একটা সময় ছিলো যখন এদেশে ধর্মীয় উৎসবগুলো ছিলো সম্প্রীতির কেন্দ্রবিন্দু। তখন হোলিতে সারফ এক্সেলের বিজ্ঞাপন নিয়ে একতরফা বিতর্ক হতো না। তখন ধর্মীয় উৎসবগুলোকে দাঙ্গা বাঁধানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতোনা। ছিলো না অস্ত্র নিয়ে অবাঞ্ছিত আস্ফালন, অথবা গণহত্যার গান ডিজেতে বাজিয়ে সারা দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভীত সন্ত্রস্ত করা হতোনা।
রহমানের দোকানের গোলাপ দিয়ে তখন পুজো হতো, আর ভোলানাথ সাহার মুদির দোকানের সিমুই দিয়ে রহমানের ঈদ। সেখান থেকে আজ আমরা এখানে দাঁড়িয়ে, যেখানে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় উৎসব মানে সংখ্যালঘুর উপরে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এক অদ্ভুত চেষ্টা, সাথে মসজিদ মাজারে আক্রমণ সহ দাঙ্গা বাঁধানো তো রয়েছেই।
অদ্ভুতভাবে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব মন্দিরে না গিয়ে বেকার হিন্দু যুবকদের অস্ত্র হাতে নিয়ে মুসলিম পাড়ায় ঢুকে অযথা অস্ত্র আস্ফালন ব্যাপারটাকে কারও দেব দেবীর অপমান মনে হচ্ছেনা! এখানেই RSS সফল। তারা নাস্তিক সাভারকরের হিন্দুত্বকে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বা শ্রী চৈতন্যের হিন্দু ধর্মের ধ্বংসাবশেষের উপরে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আজকের দিনে দাড়িয়ে তাই এই সাম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম বিদ্বেষের চরমে ওঠা ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা যাঁরা সৌভ্রাতৃত্বের কথা বলি, গঠনতন্ত্রের কথা বলি, মানুষকে ভালোবাসার কথা বলি তাঁদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে প্রকৃত হিন্দু ধর্মের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। যে হিন্দু ধর্ম যত মত তত পথের কথা বলে, যার সাথে " যব মুল্লে কাটে যায়েঙ্গে রাম রাম চিল্লায়েঙ্গে”র কোনো সম্পর্ক নেই।
বিগত কয়েক বছরে যদি খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করা যায় তাহলে দেখা যাবে প্যাটার্নগুলো একইরকম। প্রথমে একটা এলাকায় আরএসএস নিজেদের মজবুত সংগঠন তৈরি করে। বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে ভুয়ো খবরের বিপুল জোগান দিয়ে চরম মুসলিম বিদ্বেষের উত্থান ঘটায়। তাঁর পর বিদ্বেষের সেই আগুনে ঘি ঢালার জন্য ধর্মসভার নাম করে স্বাধী প্রজ্ঞা, রাজা সিংদের মতো ঘৃণা ব্যবসায়ীদেরকে দিয়ে ঘৃণা ভাষণের ফুলঝুরি ছোটায়। বর্তমানে এই ঘৃণা ভাষণগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম মহিলাদের চরম ভাবে আক্রমণ করা হয়, তাঁদের প্রতি আক্রমণ নামিয়ে আনার জন্য বেকার হিন্দু যুবকদের উস্কানি দেওয়া হয়। অনেকটা গুজরাট ২০০২ এর গণহত্যার আগের মতোই। পার্থক্য শুধু এটাই যে তখন বলা হয়েছিলো, যে মুঘলরা হিন্দু মেয়েদেরকে ভোগ করেছে তাই আজ প্রতিশোধ নিতে আমরা মুসলিম মেয়েদেরকে ভোগ করবো যার ফলাফল বিলকিস বানো আর আজ মুঘলদের জায়গা নিয়েছে "লাভ জিহাদে”র মতো সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা। মুসলিম মহিলাদেরকে টার্গেট করার এই প্রোপাগান্ডাটা ভীষণ গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ২০১৯ এর পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে মুসলিম মহিলারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তা বিজেপি এবং সংঘের কাছে যথেষ্ট চিন্তার বিষয়। শাহিনবাগ থেকে হলদাওয়ানী, মুসলিম মহিলাদের প্রতিবাদে বিজেপিকে একাধিকবার পিছু হটতে হয়েছে।যেভাবে তাঁরা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন, তা বিজেপি এবং আরএসএসকে চিন্তান্বিত করেছে।
আবার ফিরে আসি প্যাটার্নে, এই ঘৃণা ভাষণগুলোর মাধ্যমে বেকার যুবকদেরকে তাতিয়ে দেওয়ার পরে, তাঁদের হাতে বিনামূল্যে তুলে দেওয়া হয় বিভিন্ন অস্ত্র। এই অস্ত্র সরবরাহ করে বজরঙ দল, ভিএইচপি, রাম সেনার মতো সংঘের বিভিন্ন ছোটো ছোটো শাখা গুলো।
তারপর শুরু হয় অস্ত্র উচিয়ে উচ্চস্বরে বিভিন্ন প্রোভোকেটিভ গানে ডিজে বাজিয়ে মুসলিম পাড়ায় এগিয়ে যাওয়া, মসজিদের সামনে গিয়ে “যব মুল্লে নরক মে জায়েঙ্গে, ভাগওয়া হাম ল্যাহেরাঙ্গে" এর মতো গান বাজিয়ে মুসলিমদেরকে উত্তেজিত করার চেষ্টা চলে। বিজেপি শাষিত রাজ্যগুলির পুলিশ মূলত এক্ষেত্রে দর্শকের ভূমিকা পালন করে, পুলিশের সামনেই ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমি রচিত হয় আর তারা উপরতলার নির্দেশে চুপ থাকে।
দ্বিতীয় ধাপে যে সমস্ত মুসলিম মহল্লা থেকে প্রতিরোধ আসে সেখানে রাতের অন্ধকারে সংঘের ভাড়া করা বাহিনী দিয়ে বিপুল তান্ডব চলে । লোকাল বজরঙ দলের মেম্বাররা বেছে বাজারের মুসলিম দোকানগুলো চিহ্নিত করে দেয় এই দাঙ্গা বাহিনীর কাছে আর বেছে বেছে সেগুলো পোড়ানো হয়। মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ সহ বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গার পরে দেখতে পাওয়া গেছে , ৪ টি সম্পূর্ণ অক্ষত অমুসলিম মালিকের দোকানের মাঝের গরীব মুসলমানের দোকানটা ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে।
এতো কিছু্র পরেও অত্যাচার, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা কমেনা । শেষ ধাপে ইমপ্লিমেন্ট করা হয়, "The process is the Punishment" অর্থাৎ যাঁরা আক্রান্ত পুলিশকে দিয়ে তাঁদেরকে গ্রেফতার করা। তাই দেখা যায় শান্তির আপিল করা আফরিন ফাতিমার বাবা জাভেদ সাহেবের জেল হয় আর অশ্বিনী, বজরঙ মুনি, ইয়াতী নরসিংহনাদরা বাইরে থাকেন।
এ যেন এক অদ্ভুত চক্র। শেষ কয়েকবছরে রাম নবমী, হনুমান জয়ন্তী, গনেশ চতুর্থী, গরবা সহ প্রায় সমস্ত উৎসবে এই চিত্র। মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় রাখি বন্ধনের মতো উৎসবে অবধি বজরঙ দল অস্ত্র সহ মিছিল করেছে গত বছর।
দিন শেষে আমরা ভাবতে বাধ্য, গরীব মুসলমানের আগুন ভস্মীভূত হওয়া ঘর দেখে ঠিক কতটা খুশি হবেন রাম? হয়তো হবেন না। তারপর মনে হয়, রামকে খুশি করা সংঘের এই সমস্ত দাঙ্গাবাজদের কি উদ্দেশ্য? যদি তা না হয়, তাহলে কেন? শুধু কি তাঁরা তো তাদের গুরু হিটলার এবং গোলওয়ালকারকে খুশি করতে এমন করে, নাকি তাঁদের মধ্যেও অন্তর্নিহিত আছে, মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ?