স্বাধীনতার পরে ৭০ বছর মুসলমানদের কোনও প্যান ইন্ডিয়ান দল নেই, তারা সো কল্ড সেক্যুলার দলকেই ভোট দিয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বকে লাথি মেরে জন্মভূমি কর্মভূমি ভারতবর্ষের মাটিই আঁকড়ে থেকেছে। মুসলিম লিগও পাত্তা না-পেয়ে হারিয়ে গেছে ভারত থেকে।
সঙ্ঘ সাম্প্রদায়িক। তারা ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করে। সরাসরি করে। লুকোছাপা নেই। তাদের হাত ধরেই বাংলার মাঠেও আইডেন্টিটি পলিটিক্স হইহই করে ঢুকে পড়েছে। হিন্দুরা ১৮টা সিট দিয়ে সেই পলিটিক্সকে এনডোর্স করে দিয়েছে। এখন যদি সংখ্যালঘুরা এর প্রতিস্পর্দ্ধায় সরাসরি আইডেন্টিটি পলিটিক্সে ঝোঁকে, তাদের দোষ দেওয়া যাবে কি?
এই প্রবণতারই ফায়দা লুটতে গন্ধে গন্ধে হাজির আব্বাস-মিম। আব্বাসের বক্তৃতার ভিডিও দেখলে ভ্রম হয় এইসব অনুষ্ঠান বাংলাদেশী হুজুরদের কি না, কিন্তু ভ্রম ভাঙে দ্রুত। এই ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘ আরও বেশি হিন্দুত্ব নিয়ে লাফালাফি করবে। সঙ্ঘ বাড়বে। সঙ্ঘ বাড়লে লগে লগে আব্বাস-মিমও। এরা একে অপরের পরিপূরক।
এখন প্রশ্ন, বাংলার আগামী দিন কি এই আইডেন্টিটি পলিটিক্সের দখলে যাবে?
বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির সরকারি অংশ ক্রমশ চলে যাচ্ছে পেছনে। এর জন্য দায়ী তারাই। ন্যানোবাবুদের জন্য এখনও বিরক্তিকর বিলাপ আর মমতা ব্যানার্জির প্রতি অরাজনৈতিক অসূয়া, এই দুই গাড্ডা থেকে এই ১০ বছরে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা। প্রচুর ইস্যু ছিল, ব্যক্তিগত অসূয়া কাটিয়ে ত্যাগ ও তিতিক্ষা নিয়ে বছরভর মাঠে থাকতে পারলে আজ জনভিত্তি অনেকটা ফিরে পেত।
কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাঠে ঢুকে গেছে সত্তার রাজনীতি। জাতপাত বা মণ্ডলের রাজনীতিও সত্তার রাজনীতি, কিন্তু মণ্ডলের রাজনীতি ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে মানা যায় কারণ এখানে ক্লাস ও কাস্ট সমার্থক। কিন্তু কমণ্ডলুর রাজনীতি বা দাড়ি-টুপির রাজনীতি আইডেন্টিটি পলিটিক্স কেবল নয়, সরাসরি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। অন্য যে কোনও ঘোষিত সেক্যুলার দল এই রাজনীতিকে হাওয়া দিলে তা দোষের, কমিউনিস্ট পার্টি দিলে তা মহাদোষের। জোট করলে তো ক্রিমিনাল অফেন্স! সিপিএম নিজের অস্তিত্ব রক্ষার ফেক-ভাবনায়, ঠিক সেই অপরাধই করতে চলেছে।
সিপিএম এমন একটা দল, ভারতবর্ষের জ্বলন্ত ইস্যুগুলো নিয়ে যাদের কোনও সর্বভারতীয় নির্দিষ্ট নীতি নেই। যেমন এনার্সি, নাগরিকত্ব প্রশ্ন নিয়ে দেশ উত্তাল, না, এই ইস্যুতে সিপিএমের কোনও নির্দিষ্ট নীতি নেই। আসামে সিপিএম এনার্সি চায়। ত্রিপুরায় সিপিএম এনার্সি চায়। পশ্চিমবঙ্গে চায় না। ফলত নীতিগত এই অসঙ্গতির জন্য আসাম বা বাংলা, দুই ক্ষেত্রেই নাগরিকত্ব প্রশ্নে ফাম্বল করে সিপিএম।
আবার ধরা যাক সঙ্ঘের হিন্দুত্ববাদ, গোটা দেশ নব্য ও মারমুখী হিন্দুত্ববাদের আক্রমণে দিশেহারা, সিপিএম এই ইস্যুতেও দ্বিধাবিভক্ত। বাংলায় তৃণমূলের পাল্টা-রামনবমী বা দুর্গাপূজা কার্নিভাল বা পুরোহিত ভাতা ইত্যাদি কর্মসূচীকে নরম-হিন্দুত্ব বলে কঠোর সমালোচনা করে বঙ্গ-সিপিএম, অথচ কেরালায় চিত্র অন্য। কেরালায় বিজেপি ক্ষমতা থেকে এখনও দূরে, কিন্তু রাজ্যে আরএসএস তার সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য বিস্তার করেই চলেছে। ক্রমবর্দ্ধমান এই সঙ্ঘী সংস্কৃতি ঠেকাতে সিপিএম নিয়েছে নরম-হিন্দুত্বের পথ। গত কয়েক বছর ধরে কেরালা-সিপিএম সরকারিভাবে পালন করছে জন্মাষ্টমী বা রামায়ণ মাস উৎসব ইত্যাদি। গত লোকসভা ভোটে ধাক্কা খেয়ে, সবরিমালা মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নিয়ে ‘বিপ্লবী’ পদক্ষেপেও ব্রেক কষে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়েছে তারা।
‘মুসলিম মৌলবাদী’দের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে কংগ্রেস কেরালায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্ষতি করছে, কেরালায় ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট করার জন্য কেরালা কংগ্রেসকে এইভাবে দিনরাত গাল দেয় সিপিএম। অথচ আব্বাস সিদ্দিকি’র মতো পীরজাদা হুজুরের সঙ্গে অশুভ জোট করে বাংলায় সেই একই অপরাধে হাত কালিমালিপ্ত করছে তারা!
ভোটের রাজনীতি ঘুণপোকার মতো এমন কুরে কুরে খেয়েছে এই মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট দলকে, সামাজিক ও রাজনৈতিক কোনও গুরুতর প্রশ্নেই সে দৃঢ়তার সঙ্গে আদর্শবাদী কোনও স্টান্স নিতে পারে না। ডিফেন্স-দুর্বল ব্যাটসম্যানের মতো স্টান্সে তার ত্রুটি, ব্যাট ও প্যাডের মাঝে বড়সড় ফাঁক। এই ফাঁক আজকের নয়, জন্মদাগ, প্রায় স্থায়ী ট্যাটুর রূপ নিয়েছে।
অতীতে এমন ফাঁক-এর অসংখ্য উদাহরণ আছে। একটা উদাহরণ দিই, ১৯৪৬, কলকাতা ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তস্নান হয়ে আপাতত স্তিমিত, ফেব্রুয়ারিতেই জ্বলে উঠেছে বিদ্রোহের আগুন বোম্বাই আর করাচীতে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কলকাতায়। মাদ্রাজে। নৌ বিদ্রোহে উত্তাল বন্দর শহরগুলি। ইংরেজ সৈন্যরা মেশিনগান চালিয়ে দিল বিদ্রোহীদের ওপর! গোটা দেশ ফুঁসছে প্রতিবাদে! সাম্রাজ্যবাদের দালাল নেহরু বলছেন, ‘নৌবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ থাকা উচিত!’ আরেক দালাল সর্দার প্যাটেল বিরোধিতা করছেন নৌ ধর্মঘটের। গান্ধীও। একই আচরণ জিন্নাসহ লিগের নেতাদেরও। কিন্তু কংগ্রেস ও লিগ নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা অগ্রাহ্য করে সেদিনও দোদুল্যমান কমিউনিস্ট নেতৃত্ব নৌ সেনাদের আন্দোলনে সময়োপযোগী ভূমিকা পালনে ছিল অক্ষম। সাধারণ সম্পাদক পিসি জোশী ‘শেষ সংগ্রামের আহ্বান’-এ প্রায় স্বীকারও করে নিচ্ছেন সেই কথা! বিটিআর লিখছেন ‘কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রভাব কাটিয়ে ওঠার মতো শক্তি তাদের ছিল না।’ স্বাধীনতার আগেও কমিউনিস্ট দল কংগ্রেসের ধামাধরা। পরেও।
কেরালায় একদা মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে জোট করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি, তার ফলাফলও জানে সরকারি বামেরা, কিন্তু বাংলায় তার থেকেও ভয়াবহ ফলাফল হতে পারে। কারণ কেরালায় দেশভাগের ক্ষত নেই, আমাদের সেই ঘা এখনও দগদগে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘা। সঙ্ঘ বাংলাকে চারের দশকের বাংলায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্ঘী রাজনীতিকে সরাসরি হাওয়া দিচ্ছে সিপিএম। ধাপে ধাপে এই কাজ করছে তারা। প্রথম ধাপঃ সঙ্ঘের রাজনীতির বিরুদ্ধে, গত কয়েক বছর, কিছুতেই অবস্থান স্পষ্ট না-করা। পরের ধাপে, মৌলবাদী হুজুর আব্বাস সিদ্দিকিকে অসাম্প্রদায়িক সার্টিফিকেটসহ 'বহুজন রাজনীতি' নামক সুগার কোটিং দেওয়া। তারপর শেষ ধাপে তাদের সঙ্গে সরাসরি জোট।
এইভাবে সিপিএমের সর্দারিতে সরকারি বামেরা সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা করছে বাম ও সেক্যুলার রাজনীতির সঙ্গে। মুসলিম মৌলবাদীর সঙ্গে জোট করার অর্থই হল হিন্দু মৌলবাদীর হাত শক্ত করা। এই বোধটাই হারিয়ে গেছে যে, আইডেন্টিটি পলিটিক্স মাঠে থাকলে অন্য পলিটিক্স হাওয়া হয়ে যাবে।
ফলত আবার সেই স্বাধীনতার আগের কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা, কংগ্রেসের তল্পিবাহক দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে মাঠে-থাকা। কার্যত সেই চিত্রের ট্রেলার আমরা দেখছি এখন।
নাবিককে যদি বিশ্বাসহন্তারক হয়, তাকে চালকের আসন থেকে সরিয়ে দেওয়াই বিচক্ষণতার কাজ। এই অবস্থায় এই সিপিএম নামক প্রতিক্রিয়াশীল অংশকে বাদ দিয়ে অবশিষ্ট বাম-গণতান্ত্রিক শক্তিকে একজোট ও শক্তিশালী করাই সময়ের ডাক। অনেক দেরি হয়ে গেছে, জানি না, সরকারি বামের বাইরে-থাকা অংশ এখনও সচেতন হবে কিনা, এর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হবে কিনা! না-হলে সামনে অন্ধকার।
মাথায় থাকুক সেই পুরনো কথা। প্রগতিশীলের অপরাধের পদচিহ্ন ধরে আসে প্রতিক্রিয়াশীলরা। প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ।