পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ভুখামানুষের থালে কর্পোরেট আফিম আর কিছু ধনতন্ত্রের আলেয়া

  • 12 December, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1319 view(s)
  • লিখেছেন : সন্দীপন নন্দী
অটোচালকের হাতে দামি ফোন,দিনমজুরের পিপাসা মেটাচ্ছে বোতলের মিনেরেল ওয়াটার।সুইপার ভাইয়ের মায়ের শ্রাদ্ধে ক‍্যাটারার।বেতন নেই ,আকাশকুসুম স্বপ্ন আছে।স্বপ্নের ভাঙন আছে।এও এক নতুন ধনতন্ত্রের শৃঙ্খল।যেখানে খাদ‍্য আছে খাদক আছে।ওরা বুঝছে কই?
তিস্তার কোলে মাথা রেখে যে শহরের ঘুম,সেখানেই আজ নদী নিখোঁজ । একটা বৃত্তান্তকে ভুলে যেতে লাগল মাত্র কয় দশক । পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পৌরসভার গৌরবগাঁথা লেখা হল শহরবাসীর মনে । অথচ শহর আজ একসময়ের সাদাকাল অতীতকে দূরে সরিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে । বদলে গেছে রায়কত রাজাদের প্রতিবেশীরা । রূপমায়া, দীপ্তিটকিজ রূপশ্রী, শ্রীদয়ালে আজ খাঁকা ধূ ধূ। কদমতলায় টিনশেডের দোকান উধাও । মাথা তুলেছে হাইরাইস মল, প্লাজা । একটু সুখের খোঁজে আত্মহারা শহর । অনলাইনে মোচা পৌঁছে যায় ডোর টু ডোর । হাফদামে লেগিংস, কুর্তা, প্লাজো পেয়ে উদ্বেল জেন এক্স । অথচ চোখের সামনে ম‍্যাজিকের মত উধাও হল শহরের ফেরিওয়ালা । ফুটপাথ জুড়ে ছড়িয়ে বসা ক্ষুদ্র দোকানি ফিরে গেল গ্রামে । মার্চেন্টরোড, ডিবিসি রোড, প্রভাতমোড়ের চাকাওয়ালা চাওমিন গাড়িগুলো হারিয়ে গেল । এখন জন্মদিনের পার্টি বসে চারতলার ফুডপার্কে । কদমতলার চপ মোগলাই কাটলেটের দোকানে শুধুই শূন‍্যতা ।
প্রভাত মোড়ের দোকান গুলোতে এই সেদিনও লম্বালাইন । হলদিবাড়ি, রাজগঞ্জ, পাঙ্গার ভাগচাষী দোকানজুড়ে । একরত্তি বাচ্চা কোলে মা দরদাম করতে করতেই বাচ্চার মুখে গুঁজে দিচ্ছেন স্তনবৃন্ত । পাশে দোকানের হাই পাওয়ার আলোর দিকে চেয়ে থাকতেন হাটুরে কৃষক , সপ্তাহের রোজগার নিয়ে । কখনো বাগানের বোনাস নিয়েই এসব দোকানে ছুটে আসতেন পাতাতোলা মেমসাহেব । হতভাগ‍্য কৃষ্ণকলিদের অর্থেই মূলত ব‍্যবসা লাভের মুখ দেখতো এ শহরে । কিন্তু ক্রমশ উন্নয়নের কার্ভ যত এগিয়ে এল, এই শ্রেণীর ক্রেতারা জলপাইগুড়ির মানচিত্র থেকেই হারিয়ে গেল । বাতানুকূল চারপাশ, মাথার ওপর অরিজিতে হিটভোকাল, মনভাল করা পারফিউমে ভয় পেল গ্রামের মানুষ । ছাপাশাড়ি, টেরিকটের ক্রেতা হারালো দোকানি । সময়ের সাথে হাত ধরে একরাতের বুলডোজার শাসন গুঁড়িয়ে দিল চৌমাথার দোকানশেড । কি হবে ? শহর বদলাবে । ফ্লো অব মানি বাড়বে। মানুষ একটা বিপণনের নতুন ডেফিনিশন পাবে । অন‍্যশহরের মত জলপাইগুড়িও মেনে নিল । পিছিয়ে পড়া দৈনন্দিনে পার বাঁধিয়ে ক্রেতা এলো কাঁচঘরে । দরদাম উঠে গেল । কোণায় কোণায় জেগে থাকল শুধু, হেসে ওঠা ছাড় । রিডাকশন । বছরের শুধু পুজো বা চৈত্র সেলের কনসেপ্ট সরিয়ে মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানী আনল ছয়‍ঋতুর ছাড় । সারাবছর ভেবে নিলাম, অফারের বাড়বাড়ন্তে আমদের লাভ আর লাভ । দোকানিরা এতো অফার কেন দেয় ? ওরা কি ফুলমামার কলিগ ?নাকি ছোটোমেসোর ক্লায়েন্ট ? এতো ছাড় । এতো ইনভেস্টমেন্টের পরও জলের দরে জুতো, মোজা, ক্রিম, সাবান, চাল কিভাবে ? বারোমাসের বাজার নিলে তেরো মাসে আপনার পুরোসংসার খরচ ফ্রিতে দেবে ওরা । ইস, বেরুবাড়ি, মন্ডলঘাটের পরাণ রাজবংশী, হেটুয়া সোরেনরা জানলই না এ ছাড়ের কথা । ওদের দৈন‍্যদশায় একটু আনন্দের বাতাস দিতে পারতো যে সিদ্ধান্ত । যে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিতে পারতো দুবিঘা জমিমালিক বুধুয়া বাওড়ির সংসারে একটু স্বস্তি। তবু এই ছাড়ের সংবাদ জানলো না তারা । কেননা ঋতুবদলায়, ওদের পরিস্থিতির বদল নেই । কারণ ওদের বাজেট বোনাসের কটা টাকা । তার বাইরে একটা টাকা খরচ মানেই তো বিলাসিতা । মাপা খরচেই ছোটমেয়ের প্রাইভেট চলবে টিমটিম করে । আমরা দেখেও দেখবো না । একশ্রেণীর ক্রেতাকে পুরোপুরি হারিয়েও কোন অবসেশন নেই দোকানির। কেন? ওদের মার্কেটিং এখন হাট অভিমুখ । এটাও যে একটা ইকোনমিক ডাউন সিনড্রম, আমরা বুঝতে পারলাম কই ?
আজ ঝিঝি ডাকা রাজবাড়ি দিঘির পার বাঁধিয়ে কফিশপ । বটপাকুড়ের কোলে কংক্রিটের সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট । করলার দুধারে বেড়ে ওঠা চারাগাছ চোখ জুড়িয়ে দেয় । পুকুর বুজিয়ে মাথাতোলা হাইরাইজের খোপে খোপে একা পরিবার । ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোমে সিকিওরড শহরমানুষের প্রাণ । বস্তী ভেঙে অ্যাপার্টমেন্ট । অথচ এই জায়গা ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ কোথায় গেল, আমরা খোঁজ রাখলামনা । শহরের সোকল্ড এলিটবাড়ির কাজের মাসির বাড়িটা কেমন দেখতে, ইচ্ছে জাগেনি। দুবেলা ঝকঝকে করে তোলা থালাবাটির কোথাও মনে পড়েনি, দিদির হাতটা ক্ষয়ে গেছে কতদূর । সাতসকালে খবরের কাগজ ছুঁড়ে দেওয়া হাতটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়নি । কিংবা ছোটমেয়ে লিসার ড্রাইভারের লিউকোমিয়ার লাস্ট আপডেট কি, জানতে চাইনি । অথবা গতকাল সেপটিক ট‍্যাঙ্কের আবর্জনা ধুয়ে দেওয়া টিনেজার আঙুলে কোন ইনফেকশন আছে কিনা । এসব প্রশ্ন আমাদের মনে আসেনা । আসতে নেই । তবে শুধু এ শহর না, পৃথিবীর সব শহরের চরিত্রই এক । এখানে লোয়ার ক্লাসের সত‍্যিই কোন ক্লাস নেই । ওরা দয়ায় বাঁচে। সহানুভূতি হয়ে থাকে এসব মানুষের ভালথাকা ।
তাই শহর ভাল আছে । ওরা ভাল নেই। বাজারের আর, মাগুর, ইলিশ, গলদা, পাবদা, ট‍্যাংরা, কই এখন এলিট ক্লাসের মাছ। খাসির মাংস শেষ কবে খেয়েছে, মনে করতে পারেনি রাজবাড়ি দিঘির পারে বসা গ‍্যাসবেলুন ওয়ালা । সোনার দোকানে শেষ কবে দেখা হয়েছিল,ভুলে গেছে তিস্তার মাঝিবউ। আর এক নির্জন দুপুরে ছাতা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে শুকিয়ে আসা তিস্তায় সিজিনাল সবজী চাষকরা পরিবারের খড়ের চালে তাকিয়ে চমকে যায় চোখ। এক চৌকি জীবনের সংসারের মাথায় ডিস অ্যান্টেনা। নদীচরে আলুক্ষেতে জমিয়ে রাখা আলুর পাশে ধূলোমাখা অ্যান্ড্রোয়েড ফোন। ভরদুপুরের এই বৈপরীত্য তখন রোদের চেয়েও প্রখর হয়ে শরীরে পড়ছিল। কথা বলে বুঝলাম এটাই আধুনিক বিপণন। নুনফুরনো পানতার সংসারেও আজ ফোনটা এসেনশিয়াল। রাতে দুটো ভিডিও না দেখে ,একটু হোয়াটস অ্যাপ না করে ঘুম আসেনা রিকশোআলার। অন‍্যের বাড়িতে ঘর মুছেও ছোট মেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম। চারটে প্রাইভেট। এ যেন এক বাধ‍্যবাধকতা। সমাজের সাথে পাল্লা দিয়ে হেঁটে চলার সাহস পেয়ে যাচ্ছে এই অন্ত‍্যজশ্রেণী। আর এটাই এখন বদলে যাওয়া সমাজের ইকনমিক স্টার্কচার। গরীবদের স্বল্প সঞ্চয়েও হাত ফেলেছে মাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানি। ক্রেতা বদলায়নি। বদলে গেছে দোকান। একটা সিস্টেম
আর এভাবেই ব‍্যবসা অভিমুখ বদলেছে একটা লোয়ার ক্লাসের সৌজন‍্যে। অভাবের সংসারেও হাত বাড়িয়েছে অভিনব বিজনেস পলিসি। এজন‍্যই অ্যাড সংস্থাগুলো এখন বেছে নিচ্ছে লোয়ারক্লাসের সাবজেক্ট। একটু দেখলেই বোঝা যাবে,এদের সেন্টিমেন্ট নিয়েই এখন বিজ্ঞাপন তৈরী হচ্ছে। নইলে কেন টয়লেট ঝকঝক করে ওঠে ভাটিয়া বিল্ডিং বস্তীতে। কেন সুখিয়া ডোমের মায়ের শ্রাদ্ধে ক‍্যাটারার । কেন অষ্টমীর রাতে তৃষ্ণার্ত মুড়িয়ালির হাতে মিনারেল ওয়াটার। কেনই বা গারবেজ ক্লিনারের ছোটমেয়ের বার্থডেতে দামি কেক। পুঁজির অপ্রতুলতাতেও এ এক কর্পোরেট আফিম। যা কিনা ইচ্ছে না হলেও,ঘুনপোকার মত গিলে খায় মাসিক খরচ । জলপাইগুড়ি শুধুমাত্র একটা শহরের নাম। একটা ডেস্টিনেশন। আসলে এখন এটাই বদলে যাওয়া বিপণন। বদলে যাওয়া সেমি নাগরিক যাপনের আলেয়া।
যা অপ্রতুলতার মরুভূমিতেও একটু অন‍্যরকম বাঁচার ফটিকজল। যেজলে তৃষ্ণা মেটে একদিন। কিন্তু পরদিন আবার সেই সর্বহারা স্ট‍্যাটাস নিয়ে শাক বাজারে হাঁক দিতে হয়,চার আঁটি দশটাকা।
0 Comments

Post Comment