এই কোভিডকালে কোনও কোনও রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে নানান বিধিনিষেধের মতো মুখোশ ব্যবহারের আদেশও বলবৎ ছিল। অতি সম্প্রতি, এপ্রিল মাসের দুই তারিখে মহারাষ্ট্র সরকার সেই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। স্বস্তির খবর; কিন্তু সর্বত্র সকলকে মুখোশ ব্যবহার করতে হবে, এই আদেশের পিছনে কি কোনও বৈজ্ঞানিক যুক্তি আদৌ ছিল? মুখোশ ব্যবহার করে কি কোভিড সংক্রমণ রোধ করা যায়? এতে কি লাভের বদলে ক্ষতির আশংকা বেশী? অন্তত ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
মুখোশ ব্যবহারের পিছনে যে-যুক্তিগুলো প্রচার করা হয়েছে তা এইরকম। (ক) ফোঁটাণু (‘ড্রপলেট’) দিয়ে কোভিড সক্রমণ হয়, (খ) উপসর্গ না-থাকলেও সংক্রমণ ছড়িয়ে যেতে পারে, (গ) প্রত্যেকেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে, (ঘ) কোভিডের বিরুদ্ধে কোনও প্রাকৃতিক প্রতিরোধ শক্তি (‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’) অর্জন করা যায় না, (ঙ) সকলে সর্বত্র মুখোশ ব্যবহার করলে কোনও ক্ষতি নেই। এই যুক্তিগুলো একটু বিচার করে দেখা যাক।
(ক) গত ২০২০ সালের একেবারে প্রথম দিকে অনেকে ভেবেছিলেন, কোভিডের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে ফোঁটাণুর মাধ্যমে। হাঁচি, কাশি বা উঁচু গলায় কথা বললে নাক-মুখ থেকে ভাইরাসের ফোঁটাণু বেরিয়ে এসে অন্যকে আক্রমণ করতে পারে। এই কারণেই তখন পরস্পরের মধ্যে ছয় ফুট দূরত্ব রচনার কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু বহুকাল ধরে আমরা জানি যে, শ্বাসতন্ত্রীয় ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে থাকে। তারা অতি সূক্ষ্ম, এক মাইক্রোমিটার বা তার চেয়েও কম তাদের পরিমাপ (মাইক্রোমিটার/মাইক্রন = এক মিটারের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ)। ২০০৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস নিয়ে বলা হয়েছিল, “রোগীর শ্বাসতন্ত্র থেকে যে-ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাদের অন্তত ৮৭ শতাংশের পরিমাপ এক মাইক্রোমিটারের কম”। ২০২০ সালের জুলাই মাসে ‘সার্স-কোভি-২’ নিয়ে গবেষণায় জানা গেছে যে, “রোগীর কাশি, হাঁচি, থুতু বা লালা থেকে ভাইরাস বেরিয়ে এসে আশপাশের বাতাসে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে; তবে তাদের পরিমাপ ০.২ থেকে ০.৬ মাইক্রন মাত্র”।
তাহলে মুখোশ ব্যবহার করে আমরা কি বাতাসে ছড়িয়ে থাকা ভাইরাসকে আটকে দিতে পারি? দামি, কম দামি, দেশি, বিদেশী যেকোনও মুখোশে ছিদ্রপথ থাকে; কাপড়ের তৈরি মুখোশের ছিদ্রপথের আকার অনেক বড়। তাছাড়া, যত আঁটসাঁটই হোক, মুখোশ আর মুখমণ্ডলের ত্বকের মধ্যেও ফাঁক থাকা অনিবার্য। সেই ফাঁকের আকার ভাইরাসের তুলনায় কয়েক লক্ষ গুণ বেশি। এইসব ছিদ্রপথ বা রন্ধ্রের মধ্য দিয়ে ভাইরাস অতি অনায়াসে গলে যেতে পারে। অতএব, বৈজ্ঞানিক যুক্তি তো বটেই, এমনকী কাণ্ডজ্ঞানের পক্ষেও ভাইরাস আটকাতে মুখোশের ব্যবহার মেনে নেওয়া অসম্ভব।
(খ) উপসর্গ না-থাকলেও কি কেউ সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে? এরকম একটা ধারণা ২০২০ সালের প্রথম দিক থেকেই প্রচারিত হয়েছিল, “যাদের উপসর্গ নেই তারাও নিজেদের অজান্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে”। এই ধারণা গড়ে উঠেছিল সামান্য কিছু তথ্যের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু তা নিয়ে পরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রচুর গবেষণা হয় এবং ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে তার ফল প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল যে, অমনভাবে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েও বা তা অতি বিরল। পরিসংখ্যানের হিসেবে তার আশংকা ০.৭ শতাংশের বেশি না; অর্থাৎ তা নগণ্য। এখন কথা হল, একজন স্বাভাবিক, সুস্থ, উপসর্গহীন মানুষ যদি কোভিড সংক্রমণ ছড়াতে নাই পারে তাহলে মুখোশের সর্বজনীন ব্যবহারের পিছনে কোনও যুক্তি আর থাকে না।
(গ) প্রত্যেকেই কি কোভডে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে? এমন একটা ধারণা থেকেই বলা হয়েছিল, সকলেরই মুখোশ ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু দেখা গেছে যে, যারা কর্মক্ষম এবং যাদের বয়েস ৬০-এর নীচে তাদের বেলায় কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা অন্য অসুখ-বিসুখে পড়ার মতোই, তার চেয়ে বেশি না। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের বয়েস ৫০ থেকে ৫৯-এর মধ্যে তাদের বেলায় কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর হার ০.১৪ শতাংশ মাত্র। মরসুমি ফ্লুতেও মৃত্যুহার একই। বয়েস যত কমতির দিকে থাকে, কোভিডে মৃত্যুর হারও সেই অনুপাতে দ্রুত কমতে থাকে।
আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা বুঝতে পারি, শিশুদের এবং যাদের বয়েস চল্লিশের নীচে তাদের মধ্যে ক’জনই বা কোভিডে ভয়ংকরভাবে কাহিল হয়েছে? তথ্য একথাও জানায় যে, যাদের বয়েস ২৫-এর নীচে তাদের বেলায় কোভিডের আশংকা যতটা, তার চেয়ে পথ দুর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার আশংকা দশ গুণ বেশি। তাই যদি হয় তাহলে সবাইকে সর্বত্র মুখোশ পরে থাকতে হবে এমন উপদেশের পিছনে যুক্তি কোথায়? স্কুলের পড়ুয়ারাও বা কেন মুখোশ পরবে?
(ঘ) কোভিডের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ শক্তি। একবার ‘সার্স-কোভি-২’ সংক্রমণ হয়ে গেলে যে-স্বাভাবিক প্রতিরোধ শক্তি আমরা অর্জন করি তা যে যথেষ্ট শক্তিশালী সেকথা জীববিদ্যার ছাত্র হিসেবে আমাদের জানাই ছিল। একে বলে ‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’। অথচ সংবাদমাধ্যমে এর উলটো কথা প্রচার করা হল, কোনও তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই। কিন্তু ইংল্যান্ডের ১৭০০০ স্বাস্থ্যকর্মী যে গবেষণা চালিয়েছিলেন তা প্রকাশিত হল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। তাতে দেখানো হল যে, দ্বিতীয়বার একই সংক্রমণে গুরুতর কাহিল হয়েছেন এমন একটি নমুনাও নেই। এর পরে আরও গবেষণা হয়েছে। তাতে হাজার বছরে অর্জিত জীববিদ্যার জ্ঞানই নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে।
আমাদের দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ-এর পরে ২০২১ সালের আগস্ট মাস নাগাদ যে ‘সেরো-সার্ভে’ করা হয়েছে তাতে দেখা গেছে যে, মুম্বাই ও দিল্লির মতো শহরে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষজন প্রাকৃতিক বা ‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’ অর্জন করেছেন। এইসব শহরে তেমনভাবে তৃতীয় ঢেউ লক্ষ্য করা যায়নি। একই ঘটনা দেখা গেছে মুম্বাইয়ের বস্তি অঞ্চলে, ২০২০ সালের আগস্ট মাসে, প্রথম ঢেউয়ের পরে। সেখানেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের দেখা মেলেনি।
এই ‘ন্যাচারাল ইমিউনিটি’র ঘটনা সর্বজনীন মুখোশ ব্যবহারের যুক্তিকে নস্যাৎ করে।
(ঙ) সকলে সর্বত্র মুখোশ ব্যবহার করলে কোনও ক্ষতি নেই। সত্যিই কি তাই? যারা এসব কথা প্রচার করেছেন তাদের তো এখন স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, বিশ্বব্যাপী জনমানুষের উপর একটা ভুল ধারণা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সারাক্ষণ মুখোশ ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে আমরা এখনও অনেক কিছুই জেনে উঠতে পারিনি। তবে এ নিয়ে যতটুকু গবেষণা হয়েছে তা মোটেই উৎসাহিত করার মতো না। শিশুদের মধ্যে তার ফল আরও মারাত্মক। তাদের সংবেদনশীলতা দ্রুত হারে কমছে, ধীশক্তিও।
বেঙ্গালুরু শহরের ডাক্তাররা জানিয়েছেন, শিশুদের বেলায় মুখোশের ব্যবহার পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়, আর তার ফলে যাদের বয়েস পাঁচ বছরের কম তাদের মধ্যে বাকশক্তি, বাচনভঙ্গি এবং বাকপ্রণালীর ক্ষতি বেড়ে গেছে অন্তত দশ গুণ। ধীশক্তি এবং বাকপ্রণালীর এই ক্ষতি কি তারা আদৌ কখনও কাটিয়ে উঠতে পারবে? এই নিদারুণ ক্ষতির পিছনে সর্বদা মুখোশের ব্যবহার কতটা দায়ী তা কীভাবে জানা যাবে, কেউ কি জানেন?
এছাড়াও অন্যান্য ক্ষতির কথাও ভাবতে হবে। মুখোশ ব্যবহারের ফলে মুখগহ্বরের ক্ষতিকর পদার্থগুলো পুনরায় শরীরে প্রবেশ করে আমাদের শ্বাসযন্ত্রের যে ক্ষতিসাধন করে তা আটকানো যাবে কীভাবে? আমাদের মতো দেশের উষ্ণ পরিবেশে মুখোশ কতটা ব্যবহারযোগ্য? বরং মুখোশের মধ্যে যে জীবাণুগুলো জমতে থাকে তাতে তো আমাদের সমূহ ক্ষতিই হওয়ার কথা। যত বেশিকাল মুখোশ ব্যবহার করব ক্ষতি তত বাড়বে। বিশেষ করে, শিশুদের বেলায় এগুলো আমরা ভাবব না?
এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সামাজিক ক্ষতি। ভাইরাসের ভয়ে সর্বত্র মুখোশের ব্যবহার আমাদের উদ্বেগ কমায় না, বরং তা অনেক বাড়িয়ে দেয়, চিরস্থায়ী করে দেয়। এইভাবে আমাদের মানসিক কাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে।
আমরা পরস্পরকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাই, আর ভাবি প্রত্যেকেই বুঝি ভাইরাসের গোপন বাহক! তাতে কি একটা সমাজ আর স্বাভাবিক, সুস্থ থাকে? এর উপর আছে আমাদের মননের বিকার, - ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে আমরা প্রতিবেশীকেই গাল দিই, তাকেই দায়ী করি। এমন এক ভয়ংকর সংস্কৃতি সমাজে তৈরি হচ্ছে। অথচ আমরা নির্লিপ্ত।
একটা কথা অবশ্য ঠিক যে, ভাইরাস সংক্রমণ আটকাতে লকডাউন থেকে স্কুল বন্ধ করে রাখার মতো যতরকম বিশ্রী বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তার মধ্যে মুখোশের ব্যবহারজনিত ক্ষতি হয়তো তুলনায় কমই। কিন্তু একথাও সমান পরিমাণে ঠিক যে, অন্য বিধিনিষেধের মতো মুখোশ ব্যবহারের পিছনেও বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং তথ্যপ্রমাণ নেই বললেই চলে। বিজ্ঞানচিন্তার জায়গায় মনোগত বাসনাবিলাসকে বসানো যায় না। এটুকু শিক্ষা নিতে পারলেই আমাদের মঙ্গল।
লেখক - অধ্যাপক, মুম্বাই আই আই টি
(‘মাস্কস হেল্পড লেস, হার্মড মোর’ নামে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এপ্রিল ১৮, ২০২২, ন্যশনাল হেরাল্ড পত্রিকায়। ভাষান্তর – স্থবির দাশগুপ্ত)