শিকারি পাখির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলে সাপের মতো দেখালেও, প্রকৃত প্রস্তাবে, এটি একটি সরু এবং আঁকাবাঁকা সড়ক। এখানে এবং ওখানে, যেখানে যেমন পেরেছে, ইচ্ছামতো গজিয়ে উঠেছে গাছপালা—বিশেষত, গুল্মলতা। এই পথ এখান থেকে এঁকেবেঁকে বহুদূরে গিয়ে মিশেছে বড়োরাস্তায়, রাজপথে; নিতান্ত দরিদ্র আর অবহেলিতের মাফিক। এই গলিপথ নির্দিষ্ট দূরত্ব পেরিয়ে মিশে যায় ঔপনিবেশিক নগরপথে। চারপাশে ছোটো-বড়ো অজস্র টিলা, ইতিউতি আগুনপাহাড় এবং ক্বচিৎ-কদাচ তাদের অনর্গল লাভাস্রোত, ফলত শুকিয়ে যাওয়া সেই উৎস্রোতের চিহ্ন ধরে সড়কটির সম্বৎসর চলাচল। ঝামাপাথরের এই বিশেষ সড়কটি খচ্চর আর গাধাদের দ্বিমুখী যাতায়াতের কারণে হিন্দু বিধবার সাদা থানের মতোই বর্ণহীন, ফ্যাকাশে হয়ে প্রাচীন খনিজপাহাড়ের ফাঁক গলে—পশ্চিম থেকে পুবে—চলে যায়। খরতপ্ত মধ্যাহ্নে ভারী হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের বায়ুমণ্ডল, কারও-বা দমে ঘাটতি হয়; হাওয়ার আচমকা ঝাপট পথে পড়ে-থাকা গ্রানাইটের মধ্যে আন্দোলন তোলে, বাতাসে মিশে যায় প্রস্তরচূর্ণ আর ঘনিয়ে ওঠে ধুলোর ঝড়; তখন এই আপাত সংকীর্ণ অবস্থান থেকে ওই দূরের বন, সেই বনের গাছের সারিকে সবুজ ভ্রূকুটির মতো বোধ হয়। সেই রুক্ষ জমিতে, দূরে, আলপথের মতো দেখা যায় রেললাইন। দিনের মধ্যে ট্রেন আসে একবার, ফিরেও যায় সেই একবারই—এখানে রেলস্টেশন নেই, এখানে প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলে না, বিচ্ছিরি আওয়াজে নিজের আগমন এবং নির্গমনের খবর জানায় জরাগ্রস্ত মালগাড়ি; সারা দিনে মোটে ওই দু'বারই শোনা যায় তার ধাতব গর্জন। ট্রেন এলে পর তামাটে-কালো মানুষেরা ওয়াগন কুপগুলো ততোধিক কুচকুচে কালো পাথরের পিট্-ভর্তি বস্তা দিয়ে ভরে দেয়; শূন্যস্থান পূর্ণ হয়ে উঠলে শিরা বেরোনো ঘেমো হাতের ক্লান্ত বেলচা শরীর ছেড়ে দেয় ওই কাঁকুরে মাটিতে।
বড়োসড়ো একটি গিরগিটি, কর্কশ ও লোলচর্ম, আপন খেয়ালে রাস্তা পেরিয়ে হলুদ ফুল আর সবুজ কাঁটাঝোপের ভিড়ে হারিয়ে গেল।
খাদানের পাহারাদার—পেটানো শরীর সত্ত্বেও কী কারণে কে জানে, একটি চোখ সর্বদা বন্ধ, অতএব একচক্ষু—ট্রেনচালকের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছে যায় এঞ্জিনের কাছে; তার আগে হাত মেলানোর সময় লাঠিটা হাতবদল হয়েছে—ডান থেকে বামে। ঠিক তখনই, নানান মাপের পাখিদের একটা ঝাঁক পাক খেতে শুরু করে মাথার উপর : তাদের গলা দিয়ে বেরোনো খ্যানখ্যানে আওয়াজ আর দ্রুত ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলে তৈরি হয় আর্তনাদের আবহ। তখন সেই রুক্ষ মাটির উপর পিঠে বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা খচ্চরের পাল কাঁপতে থাকে, ফলে ভিতরে-ভিতরে হাড় পর্যন্ত কেঁপে যায় চালকের। চৌকিদার বুঝতে পেরে তার কাঁধে হাত রাখে, আশ্বস্ত করে এবং অধস্তনদের কড়া নির্দেশ দেয় খচ্চরগুলোর গলার দড়ি শক্ত হাতে ধরে রাখতে : রাশ সামান্য আলগা দিলে আর উদ্বৃত্ত বাড়বে না; গলায় চাপ না-দিলে মুনাফায় টান পড়ে। গলায় টান পড়ার কারণেই বোধহয় সন্ত্রস্ত খচ্চরের দল অনুজ্ঞাসূচক ঘাড় হেলিয়ে চুপ করে যায়। বড়োজোর দু'-একটার ক্ষুরের আওয়াজ, অনিয়মিত, মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। এই দৃশ্য দেখে ওই একটি মাত্র চোখ, ওয়াগনের ধাতবগাত্রে প্রতিফলিত যে-চোখ চৌকিদারের, হাসি খেলে যায় সেই চোখে—কুটিল এবং ক্রূর।
এই অঞ্চলে গরম বেশি হলেও আগের থেকে এখন অনেক কম। তবু লু বয় দিনের বেলায়। একটা সময় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত আগুনের হলকা, গড়িয়ে যেত ঢালে। অগ্ন্যুৎপাতের সেই অভ্যাস থেকে এখন রেহাই মিলেছে, পৃথিবী এখন শান্ত, তুলনায় শীতল। অদূরের ওই জঙ্গল কতবার যে সেই আগুনে ছারখার হয়ে গেছে, ইয়ত্তা নেই। ছাই হয়েছে, ফের সেই ভস্ম থেকেই জন্ম নিয়েছে নতুন প্রাণ; বানজার জমি আবারও ভরে উঠেছে কলতানে। তখন মজুরদের হররোজ মাটির গভীরে ঢুকতে হত না প্রাণ হাতে, কপিকলে লাগানো দড়ির টানে মাটির উপরে পৌঁছে যেত না বালতি-বালতি কয়লার চাঙড়; তখন অধস্তন ছিল না, এমন-কি চৌকিদারও ছিল না। তখন উৎসব ছিল, খুশির উদযাপন ছিল; ছোটো টিলাগুলির উপর উঠে পুরুষটির কাঁধে মাথা রেখে নারীটির নির্নিমেষ সূর্যাস্ত দেখার অবসর ছিল। দক্ষিণের উপাসনালয়গুলো সেই গোধূলিবেলায় মঙ্গলধ্বনি ভাসিয়ে দিত হাওয়ায়-হাওয়ায়; ঝুপ করে অন্ধকার নামত চরাচর জুড়ে। সন্ধ্যাবাসর জুড়ে থাকত গল্প আর গান—সুর আর তালের সঙ্গে ঘুরে-ঘুরে নাচ।
তারপর একদিন চৌকিদার এল, সঙ্গে এল অধস্তনেরা। জঙ্গল আর জনপদের সীমানা ধরে চরে বেড়ানো গাধা আর খচ্চরগুলো সব বন্দি হল। কাগজ এল, কালি এল; কাগজে কালির দাগ পড়ল : টিপসই। অসীম আকাশ আর দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে লীলা-লাস্যে মাতোয়ারা মানুষগুলো বিনা আয়াসে, কিছু না-জেনেই হয়ে গেল খনিমজুর। দক্ষিণের সব জাগ্রত দেব-দেবীরা চলে গেল অনন্তশয়নে। ঈশান কোণে গড়ে উঠল একেশ্বরের প্রাসাদোপম বিরাট আবাস : চৌকিদার একেশ্বরের উপাসক, সে বিশ্বাস করে একমাত্র একেশ্বরই পারে সকল ক্লেশ থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে; কর্তার ইচ্ছায় কর্ম : সুতরাং, একেশ্বরের সংকীর্তন শুরু হল। সংহারক ভেবে ভয়ে হোক বা হিতসাধক ভেবে ভক্তিতে—একেশ্বরের আরাধনা সংহিতা নির্দেশিত আচারাদি মোতাবেক নিয়ম করেই চলতে থাকল চৌকিদারের মর্জিমাফিক।
চৌকিদার আসার পর শুরু হল কর্মযজ্ঞ : গাধা আর খচ্চরদের জন্য থাকার জায়গা—ছাউনি মতন—বানানো হল, পশুপ্রেমের নমুনা পেয়ে সবাই ধন্য-ধন্য করল; অধস্তনেদের জন্য এল সাদা হাফহাতা জামা আর আজানুলম্বিত খাকি প্যান্ট—ইউনিফর্ম; মাপজোক হল চারপাশ, পাতা হল রেললাইন; ইস্পাতের সেই পাত ঘিরে বাচ্চাদের মধ্যে আমদানি হল নতুন খেলার। রেললাইন বসে যেতেই এল শাবল গাঁইতি বেলচা বালতি কপিকল, এল ব্যাটারিচালিত আলো, আর মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে অবশ্যপ্রয়োজনীয় উপাদান : ডিনামাইট। যেদিন প্রথমবার হুইসল্ বাজিয়ে এসে পড়ল রেলগাড়ি, এখানকার মানুষগুলো যখন সদ্য মজদুরি শুরু করেছে, তখনও তারা বুঝে উঠতে পারেনি, যে, মানুষের লোভ যত বাড়বে, সভ্যতায় ডিনামাইটের চাহিদাও তত ঊর্ধ্বমুখী হবে। ডিনামাইট সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এই মানুষগুলোর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না, আগামীতে এই কৃত্রিম বিস্ফোরক শুধু পাহাড় গুঁড়িয়েই ক্ষান্ত হবে না, পিষে দেবে আদি-অকৃত্রিম মানুষদেরও।
মালগাড়ির একঘেয়ে আবহধ্বনি যবে থেকে ধারাবাহিক হয়ে উঠল এই অঞ্চলে, বদলে গেল প্রাত্যহিক অভ্যাস। দিনের আলো ফুটে উঠলে শুরু হয়ে যেত কাজ : একদল নেমে যায় মাটির গভীরে, দ্রুততার সঙ্গে বালতি ভরে ওঠে কয়লায়, কপিকলের সাহায্যে পৌঁছে যায় উপরে; উপরতলায় অধস্তনেরা থাকে, তাদের নিশ্ছিদ্র নজরদারিতে বস্তাবন্দি হয়ে যায় সকল খনিজ।
শুরুর সেই দিনগুলোয় লাঠি ছিল না, চাবুক ছিল না, এমন-কি চোখরাঙানিও ছিল না। বড়োসড়ো গিরগিটিটাও নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত বস্তা পিঠে সার দিয়ে দাঁড়ানো পশুগুলোর পায়ের কাছে; দু'-একটা খচ্চর পা ছুঁড়ে তাড়ানোর চেষ্টা করলে শোনা যেত ক্ষুরের বিক্ষিপ্ত শব্দ। মানুষগুলোও তখন যা পেত, অফুরান জল আর জ্বালানি সহযোগে সেদ্ধ করে নিত সেসব, খাবারের জোগান নিয়ে কপালে বলিরেখা ফুটে ওঠার সামান্য লক্ষণও ফুটে উঠত না; কিন্তু এই সাদা জামা আর খাকি প্যান্টের দল এখানে এসে জাঁকিয়ে বসার পর থেকে যত সময় যেতে থাকল, তাদের অপ্রতুল জ্বালানিতেও টান পড়তে শুরু করল। এতদিন কাজে-অকাজে যে-কয়লা হাতের কাছেই পেয়ে আসত তারা, ব্যবহারের পরও যা অঢেল ছড়িয়ে থাকত পরিপার্শ্বে, রেললাইন পাতা এবং ধাতবপথ বেয়ে-আসা মালগাড়ির যাতায়াতের পর অবাক বিস্ময়ে সেই কালো-কুঁদো মানুষগুলোই দেখল, কয়লার উপর তাদের আজন্মের দাবি আর থাকল না। আগে তারা বজ্রপাত, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্পকে ভয় পেত; অধস্তনেদের অভিন্ন পোশাক ভয় পেতে শেখাল লাঠি, চাবুক আর ভারী বুটকে।
চটের শূন্য বস্তাগুলো মেলা থাকে টিলার ঢাল জুড়ে। অন্ধকার থাকতে-থাকতে ঘুম থেকে উঠে পড়ে মহিলারা, চটের বস্তাগুলো ধরাধরি করে, যতটা সম্ভব কম ঝাঁকিয়ে নিয়ে আসে, তারপর তার উপর চলে অকথ্য অত্যাচার : শাবলের বাড়ি আছড়ে পড়ে ক্রমাগত আর সেই আঘাতে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে আংরার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। ঝাড়া হয়ে গেলে পর সবটা জড়ো করে জল দেয় মাপমতো। এরপর সেই মণ্ড হাতের কারসাজিতে ছোটো-ছোটো, অনেকটা বড়ির আকারের হয়ে ভরিয়ে তোলে উঠোন। দিনের আলো ফুটতে তখনও বাকি; অধস্তনেদের বাঁশি বেজে উঠতে আরও দেরি।
কাজ শুরু হলে পর খাদানের ভিতর থেকে প্রতিধ্বনি তোলে ঘটাংঘট শব্দ : পাথরের সঙ্গে লোহার শাবল কিংবা গাঁইতির সংঘর্ষ একঘেয়ে অনুরণনের মধ্যে দিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে কয়লাকুঠির অবিরাম কর্মচাঞ্চল্যের প্রমাণ দিতে থাকে। কপিকলের একদিকে বাঁধা বালতি কয়লায় ভরে উঠলে শোনা যায় দড়ির সড়সড় আওয়াজ। কয়লা-ঠাসা বালতি উঠে এলে অধস্তনেদের হাতের চাবুক শূন্যে আছড়ে পড়ে, মজুরের দল ব্যস্ত হাতে বালতির পর বালতি উপুড় করতে থাকে; উত্তোলিত কয়লার চাঙড় ছড়িয়ে যায় জমিতে। নির্ধারিত সময়ে মালগাড়ি এলে একচক্ষু চৌকিদারের পা মাটিতে পড়ে; সে এসে চালককে প্রত্যুদ্গমন করে নিয়ে যায় তার সাফসুতরো আস্তানায়, যেখানে যথেচ্ছ ভোজনের বন্দোবস্ত আগে থেকে করা থাকে; এই ট্রেনচালকেরা সকলেই চৌকিদারের বন্ধুস্থানীয়।
চৌকিদারের বিলাসকক্ষ নানান কিসিমের সুস্বাদু মাংস আর হরেকরকম সুরার গন্ধে মোহিত হয়ে থাকে এইসব সময়। বন্ধুচালকেরা হরিণের মাংসের টুকরো মুখে তুলে হাত বাড়ায় পানপাত্রের দিকে। বাইরে তখন সজীব হাতগুলো ওয়াগনে তুলে দেয় কালো পাথরের পিট্, কপাল বেয়ে গড়িয়ে-নামা নোনাজল ঝেড়ে ফেলে তারপর।
এখানে এইভাবেই দিন কাটে, ঋতু বদলায়। শীতের সময় ওয়াগন ভরে ডিনামাইট এল পরপর বেশ ক'দিন, সঙ্গে এল বন্দুক আর কার্তুজ : বন্দুক শিকারের পক্ষে সহায়ক; যেহেতু প্রবল গরমে বিস্ফোরক নিয়ে-আসায় ঝুঁকি থেকেই যায়, অতএব শীতকাল। চৌকিদারের আদেশে উষ্ণ লাল ভাল্লুকের মাংস তৈরি হয়ে এল এবং কার্যকারিতা দেখে নেওয়ার পর বন্দুকগুলো সব উঠে এল অধস্তনেদের কাঁধে; কোমরে বাঁধা হল কার্তুজের কোমরবন্ধ। দক্ষিণের উপাসনাগৃহগুলি, চৌকিদারের নির্দেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যেগুলি, সেখানেই মজুত করা হল বিস্ফোরক। কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল চারপাশ, এমন-কি, অধস্তনেদের কাঁধে পালা করে প্রহরার দায়িত্বও এসে পড়ল। সামান্য উসকানি পেলেই হল, সর্বনাশ হয়ে যাবে যা হওয়ার; ফলত বাড়তি সতর্কতা—মজুরদের এমনটাই বলা হল। বিস্ফোরক যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চিত হলে পর নির্দেশিকা জারি করল চৌকিদার—
• কাজের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকবে না। যতক্ষণ দিনের আলো থাকবে, যতক্ষণ অধস্তনেরা মনে করবে, ততক্ষণই কাজ চলবে।
• সকল মজুর কাজ করতে বাধ্য থাকবে।
• জ্বালানির জন্য তারা কয়লার গুঁড়োই পাবে, কয়লা নয়।
• কাজ চলাকালীন কোনও মজুরের মৃত্যু ঘটলে তার পরিবারের একজনকে কাজে বহাল করা হবে।
• প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার কারণে কারও মৃত্যু ঘটলে তাকে নিয়তিনির্দিষ্ট বলে মান্য করা হবে এবং সেক্ষেত্রে মৃতের পরিবার কোনও ক্ষতিপূরণ পাবে না।
• শরীর সুস্থ ও নীরোগ রাখার নামই স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য রক্ষার দায় প্রতিটি মজুরেরই নিজস্ব।
• গাধা এবং খচ্চরদের বয়ে নিয়ে-যাওয়া কয়লার বস্তা চৌকিদার এবং অধস্তনেদের ব্যবহারের জন্য সুরক্ষিত থাকবে। সেই সম্পদের উপর তাদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হবে।
• জনপদের দক্ষিণ অংশে বিনা অনুমতিতে যাওয়া যাবে না।
• নির্ধারিত সময়ে একেশ্বরের উপাসনা বাধ্যতামূলক।
• উপাসনার শেষে ইচ্ছুক ব্যক্তি অনতিদূরের নবনির্মিত মদিরাভবনে সুরা পান করতে যেতে পারে। ক্লান্তি অপনোদনের জন্য সুরা অব্যর্থ।
• বন্দুকের ব্যবহারে অধস্তনেরা বিশ্বাসী নয়, কিন্তু যদি প্রয়োজন পড়ে, তাহলে প্রয়োগ করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবে না তারা।
সবটা গড়গড় করে পড়ে চৌকিদার ফিরে গেলে ঙ আর ঞ—তুতো-ভাই—দেখেছিল, ভিড় সরে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। সভার শেষে যে যার বাড়ির পথ ধরেছে। ওরা দু'জন একে-অপরের দিকে তাকায়, তারপর ফিরতে শুরু করে ওই আঁকাবাঁকা সরু সড়ক ধরে। ঙ আর ঞ, দু'জনেই পেরিয়ে এসেছে জীবনের অনেকগুলো বছর, অবসন্ন হেঁটে চলার মাঝে কখনও-সখনও এ ওর দিকে চায়; দৃষ্টিতে ধরা থাকে ভীতি—পরাধীনতা আর শোষণের মারাত্মক ভয়। আসলে ততদিনে গুলি আর বন্দুককে ভয় পেতে শুরু করেছিল মানুষগুলো; দুই ভাইয়ের চোখের সামনে অমন বড়ো আর নাদুসনুদুস ভাল্লুক মাত্র একটা গুলিতেই খানিক ছটফট করে নীরব হয়ে গিয়েছিল চিরতরে, তারপর ওদের থেকেই সেই ঘটনা মুখে-মুখে জেনে যায় সবাই। চোখের সামনে দেখার কারণেই হবে, বন্দুক সম্পর্কে ঙ আর ঞ-র ভয় অন্যদের তুলনায় একটু হলেও বেশি; অন্তত ওরা এমনটাই ভাবত হয়তো, যদিও ভয় আঁকড়ে ধরেছিল সবাইকেই—কাউকে কম, কাউকে-বা বেশি। ওরা প্রকৃতিকে এতটাও ভয় পেত না, যতটা ভয় পেতে শুরু করেছিল মানুষকে।
এভাবেই একদিন বর্ষা এল খাদানে। সেই প্রবল বর্ষণে গিরগিটিটা কোথায় কোন গর্তে গিয়ে যে গা ঢাকা দিল, কেউ জানল না। গাধা আর খচ্চরগুলো ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকল ঠান্ডায়, ক্ষুর ডুবে গেল জলে। আঁকাবাঁকা ও সরু সড়কপথ বৃষ্টির জলে খরস্রোতার আদল পেল। নতুন করে গুল দেওয়া শিকেয় উঠল। যতটুকু যা সঞ্চয় ছিল ঘরে-ঘরে, সেখান থেকেই চেয়ে-চিন্তে খরচ করা শুরু হল। পশুগুলো রেহাই পেল, তবু কাজের বিরাম নেই মজুরদের; ছুটি মিলল না তাদের। খাকি বর্ষাতি বাঁশি বাজায় আর ভিজে জবজবে মানুষগুলো পায়ের আঙুল চিপে হেঁটে যায় খনির দিকে। পা বসে যায় ভেজা জমিতে। পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য পা তোলা মাত্র মাটিতে বসে যাওয়া পায়ের ছাপ মুহূর্তে ভরে ওঠে জলে। এক নতুন ধরনের আচ্ছাদনে ঢেকে—বৃষ্টি থেকে যতটা আড়াল করা যায়—খনি থেকে উঠতে শুরু করল কয়লার বালতি। দেড়দিন টানা বৃষ্টি—কখনও টিপটিপ, কখনও-বা মুষলধারে—হওয়ার পর হয়তো একটা বেলা, কি একটা দিন, বৃষ্টি হয় না তেমন; অবশ্য রোদও ওঠে না তেমন। তখন সবার আগে রেললাইন পরিষ্কার করতে হয়, তারপর মালগাড়ি কয়লায় ভরে উঠলে সেইসব খনিজ কোথায় কাদের জন্য চলে যায়, মজুরেরা সেসব জানে না; তারা শুধু নিজেদের লুঠ করে নেওয়া লুঠতরাজকে মিলিয়ে যেতে দেখে, আর তখনই হয়তো বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে ওঠে ট্রেনের গতিপথ।
সেবার ট্রেন এসে পৌঁছতেই বৃষ্টি নামল আকাশ ভেঙে। এমন বাঁধভাঙা বৃষ্টি এখানকার মানুষ সেভাবে দেখেনি কখনও। একটানা তিনদিন এক নাগাড়ে, বারেকের জন্যও বিরাম নেই। অক্লান্ত বর্ষণ। তারই মধ্যে দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় পূজার্চনার শেষে ট্রেনের চালককে—যে কিনা একইসঙ্গে ট্রেনের মালিক এবং চৌকিদারের বন্ধুও—পাশে বসিয়ে চৌকিদার উপস্থিত সকলকে মিত্র সম্বোধনে ভরিয়ে দিয়ে জানাল, তারাই পথ দেখাচ্ছে মানবসভ্যতাকে, আগামীর কাণ্ডারী তারাই, সামান্য বৃষ্টিপাতে যদি তারা কাজে বিরতি দেয়, তবে সভ্যতাকে তারা পিছিয়ে দেবে বহু-বহু বছর, মুহূর্তে থেমে যাবে সব অগ্রগতি; ফলে যতই কষ্ট হোক, যতই দুর্যোগ আসুক, বৃহত্তর উদ্দেশ্যের দিকে তাকিয়ে, মহৎ লক্ষ্যের জন্যই কাজ চালিয়ে যেতেই হবে—মানবের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
চৌকিদারের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়েই হোক আর বন্দুকের ভয়েই হোক, পরের দিন ওই বৃষ্টি মাথায় করেই শুরু হল খনন। বড়ো খনির তুলনায় ছোটো খনিগুলো থেকে কয়লা তোলার জন্য মজুরদের একটা দল নামতেই ধসে পড়ল একটা দিকের পুরোটা পিট্। অতিরিক্ত খনন আর ভারী বর্ষণ নরম করে দিয়েছিল দেওয়াল, তাই পায়ের সামান্য চাপেই ভেঙে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে। ঙ তখনও নামেনি, কিন্তু ঞ নেমেছিল, স্বভাবতই আরও অনেকের সঙ্গে সেও হারিয়ে গেল অন্ধকারে। যেহেতু বৃষ্টির তোড় প্রবল, আওয়াজেরও তেমন দাপট, স্বভাবতই খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে-থাকা কারও কানে এসে ধাক্কা মারল না ন্যূনতম কোনও আর্ত চিৎকারও। ঞ-কে ওইভাবে তলিয়ে যেতে দেখে ঙ-র চোখে জল এসেছিল কিনা, অঝোর বর্ষণ বুঝতে দিল না।
পরের দিন দুপুরের দিকে বৃষ্টি থামলে, কোনওরকমে হাতে-হাতে, তুলে আনা হল মৃত শরীরগুলোকে। ছেলে মারা গেছে যার, সেই বুড়ো জবাব চাইতে গিয়েছিল চৌকিদারের কাছে; চৌকিদার তখন বন্ধুর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজনে ব্যস্ত; তার কাছে পৌঁছানোর আগেই গর্জে ওঠে এক অধস্তনের বন্দুক, লুটিয়ে পড়ে বৃদ্ধ। রক্ত আর কয়লার রং আলাদা করা যায় না। মাটিতে শুইয়ে-রাখা ঞ-র বেঁকে যাওয়া মুখটার দিকে তাকায় ঙ, তারপর ঘাড় উঁচু করে দক্ষিণ দিকে দেখে। সে শুধু নয়, সবাই জানে যে, সেখানে বিস্ফোরক মজুত আছে; তবু তারা জেনে এসেছে, ডিনামাইট মানবসভ্যতার অগ্রগমনে অপরিহার্য, তা ধ্বংসের কাজে নয়; তাছাড়া সেসবের ব্যবহারও ঙ-র অজানা। অন্যদের মতো সেও অতএব, অনন্যোপায়, ওয়াগনে কয়লা ভরে দিয়ে ধরাধরি করে মৃতদেহগুলোকে তুলে দেয় মালগাড়িতে। ঞ-কে শুইয়ে দিয়ে সরে আসে সে, দেখে, চৌকিদার আর ট্রেনচালক পরস্পর আলিঙ্গনরত; চালকের কাঁধের পাশ থেকে জ্বলজ্বল করছে চৌকিদারের ওই একখানি চোখ, চোরের মতো—হিংস্র, ধূর্ত, খল।
ভোঁ বেজে উঠতেই নড়ে ওঠে ট্রেন। গন্তব্যে পৌঁছানো মাত্র পরিচিত মৃত মানুষগুলো অবিকল বদলে যাবে বেওয়ারিশ লাশে। যতক্ষণ দেখা যায়, মালগাড়ির চলে-যাওয়া দেখে ঙ, আর ভাবে, ঞ-র কার্যকারিতা ফুরিয়ে এসেছিল হয়তো; হয়তো-বা এবার তার পালা।
প্রকাশ : 'আজকাল', শারদ ১৪২৭ ব.।