সরকারি কর্মচারিদের ডিএ পাওয়া কি একটা মৌলিক অধিকার?
না?
তাহলে ডিএ-র কোনো ন্যায্য অধিকার নেই বলছেন?
না, আছে। অধিকার তো বটেই। তবে মৌলিক অধিকার নয়।
একটু জটিল হয়ে গেল না স্যর?
যেখানেই রাজনীতি সে সবই জটিল হয়। জটিল হলেও সরল করে বোঝা সম্ভব। যদি ইচ্ছা থাকে।
যেমন?
যেমন, বাঁচার অধিকার আপনার আমার একটা মৌলিক অধিকার। মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার অধিকার সেই অধিকারের একটা উপপ্রাপ্য। যেমন, জীবন ধারণের উপযোগী বেতন পাওয়ার অধিকার, কিংবা সময়ের সমান্তরালে মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে বেতন বৃদ্ধির অধিকার – এগুলোও বাঁচার মৌলিক অধিকারের উপ-অধিকার।
সংবিধানে কি এই ভাবে জিনিসটা এত সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা আছে?
না, নেই। দেশের সংবিধান প্রণেতারা তার নাগরিকদের কিঞ্চিত বুদ্ধিমান বলে ধরে নিয়ে তৈরি করেছিলেন। সবই লিখে যেতে হবে, তাঁরা বুঝতে পারেননি। ডিএ হচ্ছে বেতন বৃদ্ধির একটা সরকারি ফরমুলা। দেশের অত্যাবশ্যক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সূচকের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ফরমুলাটা তৈরি। সরকারি অসরকারি সকল কর্মচারির জন্য সেটা প্রযোজ্য।
তাহলে যে রাজ্য সরকার বলছে, ডিএ কোনো অধিকার নয়, রাজ্য সরকার চাইলে দিতে পারে, নাও দিতে পারে?
রাজনৈতিক লোকেরা অমনিই বলে। সরকারে থাকলে এক রকম বলে। আবার বিরোধী পক্ষে থাকলে আর এক রকম বলে। নিয়ম জেনে বা মেনে বলে না, যা বললে ভোটুল রাজনীতিতে সুবিধা হবে সেই অনুযায়ী বলে।
বলেন কী? সুবিধা অনুযায়ী বলে?
তা নয়ত কী? এই যে মুখ্যমন্ত্রী একবার বললেন, সমস্ত ডিএ দেওয়া হয়ে গেছে, এখন আবার ৩ শতাংশ দিয়ে বলছেন আর দিতে পারব না, তার চাইতে আমার মুন্ডু কেটে নাও – এটা বলেন কী করে? আদালতের আওতায় এখন উনি আর সব দেওয়া হয়ে গেছে বলতে পারছেন না, সেই জন্য মুন্ডু অফার করছেন!
ভারি তাজ্জব ব্যাপার তো!
হ্যাঁ, তাজ্জবই বটে!
আচ্ছা, এই যে অনেকেই বলছেন, শিক্ষক রাজ্য সরকারি কর্মচারিরা অনেক টাকা বেতন পান, তাদের আর ডিএ লাগবে কেন – এই ব্যাপারে আপনার মত কী?
হাসালেন দাদা। মন্ত্রী এমএলএ-রাও অনেক টাকা বেতন ও ভাতা পান। মাসে অন্তত আড়াই লাখ টাকা। তার উপর ট্রেনে বাসে প্লেনে যাতায়াতে পয়সা লাগে না। সরকার থেকেই গাড়ি তেল এবং ড্রাইভার পান। ওঁদের ফোনের বিল সরকার মেটায়। দেশে বিদেশে চিকিচ্ছেয় পয়সা লাগে না। তা, ওনারা কি ওদের প্রাপ্ত ডিএ প্রত্যাখ্যান করেছেন? শুনেছেন কখনও?
না, তা শুনিনি।
যে সব বর্তমান বা প্রাক্তন কেন্দ্রীয়/রাজ্য সরকারি কর্মচারি ডিএ-র দাবিকে বিরোধিতা করে গবেষণা চালাচ্ছেন, তাঁরা কেউ ডিএ ফেরত দিয়ে ফেলেছেন বলে আপনার কাছে খবর আছে?
উঁহু, আমার কাছে সেরকম কোনো খবরও নেই।
এই যে সংলাপন বাঁড়ুজ্জে অবসর নেবার পর মোটা অঙ্কের পেনসন পাচ্ছেন, প্রচুর টাকা নিয়ে দপ্তর ছেড়েছেন, তা ওনাকে চাকরির শেষে অবিলম্বে কী একটা কুরসিতে বসিয়ে আবার মাসে মাসে আড়াই লাখ টাকা দিচ্ছে – এই ব্যাপারে সেই সব পণ্ডিতদের মতামত শুনেছেন কিছু? তার জন্য কারুকে মুন্ডু কেটে ফেলতে হল কি?
না, তাও শুনিনি। সেটাও হয়নি।
ওনার পরিবারের সমস্ত সদস্যদের বিবিধ চাকরিবাকরি দিয়ে পোষণ করা হচ্ছে কেন – জেনেছেন?
না, সত্যিই জানি না এত সব কাণ্ড!
দিল্লির বঙ্গভবনের কর্মচারিদের বেতন ও পুরো ডিএ দেওয়া হয়, জানেন কী?
না, তা জানি না। বলেন কি মশাই? সত্যি বলছেন?
সত্যিই বলছি। ওসব জায়গায় কেউ যাবেই না ঠিকঠাক বেতন ও ডিএ চুকিয়ে না দিলে। মন্ত্রীফন্ত্রীরা গিয়ে ওখানে থেকে ফুর্তি করবে কীভাবে তখন? তাহলে বুঝতে পারছেন, আপনি এধারে ওধারে যা শুনছেন তার অনেকটাই মিছা কথা? আমরা যারা ডিএ পাচ্ছি, নিতে থাকব। অন্যেরা দাবি করলে চেঁচামেচি করব – কেন, কেন এত চায়?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। আচ্ছা, কেউ কেউ এও বলছেন, দেশের শ্রমিক কর্মচারিদের ৯৪ শতাংশই অসরকারি এবং তারা ডিএ পায় না। মাত্র ৬ শতাংশ সরকারি কর্মচারির খুব খাঁই। বিশাল অঙ্কের বেতন চাই, সেই সঙ্গে ডিএ চাই। আরও কত কিছু চাই! এই সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এভাবে বললে, দেশের অর্ধেক লোক পেট ভরে খেতে পায় না। আপনিও কাল থেকে এক বেলা উপোস করতে থাকুন। দেশের বেশির ভাগ যুবক যুবতী হয় চাকরি পাচ্ছে না, অথবা পেলেও খুব কম মাইনেতে কাজ করছে। আপনিও আপনার ছেলে বা মেয়েকে বড় বেতনের চাকরি থেকে ছাড়িয়ে এনে প্যারা টিচার পদে যোগ দিতে বলুন। সরকার এবং সেই সব কোম্পানির অনেক টাকা সাশ্রয় হবে। দুচারটে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি হোক। বলবেন তো?
না, সে আর কী করে বলি?
তাহলে শুনুন। এবার একটু নীতিশিক্ষা দিই কেমন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।
দেশের সমস্ত শ্রমিক কর্মচারিদের জন্যই ন্যায্য বেতন ও ভাতা দাবি করাটাই স্বাভাবিক। সে সরকারি হোক বা অসরকারি। সরকারি কর্মচারিদের ক্ষেত্রে সরকার দিতে পারে। অসরকারিদের ক্ষেত্রে সরকার অনুরোধ করতে পারে। পুরনো ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে কথা বলুন। বিশ বছর আগেও বিটি রোডের ধারে অসরকারি জুটমিলগুলিতে দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মজুরি এবং ডিএ নিয়েও দর কষাকষি হত। নেতারা অনেক সময় বলতেন, ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক নিয়ে নানা রকম কারচুপি হচ্ছে।
এটা আপনি ঠিক বলেছেন। আমার বাবার কাছেও এরকম কথা শুনেছি বলে মনে পড়ছে। পয়েন্ট ফয়েন্টের কী সব কথা বলতেন।
বিশ্ব পুঁজিবাদ উদার হয়ে ওঠার পর থেকে অসরকারি মালিকরা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারদের বদান্যতায় এখন শ্রমিকদের মাইনেই ঠিক মতো দেয় না, তার ডিএ। সেই অব্যবস্থাটা সরকারও এখন তার এলাকায় চালু করতে চাইছে। ঠিক যেমন অসরকারি ক্ষেত্রের দেখাদেখি স্থায়ী লোকের বদলে ঠিকা কর্মচারি এখন সরকারও নিয়োগ করছে। কম বেতনে কাজ হবে। অন্যান্য ভাতা এবং সুযোগসুবিধা দিতে হবে না। এরকমই চলা উচিত নাকি?
অবশ্যই না। তবে কেউ কেউ বলছেন, এত কর্মচারিকে এক সঙ্গে এত টাকা বকেয়া ডিএ মেটাতে গেলে সরকার পথে বসবে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের প্রাপ্য টাকাই দিচ্ছে না। রাজ্য কোথায় পাবে?
সেটা সত্যিই একটা বাস্তব সমস্যা। তবে তার জন্য আন্দোলনকারি শ্রমিক কর্মচারি শিক্ষকদের সঙ্গে মিলিত ভাবে রাজ্য সরকারও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করুক, ধর্নায় বিধায়ক সাংসদদের বসিয়ে দিক।
এটা ভালো বলেছেন তো।
হ্যাঁ, আর মামলাগুলি তুলে নিলেই অনেক টাকা বেঁচে যাবে। জেলায় জেলায় বিশাল কনভয় নিয়ে রাজকীয় পিকনিকের স্টাইলে সভা বন্ধ করে নবান্নেই জেলার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ডেকে এনে মিটিং করা উচিত। মাসে বেশ কয়েক কোটি টাকা তাতেও বাঁচবে। আর এই সব পিঠে খিচুড়ি ম্যাগি উৎসব ইত্যাদি না করলেও চলবে। ক্লাবগুলিকে দুর্গাপূজায় অনুদান না দিয়ে, বিদ্যুতের বিল মকুব না করলে রাজ্য সরকারের অনেক টাকা সাশ্রয় হতে পারে। এগুলির জন্য একটা মাথা শুধু নয়, মস্তিষ্কওয়ালা মাথা দরকার ভাই! এইটে দেখুন যদি রাজ্য মন্ত্রীসভাকে যোগাড় করে দিতে পারেন!