলত : উক্ত প্রতিষ্ঠানের সমস্ত কিছুই অত্যধিক মূল্য দিয়া ক্রেতাগণ ক্রয় করিতে বাধ্য হয়েছেন। শুনিয়া আশ্চর্য হইবেনচ, তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগ করিতে প্রতিবার মাত্র দ্বাদশশত মুদ্রা এবং প্রতিবার রাসায়নিক ওষধি প্রয়োগ করিতে আমরা মাত্র চারিশত মুদ্রা গ্রহণ করিয়া থাকি! অনুমান করা যাইতে পারে , সর্বাধিক মাত্র ত্রিশসহস্র মুদ্রায় আপনার ব্যাধির সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। অনুগ্রহ করিয়া আমাদের কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করুন ! স্বচক্ষে সমস্ত কিছু ব্যবস্থার চিত্ররূপ কক্ষস্থিত যন্ত্রগণকের পর্দায় দেখিয়া সিদ্ধান্ত লউন ! "
সবলে নিজের কেশাকর্ষণ করিয়া দীপন বুঝিল, সে নিদ্রিত নহে। সুলভ চিকিৎসা এবং যুবতীর সাহচর্যের প্রলোভন সে দমন করিল। এই 'কারসিকিওর ' সংস্থার নাম অশ্রুতপূর্ব। যুবতীকে উপেক্ষা করিয়া দীপন অগ্রসর হইল। কিয়দ্দূর পরিক্রমা পরিবার পর সে পরমাশ্চর্য হইয়া উপলব্ধি করিল, ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তির সম্মুখে একাধিক বিকল্প রহিয়াছে ! কোন সংস্থার নাম 'কারসিকেয়ার 'কোনটি আবার 'কারসিথেরাপি' প্রভৃতি। প্রত্যেকেরই বক্তব্য,' তাহাদের চিকিৎসা কেন্দ্রটির ধার্য করা অর্থের পরিমাণই সর্বনিম্ন।' চরম বিভ্রান্ত এবং চঞ্চল চিত্তে সে এক শীতল পানীয় বিপণিতে প্রবেশপূর্বক কাষ্ঠাসনে উপবেশন করিল ।
ক্যাটক্যাটে লাল রংয়ের চুলের সেই খেঁকুরে মার্কা লোকটা যে গতকাল থেকে তাদের শহরের হাসপাতাল থেকে তাকে ফলো করছে সে তার পাশে এসে বসলেও তেমন গ্রাহ্য করে নি। কি কাণ্ড বাবা ! এ তো চৈত্র সেলের বাজার মনে হচ্ছে ! এ বলছে, 'আমার কাছে চিকিৎসা করান' তো ও বলছে,' আমরাই সবচাইতে সস্তায় চিকিৎসা করি।' এ তো স্বপ্নেও ভাবিনি ! কোথায় চিকিৎসা করাবো ডিসিশন নেওয়াই মুশকিল ! খেঁকুরে লোকটাও তারই মতন বিভ্রান্ত ! পাশে বসে বিড়বিড় করছে স্পষ্ট শুনল দীপন। " হুঁ: ! রোজগারের কত রকম জাল বিছানো বাবা ! কেউ ছ'শো টাকা নিচ্ছে রেডিওথেরাপির চার্জ তো কেউ নিচ্ছে চারশো ! কেমোথেরাপি কোথাও তিনশো তো কোথাও দুশো ! হুঁ হুঁ বাব্বা ! কমপিটিশন ওভাবে হয়না ! মুরোদ আছে তো বিনি পয়সায় চিকিৎসা করে দেখা ! তাহলে বুঝবো তোদের দৌড় কতদূর ! "
ও আচ্ছা ! এই লোকটিও তারই মতনই রুগী ! তাহলে ফলো টলো করছে না , তারই মতন বিভ্রান্ত , সমব্যথী যখন তখন ভদ্রতা করা উচিত। দীপন বলল , " হ্যাঁ ! তা যা বলেছেন! ওই বিনা পয়সায় চিকিৎসা চালু হওয়াটাই বাকি আছে খালি !" লোকটা এবার দীপনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, "বাকি আছে কি বলছেন ! চালু হয়ে গেছে গত বছর থেকে। চিকিৎসা করানোর জন্য স্পনসর পাওয়া যায় । আপনার লাগবে ?" এ তো শালা বদ্ধ পাগল অথবা নতুন ধরনের ফেরেববাজ মনে হচ্ছে ! এর কথায় সাড়া দেওয়াটাই গান্ডুর মতন কাজ হয়েছে। নাঃ ! উঠে পড়াই ভালো। দীপন উঠে দাঁড়ালো। লোকটা খুব অবাক হয়ে দীপনকে বলল, " কি হলো? বললেন না আপনার লাগবে কিনা ? একটি পয়সাও খরচা করতে হবে না। নার্সিংহোমে এসে শুয়ে পড়বেন, ডাক্তারের ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়ি যাবেন। খরচা করবে ' আদানি মেডিক্লেইম ইন্সুরেন্স কোম্পানি" দীপন লোকটির দিকে পিছন ফিরে বলল, "আমার কোন মেডিক্লেম করা নেই আর আমি কোনরকম পলিসি করতে চাইও না। "
— দরকার নেই ! আদানি কোম্পানি বছরে এক হাজার জন রুগীকে স্পনসর করছে। রুগীদের সঙ্গে কোম্পানির কনট্রাক্ট এটাই যে তারা কোম্পানির লোগোটি তাদের জামার বুকপকেটে লাগিয়ে রাখবে পাক্কা একটি বছর এবং একটা অ্যাড ফিল্মে খালি জানাবে যে আদানি কোম্পানি থেকে পলিসি করিয়ে তারা কিভাবে বিনা পয়সায় বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছে ! ব্যস ! এটুকুই !
লোকটির বাচালতায় ক্ষিপ্ত দীপন বলল, "আরে ! আমি কোন বচ্চন বা শচীন যে আমার জামার বুক পকেটে কোম্পানির লোগো রাখলেই আমার জন্য তোমার কোম্পানি পয়সা খরচা করবে , মামার বাড়ি নাকি ? "খেঁকুরে লোকটা ফিচেল হাসি হেসে বলল, "বেওয়ারিশ ডেডবডি রাস্তায় পড়ে থাকলে শোভাযাত্রা করে দাহ করার জন্য স্পনসররা এসে কামড়াকামড়ি করছে না ? টিভিতে দেখছেন তো?"
দীপন বেশ বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল। রাস্তায় পা দেবার আগে লোকটাকে বলল, "তুমি এখানে এলে কেন ? তোমার তো রাঁচি যাওয়া উচিত! পাগলামির চিকিৎসা ওখানেই হয়। "লোকটা হো হো করে হেসে উঠে দীপনকে বলল, "টিভি ক্যামেরা, ম্যাটাডোর ভ্যান, ফুলের ঝুড়ি নিয়ে এসে শবদেহ স্পনসর করা হচ্ছে না ? অবাক হচ্ছেন ! হ্যা :হ্যা :হ্যা : ! করছে করছে ! পলিটিক্যাল পার্টিগুলো করছে কিনা? তাদের পাবলিসিটির জন্য একটা লাশ দরকার। "আমার পার্টির লোককে খুন করেছে ওরা। সাথী, আমরা তোমায় ভুলছি না ভুলব না ! ল্যাংড়া পানু অমর রহে! "দেখছেন তো ? আর আপনি তো ক্যালা একটা জ্যান্ত মানুষ ! লোগো বুকে নিয়ে ঘুরবেন, বাজারে ,অফিসে যাবেন, টিভি অ্যাড একটা বছর ধরে! হ্যা: ! কম পাবলিসিটি ! সেই জন্যই তো আমাদের মতন এজেন্টদের কমিশনের ব্যবস্থাও আছে ।
— অ ! তুমি এজেন্ট ?
— হ্যাঁ ! না হলে আমার কি দায় পড়েছে আদানি মেডিক্লেম কোম্পানির হয়ে বলার ! আর এক বছর অব্দি ওরা এজেন্ট লাগাবে তারপর আর দরকার নেই বলছে। ততদিনে অবশ্যই ঝেড়ে পাবলিসিটি হয়ে যাবে, তাই না? এর মধ্যে যতটা পারি কামিয়ে নিই! আপনি খালি বাঁদিকের অফিসটাতে চলুন ! কনট্রাক্ট ফর্মটায় সই করবেন আর এজেন্টের নামের বাক্সটাতে আমার নামের সীল টা বসিয়ে দেব । তাহলেই মাসের শেষে আমার কমিশনটা পেয়ে যাব।
কে জানে সব দেখেশুনে দীপনের মাথা গুলিয়ে গেছে বোধ হয়, একটু ইতস্তত করে লোকটাকে বলল , "চলো ! কনট্রাক্ট ফর্মটি পড়ি ভালো করে ! "
— চলুন চলুন ! এ মাসে বাহান্নখানা জোগাড় করেছি ! বাম্পার সেল একেবারে ! চলুন স্যার ! নিজের চোখেই একবার দেখে নিন ! "কে জানে সব দেখেশুনে দীপনের মাথা গুলিয়ে গেছে বোধ হয়, একটু ইতস্তত করে লোকটাকে বলল, " চলো ! কন্ট্রাক্ট ফর্মটা পড়ি ভালো করে। শোন ভাই! আর একটা ব্যাপার –ইয়ে – একটা বুদ্ধি দাও দেখি! আমার মোবাইল থেকে আমার বাড়িতে কিংবা দু চারজন বন্ধুকে এমনকি আমাদের অফিসেও ফোন করতে পারছি না ! বাড়িতে মা বোন রয়েছে, তারা চিন্তা করছে, বেশ ঝামেলায় পড়েছি ! সবচেয়ে বড় কথা, ফোন করা যাবে না কেন? এটাই মাথায় ডুকছে না ! "উত্তর দেবার বদলে লোকটি চিন্তিত মুখে পকেট থেকে বিড়ির বান্ডিল বের করে দীপনকে বলল, " চলবে? "দীপন বিরক্ত মুখে ঘাড় নাড়তে সে নিজের বিড়িটি ধরাল তারপর ধীরে সুস্থে বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দীপনকে বলল, "নম্বর ডায়াল করার পর কি এনগেজড পাচ্ছেন নাকি নট রিচেবল? আপনার মোবাইল কি বলচে ?"
— কখনো 'নট রিচেবল' বলছে তো কখনো বলছে, 'এই নম্বরটির কোন অস্তিত্ব নেই '।
খেঁকুরে আবার বিড়ি টানল , সেই একই ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, "ল্যান্ডলাইনগুলো সব সারেন্ডার হয়ে গেছে। মোবাইল নাম্বারগুলো পাল্টে গেছে। কুড়ি বছর তো কম সময় নয় ! "
দীপন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ! তার শিক্ষা দীক্ষা রুচিবোধ সমস্ত কিছু ঢাকা পড়ে যায় বিরক্তিতে। এমনিতেও বিরক্তি ভেজা কাঠের ধোঁয়ার মতো, অবলীলায় মানুষকে ঢেকে ফেলে। মুখ ভেংচে সে বলে ওঠে, "দূর বোকাচোদা ! এ শালা একটা ডাহাঁ পাগলের পাল্লায় পড়ে গেছে ! আমি মরছি নিজের জ্বালায় আর এ শালা বছর মারাচ্ছে ! "
লোকটি গালাগাল শুনেও হেসেই বলে, " আচ্ছা আপনাকেও তো কেউ না কেউ ফোন করার চেষ্টা করছে ! তারা লাইন পাচ্ছে না কেন ? আপনি কুড়ি বছর এগিয়ে এসেছেন অথচ আপনার মোবাইলটিকে আপডেট করান নি ! তাই না ? "অবাক হয়ে দীপন প্রশ্ন করল, "কুড়ি বছর এগিয়ে এসেছি মানে? মোবাইল আপডেটেড – কি সব গাঁজাখুরি বকছ মাইরি!"
ধোয়া ছেড়ে খেঁকুরে বলে, "আপনার মাথা গুলিয়ে গেছে দেখচি ! এই জন্যই তো বলে, বিড়ি খেলে মাথা খুলে যায় ! বিড়ি সিগারেট টেনে কান দিয়ে ধোঁয়া বের করতে পারবেন ? হ্যা : হ্যা : হ্যা : ! পারে, পারে অনেকেই ! কুম্ভমেলায় গেলে দেখবেন অনেক সাধুই পারে এটা। ত ল্যান ! ধরেন, বিড়িটি টানেন বেশ মৌজ করে! দেখবেন , মাথাটি পরিষ্কার হয়ে যাবে ! তখন সমস্ত কিছুই জলের মতন পরিষ্কার বুঝে যাবেন। "
দীপন তাহার দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করিল। তাহা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, নাকি ধূমপানের আকর্ষণে তাহা উপলব্ধি করা সম্ভবপর হইল না।
কবিতাংশের জন্যে ঋণস্বীকার :-- শরৎ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ।