বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের সামনে এখন দুটো পথ খোলা আছে। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অথবা হিন্দু রাষ্ট্র। সামনের লোকসভা নির্বাচনে এই দুটো পথের মধ্যে একটাকে আমাদের বেছে নিতে হবে।
২০১৪ সালের নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তার নির্যাস বলে দেয় ভারত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের অর্থনীতি আজ বিপন্ন। ভুল অর্থনৈতিক নীতি, নোটবন্দি ত্রুটিপর্ণ জিএসটি দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে। এদিকে কোভিদ মহামারীর আঘাত ভারতের অর্থনীতি আজও সামলে উঠতে পারেনি। বৃদ্ধির হার নেমে হয়েছিল -২৩%। তারপর বৃদ্ধির হার কিছুটা উর্ধমুখী হলেও এই বছরে বৃদ্ধির হার পুনরায় নিম্নগামী। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর একের পর এক ভ্রান্ত অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করার ফলে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে ভারতীয় জনগণকে।
এনডিও সরকারের বিমুদ্রাকরণ নীতি ভারতের সাধারণ জনগণের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মেরুদন্ড এর ফলে ভেঙে গিয়েছে। বেকারির হার বিগত ৪০ বছরের তুলনায় শীর্ষে অবস্থান করে। সর্বোপরি ধনী-দরিদ্রদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিপুল বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী উন্নত দেশগুলি মুদ্রাস্ফীতি রোধ করতে সমর্থ হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশে মহামারী চলাকালীন ভারতীয় ধন কুবেররা তাদের সম্পত্তি বৃদ্ধি করেছিল ৩৫%। লকডাউনের সময় প্রতি ঘন্টায় মুকেশ আম্বানির আয় ছিল সত্তর কোটি টাকা। একই সময়ে ভারতের ২৪% নাগরিকের আয় ছিল মাসে ৩০০০ টাকার কম। কোভিডকালীন ভারতের শীর্ষ পুঁজিপতিরা যে পরিমাণ সম্পদ আহরণ করেছে সেই সম্পদের পরিমাণ আমাদের ১০ বছরের স্বাস্থ্য বাজেটের সমতুল।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য আজ বিপন্ন। মোদি সরকার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিনষ্ট করে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে বিভাজিত করতে চাইছে। গত ৭ বছরে অযোধ্যায় রাম মন্দির স্থাপনের প্রক্রিয়া, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ বিলোপ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, সংখ্যালঘুদের মূল স্রোত থেকে বল প্রয়োগ করে বিচ্ছিন্ন করে রাখার প্রচেষ্টা প্রভৃতির মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপন করতে চাইছে। হরিদ্বারের ধর্ম সম্মেলন থেকেও ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার ডাক দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেই সম্মেলনে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশে মুসলমানদের জনসংখ্যা কুড়ি কোটির বেশি। তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে গেলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। ভারতের মাটিতে যারা জন্মেছে তারা জন্মগতভাবে ভারতীয়। শাহরুখ খান বলেছেন, ‘আমরা ভারতের জন্মেছি ভারতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করব।’ হরিদ্বারের ধর্ম সংসদে মুসলমান সম্প্রদায়কে গণহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার যে আহ্বান জানানো হয় তা গণহত্যার সামিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জেনোসাইড সম্মেলনের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ভারত স্বাক্ষর করেছে। তা সত্ত্বেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই ধর্ম সংসদে যে গণহত্যার আহ্বান জানানো হয়েছে তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আরও দুর্ভাগ্য জনক যে এরপরেও সুপ্রিম কোর্ট তার মৌলিক দায়িত্ব পালন করেনি। সুপ্রিম কোর্টের ৭৫ জন আইনজীবী এই নীরবতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়ে চিঠিতে উল্লেখ করেছে যে হরিদ্বার ধর্ম সম্মেলন থেকে যে আহ্বান জানানো হয়েছে তা ফৌজদারি আইনবিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করার অপরাধে আজ কুড়ি হাজারেরও বেশি ভারতীয় বিনা বিচারে বন্দি।
ভারতের এই আর্থসামাজিক বিধ্বংসী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের উদ্যোগে ভারত জোড়ো পদযাত্রার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির নেতৃত্বে ৭ সেপ্টেম্বর কন্যাকুমারী থেকে ভারত জোড়ো যাত্রা শুরু হয়। সুদীর্ঘ ৩৫৭০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পদযাত্রীরা কাশ্মীর পৌঁছবেন। এই কর্মসূচি অনুযায়ী সমগ্র ভারতের বারোটি রাজ্য এবং দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল অতিক্রম করবে পদযাত্রীরা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এই পদযাত্রায় যোগ দেওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছেন। পদযাত্রায় মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মহিলার সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ। পদযাত্রায় যারা পা মিলিয়েছেন তাদের গড় বয়স ৪০ এর নিচে। প্রতিদিন তাঁরা গড়ে ২১ কিলোমিটার করে হাঁটছেন। সমগ্র দেশজুড়ে ভাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় করে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য। মোদিজির সরকার ভারতকে বিভাজিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছে। তাকে প্রতিহত করে সম্প্রীতির বাণী প্রচার করার উদ্দেশ্যেই এই পদযাত্রার আয়োজন। রাহুল গান্ধি বলেছেন আমরা দুটো ভারত চাইনা। আমাদের ভারতে ঘৃণা এবং বিদ্বেষের কোনও স্থান নেই। সকলের জন্য সেখানে একই আইন প্রযোজ্য হবে ,সকলকে সমান চোখে দেখা হবে, প্রত্যেক নাগরিক ন্যায় বিচার পাবে।
এখন পর্যন্ত পদযাত্রা তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক, অন্দ্রপ্রদেশ হয়ে এখন তেলেঙ্গানা রাজ্যে। এখন পর্যন্ত বয়স, নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ তাঁদের স্বাগত জানিয়েছেন। রাহুল গান্ধি অন্তত ৬০ টি সামাজিক, মহিলা ও শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। আর অসংখ্য শিশু ও ব্যক্তি এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন। এ কোনো এসি গাড়ির রথ নয়, যাতে করে রামচন্দ্রের নাম করে সারা দেশে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল ও দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল। পথে এখন পর্যন্ত রাহুল ৪ (চারটি) বিশাল জনসভা ও ৪০ (চল্লিশটি) ছোট ও মাঝারি জনসভা করেছেন। এরপর পদযাত্রা মহারাষ্ট্রে যাবে, সেখান থেকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব হয়ে জন্মু ও কাশ্মীর গিয়ে শেষ হবে।
কর্নাটকের বল্লারি যাওয়ার পথে পদযাত্রা এক হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। পদযাত্রা যত এগিয়ে চলেছে, ততোই পথযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাহুল গান্ধির সঙ্গে আরো নেতা সহ বহু মানুষ এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করছে। কিছু মানুষ তাদের রাজ্যের মধ্যেই হাঁটবে, অনেকে পদযাত্রীদের সঙ্গে আরও এগিয়ে যাবে। বল্লারি পশ্চিম কর্নাটকের একটি শিল্পনগরী।
বল্লারি থেকে বেঙ্গালুরু পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর প্রতিবেদন থেকে জানতে পারি, তাঁরা ৬ জন একসঙ্গে হাটছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, একজন পরিবেশবিদ, একজন দর্জি এবং এমএ পাঠরত, একজন প্রযুক্তিবিদ, একজন তরুণ অধ্যাপক এবং তিনি নিজে— যিনি একজন প্রাক্তন ব্যাংক অফিসার ও একদা বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। ছয়জনের বয়স কুড়ি থেকে সত্তর এবং তাঁরা চারটি বিভিন্ন ভাষায় বাড়িতে কথা বলেন। অর্থাৎ এই দলটি ভারত জোড়ো আন্দোলনের একটি ক্ষুদাতিক্ষুদ্র সংস্করণ।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তাঁরা তাঁদের রাতের আশ্রয়স্থলে পৌঁছান। সেটা অনুষ্ঠান হল। এই হলটিতে হাজার আসন বিশিষ্ট একটি মঞ্চ আছে। একটি বিরাট খাবার জায়গা এবং একটি রান্নার জায়গা। সেইসঙ্গে গুটিকয়েক ঘর যেখানে রাত্রি বাস করা যেতে পারে। তারা হলে ঢুকে করে দেখেন মঞ্চের উপর এবং মাটিতে ঢালাও বিছানা পাতা রয়েছে, যেখানে ২০০ জন শুতে পারে। হলের মধ্যে ২৪ ইঞ্চি একটি কম্পিউটার স্ক্রিন, সেখানে একজন ভদ্রলোক বসে কাজ করছেন। ঘরটিতে আলো জ্বলছে। পাখার ব্যবস্থা আছে। কিছু পুরুষ ও মহিলা পদযাত্রী বিছানায় শুয়ে আছেন। কয়েক জন ঘুমিয়ে পড়েছেন। এরা সবাই আজ ৩০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছেন। পাশের বড় হল ঘরটিকে দুটি ভাগ করে, একদিকে বড় বড় টেবিল পেতে খাবার ব্যবস্থা, অন্যদিকে শোবার জন্য বিছানা পাতা। বন্ধুটি সদলবলে খাবার আসনে বসে পড়লেন। সেখানে গরম গরম নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। সুস্বাদু খাবার খেয়ে তাঁরা শোবার জায়গার খোঁজ করলেন। হলগুলোতে শোবার জায়গা ছিল না। পাঁচ তলায় ছয়জনের শোবার ব্যবস্থা হল। পরের দিন ভোর পাঁচটায় খাবার ছিল গরম উপমা ও চাটনি। দীর্ঘাকৃতি এক ভদ্রলোক খাবারের ব্যবস্থায় ছিলেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহারে সকলে আপ্লুত। সমগ্র ব্যবস্থাপনার জন্য কংগ্রেস দলের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন লেনিন উক্তি ‘প্রত্যেক বিপ্লব, নিম্নবর্গ এবং শোষিত মানুষদের আনন্দ-উৎসব।’ মার্কস বলেছিলেন, ‘বিপ্লব হচ্ছে ইতিহাসের লোকোমোটিভ’। যদিও আমরা কেউ জানি না আমাদের ভারত জোড়ো যাত্রা দেশজোড়া হিংসা এবং বিদ্বেষের অবসান ঘটাতে পারবে কিনা।
খাওয়া সেরে পর যখন পদযাত্রার সূচনা স্থলে পৌঁছে দেখি সেখানে হাজার মানুষ। সার বেধে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে স্থানীয় শিল্পীরা আনুষ্ঠানিক পোশাক পড়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে এবং তাদের পিছনে কংগ্রেস সেবাদলের কর্মীরা। যাত্রীদের মধ্যে থেকে স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে। স্লোগানের ভাষা বাস্তবিক অর্থপূর্ণ। কোথাও বিদ্বেষের ছোঁওয়া নেই। স্থানীয় শিল্পী এবং সেবা দলের কর্মীর ছাড়াও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পদযাত্রা অংশ নিচ্ছে। সেখানে কোন বিধি-নিষেধ নেই।
রাহুল গান্ধী এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন জনসমুদ্রে জোয়ার নেমে এলো। রাহুল গান্ধীকে ঘিরে তার নিরাপত্তা বলয়। পথযাত্রীদের কেন্দ্রে তিনি। তার দৃঢ় এবং দ্রুত পদক্ষেপ পদযাত্রীদের এগিয়ে নিয়ে চলল। তার যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান গর্জনে পরিণত হল। হাজার হাজার মানুষ আনন্দের সঙ্গে হেঁটে চলেছে, স্লোগানে গলা মিলাচ্ছে। এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা। এই পদযাত্রা থেকে তীব্র একটা অনুভূতি হৃদয় ছুঁয়ে গেল। পদযাত্রা শেষ হলেও পদযাত্রীরা হাল ছাড়বে না।