পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পিসির সাইকেল

  • 03 September, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 609 view(s)
  • লিখেছেন : জয়ন্তী মন্ডল
দীপু সাইকেল টা উঠোনে রেখে যাবার পর অজিতেশ অনেকক্ষণ সাইকেলটাকে পরখ করছিল। সুচেতনা ভাইঝি কে পুকুরের বাঁক টা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে উঠোনে পা দিতেই অজিতেশ বলল, এই রংচটা ঝড়ঝড়ে সাইকেলটা নিয়ে কি করবে? সুচেতনা শুকনো মুখ করে সাইকেলটা দোর দিকে তুলে রাখতে রাখতে বলল, এখন আর উপায় কি? তাছাড়া কবে মোটর বাইক কিনবে তবে চাপব। সে ও তো পরের উপর ভরসা করে বসে থাকা। আমি তো মোটরবাইক চালাতে পারি না। তাই এখন এইটাই আমার পক্ষীরাজ বলতে পারো।

তারপর কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বলল,

কতদিন এখানে থাকতে হবে কে জানে। এমন হঠাৎ করে লকডাউন করে দেবে  কে জানে!

অজিতেশ একটু বিরক্তি নিয়ে বলল এই লেডিস সাইকেলটাই চেপে আমি কিন্তু বাজারে যাব না।

সুচেতনা বলল, বেশ তো এখানে বাজারটা না হয় আমিই করব।

এতক্ষণ সুচেতনা একটা ছেড়া কাপড় দিয়ে সাইকেলটা মোছামুছি করছিল।

এমন সময় ওদের জন স্বরূপ মুখে গামছা বাধা অবস্থায় দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে দাদাবাবু তোমরা কি কলকাতা থেকে লকডাউনের জন্য চলে এলে।

অজিতেশ বলল লকডাউন হবে জানলে কি আসতাম গো। সব আমাদের কলকাতায় পড়ে রয়েছে আর এই গ্রামের বাড়িতে না আছে চাল ডাল। না আছে জামা কাপড়।

এই দেখো না হাট বাজার যাওয়ার জন্য তোমার বৌদি ওর বাবার বাড়ি থেকে এই পুরনো সাইকেলটা আনিয়েছে। এদিকে হাট বাজারই তো সব বন্ধ। তার ওপর সাইকেলের অবস্থা দেখো শুধু পুরোনো নয় একেবারে ঝড়ঝড়ে।

স্বরূপ মুখে ঘামছা ঢাকা অবস্থায় দূর থেকে জিজ্ঞেস করলে বৌদি এটা কি তোমার ভাইঝি দীপুর সাইকেল।

সুচেতনা বলল না গো স্বরূপ, আমি যখন স্কুলে পড়তাম বাবা তখন আমায় সাইকেলটা কিনে দিয়েছিলেন। স্কুলে যাবার জন্যে। সে প্রায় নাই নাই করে বিশ পঞ্চিশ বছর তো হবে। একটু আধ টু সারিয়ে নিলে বেশ চলবে। কি বলো ?

কিন্তু কে এই লকডাউনে সাইকেলটা বাজার থেকে ঠিক করে এনে দেবে। তাই ভাবছি।

স্বরূপ বলল, আমাকে দিও বৌদি আমি গঞ্জ থেকে ঠিক করে এনে দেবো।

সুচেতনা খুব খুশি হয়ে বলল, তবে তো খুব ভালো হয়। তোমার দাদাবাবুর আবার লেডিস সাইকেলে চড়লে মান যাবে। তাই এখানে আমিই এতে চেপেই বাজার হাট করব।

স্বরূপ বলল তবে আমি কাল সকালে এসে সাইকেলটা নিয়ে যাব।    

পরদিন সকালবেলায় স্বরূপ সাইকেলটা নিয়ে চলে গেল।

সুচেতনা স্বরূপ কে বলল দেখো  হাতে পায়ে যেন না লাগে। সাইকেলটার অনেক জায়গায় জং ধরে গেছে।

স্বরূপ মুখে গামছা বাঁধা অবস্থায় হ্যাঁ, না কী বলল বোঝা গেল না।

দিন দুই পর স্বরূপ সাইকেলটা এনে যখন উঠোনটাই দাঁড় করাল তখন বোঝা গেল না যে দুদিন আগের সেই সাইকেলটা।

সুচেতনা বলল, বাহ্ কি চমৎকার হয়েছে! যেদিন  বাবা নতুন এনেছিলেন সেদিনের মতই লাগছে।

স্বরূপ  মুখের বাঁধা গামছাটা সরিয়ে বলল, ছোট বৌদি তোমার সাইকেল নয় যেন পঙ্খীরাজ ঘোড়া। পুরোনো জিনিষ কিনা। সাইকেলটাই যেন জাদু আছে ।

সূচেতনা বলল, জাদু! কেন?

স্বরূপ বলল,  চালিয়ে বুঝতে পারবে।

স্বরূপের মুখ থেকে কথা গুলো শুনে সুচেতনার আনন্দে মনটা ভরে গেল। বাবার কেনা সাইকেলটাই কতদিন পর সে চাপবে। নিজের মনেই ভাবল লক ডাউন হল  বলেই সাইকেলটা চাপার দরকার পড়ল। এও বেশ। জীবনে এমন একসময় আসে যখন কবেকার বাতিল জিনিষ একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সময় বুঝিয়ে দেয় জীবনে পুরোনো মানে বাতিল নয়।

স্বরূপ চলে গেলে সুচেতনারা কলকাতা থেকে আসার পথে বাজার থেকে যে টুকু আলু সবজি এনেছিল তাই সুচেতনা বটি নিয়ে কাটতে বসল। যাহোক একটা তরকারি বানাতে হবে।

তাড়াতাড়ি রান্না সেরে একবার পিচ রাস্তায় সাইকেলটা নিয়ে চালাতে যাবে। এক তো অনেকদিন সাইকেল চালাই নি। তারওপর এটা শ্বশুর বাড়ি। সাইকেল চালাতে কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল সুচেতনার।

ভাবছিল, পিচ রাস্তায় চলে গেলে ওখানে কে আর কে চেনে সুচেতনাকে। যারা চিনত তারাও  এখন অনেক বদলে গেছে। ফলে সুচেতনা নিজে না পরিচয় দিলে ওকে কেউ চিনতে পারবে না।

বিকেলে সাইকেলটা নিয়ে বের হবে আসিফ ভাই এল। ওরা এসেছে শুনে খবর নিতে এসেছে। তবে সকলেই গামছায় মুখ ঢেকে দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।

আসিফ এর সঙ্গে দু চার কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে নেমে এলে আর সেদিন সাইকেল নিয়ে বের হওয়া হল না সুচেতনার।

পরদিন সুচেতনা আর দেরি করল না। গ্রামের মানুষজন একে অপরের খবর নিতে ভালোবাসে। দেরি করলে কেউ না কেউ এসে পড়বে।

বিকেল নামতেই চটপট  ঘর থেকে একটা ব্যাগ সাইকেলের সামনে বাক্সটাই রেখে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সুচেতনা।

কোনোদিকে না তাকিয়ে এক ঝোঁকে সাইকেলটা চালিয়ে গিয়ে উঠল বাঁধা রাস্তার পিচে। তারপর চমকাইতলার ডাঙ্গা, ফুটবল খেলার মাঠ, নিশ্চিন্দিপুর পেরিয়ে গিয়ে পড়ল বাঁশদার জঙ্গলের মাঝ বরাবর পিচ ঢালা রাস্তায়।

ইউক্যালিপটাস এর ঘন জঙ্গল আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সুচেতনা সাইকেল থেকে নেমে বনের ধারে এসে দাড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ আকাশ পানে গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুচেতনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে করছিল গাছগুলো লাগানোর সময়ের কথা।

তখন গোটা গাঁয়ে যেন একটা উৎসব পড়েছিল ইউক্যালিপটাস গাছগুলো লাগানোর সময়।

সুচেতনারাও হাত লাগিয়েছিল গাছ লাগানোয়। আসলে ওদের স্কুল থেকে দায়িত্ব  দিয়েছিল গাছ লাগাতে।

সকাল বেলা উঠে সাইকেলে করে পঞ্চায়েত থেকে চারা আনত ওরা। দশটা থেকে হেড স্যারের তত্বাবধানে ছেলেরা গর্ত করত আর সুচেতনারা কুয়ো থেকে জল তুলে গাছ পুতত।  তখন মর্নিং ইস্কুল চলছে।পরদিন সকাল সকাল এসে গাছে জল দিতে হত।

একটু গা আঁধারি মত হতেই সুচেতনা আর দাড়ালো না। ফেরার পথ ধরল।

বনের শেষে চমকাইতলা পার হয়েছে ঝুপ করে সন্ধে হয়ে গেল।

অন্ধকার তেমন গাঢ় হয়নি। আকাশে আধখানা চাঁদ। পিচ রাস্তার ওপর দিয়ে সাইকেল নিয়ে চলেছে সুচেতনা। মনে  হচ্ছে যেন রাস্তা জুড়ে লম্বা তালায় পেতে দেওয়া আছে।

একটুও ভয় লাগছে না সুচেতনার। বেশ লাগছে । মনে হচ্ছে চাঁদ বুড়ি সুচেতনার জন্য পথে সব আলো ঢেলে দিয়েছে। কতদিনের পরিচিত সব রাস্তা। একই রকম আছে। শুধু পথের দু পাশে গাছগুলো একটু ফাঁকা হয়ে গেছে।  মনে হয় বর্ষায় পঞ্চায়েত থেকে গাছের ডাল গুলো কেটে ফেলেছে।  গ্রামের মানুষ এটাকে ডালানো বলে। আর রাস্তায় লাল কাঁকরের বদল কালো পিচ।

 

নিজের মনেই কত কি ভাবছে। এখন বাবার কথা খুব মনে পড়ছে সুচেতনার। গান শিখে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেলেই বাবা এগিয়ে আসতেন সাইকেল নিয়ে।

ভয় করছে নাকি?

গলাটা খুব চেনা। সুচেতনা  পিছন ফিরে তাকাল।

যা ভাবছিল ঠিক তাই। শ্যামলেন্দু সাইকেলে সুচেতনার পাশে সাইকেলে চলেছেন!

সুচেতনাকে অবাক হতে দেখে শ্যামলেন্দু বললেন অবাক হলি তো?

সুচেতনা কি বলবে না বলবে ভেবে বলল, অবাক হব না? তুমি এখানে? কি করে?!

আলো আঁধারির মধ্যেই সুচেতনা দেখল শ্যামলেন্দু মুচকি হাসছেন। মুচকি হাসতে হাসতেই বলল, তুই একা এই অন্ধকারে ভয় পেয়ে যাবি তাই চলে এলাম।

শ্যামলেন্দু বলল, তোর মনে আছে একবার তুই চিত্ত মাষ্টারের কাছে গান শিখে বাড়ি ফিরিস নি দেখে আমি চলে এসেছিলাম এখান পর্যন্ত।

সুচেতনা বলল বেশ মনে আছে। তারপর চমকাইতলায় গিয়ে চায়নাদির দোকানে তু্মি আমায় জিলিপি কিনে খাওয়ালে।

শ্যামলেন্দু বলল, সে সব এক দিন ছিল। গরম পড়লে তোদের দুই বোনকে সাইকেলে চাপিয়ে চমকাইতলা দিকে বেড়াতে নিয়ে আসতাম।

সুচেতনা বলল, দেবলীনা কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাইত না। ওদিকে ভানু মাষ্টার এসে বসে থাকতেন। সে যে কি কাণ্ড হতো তখন।

আমরা ফিরলে তোদের মা কুজোর জল দিয়ে কচি আমের সরবত করে দিত।

সুচেতনা বলল, আর ঠাকুমা। ঠাকুমা রামায়ণ খানা নিয়ে বসে থাকতেন। আমি গিয়ে পড়ে শোনাব বলে। এখন সে সব যেন পুরাণ কথা। এখন কেউ সন্ধে বেলা রামায়ণ, মহাভারত বা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে না। পড়ে শোনাতেও বলে না। সন্ধে হলেই সব টিভিতে সিরিয়াল দেখতে বসে যায়।

শ্যামলেন্দু বলল, এর ভালোও যেমন। আবার খারাপ দিকও আছে।

তখন আমাদের গ্রামে ছেলে মেয়েরা কত  ভালো গান করত। ভালো নাটক করত। কিন্তু এত মিডিয়ার যুগ ছিল না। সব কোথায় হারিয়ে গেল। এখন ছেলেমেয়েরা গান, বাজনা, নাটক, নৃত্য  যাই শিখুক ভাল ট্রেনার পায়,  টিভি তে, সিরিয়ালে জায়গা পেয়ে  কত নাম ডাক হয়। অর্থ ও রোজগার করে। জীবনটা সুন্দর হয়ে ওঠে।

তখন ভালো গান গাইতে পারা মানে বিয়ের বাসরে, পাড়ার সরস্বতী পুজোয়, দুর্গা পুজোর প্যান্ডেলে বিনি পয়সায় গান গাওয়া। পাওনা বলতে একটু চা বিস্কুট। বড়ো জোর একটা প্যাকেট। তাতে মিষ্টি, শিঙ্গাড়া। একটা গজা। ব্যস।

পেঁচার মোড়ে শিবুর সঙ্গে দেখা। সুচেতনাকে দেখে চিনতে পেরে শিবু বলল, কিরে একা একা কোথায় গিয়েছিলি।

চমক ভাঙ্গল সুচেতনার।  এদিক ওদিক তাকাল। কোথায় শ্যামলেন্দু।

একটু অন্যমনস্ক হয়েই বলল, এই চমকাইতলার দিকে বেড়াতে গিয়েছিলাম।

সাইকেল কিনলি?

 না না। এখানে সাইকেলের দোকান কোথায় পাব? স্কুলে যাওয়ার জন্য বাবার কিনে দেওয়া পুরোনো সাইকেলটা।

শিবু বলল এখনো তো বেশ চলছে।

একটু সারিয়ে নিতে হল। আর কথা বাড়াল না সুচেতনা।

পেঁচার মোড় পেরিয়ে মেঠো পথ ধরল সে। এরপরও কুমোর পাড়া পেরিয়ে বেশ খানিকটা ফাঁকা মাঠ পার হতে হবে তাকে। বাড়ি পৌঁছতে একটু দেরি হবে। তা হোক।

কুমোর পাড়ার পাশ দিয়ে যাবার সময় ভাবছিল একটা কুজো কিনে নিয়ে যাবে।

কলকাতায় ফ্রিজ। এখানে টুলু পাম্প মেশিন চালিয়ে ঠান্ডা জল তোলা। কতবার আর টুলু পাম্প মেশিন চালানো যায়। তাই একটা কুজো কেনা।

পথে কুমোর পাড়া্র সাজানো মাটির পসরা দেখে সুচেতনার মনটাও কুজোর জলের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। শেষে অনেক দেখে শুনে কুজোর বদল একটা বড় কলসী কিনে বাড়ির পথ ধরল সে।

কলসী তো নয় যেন আস্ত জালা।

দোকানি বেশ ভালো করে সাইকেলের পিছনের সিটে কলসীটা দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলেন।

কতদিন পর গ্রামের কুমোর পাড়ায় এসেছে সে।

খুচরো পয়সা রাখার জন্য একটা লক্ষ্মীর ভাঁড়,  দুটো মাটির গ্লাস, ফুলদানি কত কি যে কিনে ফেলল সুচেতনা।

লক্ষ্মীর ভাঁড়, গ্লাস, ফুলদানি সাইকেলের সামনের বাক্সতে রাখল ঠিকই কিন্তু সমস্যা হল মাটির কলসী টাকে নিয়ে। যেই না সাইকেল চলতে শুরু করল অমনি কলসীটা সাইকেলের পিছনের মালগার্ড টাতে ঘষা লেগে টং টং করে শব্দ হতে লাগল।

শব্দ হতেই সুচেতনা সাইকেল থেকে নেমে ঠিক করে বেঁধে আবার চলতে শুরু করল।

একটু পরেই আবার সেই টং টং শব্দ।

সুচেতনা এবার সাইকেল থেকে নেমে বাম হাতে সাইকেলটা আর ডান হাতে কলসীটা ধরে হাঁটা দিল।

একটু কষ্ট হলেও বিকেলের ঝিরঝিরে বাতাসে ভালোই লাগছিল সুচেতনার।

আবার একটু  হাঁটার পর ডান হাতটা ভারী লাগলে কলসীটা নামিয়ে রেখে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল সে।এবার কলসীটা তুলতে যাবে দ্যাখে কলসীটা এক হাতে ধরে দাঁড়িয়ে সাবু পিসি।

 সুচেতনার দিকে তাকিয়ে  মুচকি হেসে বলল, চল।

সুচেতনা চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বলল,

ওমা সাবু পিসি?  বলে কি একটা বলতে যাবে সাবু পিসি বলল,

আর দাঁড়াস না। সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তখন সেবার কার মত গাড্ডায় পড়বি।

সুচেতনা সাইকেলটা এক হাত এ ধরে বলল, বাব্বা সেবারকার কথা আর বোলো না।

পিসি ফিক করে হেসে বলল, তোর মনে আছে তাহলে? কামারপুকুর মেলা থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। তারপর অন্ধকারে সরষে খালের জলে কেমন দুজনে পড়লাম।

সুচেতেনা বলল, তারপর বাবা কেমন বকল দুজনকে।

সাবু পিসি বলল, আমি পিছনের সিটে কলসীটা ধরে বসচ্ছি। আর অসুবিধে হবে না।

এবার সুচেতনা নিশ্চিন্ত মনে সাইকেলে চেপে বসে প্যাডেলে পা দিল। গড়গড়িয়ে চলল সাইকেলের চাকা। সঙ্গে চলল পিসি ভাইঝির গল্প।

সাবু পিসি বলল আমার খুব ইচ্ছে ছিল রে সাইকেলে চেপে  কুসুম পুরের হাট থেকে তোর মতো এক ব্যাগ বাজার করে আনবো। নিজের ইচ্ছেমতো জিনিস কিনব। তাঁতী ঘর থেকে আসন সেলাই করা সুতো কিনব।

তারপর একটু থেমে বলল, কোনদিন ইচ্ছে হত সাইকেল নিয়ে চলে যাব ধান ঝরির মাঠ পেরিয়ে শানমুড়া গ্রামে শুভঙ্করদার বাড়ি। কিন্তু বাবা কিছুতেই সাইকেলে চড়তে দিলেন না।

তারপর একটু আবেগপ্লুত হয়ে সাবু পিসি বলল, আমি কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে সাইকেলে চড়া শিখেছিলাম।

সুচেতনা বলল, তাই নাকি!

সাবও পিসি বলল হ্যাঁরে আহেরের ডাঙ্গায় ছেলেরা যখন সাইকেল চালাত, আমি বিকেলের দিকে পুকুরে কলসী করে জল আনতে এসে কখনো দীপুর, কখনো হারুর কাছ থেকে সাইকেল চেয়ে নিয়ে সাইকেল চড়া শিখেছিলাম। বাড়ির কেউ জানত না।

সুচেতনা চোখ বড় বড় করে বলল, এখন মনে আছে। চালাতে পারবে?

সাবু পিসি বলল হ্যাঁ, পারবো না আবার। তুই একবার সাইকেলটা আমায় দে। তোকে কেমন চাপিয়ে নিয়ে যেতে পারি দ্যাখ।

সুচেতনা একটু ভেবে বলল, কিন্তু তুমি শাড়ি পরে সাইকেল চালাতে পারবে? তাছাড়া তুমি….বলে কি একটা বলতে গেলে সাবু পিসি করুণ হাসি হেসে বলল, আমি এখন ওপারের মানুষ ঠিকই । আসলে জানিস সূচি মানুষের দেহটাই শুধু পঞ্চভূতে বিলীন হয়। মন পড়ে থাকে এখানে। তখন কোনো অসুবিধে সমস্যা বলে মনে হয় না।

সুচেতনা বলল, বেশ তো তবে তুমি চালাও আমি পিছনে বসি।

সাবু পিসি সুচেতনার হাতে মাটির কলসীটা দিয়ে চেপে বসলো সাইকেলের সিটে।

কে বলবে এতদিন পর পিসি সাইকেলে চড়ছে। মনেই হবে না।

সাবু পিসি সাইকেলটাই চড়ে বসে প্যাডেল পা দিল। সাইকেল চলতে শুরু করলে,পিসি আবার গল্প শুরু করল।

সুচেতনাকে সাবু পিসি ছোটো বেলায় সূচি বলেই ডাকত। 

বলল জানিস সূচি, একদিন হারুর কাছে সাইকেল নিয়ে লুকিয়ে শুভঙ্করদার  বাড়ি শানমুড়া চলে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। বাবা, ঠাকুমা আমার খোঁজ করতে করতে অস্থির। পাল পুকুরের মোড়ে হারুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবার সন্দেহ হয়।

বাবা হারুকে একটু ধমক দিতেই হারু ভয়ে সব বলে ফেলল, সাবুদি সাইকেলটা নিয়ে শানমুড়া গেছে।

ব্যাস। বাবার আর বুঝতে অসুবিধে হল না শুভঙ্কর দার আমাদের বাড়িতে আনাগোনার কারণ।

বাবা দাঁড়িয়ে ছিলেন পাল পুকুরের মোড়ে আমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখে। ধরা পড়ে গেলাম।

তারপর থেকে শুভঙ্করদারও আমাদের বাড়ি আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমার লুকিয়ে সাইকেল শিখে শুভঙ্করদার বাড়ি যাওয়ার সত্যটাও বাড়ির দরোজায় ঢোকার আগেই উধাও হয়ে গেল।

সুচেতনা মিনতির সুরে বলল, চলো না পিসি আজ আমরা শানমুড়া যায়।

সাবু পিসি কি একটা ভেবে বলল, চল আজ পিসি ভাইঝি দুজনে গিয়ে শুভঙ্করদাকে চমকে দিই।

কুমরির ডাঙ্গা, ধান ঝরির মাঠ পেরিয়ে শানমুড়া গাঁয়ের দিকে চলল পিসি আর ভাইঝি।

 

 

 

 

  

     

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment