মায়ের বারণে হাসি-ব্যামু বাড়ে হুহু করে, কমে তো না-ই আরও হেসে কুটিকুটি হয় ! হাসির শব্দে কমলা বেগম অর্থাৎ বাতাসির মায়ের বুকে কাঁপন ধরে। তার নিজেরও অতি-হাসিব্যামু ছিল। এই হাসিই তার দুকূল কেড়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করেছে। তা নয়তো কী !
সে নিজের মনে বকবক করে, মেয়েকে উদ্দেশ্য করে-”মাইয়্যা মানুষের দাঁত-মুখ কেলাতে নেই, মাইয়ামানুষ আওয়াজ করে হাসলে ওপরআলা বেজার হন! তাঁর বেজারে আকাশ থেকে দেদারছে গজব নামে”! মাইয়াডার হাঁটনের রকমসকমও সুবিধার না, হাতির মতো থপথপ আওয়াজে হাঁটে। তা-তে মাটি কষ্ট পায়, ওপরআলার কাছে মাটি নালিশ জানায়। ওপরআলা হক বিচার করেন- দোষীর উপর গজব ফেলেন”! বাতাসি-মায়ের বকবকানিতে আরেক দফায় মুখে হাত চেপে ধরে হাসে!
কমলা বেগম,তাঁতীপাড়ায় চরকায় সুতা-বোনার কাজ করে। সেই সাতসকালে বাড়ির বাইর হয়, বাড়ি ফিরতে প্রায়ই ঘোর-সন্ধ্যা নামে। একসময় অবশ্য তার এমন বেহাল দশা ছিল না। বাবারবাড়ি চার- চারটে তাঁতকল ছিল। গোমস্তা ভাড়ায় এনে সেসব তাঁতে দিনরাত কাপড় বোনা হত। শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও ফেলনা ছিল না।
এসবই এখন অতীতের কথা। যারা নিজচোখে তাদের অবস্থা দেখেছে, তারা আজও সেসব দিনের গল্প করে বেড়ায়। কমলা বেগমের বর্তমান-দশায় গাঁয়ের লোকেরা আফসোস করে। গাঁয়ের কতোজন তাদের বাড়ি পৈরত খেটে সংসার চালাত। সেই কমলা বেগমের আজ এই দশা! বাপের খুব আদর আহ্লাদের মেয়ে, এখন পরেরবাড়ি কামলা দিয়ে মা-মেয়ে পেট চালায়। সবই নছিব-বরাত, অদৃষ্টের লিখন! দিনভর নিজের কপালকে শাপশাপান্ত করে কমলা বেগম। নিজের মতো মরা-কপাল মেয়েটাও সাথে করে নিয়ে এসেছে। তা-না হলে মেয়ের জন্মের পরপর বাপটা কেনো নিরুদ্দেশ হবে !
বাতাসির বাবা, ঘরসংসার পাগল মানুষই ছিলেন। বাপের কালানের বিষয়আশয় মোটামুটি যা ছিল সেসব ধরে রেখে কাজ কারবার করে ভালোমন্দে সংসার চলছিল। কিন্তু কী হতে কী হল, কার অশুভ ছায়ায় পড়ে- সোনার সংসারটা ভেঙ্গেচূড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল! লোকটার কথা আজও মনে পড়লে বুকটা ধক করে উঠে!
একদিন দুপুরবেলায় গেরুয়া রঙের লেবাসে দাড়িগোঁফে-ঢাকা এক যোগী-বৈরাগী বাতাসিদের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বাতাসি তখন সবেমাত্র একপা-দু’পা হাঁটতে শুরু করেছে। বাইরবাড়ির উঠোনে মাটির পরে বসে খেলছিল ও। অপরিচিত-লেবাসে লোকটিকে দেখে মেয়ে ভয়-ত্রস্তে মরণ চিৎকার জুড়ে দিলে, হাতেরকাজ ফেলে কমলা বেগম বাইরে দৌড়ে ছুটে আসে। লোকটির এমনতর বৈরাগীর সুরতহাল দেখে সে নিজেও চরমভাবে ভড়কে যায়। একইসময়ে পেছন-পেছন বাতাসির বাবাও বেরিয়ে আসে।
সেই সর্বনাশের শুরু,অধঃপাতের পথে হাঁটা ! সেদিনের কথা পরিষ্কার মনে আছে কমলা বেগমের। খুব নিচু গলায় ফিশফাস করে যেন বহু গোপন কথা বাতাসির বাবার সাথে যোগী বলছিল-জল চাইলে বাতাসির বাবা তাকে মুড়ি আর ঝোলা খেজুরগুঁড় খেতে দিলেন। লোকটি ক্ষুধার্ত ছিল। দাড়ি-গোঁফ-জটাচুল ডুবিয়ে মুড়ি-গুঁড় খেয়ে, কাঁসারজগের পুরোটা জল তৃপ্তি মিটিয়ে পান করছিল। কমলা বেগম গভীর মনোযোগে ভেজানো জানালার ফাঁক দিয়ে সেদৃশ্য দেখে- জটাচুলের ফোঁকর ঠিকরে শিয়ালের মতো একজোড়া ধূর্ত ধূসর-চোখে চোখ পড়তে, তার বুকটা মোচড়ে কেঁপে উঠছিল!
এরপর দেখা যেত মাঝেমধ্যেই লোকটা বাড়ির পরে বাতাসির বাপের খোঁজে আসত। কমলা বেগম সেসময়ে স্বামীর ওপর ভীষণ রকম ক্ষেপে যেতেন। লোকটাকে তার কাছে ভয়ঙ্কর কিছু মনে হত, যেন অশরীরী কিছু একটা! পারতপক্ষে তার সামনে সে পড়ত না। যোগীর উপস্থিতি টের পেলে বাতাসিকে নিয়ে দ্রুত সে আড়ালে লুকাতো। সাধুসন্ত মানুষ। মনের ভিতর কী আছে, তা কে জানে! চোখজোড়া বড়ো ভয়ঙ্কর, ব্যাখ্যা করা যায় না। লোকটার চোখের দিকে তাকালে কেমন অস্থির- বেহুঁশ হতো মন, ঠিক বলে বোঝানোর মতো নয়! রহস্যময় সেসব অনুভূতি, বাতাসির বাবাকে বললে সে তাচ্ছিল্যে তা উড়িয়ে দিত, পাত্তা দিতে চাইত না !
একদিন মোরগ ডাকা ভোরে, এতকাল পরেও হুবহু মনে পড়ে- তখনও শেষরাতের পাতলাআঁধার পুরোপুরি কাটেনি। বাড়ির সীমানাঘেঁষে চকিদারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা কদমগাছের মাথার উপর রাতের আঁধারের কালো রং কেবল যায় যায় করছে- কমলা বেগম দুয়োর খুলে ছোটঘরে যাবার তাড়ায়, সবে চার কদম এগুতে- লোকটাকে সন্মুখে দাঁড়ানো দেখে যারপরান চমকে উঠে ! উঁচুলম্বা পাতলা দেহের মাথার উপর একগাছি নাড়ার বিড়ার মতো জটাচুলের বেড়িসমেত যোগীকে দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি- নামার উঠোনের হিজলগাছটা একরাতে দুয়ার ঘেঁষে এসে শিকড় গেঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কমলা বেগমের হঠাৎপাওয়া ভয়ে দমবন্ধ হবার যোগার, একদলা থুথু শাড়িরভাঁজ সরিয়ে বুকে ফেলে, সে একদৌড়ে ঘরে ফিরে বাতাসির ঘুমন্ত বাবার উপর ঝাঁপটে পড়ে!
ওর বাবা যোগী’র কথা শুনতে, কী হল কে জানে, একঝটকায় উঠে বসল, তাকে বেজায় কিংকর্তব্যবিমূর দেখাল বটে কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, যেন সে জানত ওই লোক এইসময়ে আসবে-নিজে পড়ে পড়ে ঘুমানোর অপরাধে যেন ছটফটিয়ে বিছানা ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল লোকটার কাছে ! বেশ কতক্ষণ বাইরঘরের দাওয়ায় বসে দু’জনে ফিসফিসিয়ে কীসব আলাপে মত্ত হল। একটুবাদে যোগীকে সেখানে বসিয়ে রেখে,অস্থির হয়ে ঘরে ফিরে আসে সে। কমলা বেগম আড়চোখে এসবই লক্ষ করছিল!
বাতাসির বাবার গাত্রবর্ণ বলতে গেলে একদম বাড়িয়ে বলা হবে না, যেন জলজ ভাঁটফুলের মতো সাদা ফকফকা পরিষ্কার ছিল! সেই ফরসা-কপালে চিন্তারভাঁজ দুধের সরের মতো বিছিয়ে থাকে। দূর্বা-ঘাসের পরে বিন্দুবিন্দু শিশির জমার মতো করে ঘাম জমে উঠে তার কুঁচকানো কপালটাজুড়ে।
কমলা বেগম স্বামীর এমন উতলাদশা এরআগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না! এমনেতে স্বভাবচরিত্রে সে বেশ কোমল প্রকৃতির। হাত দু’খানা পেছনে মুঠিবদ্ধ রেখে ঘরময় গুটিকয় চক্কর দেয়- কী যেন ভাবে, যেন কিছু বলতে চায় আবার মত বদলায়! কমলা বেগম তার পিছু পিছু ছুটে কিন্তু বাতাসির বাপ কোন প্রতি উত্তর করে না।
তারও কিছুক্ষণ পর, চটের ব্যাগে ব্যবহারী কাপড়চোপড় গুছিয়ে জরুরি কাজের কথা বলে যোগীর পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করে। এসবই খুব দ্রুত সময়ে অর্থাৎ আলটপকা ঘটে গেল! কমলা বেগম উদগ্রীব হলে দিন-সাতেকের মধ্যে ফিরে আসবে বলে কথা দেয়। স্বামীর প্রস্থান পথে অসহায় চোখে চেয়ে থাকে সে। যোগীর পিছুপিছু বাতাসির বাপ নদীরধারের ঢোলকলমির ঝোপঝাপঘেরা মেটে-পথটা ধরে একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়। কমলা বেগমের বুকটা হুহু করে উঠল-সেই যে ঘরের বাইর হইল লোকটা,তারপর আর ফিরে আসল না!
সেই কবেকার কথা। এরপর কতো সপ্তাহ কেটে গেছে। মাস-বছর-যুগও পার হয়েছে। বাতাসির বাপ আর ফেরেনি। এখন বাতাসির বয়স প্রায় পনের। চৌদ্দবছর আগেকার কথা। লোকে বলাবলি করে বাতাসির বাপে নাকি সাধুসন্ত হয়ে দূরে পাহাড়ের দেশে ঘুরে বেড়ায়। বট-অশ্বখের গোঁড়ায় বসে ধ্যানজ্ঞান করে। অনেকে তাকে নাকি স্বচোখে দেখেছেও।
এসবই উড়া খবর, লোকের মুখে ভেসে বেড়ানো বাড়তি খবর যাকে বলে! না-তো কী ! তবে প্রথম প্রথম উটকো সংবাদে কমলা বেগমও বিশ্বাস করতো ষোলআনা। তার ভাইকে নিয়ে ছুটে যেত বাতাসির বাপের খোঁজে সেসব স্থানে। কিন্তু কোনো হদিস পাওয়া যায় নাই। মাঝেমাঝে এখনো রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে কানপেতে সজাগ থাকে সে। মনে হয় যেন লোকটার পায়ের আওয়াজ হাওয়ায় ভেসে আসছে। বিড়ালের পায়ে হাঁটতো লোকটা। কাজের ফাঁকে কখন যে তার পাশে এসে দাঁড়াত, টেরও পেত না কমলা বেগম।
লোকটা কথাও বলত নিচু গলায়, মিনমিনিয়ে। বেটাছেলে কথা বলবে তর্জন গর্জন করে, তা-না! কমলা বেগমের অযথা হাসিরোগটা তখনও ছিল।
মাঝেমধ্যে অসময়ে হাসির ধকল সামলে উঠতে না পারলে, মৃদু গালমন্দ করত বাতাসির বাপ। ওই অতটুকুই, গলা উঁচিয়ে রাগ-ক্ষোভ ঝারতে দেখেনি তাকে কেউ। সহজসরল লোকটা, মানুষে অবিশ্বাস আনতে পারত না। এই গুণটাই তাকে সংসার থেকে টেনে বের করে নিয়ে গেছে ভিন্নবলয়ে। লোকটা মরে গেলেও একসময় সান্তনা পেত মন কিন্তু হারিয়ে-যাওয়ার কষ্ট ভুলে থাকা যায় না। অহোরাত্র চিতার আগুনসম যন্ত্রণায় পুড়তে থাকে মন। কমলা বেগম স্বামীর শোকে প্রতিরাতে কাঁদে। স্বামীর একমাত্র চিহ্ন বোবামেয়ে বাতাসিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে মনেরভার সাফ করে!
কমলা বেগমের মায়ের পেটের কোনো ভাইবোন নেই। ছেলের-মা হওয়ার বেজায় শখ ছিল তার মায়ের। শখ পূরণে একাধারে বছর বছর তিন তিনটে মরা-মেয়ের জন্ম দিয়ে নিজের অবস্থা যম কাহিল করে তুললেন। একসময় ফলস্বরূপ নিজেও অল্পবয়সে সূতিকা রোগে মরে গেলেন!
মা মরে যাওয়ার কিছুকাল পরের কথা। বাবা একদিন শিবরামপুরের হাটে গেলেন তাঁতের কাপড় বেচতে। উড়াধুরা আছাঁটা চুল, পোড়া গায়ের রং,ছেঁড়া-মলিন বসনের এক পাঁচ-ছ’বছরের ছেলে, বাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ! বাবা অন্তরে তীব্র যাতনা টের পেলেন। কিছুকাল আগে গত-হওয়া বউটার কথা খুব করে মনে পড়ল। তিনি এতিম ছেলেটাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে ফিরলেন। বউটার ছেলের এমন শখ ছিল যে, ছেলেবাচ্চার একটা নামও ঠিক করে রেখেছিলেন,প্রথম সন্তান কমলা বেগম তার গর্ভে আসার পর পরই।
কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেটার আগের নাম ছেঁটেফেলে,জোড়াখাসির আকিকা করে মরা-স্ত্রীর সেই নাম রাখলেন এই ছেলের। কমলা বেগমের সাথে বয়সে বেশ তফাৎ হলেও তারা দু’জন পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো বড় হতে থাকল। একসময় কমলা বেগমের বাবা চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে। কুড়িয়ে-পাওয়া ভাই-ই মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো তাকে আগলে রাখছে এতকাল। সে সারাদিন ঘরের বাইরে কাজ করে। বাতাসিকে কোলেপিঠে করে ভাই-ই মানুষ করল। গত দু’বছর আগে ভাইকে নিজ দায়িত্বে বিয়ে দিয়ে আলাদা ঘরসংসারের যোগারযন্ত সে নিজগরজেই করে দিয়েছে।
কমলা বেগমের এ জীবনে সুখ’ নামক ধ্রুবতারার দেখা মিলল না। বিয়ের দু’বছরের মাথায় স্বামী নিরুদ্দেশ হলে অবধারিতভাবে তাকে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপেরভিটেয় ফিরতে হল। শেষবয়সে বাবা কর্কট রোগে পড়লেন। উপায়ান্ত না পেয়ে বিষয়আশয় যা ছিল বেচাবিক্রি করে কোনোমতে কষ্টেসৃষ্টে জীবনের শেষের দিনগুলো পার করলেন। এবং বাবা চলে গেলেন পরপারে, শুধুমাত্র খরখরে ভিটেখানা পরে রইল পেছনে। তারপর থেকে ভাইবোন বেঁচে থাকার যুদ্ধে নামল। কমলা বেগম পরেরবাড়ি পৈরাত দেন আর ভাইটা ভাঙ্গারি কাজে নেমে পড়ে।
কয়েক বছর না ঘুরতে বাতাসি লাউয়ের ডগার মতো লকলকিয়ে হাতেপায়ে বেড়ে উঠতে লাগল। দেখতেশুনতে মন্দ না, সহজেই সবার চোখের নজর কাড়ে। বাপের মতো গায়ের রং। পিঠভর্তি একগাছি চুল পিঠের পরে বিছিয়ে যখন হেঁটে চলে দেখে মনহয় যেন হাওয়ায় দোলে-ওঠা সবুজ ধানখেত।
দোষের মধ্যে ও-ই একটাই দোষ। মুখে বোল ফুটল না ! কত পীর-ফকির দেখানো হল- কাজের কাজ কিছুই হল না। স্কুলমাঠে একবার বিনামূল্যের পাশকরা ডা.আসলো গরীবদের চিকিৎসা করতে। কমলা বেগম সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে ডা. দেখালো। ডা. শহরে নিয়ে জিহবা কাঁটাছেঁড়া করার উপদেশ দিলেন। ও-বিষয় অবশ্য কমলা বেগম আগেই জানতো ! বুলি ফোটার বয়স পেরিয়ে গেলে কমলা বেগম ঠিকই বুঝতে পারে ওর আলা-জিহবায় সমস্যা আছে। তা আর ডা. নতুন করে কী বলবে। পেটে ভাতের যার যোগার নেই,শহুরে ডা.-এর বিলাসিতা, সে করে কি করে! পোড়া কপাল মেয়ে! মুখে বোল ছাড়াই বেঁচে রইল।
বাতাসির যখন মুখে বুলি ফোটার বয়স তখন ওর গলা দিয়ে মাটির হাঁড়িকুড়ি ঘষামাজার শব্দের ন্যায় ঘসঘস আওয়াজের মতো প্রকৃতিবিরুদ্ধ শব্দ বের হত! ওর বয়সী বাচ্চারা অবলীলায় কথা বলতে শুরু করল আর বাতাসি খিলখিলিয়ে খালি হাসে,সেই হাসির শব্দও কেমনতর যেন মনে ভয় ধরিয়ে দেয়! গাঁয়েরলোক বলতো-, জীনভূতে আছর করেছে। তা অবশ্য ফেলনা কথা না এবং কমলা বেগম, আছর ছাড়ার রোগপয়নেরও ব্যবস্থা করলো। পীর-ফকির ঘাঁটল কিন্তু মেয়ের মুখে বুলি ফুটল না। মাঝেমধ্যে অবশ্য কিছু বলার চেষ্টা করত, কিন্তু অপরিস্ফুট সেসব শব্দেরা গলার কাছে এসে বংকিল কাঁটার মতো আটকে যেত।
বাতাসি সারাদিন এদিক-ওদিক বনেবাদারে একা একা ঘুরে বেড়ায়। কমলা বেগম তাঁতীপাড়ায় কাজে ব্যস্ত থাকে। মামা-ও নানান কাজে ঘরের বাইরে থাকে। বন-জঙ্গল, ঝুপঝার, নদী,ফুল-পাখি তার খুব পছন্দ। গাঁয়ের উপর দিয়ে জলঢোঁড়ার চলাপথের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে চলেছে ইছামতী নদী। নদীরপাড়জুরে ঘনসবুজ কাশবন। বাতাসি মাঝেমধ্যে একমনে বসে থাকে কাশেরবনে। এতবড়ো মেয়ে পাগল-বেশে কোথায়-কোথায় ঘুরে বেড়ায় কমলা বেগমের খোঁজ রাখার জো মেলে না। দিন যায়, মেয়ের গা-গতর ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়।
গাঁয়ের বেশিরভাগ লোক বাতাসির শিশুত্ব মেনে নিলেও কিছুলোক স্বভাব মতো মন্দকথা বলে বেড়ায়। “ সিয়ানা মেয়েমানুষ, তারওপর মেয়ের মুখে বোল নাই, বোবা মাইয়া। কোন আকাম-কুকাম হলে তার দায়ভার নেবে কে” ! কমলা বেগম মেয়েকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি রেখে কাজে যায়। একা ঘরে বাতাসির দম বন্ধ হয়ে আসে। মায়ের বারণের পাশ কাটিয়ে সে খোলাপ্রান্তরে বেরিয়ে পড়ে।
ঝিমিয়ে-পড়া গ্রীষ্মের দুপুরে প্রায়শই নদীপাড়ের কাশবনের ঝুপে হাতপা ছড়ায় ছিটায়ে বাতাসিকে বসে থাকতে দেখা যায়। মনের সুখে গুনগুনিয়ে গান গায়। অস্পষ্ট কথার মতো গানগুলোও দুর্বোধ্য,অব্যক্ত। এসময়ে ওপারের গৃহস্থ-ছেলেরা দলবেঁধে নদীতে নাইতে নামে। পাগলের বেশভূষায় বাতাসিকে দেখে এরা কৌতূহল মেটাতে অগভীর নদী সাঁতরে এপারে চলে আসে।
বিকেলে মাঝেমধ্যে বাতাসিকে, নামা-চকের ডেঙ্গাপাড়ের লাউ কোমড়ার ক্ষেতে দেখা যায়। ছোট্টবেলায় ওর পড়শিবন্ধুর অভাব না থাকলেও একসময়ে একে একে সবাই ওর সঙ্গ ছেড়েছে। ওর আসল বন্ধু এখন গাছগাছরা,ঝুপজঙ্গল, নদী ফুল পাখি আর মাথার উপর নিঃসীম আকাশটা। এদের সাথে সে মন খোলে কথা বলে। তারাও বাতাসির সাথে কতো গল্প করে আবার মনের সুখে খিলখিলিয়ে হাসিতেও তার সঙ্গী হয়। মানুষের মতো এরা কেউ তাকে আজপর্যন্ত ছেড়ে যায় নাই।
বিকেলে ডেঙ্গাপাড়ে বদ লোকেরা তাসের আসর বসায়, মদতাড়ি খেয়ে মাতাল হয়। বাতাসিকে তাদের সাথে প্রায়ই খুশগল্প করতে দেখা যায়। মানুষ এসব দেখে নানান কথা বলে- বাতাসি সেসব ছেঁদোকথা আমলেই নেয় না !
কিছুদিন পরে গাঁয়েরলোকের আশঙ্কা সত্য হয়ে ফলে। শুরুতে অবশ্য কমলা বেগম আসল ঘটনা আঁচ করতে পারে না। মেয়েটা সেই ছোট্টবেলা থেকে মাঝেমধ্যে পেটেরপীড়ায় ভুগে। ডা. কৃমির ওষুধ দেয়, সেরেও ওঠে। শুরুতে তেমন ভেবে কৃমির ওষুধ খাওয়ানো হয় কিন্তু মেয়ে এবার সুস্থ হয় না! বেশ কদিন ধরে মেয়ের ঘরেরবাইরে যাওয়ায় অনীহা, খাওয়াদাওয়া পেটে ধরতে পারে না, উগরে ফেলে দেয়। তলপেট দিনে দিনে ফুলেঢুলে উঠে ! বাচ্চা মানুষ, যন্ত্রণার ধকলে রাতে ঘুমাতে পারে না।
মূলঘটনা আঁচ করতে, কমলা বেগমের হাত-পা অবশ হয়ে আসে, মাথাটা অবিরত শূন্যে ঘুরতে থাকে। মেয়ের এমন সর্বনাশের আশঙ্কা তার কল্পনাতেও ছিল না। মানুষ কতো কথা বলতো কিন্তু এমনকিছু তার মনে কখনো আসেনি।
এর কিছুদিন যেতে না যেতে বাতাসির পেট-বুক স্ফীত হয়ে উঠে। শরীর ভারি হয়ে যায়। কচি বয়সে মাতৃত্ব তাকে শরীর-মনে বিধ্বস্ত করে তোলে। ঘটনার মূল হোতাকে ধরতে বাতাসিকে জিজ্ঞেস করলে সে স্বভাববিরুদ্ধ চুপ হয়ে থাকে। কমলা বেগম দিশেহারা হয়ে উঠেন। এমন ভয়ঙ্কর বিপদের কূলকিনারা না পেয়ে বাতাসির গলা দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে সারাজীবনের জন্যে নাই করে দিতে মনস্থির করে সে। ভাগ্যিস ভাইটা তার কাছেধারে ছিল-ছুটে এসে বাতাসিকে উদ্ধার করে বলে রক্ষা এবং বোনকে শান্ত করে। কমলা বেগম, ভাইয়ের বুকে আছড়ে পড়ে কাঁদে।
এখনো গাঁয়ের ভেতর বিষয়টা জানাজানি হয় নাই। তার আগেই ঘটনার একটা দফারফা করতেই হবে- ভাইবোন মিলে পরামর্শ করে। পরদিন ওরা রাতের আঁধারে বাতাসিকে নিয়ে শহরে রওনা হয়। দূরসম্পর্কের এক আত্নীয়ের সহায়তায় তারা অল্পখরচায় কাজ উদ্ধারের পথ খোঁজে পায়। দিন দুয়েক পরে বাতাসির পেট খসানো হয়। হাতুড়ে-লোকের আনাড়ি কাজে বাতাসি মরতে মরতে, কেমন করে যেন ফেরত আসে তবে তার-ধকল পোক্তভাবে শরীরের ওপর বসে যায়।
শরীর-মন দীর্ঘমেয়াদে ভেঙ্গে পরে। ক্ষতির পরিমাণ তো আছেই এও জানা যায়,এজীবনে বাতাসি আর মাতৃত্বের স্বাদ নিতে পারবে না।। যদিও বাতাসির জীবনে এমন ঘটনা না ঘটলেও যে তার একটা সুখের সংসার-সন্তানের ভাগ্য হতো তা হলফ করে বলার জো নাই। বাতাসির জীবন, স্বাভাবিক জীবনের মতো ডালপালা-ফুলে ফলে ভরে থাকবে না,এটা জানা কথা, সমাজের সহজ হিসাব! কাজেই ওসব নিয়ে কমলা বেগমের মাথাব্যথা নেই। গাঁয়েরলোকের কাছ থেকে বিষয়টা আড়াল করা গেছে এটাই মুখ্য বিষয়।
এ ঘটনার পর থেকে বাতাসির হাসি মরে যায়। বহুদিন তার হাসির আওয়াজ কেউ শোনেনি। সারাক্ষণ ঘরেরকোণে ঝিমিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। একটা মড়াজীবন বয়ে নিতে বিষিয়ে উঠে মন। শরীর-মনে আগের মতো জোর নেই। মাঝেমধ্যে মনটা ঘরের বাইরে যেতে আনচান করে বটে। গাছ-গাছড়া তার অপেক্ষায় আছে। কতদিন ওদের সাথে সাক্ষাত নেই। বাতাসির মনের দুঃখ ওদের চেয়ে বোঝার ক্ষমতা মানুষের যে নেই। একদিন বিকেলবেলায় মনস্থির করে ঘরের বাইর হবে।
একপা-দুপা করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে সে। খুড়িয়ে হাঁটে। দুপায়ের ভাঁজে জখমটা হয়েছে যুতমতো। আরজীবনে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা হবে না হয়তো। অনেকটা পথ হেঁটে কাশবন পেরিয়ে আজ চলে আসে সে,নদীটা যেথায় মোচড়-মেরে বেঁকে ভিন্নপথ ধরেছে সেই স্থানটিতে। উঁচু জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। সেখানে হাতপা গুঁটিয়ে বসে থাকে, বাতাসি। এখান থেকে দু’পাশের বয়ে-চলা নদীটির সৌন্দর্য স্পষ্ট চোখে পড়ে। যদিও এসবকিছুই বাতাসির মনে আগের মতো দোলা দেয় না। বিষণ্ণমনে স্থিরচোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে।
কমলা বেগম আগের মতো সবকিছুতে মেয়েকে আর নিষেধ করে না। এই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনটা সে কাটিয়ে দিল অথচ কী ভূত ভর করেছিল সেদিন! মেয়েকে নিজহাতে খতম করে দিতে মনস্থির করেছিল! এই ভাবনাটা মনের উপর বর্ধিষ্ণু একটা দাগ কেটে গেছে। বোবা-মেয়েটার সামনে দাঁড়াতে বড়ো কষ্ট লাগে। সেদিনের পর থেকে সারাক্ষণ সে অসোয়াস্তিতে ভুগছে। বুকের ভেতরটা কেউ যেন তুরপুনে অবিরাম ছেদ করে চলছে। কমলা বেগম একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছে। মেয়ের সর্বনাশের মূল-হুতাকে যে করেই হউক খোঁজে বের করবেই। নিজ হাতে তার বদলা নেবে। দুনিয়ার কোর্ট-কাচারি, আইন-কানুনে তার বিশ্বাস উঠে গেছে সেই বুঝতে শেখার পর থেকে। সবলের-গলে বিজয়েরমালা ঝুলে থাকে, সে সকলের জানা । তার মতো মানুষের হক-বিচার পাওয়া দুনিয়ার বিচারে নেই। একমাত্র উপায় বিচারের ভার নিজকাঁধে তুলে নেওয়া। কমলা বেগম নিরক্ষর কিন্তু জীবনমুখি শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমতী।
সে নিজে বাজার থেকে নতুন মলাটের বলাকা ব্লেডের পুরোপ্যাকেট কিনে নিয়ে আসে। বাড়ি ফিরে বাতাসিকে নিয়ে শিথান-বালিশের তলা,ঘরের চতুরকোণা,বেড়ার ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দেয় ধারাল সেসব ব্লেড। বাতাসির জামার আস্তরে নিজে সেলাই করে গোপন পকেট বানিয়ে সেখানেও ব্লেড রাখার কৌশল মেয়েকে শিখিয়ে দেয়। বাতাসি মায়ের এ-রূপের সাথে পরিচিত নয়, খুনের নেশায় চকচক করা মায়ের চোখজোড়ার দিকে সে সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। মা তাকে শয়তান ধরার কৌশল শিখিয়ে দেয়। এরপর থেকে কমলা বেগম নির্ভাবনায় কাজ করে আর বাতাসি মনের খেয়ালে ছুটে বেড়ায় কাশঝারে,ডেঙ্গাপাড়ে যেখানে ওর মন টানে।
এর কিছুদিন পরে একদিন ভরদুপুরে, বাতাসির ঘর থেকে গগনবিদীর্ণ হাসির ঝনঝন আওয়াজ হাওয়ায় ভেসে বহুদূর ছড়িয়ে পড়ে। গাঁয়ের লোক কানখাড়া করে সেশব্দ শোনে। বহুদিন পরে বাতাসি মন খোলে হাসছে কিন্তু সে শব্দে কেমন যেন অপ্রত্যাশিত বিপদের ঘ্রাণ! ভয়-জাগানিয়া সে-হাসির সুত্র খোঁজতে দলে দলে লোক ছুটে আসে বাতাসির বাড়ি দিকে!
ওদিকে কমলা বেগমের মনটাও আজ সকাল থেকে কেমন যেন ছটফট করছিল। মেয়ের কাছে মনটা পড়েছিল কিন্তু কাজের চাপে বাড়ি ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। কেউ একজন বাতাসির রহস্যময় হাসির কথা ছুটে যেয়ে তাকে জানালে, দ্রুত সেও বাড়ির পথ ধরে।
আধ-ভেজানো দরজা ঠেলে কমলা বেগম বাতাসির ঘরে ঢুকে বিস্মিতচোখে চেয়ে থাকে! বাতাসির ঝড়ো-হাসির দাপট তখনো একবিন্দু কমেনি। ওর বিজিত হাতদু’খানা উঁচু করে মেলে ধরা। এক হাতে ধারালো ব্লেড অন্য হাতে রক্তভেজা একটি অণ্ডকোষ! এবং কমলা বেগমের একমাত্র মায়ের পেটের চেয়েও কাছের ভাইটি, রক্তাক্ত মেঝের ওপর অণ্ডকোষ হারিয়ে তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করছে !