২০২২-এর ৭-ই সেপ্টেম্বর কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কন্যাকুমারিকায় শুরু হয়েছে ভারত জোড়ো যাত্রা। ওখান থেকে মোট ৩৫৭০ কিমি পথ পেড়িয়ে আকাশছোঁয়া উচ্চাশা নিয়ে ১৫০ দিন পরে যাত্রা পৌঁছবে জম্মু - কাশ্মিরে। এই যাত্রায় বেলাগাম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মহীনতা, অর্থনীতির ধূসর মানচিত্র, সর্বোপরি হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের দেশব্যাপী বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতি - রাহুল গাঁধীর হাতে প্রাথমিক ভাবে ছিল বিজেপি সরকার বিরোধী প্রচারের এই চেনা স্ক্রিপ্ট। ৬৯ তম দিনে মহারাষ্ট্রের ২৮-টি জেলা পার করে ১৫-ই নভেম্বর যাত্রা পৌঁছাল আদিবাসী অধ্যুষিত তামসালা গ্রামে(ওয়সিম রোডের কাছে)। এখানে রাহুল ওই স্ক্রিপ্টের সামান্য অদল বদল করে আস্তিনে লুকিয়ে রাখা আরও একটি তাস বের করলেন। উপলক্ষ্য, আদিবাসী বীরত্বের প্রতীক বিরসা মুণ্ডার জন্মজয়ন্তী তে জনসভা। তিনি বললেন প্রয়াত বি ডি সাভারকার ব্রিটিশ প্রেমী ছিলেন, উনি ইংরেজদের দেওয়া পেনসন নিতেন। আর বীরসা মুণ্ডা আদিবাসীদের জমির অধিকার রক্ষায় জীবন দিয়েছেন, কোন আপোষ করেননি।
হিন্দি বলয়ের হার্টল্যান্ড বলে সাধারণ ভাবে পরিচিত মহারাষ্ট্র। ১৭-ই নভেম্বর আকোলা'য় এক প্রেস কনফারেন্সে রাহুল গান্ধী বললেন সাভারকার ব্রিটিশদের গোলাম হিসেবে নিজেকে বর্ণনা করতেন, রাহুলের হাতে ছিল ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ প্রশাসনকে লেখা সাভারকারের মার্জনা ভিক্ষার চিঠি। এদিকে, মহারাষ্ট্রে পা রাখার অব্যবহিত পরে যাত্রায় অংশগ্রহন করেন এনসিপি' র সুপ্রিয় সুলে, সঙ্গে শিবসেনার আদিত্য থাকরে। এটা ছিল মহারাষ্ট্রে বিরোধী মোর্চা এমভিএ' র (মহা বিকাশ আগাদি) মধ্যে এক ঐক্যের বার্তা। মহারাষ্ট্রে শিবসেনার প্রকাশ্য ও ধারাবাহিক সাভারকার প্রেমের কথা সকলেরই জানা। অটল বিহারী বাজপেয়ির সময় থেকে তাঁরা সাভারকারকে মরণোত্তর ভারতরত্নে ভূষিত করার জন্যে উদ্যোগ নিয়ে চলেছেন। সাভারকার সম্পর্কে রাহুল গাঁধীর ওই 'বক্রোক্তি' একই নৌকার যাত্রীদের (কংগ্রেস, শিবসেনা, এনসিপি) মধ্যে সমঝোতার ক্ষেত্রে, আপাত দৃষ্টিতে, হয়তো ফাটল ধরাতে পারে! স্পর্শকাতর এই বিষয়টা মাথায় রেখেও রাহুল আরও বললেন যে হিন্দুত্বের প্রচারক সাভারকার ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন। তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে জানালেন যে তাঁর অবস্থান রাহুলের বক্তব্যের বিরুদ্ধে। আর দেবেন্দ্র ফড়নবিশ (মহারাষ্ট্রের উপ মুখ্যমন্ত্রী) বলেই বসলেন যে রাহুল যা বলছেন তা নির্জলা মিথ্যে কথা।
কংগ্রেসের মধ্যে একটা অংশ সেই স্বাধীনতার সময় থেকেই নরম হিন্দুত্ববাদী অবস্থান নিয়ে চলেছেন। সরকার বিরোধী প্রচারে রাহুলের ওই মন্তব্য বা গিয়ার চেঞ্জের বিষয়টি ওই অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তবে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম নরেশ রাহুলের বক্তব্যের সমর্থনে জানালেন - কই, মহারাষ্ট্রের আর এক আইকন প্রয়াত বাল গঙ্গাধর তিলক তো কোন মার্জনা ভিক্ষার চিঠিতে সাক্ষর করেননি ! মহারাষ্ট্র কংগ্রেসের নানা পাটোলা বললেন' সাভারকার ব্রিটিশদের কাছ থেকে পেনসন নিতেন - একথা জানলে সাধারণ মানুষের কী প্রতিক্রিয়া হবে।' তবে ওই প্রেস কনফারেন্সে রাহুল বোঝালেন তিনি তাঁর বক্তব্য থেকে পিছু হটছেন না। 'সাভারকার ভয় পেয়ে ওই মার্জনা ভিক্ষার চিঠিতে সাক্ষর করেছিলেন। এটা মহাত্মা গাঁধী, প্যাটেল, নেহেরু সহ অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ' - সোজাসাপটা জানালেন তিনি।
কেরলের এর্ণাকুলাম জেলার আলুভায় এই যাত্রার সূচনায় রাহুল গাঁধী নির্দেশিত চিত্রনাট্যের তাল কেটে দিয়েছিলেন কিছু অত্যুৎসাহী স্থানীয় কংগ্রেসের কর্মকর্তারা। ভারত জোড়ো যাত্রার প্রচার ব্যানারে দেখাগেল অন্যান্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে সাভারকারের ছবি। বিষয়টা সামনে আসতেই স্থানীয় কর্মকর্তারা তড়িঘড়ি ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়লেন, সাভারকারের ছবির উপর পিন দিয়ে আটকে দেওয়া হল মহাত্মা গাঁধীর ছবি, যদিও প্রেস ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যানারের ছবিটি ততক্ষণে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। রাহুলের মতে ভারত জোড়ো যাত্রা এক খন্ডিত, ভেতর থেকে বিদীর্ণ ভারতকে সবদিক থেকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে, যে ভারত সীমাহীন যন্ত্রনা ভোগ করছে। সংঘীদের ঘৃণা ভাষণ ও বিদ্বেষের রাজনীতিতে দেশবাসী আতঙ্কিত। নাগরিকরা শিক্ষা স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর সাভারকারের অবস্থান ছিল ঐক্যবদ্ধ ভারতের বিপরীতে। ভারতীয়দের হিন্দু ও মুসলমানে (তাঁর মতে দুই জাতিতে) ভাগ করে কুখ্যাত দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রবর্তন করে এই উপমহাদেশকে খণ্ডিত করার তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রস্তুত করেন তিনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অবিশ্রাম ঘৃণা বর্ষণের শুরু সেদিন থেকেই। ভারত জোড়ো যাত্রায় সাভারকারের উল্লেখ তাই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
এই যাত্রায় প্রথম পর্যায়ে যোগ দিয়েছিলেন শ্রীমতী মেধা পাটকার। সঙ্গে ছিলেন হিজাব পরিহিতা মুসলমান ধর্মাবলম্বী তরুণীরা, ঘৃণার রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলি গৌরী লঙ্কেশের মা এবং বোনেরা, রোহিত ভেমুলার মা এবং মহাত্মা গাঁধীর প্রপৌত্র শ্রী তুষার গাঁধী । যাত্রায় যোগদান করেন আর এক প্রতিবাদী কন্ঠ শ্রীমতী স্বরা ভাস্কর। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ চ্যাপ্টারের শেষে রাজস্থানে রাহুল তৃতীয় বার সাভারকারের নাম উল্লেখ করে বলেন 'কংগ্রেস হল মহাত্মা গাঁধীর পার্টি, গডসে- সাভারকারের নয়।' ইঙ্গিত ছিল মহাত্মা গাঁধী হত্যায় সাভারকার যোগের দিকে। ''লেট' স কিল গাঁধী '' বইয়ের রচয়িতা শ্রী তুষার গাঁধীর যাত্রায় যোগদানের পর এই প্রসঙ্গের অবতারণা নিতান্ত কাকতালীয় নয়। দিল্লিতে যাত্রায় যোগ দেন চিত্রাভিনেতা শ্রী কমল হাসান।
শ্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বলেছেন সাভারকার সম্পর্কে রাহুল যা বলছেন তা নির্জলা মিথ্যে কথা। ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলছে। মহাত্মা গাঁধী, বিঠঠল ভাই প্যাটেল ও বাল গঙ্গাধর তিলকে'র অতি সক্রিয়তায় আন্দামান জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান সাভারকার। এরপর তাঁকে মহারাষ্ট্রে রত্নগিরি জেলে বন্দি করা হয়। ১৯২৪ সালে ওই জেল মুক্তির পর ইংরেজ সরকার বাহাদুর আবেদনের ভিত্তিতে তাঁর পেনসন মঞ্জুর করেন, পরিমান ৬০ /-টাকা প্রতিমাসে। ওই সময়ের মূল্যমানে বর্তমানে টাকার অঙ্কটা কী হতে পারে আন্দাজ করে নিন।
দ্বিতীয়তঃ রত্নগিরি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই জেলার মধ্যেই সাভারকারের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করা হয়। ওই সময়ে বাজারে একটি বই প্রকাশিত হয়, নাম 'দ্য লাইফ অফ বীর সাভারকার', লেখক চিত্রগুপ্ত। বাস্তবে 'চিত্রগুপ্ত 'সাভারকারের ই ছদ্মনাম। তিনি নিজেই নিজেকে 'বীর' উপাধি দিয়েছিলেন।
তৃতীয়তঃ ১৯১৩ সালের উল্লেখিত চিঠিতে সাভারকার নিজেকে শুধু ' ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের বিশ্বস্ত সেবক বলেই উল্লেখ করেননি, তিনি লিখেছিলেন, '... ক্ষমতাশালীরাই অন্যকে ক্ষমা করতে পারে। আমাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষের ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আস্থা বাড়বে শুধু তাই নয়, সংবিধানের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা দেখলে দেশ বিদেশের বহু সংখ্যক পথভ্রষ্ট তরুণ ভারতবাসী, যারা আমাকে তাদের পথপ্রদর্শক বলে মানেন, তারা তাদের পথ পরিত্যাগ করে সরকারের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। আমি সারা জীবন ব্রিটিশ সরকারের গোলামী করে যাব।' এই চিঠিটা ১৯১৩'র ১৪-ই নভেম্বর সরাসরি সেলুলার জেলের প্রশাসক রেজিন্যান্ট ক্র্যাডকের কাছে জমা দিয়েছিলেন তিনি।
ভারত জোড়ো যাত্রার মহারাষ্ট্র চ্যাপটারে অন্যান্য রাজনৈতিক ইস্যু গুলোর সঙ্গে আদিবাসীদের জমির অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সামনে এনেছেন রাহুল। বিজেপি - আরএসএস'র মুখিয়াদের ওই 'আদিবাসী' বা ‘মূলবাসী' নামটা একেবারেই না পসন্দ, তাঁরা দেশের ওই বিশাল সংখ্যক মানুষকে 'জঙ্গল বাসী' বলে চালিয়ে দিতে চান তাদের কর্পোরেট লুঠেরাদের স্বার্থে। সংবেদনশীল এই ইস্যুটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির পরম্পরা। তবে সেই আলোচনা অন্য পরিসরে।