জাতীয় এম্বলেম বিতর্কে গত কয়েক দিন ধরে পক্ষে বিপক্ষে নানান গুণী মানুষ নানান দৃষ্টিকোণ থেকে দল পাকিয়ে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। একদলের বক্তব্য লারসন এন্ড টুব্রোর মত কর্পোরেটে কাজ করা মারাঠি শিল্পী সুনীল দেওরে যে রাষ্ট্রীয় বরাতি শিল্পকর্ম উৎপাদন করেছেনসেটা খুব খারাপ নিদর্শন হয়েছে; মোট কথা দেশের অপমান; অন্যদিকে রাষ্ট্রবাদী জাতীয়তাবাদী দলের বক্তব্য এই ধরণের সিক্স প্যাক সিংহই নতুন কর্পোরেট ভারতের ভিত্তি; নরেন্দ্র মোদি নতুনসিংহ তৈরি করে ভারতের সম্মানই বৃদ্ধি করেছেন।
আমি পুরো ব্যপারটাকে দু’ভাবে দেখার চেষ্টা করব -
১) প্রাচীনকালের তুলনায় আধুনিক কালেরকারিগরদের দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে কী না,
২) এই ধরণের শিল্প যদি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তৈরি করা হয়, তাহলে তার পিছনের রাজনীতিটিকেও বোঝার চেষ্টা করব।
আমি যদি কারিগরদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টাকে দেখতে চাই আশা করি পাঠকেরা বিরক্ত হবেন না। এখনও নোটবন্দীর ক্ষত, জিএসটির তীব্র মারের ক্ষত সহ্য করে গ্রামেগঞ্জের হাটে বাজারে, শহরের নিম্নআয়ের লোকালয়ে কর্পোরেট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিরন্তর লড়ে যাওয়া হকার-চাষী-কারিগরদের সংগঠনের একজন হয়ে চলতি বিতর্কের বাইরে দাঁড়িয়ে একটু অন্য কথা বলতে চাই - আমি অন্ততএই আধুনিক শিল্পসৃষ্টি কাণ্ডে আধুনিকপূর্ব সময়ের কারিগরদের গৌরবই লক্ষ্য করছি। যে শিল্পকর্ম অনুসরণ করে, বঙ্গ-পাঞ্জাবভাগের আশেপাশের সময়ে জাতীয় এম্বলেম তৈরি হল সেটি আদতেএশিয় রেশমপথের কেন্দ্রে থাকা বিশ্বের অধিকাংশ শিল্প এবং কৃষি উৎপাদন উৎপন্ন করা দক্ষিণ এশিয়ার বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থার ধারক বাহককারিগর শিল্পীদের হাতে তৈরি শিল্পকর্মের প্রতীক। গত কয়েক দিন ধরে যে বিশালকায় চার-সিংহর ‘শিল্পকর্ম’র বাগাড়ম্বরআমরা দেখছি, সেটি মূলত গত আড়াইশ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রণোদিত অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং তাদের দেশিয় কোলাবরেটারদের জীবন-জীবিকার স্বার্থ নিশ্চয় করতে ব্রিটিশপূর্ব বিকেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকা চাষী-হকার-কারিগরের দেশিয়, বিশ্ববাজার ধ্বংস করে যে কেন্দ্রিভূত ইওরোপমন্য কর্পোরেট উৎপাদন ব্যবস্থারগড়ে উঠেছে, তার দার্শনিক প্রতিভূ।
দুটো শিল্পকর্মের লক্ষ্যেরও পার্থক্য রয়েছে। একটি বিনয়ী, আত্মবিশ্বাসী, সমৃদ্ধশালী, স্বনির্ভর সমাজ ব্যবস্থাজাত শিল্পকর্ম – যে সময়কার উৎপাদন, সমাজ, অর্থনৈতিক পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করেছেন সুতনু ভট্টাচার্য, রণবীর চক্রবর্তী, সদ্য প্রয়াত ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় বা প্রয়াত কল্যাণ সান্যাল মশাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কারিকুরিতে গত ২৫০ বছরে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র এশিয়া থেকে চলে গিয়েছে ইওরোপে। ফলে আমদানি নির্ভর, ইওরোপিয়দের হাতে তৈরি নব্য কেন্দ্রিভূত উতপাদন ব্যবস্থা, ইওরোপিয়দের তৈরি আন্তর্জাতিক নিয়মে খেলতে খেলতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এশিয় আফ্রিকিয় দক্ষিণ আমেরিকিয় দেশগুলোর আর কীই বা করার আছে বিশ্বের সামনে ‘সব থেকে বড় উপসর্গওয়ালা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে পৃথিবীর সব থেকে বড় স্ট্যাচু, পৃথিবীর সব থেকে বড় রাজনৈতিক দলের সব থেকে বড় হেডকোয়ার্টার,অথবা বিশ্বের সব থেকে ভারি ন্যাশনাল এমব্লেম তৈরি করা নিয়েপেশিফোলানো ছাড়া? আমেরিকার স্টুজ না হয়েও ইওরোপিয় বিষচক্র ভেঙে ইওরোপকে ১০ গোল দেওয়া চিনের পণ্য বয়কট করতে বলেও চিনের অর্থনীতির সর্ববৃহৎ খাতক হয়েছে নরেন্দ্র মোদির কর্পোরেট ভারত। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সমস্ত পুঁজিবাদী ডেকোরাম জলাঞ্জলি দিয়ে চিনা কোম্পানির মডেল সেজে আত্মনির্ভর ভারতবর্ষের ডাক দিতে হয়। সেই ‘আত্মনির্ভর’ মেক ইন ইন্ডিয়ার লোগোটাও পশ্চিম তৈরি করে দেয়, আধা-ফ্যাসিস্টেরসর্ববৃহত স্টাচুটাও চিন থেকে তৈরি হয়ে আসে। প্রকাশ্যে দম্ভের পরিবেশ তৈরি করে বিশ্ব ফাটকা ডিজিটাল পুঁজির সমস্ত শর্ত মেনে অর্থনীতিকে কর্পোরেটমন্য করে ঢেলে সাজাতে হয়। ডিজিটাল গণতন্ত্রের কাঠামোয় যে নতুন পার্লামেন্ট ভবন তৈরি হচ্ছে, সেই কাঠামোর দখলদার কর্পোরেট দার্শনিকতার সঙ্গে মানানসই নতুন পেশি ফোলানো, দাঁত বার করে ভয় দেখানোমার্কা শিল্পকর্ম এই নতুন চার-সিংহ। নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পর সংঘ পরিবার তার লুকোনো ‘সামাজিক’ দাঁত নখ বার করে দেশের সংখ্যালঘু, দলিত, নিম্নবর্গের ওপর খুনে মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার দার্শনিক অবস্থার সঙ্গে মানানসই ‘সিএক্সপ্যাক’মার্কা চার-সিংহ‘শিল্পকর্ম’।
কিন্তু অশোক রাজার চার-সিংহ পলাশীপূর্ব সময়ের কারিগরদের গৌরবের প্রতিনিধি কেন বলতে চাইছি? মূর্তিশিল্প বিশেষজ্ঞ শুভদীপ সান্যালের বক্তব্য, গলদটা জ্ঞানচর্চায় নিহিত। যে স্থাপত্য বিকাশের জ্ঞান তথাকথিত প্রাচীন এবং মধ্য যুগের কারিগর স্থপতিরা অর্জন করেছিলেন এশিয়া জোড়া স্থাপত্য বিকাশের সঙ্গে জুড়ে থেকে, সেই অর্জিত জ্ঞান আড়াইশ বছরের কর্পোরেটিয় কৃষ্টির পরিবেশে কোথাও মরচে পড়েছে কোথাও বা ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলছেন তাজমহলের চারটে জবাবি মিনারের কোনওটাই সোজা দাঁড়িয়ে নেই। আমরা বুঝতেই পারি না প্রত্যেকটিই হাল্কা করে বাইরের দিকে হেলিয়ে রাখা আছে, যাতে অনেক নিচে দাঁড়ানো মানুষদের সব কটাকেই সোজা ভূমির সঙ্গে সমকোণ দাঁড়ানো বলে মনে হয় – কারিগরদের জ্ঞান আর অসামান্য দক্ষতায় তৈরি প্রতি সাম্যএকটি চাক্ষুষ অনুভূতির দৃষ্টি বিভ্রম সৃষ্টিকরে। ঠিক একইভাবে বহু উঁচু স্তম্ভে বসানো চারটি পিঠেপিঠি সিংহরও কিন্তু প্রত্যেকটাই একে অপরের অনুকরণ নয়, প্রত্যেকটিরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হাল্কা চোখে না পড়া পার্থক্য তৈরি করা আছে – যে জন্যে নিচ থেকে দর্শকদের চোখে সমতার দৃষ্টি বিভ্রম তৈরি হয়,দর্শকদের চোখে সব কটা সিংহকেই একইরকম মনে হয়। ২৩০০ বছর আগে সারনাথের সিংহ তৈরি করতে গিয়ে, যাকে আমরা আজ অশোকস্তম্ভ নাম দিয়েছি অথবা আজ থেকে মাত্র ৪০০ বছর আগে সুন্দরতম উজ্জ্বলতম মকবরা বা তাজ বিবি কী মকবরাতৈরি করতে গিয়ে, যাকে আমরা আজ সকলে তাজমহল নামে চিনি,কারিগরেরা আত্মজ্ঞান, আত্মদক্ষতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে শুধু কিছু সাধারণ হাতিয়ার নিয়ে এমন শিল্পকর্ম তৈরি করেন, যা আজও আমাদের বিস্মিত করে, মুগ্ধ করে, তাদের বিশেষ জ্ঞান আমাদের রোজই আবিষ্ট করে।
শুভদীপ স্পুষ্ট ভাষায় বলছেন শিল্পকর্মে ৯৫০০ কিলোর সিংহ তৈরির মত আরও বড়, আরও ঐশ্বর্যপূর্ণ শিল্প বহু সময়ই মূল শিল্পের আবেদনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না, মুখ থুবড়ে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়। আলাউদ্দিন খলজি কুতুব মিনারের থেকেও বড় মিনার তৈরি করানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার এক তলা তৈরি হওয়ার সময়েইতিনি মারা যান। তিনি যদি শেষও করে যেতেন তাহলে তার তৈরি অনুকরণটি মূল শিল্পের ক্যারিকেচার হত, আজকের চার সিংহের হনুকরণের মত। শুভদীপ লিখছেন আলাউদ্দিন খলজি যদি মিনারটা তৈরি করতে সফলও হতেন তাহলে it would have been a disaster. There is a theory of Optimum in art. When things are over-done, when carvings become too ornate, the overall visual impact gets detoriated. It's all about harmony। বিদ্যুৎ নির্ভর আধুনিকতায় দক্ষতা, জ্ঞাননির্ভর প্রাকৃতি নির্ভরতার হারমনিটাই ধ্বংস হয়েছে।
এই নব্য-ভারতে অ-শোকীয় কর্পোরেট দম্ভে আবহমানকাল ভারতবর্ষ যে প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পতত্ত্ব প্রয়োগ করে বিশালতম থেকে ক্ষুদ্রতম শিল্পকর্ম স্থাপন করেছে, আধুনিক কর্পোরেট যুগে সেই শিল্পতত্ত্বের বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠেছে। নোট-বাতিল প্রকল্পে তিনি চাষী-কারিগর-হকারদের বাজার খেয়েছেন, মুড়ি বা টক দই বা কারিগরির ওপর জিএসটি প্রয়োগ করে প্রাতিষ্ঠানিক কর্পোরেট উৎপাদন ব্যবস্থার বাইরের অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যমীদের যতটুকু শক্ত মাজা ছিল তাকেও ভেঙে দেওয়ার উদ্যম নিয়েছেন। এই ব্যবস্থায় লাভ হয়েছে, নরেন্দ্র মোদির অভয়হস্ত মাথায় থাকা ডিজিটাল যুগের কর্পোরেটের। দাঁত-মুখ-খিঁচিয়ে থাকা নতুন চার-সিংহ নরেন্দ্র মোদির যুগেরই যোগ্য প্রতীক।
গতকালই ধর্মতলায় যতদূরসম্ভব মধ্য যুবা বাঙালি বাইক চালকের সামনের আলোগার্ডের কালো প্লাস্টিকে ওপরে বাংলায় লেখা হরিগুরু আর নিচে নব্য সিএক্সপ্যাক হনুমানের গেরুয়া বিকৃত পৌরুষমন্য মুখ দেখে অবাকই হলাম। পলিমাটিরমত নরমসরম পূর্বাঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে শৈবই হোক, শাক্তই হোক বা বৈষ্ণব প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, আচার চর্চাই হোক, সেই প্রকাশ্য ফলিত কাঠামোয়‘সিক্সপ্যাকিয়’ পৌরুষত্বের আজও প্রবেশাধিকার নেই। বিজেপির পথে দেশ চালাতে গিয়ে শ্রীলঙ্কারঅর্থনীতি সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। নেতারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। ভারত সরকার নির্দেশ জারি করে সরকারি চাকরির সুযোগ খতম করে দিয়েছে, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে এনেফেলেছে, গত আড়াই বছর কোভিদের ধাক্কায় অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে, নব্য ধরণের সিংহ তৈরি করে সঙ্ঘ পরিবার কী এই তৃণমূলস্তরের মানুষজনের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণ না করতে পেরেলুকিয়ে থাকা বিদ্বেষপৌরুষকে জাগানোর উদ্যম নিচ্ছে? বাইকে সিক্সপ্যাকিয় হনুমানের ছবি লাগানো বৈষ্ণব বাঙালি কী বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রতিকার চাইবে, না কী সিক্সপ্যাক চার সিংহের বিদ্বেষ-বার্তায় উদ্বেল হবে?সেই বিদ্বেষীদম্ভের প্রতীক কী হবে নব্য কেশর ফোলানো, দাঁত বের করানো দম্ভী অ-শোকিয় হেভিওয়েটচার সিংহ? শেষ অবদি ক্ষমতায় থাকা কর্তাদের হিতপোদেশের সিংহের মত অবস্থা হবে না তো! ইতিহাসের শিক্ষা হল, কোনও শাসকই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, কিন্তু লঙ্কাকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে আজও দেখিয়ে দিয়েছে প্রত্যেক ফ্যাসিস্টেরই শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর। অ-শোকিয় হেভিওয়েট চার সিংহের জনক নরেন্দ্র মোদিরা কী সেটা মনে রাখেন?