গত ডিসেম্বর মাসে চিনে শুরু হয়ে কোভিড যখন গড়াতে গড়াতে গড়িয়াহাট মোড় পর্যন্ত এল, তখন যা যা সঙ্গে আনল তার মধ্যে এসে গেল নতুন কিছু শব্দও। শব্দের পাশাপাশি অভ্যাস। হাত ধোওয়া, মুখ ধোওয়া, নাক ঢাকা মাস্ক। সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করার শিক্ষা। সে দূরত্ব যদিও শারীরিক, ফিজিক্যাল, কিন্তু বহুল প্রচলিত হল সোস্যাল ডিসট্যান্সিং নামে। যেন শারীরিক দূরত্বের চাইতে সামাজিক দূরত্বই বেশি জরুরি। আমরা পড়শির দিকে আড়-চোখে তাকাতে শিখলাম।
করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি, তার চাইতেও অনেক দ্রুত বেগে ছড়ায় এই সামাজিক দূরত্বের তাগিদ। তাগিদের কারণ ভয়। ইউরোপ উত্তর আমেরিকার সমাজ আগে থেকেই সামাজিক ডিসট্যান্সিং-য়ের আওতাভুক্ত। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, পরিবারের সঙ্গে পরিবারের এমনিতেই সেখানে সামাজিকতার পাঁচিল। বাবা ও ছেলে, বড় হয়ে যাওয়া ছেলে ও মা, এদের ভেতরেও সম্পর্কের চেহারা এত ফর্মাল বা নিয়মনিষ্ঠ যে আমাদের অনভ্যস্ত এশিয় চোখ শিউরে শিউরে ওঠে। বিশুদ্ধ বাজার নিয়ন্ত্রিত পারিবারিক যে সম্পর্কে ইউরোপ আজ অভ্যস্ত, তাতে বেঘোরে পড়লে ভয় কাটাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গিটার বা থালা-বাটি হাতে প্রতিবেশীর সন্ধান করতে হয়। আমাদের চার পাশেও এমন কিছু নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া, করপোরেটের জগতে আত্মসমর্পণকারী পরিবার-ই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থালা হাতে প্রতিবেশী খোঁজার প্রচারণার শিকার।
এহ বাহ্য। আমাদের যাদের ভেতর দেখাশুনা অটুট ছিল, যারা কথা না থাকলেও দেখা হলেই হ্যাঁরে তোর রুমা মাসি কেমন আছে, জ্যেঠুর খবর কী, ইত্যাদি করে সবজি কিনতে বেরিয়ে বেলা বইয়ে দিতাম তাদের কী হল! যে সমাজ শীবের গীতকে ধান ভানার অনুষঙ্গ করে দিব্যি থেকেছে, তার অবস্থা কী! বা সেখানে ব্যক্তি সংক্রমণের হার কতখানি! বলা বাহুল্য বা ক্ষেদ বাহুল্য যে, আমাদের এই চেনা, আলাপি, আড্ডাবাজ, অজস্র মতের অমিল নিয়েও পাশাপাশি হয়ে জীবন কাটানো সামাজিকতাই করোনার ধাক্কায় ধ্বস্ত হয়েছে সব চেয়ে বেশি। ব্যক্তির থেকে ব্যক্তি ছিটকে গেছে বহু দূর। বন্ধুত্বের আশ্বাস ঢাকা পড়েছে মাস্কের আড়ালে সন্দেহের আত্ম-নিঃশ্বাসে। যে দেশ, যে রাজ্য, যে গদিয়ান কর্তা তার বা তাদের চৌহদ্দিতে সংমিশ্রন তথা ইউনিয়ন রোধে কখনও তৎপর ছিল, ভাইরাস সেই কর্তৃত্বের হাত বেশ খানিক পোক্ত করল। কারণ চতুর্দিকে হালকা হয়ে গেছে ব্যক্তি বন্ধন। নাক-মুখ ঢাকা অর্ধায়িত মুখমণ্ডলে স্লোগান অন্তত বহু দিন আর উচ্চকিত হবে না। প্রাণ ভরে মানুষ আর দেখতে পাবে না পাশের মানুষের সঞ্চিত ক্রোধ, জমে থাকা হতাশা বা উন্মুখ ভালোবাসা। করোনা এই দীর্ঘস্থায়ী সুবিধাটি আদায় করে দিয়ে গেল ক্ষমতার সংস্কৃতির জন্য। সামাজিক বন্ধন আলগা করে সমস্ত ঘনিষ্ঠতাকে নড়বড়ে করে দিতে পেরেছে ভাইরাস।
করোনা সংস্কৃতিতে ব্যক্তি একা ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছে বলেই কোম্পানি-দৈত্যরা তাদের তীব্র রূপ ধারণ করতে পেরেছে। শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবার দিক তাকালে দেখা যাবে কলকাতা শহরে বাইপাসের ধারে যে হসপিটাল সমূহ এত দিন বিত্তবানদের সুচিকিৎসার পাশাপাশি বিল-ছলনাতেও তৎপর ছিল, তারা এখন নতুন করে শুরু করেছে করোনা-টেস্ট, আচ্ছাদনী ও পিপিই কিটের ব্যবসা। ভর্তি রোগীকে দিনে তিন বার ডাক্তার দেখতে এলে ভিজিট প্রতি ডাক্তারের পিপিই কিটের জন্য সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা ধার্য করা হচ্ছে। ফলে এত দিন ছলনার যে আড়াল বিল-যন্ত্রে ছিল, সেই আড়ালে যুক্ত হয়েছে নাক-মুখ-শরীর ঢাকা পোশাকের আবডাল। এবং এই যে অনিয়ম, এই যে মারাত্মক কারচুপি, এর ফলে মাত্র ক দিনে সমস্ত বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে গেল। এর সামনে ব্যক্তি অত্যন্ত অসহায়। একার কিচ্ছুটি করার নেই। কারও জন্য জন্য দল তো দূরের কথা, কথা বলতে পারা এত কালের প্রতিবেশীটিও এখন নেই। ভাইরাস সকলকে সামাজিক দূরত্বে সরিয়ে রেখেছে। কোম্পানি কাউন্টারের সামনে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা তাই একান্তই প্রকট। চৌহদ্দিতে কোনও চেনা মুখ নেই।
ব্যক্তি একা হয়ে গেছে বলেই কোম্পানি-সমূহ কর্মী সংকোচন ও ছাঁটাইতেও তৎপর। ফোন করে বা নিছক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার মাধ্যমে যাকে তাকে যে কোনও সময় বরখাস্তের বার্তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যতগুলি কোম্পানি আইন সাংবিধানিক ভাবে এ দেশে লাগু, সে আইনের আওতা পর্যন্ত ছাঁটাই হওয়া কর্মীটিকে পৌঁছে দেওয়ার কেউ নেই। দরখাস্তের বার্তা পাচ্ছে যে, তার পিঠের ওপাশে খাদ বা দেওয়াল। মাস্কের আড়ালে কান্না ঢেকে স্ত্রী সন্তান বা বয়স্ক বাবা-মার কাছে নিভৃতে ফেরা ছাড়া আর কোনও গন্তব্য নেই। সামাজিক দূরত্বের জিগির এত দূর পৌঁছেছে যে তার ভয় ও তাগিদে সমস্ত ইউনিয়ন অফিস বধির ও তালাবন্দী হয়ে গেছে। মধ্যস্থতাকারী বা মধ্যসত্ত্বভোগী যেসব দল এত কাল দেখছি-দেখব জপেছে, ইদানিং তাদের জপের দায়টুকুও নেই। ফলে যে লোকটি জানছে তার আর চাকরিটি নেই সে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে একাকীত্বের অন্ধকার কূপে। বিল কাউন্টারে দাঁড়ানো রোগীর পরিজনটির মতোই চাকরি খোয়ানো ব্যক্তির আশপাশ বা চৌহদ্দিতে একটিও চেনা মুখ নেই।
আর এ ব্যাপারে কাছের বা দূরের সরকার, যুদ্ধে যাওয়া সরকার বা আম্ফান ত্রাণের দলীয় ভাগ সামলাতে ব্যস্ত সরকার, সকলেরই মুখে কুলুপ। সকলেই অত্যন্ত অন্ধ।
কিন্তু কোথাও ছাঁটাই চলবে না, ব্যক্তি লুন্ঠন চলতে পারে না কিছুতেই, যারা ভোটে জেতেন বা জেতেন না তারা সকলেই কি এ ব্যাপারে একমত হয়ে উঠতে পারতেন না?