কুইক রাজু কুইক। অবসাদের এ গাড্ডা থেকে নিজেকে টেনে তুলতে হবে। এক্ষুণি। সামান্য সময় পেলেই মন খারাপের রাজহাঁসরা লম্বা ঠোঁটে ঠুকরে ছিঁচড়ে কুচি কুচি করে ফেলবে ওর হৃদয়। তখন টানা সাতদিন ধুঁকরে কুঁকড়ে কাটাতে হবে মনহারা ভাবনাহারা ইচ্ছেহারা হয়ে। এত কষ্টের লেখাটা ঠিক সময় পৌঁছে দেওয়া যাবে না পত্রিকা অফিসের দপ্তরে। সাধারণত সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে লেখালিখির নির্দিষ্ট মেয়াদ বেঁধে দেওয়া হয় লেখককে। কারণ এই লেখাগুলো দেশবিদেশের সম্প্রতি ঘটে যাওয়া চলমান ঘটনা সম্পর্কে আঁতেল শ্রেণীর আগ্রহী পাঠকদের চাহিদার উপর লক্ষ্য রেখে তৈরি করা হয়।
নিজের বানানো কালো কফিতে চুমুক দিয়ে নিজের ভেতরে ডুবে যায় রাজু।
তার যৌবন কেটেছে প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র গুপ্ত রাজনীতি করে। তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। রাজুর দীপ্র যৌবনকাল। দলীয় পাঠচক্রে তীব্র শ্লেষে ওদের জানিয়ে দেওয়া হল, এ স্বাধীনতা খয়রতি স্বাধীনতা। ভারতের দেওয়া এ খয়রাতি স্বাধীনতাকে তারা হাতি ও গন্ডারের সঙ্গমজাত সন্তান বলে মনে করে । এক কথায় এ স্বাধীনতা বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থ, আগ্রাসন আর দাদাগিরির আবর্তে বাংলাদেশকে কব্জায় রেখে অতি অলক্ষ্যে নয়া উপনিবেশবাদের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার গুপ্ত কৌশল মাত্র।
তাছাড়া ক্রমশঃ চরম ঘন হয়ে আসা চলমান মুক্তিযুদ্ধের এমন হঠাত দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটানো হয় যে সাধারণ অনেক বাঙালি স্বাধীনতার মূল তাৎপর্য ও গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম না হয়ে ভারতের কারসাজি বলে ধরে নেয়। স্বাধীনতার পর প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ধর্মহীনতার রঙ দিতে শুরু করে। এটি আবার কিছু সংখ্যক জনগণের বেশ মনে ধরে। সেই সঙ্গে যুদ্ধ পরবর্তী সঙ্কটসঙ্কুল সময়ে সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা খাদ্য দ্রব্যসহ নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিছু নেতা, পাতিনেতা থেকে গলি নেতারা দলবাজির সুযোগ নিয়ে সাড়ম্বরে মজুতদারী চালিয়ে যাচ্ছিল। এছাড়া বিভিন্ন শহর ও গ্রামে উছৃংখল কিছু মুক্তিযোদ্ধার অনৈতিক কার্যকলাপ সরকারের ভাবমূর্তিকে দ্রুত খবিস করে তুলেছিল। হয়ত এ পরিস্থিতিও সামাল দেওয়া সম্ভব হত কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বড় বড় নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি লুটতরাজ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্যে পাঠানো বিদেশি সাহায্য তছরূপ, মূল্যবোধের অবক্ষয় সদ্য স্বাধীন দেশটাকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সাধারণ বাঙ্গালীদের কেউ কেউ প্যারোডি বানিয়ে ফেলেছিল, ছিলাম ছিলাম ভালোই ছিলাম পা--কি-স—তা--নের আমলে----
২
সিগ্রেটের মাথায় পতন উন্মুখ ছাইয়ের লম্বা আয়তন দেখে আগ্নেয়গিরির পোড়া ছাইয়ের কথা মনে পড়ে যায় রাজুর।
পদ্মার ওপারে রাজবাড়ি জেলা। এর কয়েক মাইলের ভেতরে রাজুর এক সম্পদশালী জোতদার মামার বাড়ী ছিল। ঝড় বৃষ্টির এক রাতে বিশাল এক নৌকায় পদ্মা পাড়ি দিয়ে সেই মামা রাজুদের বাড়ি এসেছিল সন্ত্রস্ত্র সংগোপনে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে। ওকালতিতের দক্ষ রাজুর আব্বার কাছ থেকে বুদ্ধি নেওয়াই ছিল মামার উদ্দেশ্য। প্রচন্ড রাগে ফোঁপাচ্ছিল সেই মামা, কি মজিবরের এতবড় সাহস ! বাপদাদার আমলের শত শত জমি এখন চাষাভুষোদের মধ্যি বিলি করে দিতে হবে ! তারে কি এজন্যি আমরা এদেশের রাজা বানাইছি !
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৯৮ সংখ্যক আদেশ মোতাবেক বাংলাদেশে জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা পরিবার প্রতি একশত বিঘায় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে সম্পদশালী ধনবান জোতদাররা ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে ক্ষেপে গেছিল। রাজুর এই মামা ছিল এই জোতদারদের একজন বড় ষন্ডা।
এরই সাথে সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা বিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা। রাষ্ট্র এবং জনগণক বিভ্রান্ত করতে এরাই ছিল সবচেয়ে ক্ষতিকর পক্ষ। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী যারা পালিয়ে যেতে পেরেছিল ভারত হয়ে পাকিস্তান এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে তারা নিজেদের ভেতর সংযোগ স্থাপন করে নিয়েছিল। এর সঙ্গে মিশে গেছিল বিশ্বরাজনীতির কূটকৌশল। ক্ষমতার দুটি বলয় ছিল সে সময়ের পৃথিবীতে। সাদা কথায় দুই পরাশক্তি, আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়া। তো চোখের সামনে এবং আড়ালে ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়ার নিরবিচ্ছিন্ন সখ্যতার সঙ্গে সদ্য স্বাধীন চুনো বাংলাদেশ যে জুড়ে যাচ্ছে ---- এ ব্যাপারটি চীন এবং আমেরিকার ভালো লাগার কথা ছিল না। একশ্রেণীর চীন সমর্থিত রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের কূপমণ্ডূক অংশ নাস্তিক রুশ ভারত বলয়ের গ্রাসে বাংলাদেশের ক্রমশ এই ঝুঁকে যাওয়া মেনে নিতে পারছিল না।
আবার মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ প্রথমে মতাদর্শগত দলীয় কোন্দল পরে স্বজনতুষ্ট সরকারের উপর অনাস্থা এনে দল ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে গেছিল। সৃষ্টি হয়েছিল জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দলের। একই সাথে নকশাল আন্দোলনের গোপনকর্মীরা বাংলাদেশ জুড়ে শুরু করে দিয়েছিল খতম রাজনীতি। প্রতিদিন খতমের খবর আসছিল। যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, বরিশাল, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশ জুড়ে চলছিল নক্সাল আন্দোলন। তরুণ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা প্রাণ ঢেলে দিয়েছিল লাল সালাম লাল সালাম বলে।
ক্ষমতাসীন সরকারের সে এক ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
সেই ক্রান্তি লগ্নে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েই রাজু সরাসরি জড়িয়ে গেছিল গোপন বাম দলের সঙ্গে। ওর দু চোখে ছিল স্বপ্ন। সিনায় সিনায় অদম্য সাহস। সহজ অঙ্কের উত্তরের মত ভেবেছিল, যত্তসব জোতদার, মজুতদার আর বিরুদ্ধ রাজনৈতিক নেতা শালাদের খতম করে ফেললেই এদেশে সমাজতান্ত্রিক সাম্যব্যবস্থা কায়েম হয়ে যাবে।
সময়ের স্রোতে সেই সংগ্রাম ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। রাজুর সঙ্গী কমরেডদের অনেকেই নির্বিচারে খুন এবং হত্যার শিকার হয়ে গেছিল। ভাগ্য ভালো হলে জেলবাস ছিল অনিবার্য। আর যারা বেঁচে গেছিল তাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে ভিড়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সহজপাঠে। ব্যক্তিগত মোক্ষ লাভে অনেকেই আবার ক্রমশঃ ধনপতি হয়ে উঠেছে। শিল্প কলকারাখানার মালিক হয়ে তারা প্রকাশনা শিল্পেও নাম দাগিয়েছে বুদ্ধিজীবি হিসেবে। আবার কেউ কেউ এসব না পেরে হয়ে গেছে চতুর বায়স। রাজু এই শেষ দলের একজন।
ওদের তরুণকালের নিভন্ত সেই সংগ্রামী ছাইভস্মকে এনালোজি করে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের উস্কে দেয় রাজুরা। এশিয়ার রাজনীতি যতই গণতান্ত্রিক হোক না কেন মূলত তা পারিবারিক নেতৃত্ব তিয়াসি। পরিবারতন্ত্র এশিয়ার ইজম হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ধরণের গণতন্ত্রে সুফল যতটুকু যাই থাকুক না কেন, কুফলের কখনও অভাব হয় না। তাই যে কোন দলের ক্ষমতাসীন সরকারের অপকর্মের যেমন কোন বিরাম বা প্রমাণ থাকে না, তেমনি আন্দোলনও চলতে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশে দু দুবার সামরিক শাসন জারি হয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব চলে গেছে জলপাই ব্যারাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী দু দুজন সামরিক শাসকই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে শাসন করে গেছে। ইন্টেরেষ্টিং ব্যাপার হলো, এই সামরিক শাসকরা বাম ফ্লেভার লাগা রাজুদের ভোলেনি। রাজনৈতিক নানা সঙ্কটে এরা রাজুদের শরণাপণ্ণ হয়েছে। নিয়েছে শলা পরামর্শ। সঙ্কটকালে এদের বুদ্ধির উপর ভরসা করেছে। বিণিময়ে তারাও দিয়েছে আর্থিক সহায়তা। জনগণকে কাছে টানতে এদের কাউকে কাউকে আবার ক্ষমতার অংশ করে নিয়েছে।
এছাড়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে দেশের দু একটা প্রতিষ্ঠানও গোপনে রাজুদের পেছনে ফুয়েল যোগান দিয়ে চলেছে।
রাজুদের ক্যারিশমায় বাংলাদেশের যে কোন ক্ষমতাসীন দলের সরকারের বিরুদ্ধে ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছেলেমেয়েরা ধেয়ে আসে উন্মত্তের মত। তাদের মুখে ও মনে জ্বলজ্বল করে প্রতিবাদের গন্গনে রাগ। পোষ্টার ফেস্টুনে শাহবাগ থেকে সমগ্র বাংলাদেশ কেঁপে ওঠে। পুরনো শ্লোগানগুলো নতুন নতুন কন্ঠে শানিত হয়ে আগুন ছোটায়। রক্ত স্তিমিত হয়ে গেছে এক সময়ের যে সব বিপ্লবী বুড়োবুড়িদের, তারাও নতুন করে চলকে ওঠে উত্তেজনায়। দেশের পত্রপত্রিকা টিভি চ্যানেলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের সাহায্যে দ্রুত বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পুলিশের ধরপাকড় মারপিটসহ আন্দোলনের চুম্বক অংশ এবং সরকারের পেটোয়া বাহিনীর নির্যাতনে আহত শিক্ষার্থীদের সচিত্র দৃশ্যের করুণ ভিডিও। কিছু কিছু রক্ত ঝরে। কেউ কেউ জেলে যায়। কদিন টগবগ করে ফোটে বাংলাদেশ। মনে হয় বিপ্লব আর দীর্ঘ দূরের কোন ষ্টেশন নয়। খুব কাছে। এবার ঘটেই যাবে ফসলের মাঠে, কৃষাণের ঘরে, শ্রমিকের ব্যারাকে বিপ্লব এনে দেবে সমান অধিকারের ইস্তেহার। মাঝারি কিছু নেতা, বিদ্রোহী কোন ছাত্রনেতা অনলবর্ষি বক্তৃতা দিয়ে মাঠ গরম করে রাখে। প্রতিদিন তপ্ত খবর শোনার জন্যে ঘাড় সোজা করে রাখে জনগণ। ঘরে ঘরে, অফিস আদালতে, রাস্তাঘাট, দোকান বাজার, হাট গঞ্জের সাধারণ মানুষ চোখ মেলে কান পেতে থাকে, তবে কী অনাগত সেই সুদিন এলো তাদের এই মরা দেশে !
কেবল কিছু পোড় খাওয়া বুদ্ধিমান মানুষ রূপকথার বেঙ্গমা বেঙ্গমির মত এ আন্দোলনের সাজানো ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তারা আড়ালে মুচকি হাসে। কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় গুঁজে দেয় প্রাত্যহিকতার ঢালাও জীবনে।
৩
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাগ, ক্ষোভ, চীৎকারকে ক্যাশ করে, মওকা নেয় ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধী পক্ষরা। তারা লাগাতার বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে ছাত্রদের দাবিদাওয়ার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ফেলে। স্বার্থ তাদেরও আছে। সবই খুল্লামখোল্লা এ যুগের রাজনীতি। এইসব বিরোধী দলের গোপন অভিলাষ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দ্রুত পতন ঘটানো। রাজনৈতিক টালমাটালের এ সময়ে, জনগণের যে অংশ ঘিলু খাটিয়ে চলে তারা অবশ্য চিন্তা করে, এরপর কে আসতে পারে ক্ষমতায় ! দেশে নেই কোন শক্তিশালী বিরোধী দল। যারা আছে তারা পাপেট এবং সরকারী দলেরই অন্য পিঠের পোষ্য।। সুতরাং এদের কেউ এলে কতখানি গুণগত পরিবর্তন হতে পারে দেশ এবং জনগণের ? তারা বোঝে, ছাই হবে অথবা কচু জাতীয় কিছু গজাবে। সেই ত পার্সেন্টাজ খাওয়ার সরকার আসবে ! এ টিম গেলে বি টিম আসবে ক্ষমতার সিংহাসনে। বি টিম গেলে আবার এ টিম। যে লাউ সেই কদু। এর চে যারা আছে তারাই থাকুক গে। যা আছে তাই চলুক এদেশে। অন্তত দেশটা ত স্থিতিশীল আছে।
ওদিকে বড় পর্দার আড়ালে শুরু হয়ে যায় নাটক। আন্দোলনে্র উল্লেখযোগ্য কিছু নেতাদের সঙ্গে চলে সরকারের দেন দরবার সমঝোতার আলোচনা। স্ক্রিপ্ট টানটান। সরকার নমনীয় হয়ে প্রকাশ্যে কিছু দাবিদাওয়া মেনে নেবে। এতে নেতাদের মান যেমন বজায় থাকবে তেমনি তাদের পকেটও ভরে যায়। এরপর কিভাবে যেন আন্দোলনরত তরুণ নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়ে। সাধারণ ছাত্রদের অনেকেই বুঝতে পারে আবার অনেকেই বোঝে না। তারা হতাশ স্খলিত মনে আন্দোলনের রাস্তা ছেড়ে আস্তে আস্তে চলে যায়।
আমজনতা যা বোঝার বুঝে যায়।
কেন না ইতোমধ্যে পশ্চাতের ঈশ্বররা সরকারের দেওয়া হালুয়া রুটি পকেটে পুরে আন্দোলনের রাশ টেনে ধরেছে। তখন ছাত্রদের ভেতরের কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে হাত মেলায়। কেউ আবার নেতা টেতা হয়ে যায়। টিভির টক শোতে এসে একদা রাজুদের বলা কথাগুলোর পূনরাবৃত্তি করে স্ক্রিন গরম করে ফাটিয়ে দেয় অডিয়েন্স। জ্বালাময়ী এসব বক্তব্যের জন্যে কিছু সাংবাদিক ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে কাউকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দেয়। মিডিয়ার বাড়তি খাতির পেয়ে ‘মুই কি হনু রে’ হাবভাব নিয়ে এরা তখন চলাফেরা করে। পেছনে জুটে যায় একদল মোসাহেব। সবাই মিলেঝুলে আয় রোজগারের ধান্ধা খুঁজতে সরকারের বিপক্ষ দলের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর চিপাচাপায় থেকে প্রেশার গ্রুপের কাজ করে। আবার এদের মধ্যে যারা একটু বেশি রকমের চালাকচতুর আর ব্যক্তিস্বার্থ বুঝদার তারা রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে চলে যায় বিদেশ। সেখান থেকে সরকার বিরোধী বিভিন্ন গরম গরম লেখা ছড়িয়ে দেয় নিজের টাইম লাইনে অথবা সমমর্মি কোন প্রিন্ট এবং ওয়েব পত্রিকার পাতায় পাতায়।
আন্দোলনের তলানিতে থাকা সাধারণ এবং অতি সাধারণ ছাত্ররা জীবিকার দাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা কর্মক্ষেত্রে। কেউ বেশি কেউবা কম আরামের বশংবদ হয়ে জীবনটাকে বেঁধে ফেলে চিরাচরিতের নিয়মে। স্বামী স্ত্রী ছেলেমেয়ে বাজারঘাট স্কোয়ার ফুটে মাথাগোঁজার একটি ফ্ল্যাটের চিলতে ব্যালকেনিতে বনসাই কিম্বা বিদেশি অর্কিডে ফুল ফুটিয়ে সংসার সাজিয়ে নেয়।
এই তো রাজনৈতিক সিষ্টেম এখন ! বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রায় একই চেহারা। একই স্ট্রাকচার। আজকের রাজনীতিবিদদের বাপ দাদা পর দাদারাও এই সিষ্টেমের চক্করে গড়িয়ে দিয়েছে তাদের স্বপ্ন জীবন ও কর্মকে।
রাজু প্রথম চোটে অতটা কানকাটা হতে পারেনি। অবশ্য চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না ওর। তবে ব্যাটে বলে মেলেনি। হয়ত ভাগ্য সদয় ছিল না বা তখনও কিছু আদর্শ, লোকলজ্জার দ্বিধা রাজুর মনের কোণে সংশয় আবিষ্ট হয়ে চেতনার ছুরি মারছিল ! সে যাই হোক শেষপর্যন্ত সেসব ঝেড়েঝুড়ে সে কামিয়াব হতে পেরেছে।
মাঝে মাঝে রাজু নিজেকে নিয়ে পরিহাস করে। দেশের প্রিমিটিভ এই সিষ্টেম ভাঙ্গার কমরেড হতে গিয়ে ও নিজেই সিষ্টেম প্লেয়ার থেকে একজন পলিটিক্যাল সিক্রেট এজেন্ট হয়ে গেছে !
৪
কফি পানসে লাগছে। বিশ্রী স্বাদ। ন্যাপথলিন গুলানো গন্ধও আসছে। জিহবা নিতে চাইছে না বলে রাজু কফি পাত্র উপুড় করে দেয় বেসিনে। কল খুলে আয়নায় নিজেকে দেখে। ঝুলে নুয়ে পড়েছে ভ্রুর কাঁচাপাকা চুল। চোখের মণি দুটো ঘষা মার্বেলের মত অনুজ্জল, ধোঁয়াটে। গলার নিচে তিন তিনটে শক্ত পাকদন্ডি। রাজু কোন দিনই দেখতে মোটেও স্বাস্থ্য উজ্জ্বল, মোটাসোটা টাইপের ছিল না। বরং রোগা শরীরে কিছুটা হতভাগা সুলভ চেহারা ছিল ওর। দেখলে সহজেই বোঝা যেত, লোকটা বামপন্থী। আহা রে এক সময় বাম আদর্শে বিমোহিত হয়ে সযত্নে লালিত এবং নিমজ্জত থেকে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে বেচারা। খুব সিম্পল রাজু। স্বল্প খায়। সস্তার সামান্য পরিধান ব্যবহার করে। এই কয়েক বছর হলো পাঞ্জাবীর উপর শ্রী ছড়াচ্ছে কালো মুজিব কোট। কখনও ঘড়িটড়ি পরে না। চোখে হাজার দুই টাকার হাফ রিম নিকেলের চশমা। গরম কালে পরে বাটার স্যান্ডেল সু আর শীত পড়লে অই বাটা কোম্পানীর কেডস পরতেই সে আরাম বোধ করে।
বাহ্যিক অতি সিম্পল রাজুর চেয়ে গুপ্ত রাজুর অর্জিত সঞ্চয় অনেক অনেক বেশি ওজনদার। এখন সে প্রচুর ধনী। এ কথা ভাবতেই হাহাকার বেজে ওঠে ওর শরীরে। বুকের ভেতর, হাড় ও মজ্জায় ভূমিকম্প বয়ে যায়। হুহু করে ওঠে মন। কার জন্যে ? কাদের জন্যে সে এতসব করে চলেছে ! কে আছে তার আপনজন ! প্রিয়, খুব প্রিয় একটি কিশোর মুখ জেগে আছে ওর অন্তর জুড়ে। সে কিশোর রাজু ফারহানার গোপন প্রেমের সন্তান। লোক সমাজের সামনে রাজু তাকে নিজের সন্তান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছে না ! কখনও কি পারবে ? সে কিশোর মানুষ হচ্ছে কাকের বাসায়। মানুষই হচ্ছে। কোকিলের ছানা হয়ে উড়ছে না। লেখাপড়া, কথাবার্তা, খেলাধূলায় প্রখর বুদ্ধিমান। যেন রাজুর কিশোর বেলা খেলা করছে অই কিশোরের মুখে। ফারহানা অনেক অপেক্ষা করেছে। অনেক দিন বছর। শেষপর্যন্ত রাজুর পক্ষে পুরবীকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করা অসম্ভব বুঝে গেছিল। তাই দীর্ঘদিনের প্রবাসী কাজিনকে বিয়ে করে চলে গেছে জার্মান। স্বামী, স্বামীর আগের পক্ষের দুটি সন্তান এবং নিজের সন্তানকে নিয়ে বেশ ভালো আছে এখন।
পেট মোটা একটি ভদকার বোতল বের করে রাজু। কফি কাপে ঢেলে কয়েক টুকরো লেবুর শুকনো ছিলকে দিয়ে বারান্দার আলো আঁধারিতে এসে বসে।
দলছুট বাতাসে উগ্র পানীয় আর সিগ্রেটের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে বাইরে। পাশাপাশি বারান্দায় পাথর হয়ে বসে থাকা স্ত্রী পূরবীর মন ভেসে যায় দুঃখে। কন্টকিত কাঁকড়া বিছের মত হয়ে গেছে রাজু। শিরায় শিরায় প্রতারক। সারাক্ষণ হুল খাড়া করে থাকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুডে। তবু রাজুর জন্য ওর খারাপ লাগে। মায়া জাগে। এত এত কষ্ট সহ্য করে কি পেলো রাজু ! কিছুই না। বেচারা। টনটন করে ওঠে পূরবীর মন। রাজু যা পেয়েছিল সে সবকিছু সামাজিক সম্মান, সমর্থক প্রিয়তা আর রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য হারানোর ভয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। রাজুর দ্বিতীয় প্রণয়ের সন্তানটি মানুষ হচ্ছে বিদেশে। প্রতিপালনের খরচ রাজু দিলেও পিতৃপরিচয় দিতে পারেনি। রাজুর অল্পবয়েসি প্রেমিকা রাজুকে সে সুযোগ দেয়নি। চাচাতো ভাইকে বিয়ে করে বেশ ভাল আছে মেয়েটি। ফেসবুকে ছবি দেখে অন্তত তাই মনে হয়। তবে ছেলেটি যত বড় হচ্ছে চেহারায় রাজুর আদল তত বেশি ফুটে উঠছে। দেখতে অনেকটা রাজু পূরবীর ছোট মেয়ে মিতিলের মত লাগে ছেলেটিকে।
পূরবীর মনের কোণে জ্বলে ওঠে প্রাচীন এক জোনাক। মায়া মমতার আলো ছায়ায় ওড়াওড়ি করে পূরবীর প্রাণ ধরে দেয় টান। অমনি কলকল করে ছুটে আসে ভালোবাসা দল। রাজুর জন্য, রাজুর ছেলেটির জন্য মায়া আর ভালোবাসায় কেঁদে ফেলে পুরবী।
ভালোবাসা সে তো পাথরকুচি পাতার মতো পুস্পিত অশেষচক্র। জন্মান্তর পিয়াসী। অক্ষয় অশেষ। শেষ কোথায় ভালোবাসার ! বেচারা রাজু।