দাবার ছক দেখার ভঙ্গিতে খুচরোগুলোর দিকে তাকিয়ে।
ইচ্ছে করেই পুরোটাই কয়েনে দিয়েছিল সুকৃতী। দুটো পাঁচ। তিনটে দুই। সঙ্গে ছোট কয়েনটা। এক পিশ গোল্ড ফ্লেক লাইটের দাম। এতদিন পর সিগারেট ঠোঁটে তুলে গুমটির গায়ে ঝোলানো দড়িটাকে ঘষতে লেগেছিল টিনে। ছাই খসে লাল রং-টা সবে দেখা দিয়েছে। বোড়ে এগোনোর কায়দায় তর্জনীর ডগা দিয়ে কয়েনটাকে ঠেলে দিল লোকটা।
দড়ির প্রান্ত হাতেই ধরা রইল সুকৃতীর।
মনে পড়ল বড় বড় হরফে লিখে দেওয়া ডাক্তারের ফরমানস্মোকিং , স্ট্রিক্টলি প্রোহিবিটেড।
কাঠগোলার দিক থেকে আসা গাড়িগুলো এতক্ষণ আটকে ছিল সাপ্লাই অফিসের সামনে। সিগন্যাল পেয়ে দু’ ভাগ হয়ে যেতে লেগেছে এবার পুবে আদহাটা রোড আর পশ্চিমে তালপুকুর রোডের দিকে। ভাগ্যে বড় কিছু ছিল না সেই ভিড়ে। বাস বা লরির মতো কিছু একটা এসে পড়লেই মুশকিল হত বুলেট নিয়ে এখানে দাঁড়ানো। পাওয়ার হাউস মোড়ের তেমাথাটা যদি চৌমাথা হত, পানবিড়ির গুমটিটাই হত আর-একটা রাস্তার মুখ। পেছনে পাঁচিল ঘেরা একফালি জমিটুকু আর লাগোয়া ট্রাফিক কন্ট্রোলের ঘরটার সঙ্গে মিলে দীনহীন চেহারার গুমটিটাই যেন মোড়খানাকে আটকে রেখেছে তেমাথায়।
বাধ্য হয়েই ঝাড়তে হয় নির্জলা ঢপটা, আর নেই আসলে খুচরো।
দশের নোট হবে? চোখ তুলে এবার তাকিয়েছে লোকটা, দিন, ফেরত দিচ্ছি আমি। তিন টাকা দিতে পারব...
তা-ও নেই, আগুনের কাজ মিটে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই সতেরো টাকার সিগারেটখানাকে দু’ আঙুলের ফাঁকে ধরে এমনি এমনিই পুড়ে যেতে দেয় খানিক। আর-একখানা ঢপ ছাড়ে অম্লানবদনে, আর সবই পাঁচশোর নোট...
সব কুড়িয়ে বাড়িয়েও বোধহয় পাঁচশো হবে না এই মুহূর্তে পকেটে।
তাহলে রেখেই দিন, পাটাতন থেকে তুলে কয়েনখানাকে তর্জনী আর মধ্যমার ভরে বাড়িয়ে ধরেছে লোকটা, আবার যেদিন আসবেন অ্যাডজাস্ট করে দেবেন...
হুম। এসো। মনে মনে বলে সুকৃতী। যে যার তালে থাকে। আজ টাকা বাকি থাকুক। যাতে আবার ঘুরে আসতে হয় কাল। বেশ বুঝে নিয়েছে মাল। রেগুলার কাস্টোমারটা খসেছে যে কোনও কারণেই হোক। নইলে এই সেদিনও দু’ বেলা আসত যে লোক, হঠাৎ কী হল তার?তাতে বিগত মাস দেড়েকে কিছু না হলেও একশো বার এ রাস্তা দিয়ে তাকে যেতে আসতে দেখেছে লোকটা। ঘাসে মুখ দিয়ে তো চলে না কেউই।
আজও কি আসত দায়ে না পড়লে?
কিন্তু কী করে!
উপায় ছিল না যে।
তিন দিনেও চালাতে পারেনি কয়েনটা। খচখচ করতে লেগেছিল মনটা। মানুষটাই এমনি সে। হাজার হাজার টাকা খেয়ে উড়িয়ে দিতে পারে এক সন্ধ্যায়। কিন্তু সয় না আট আনা পয়সারও বেকার আটকে থাকা। পোস্ট পেডের বিল মেটানোর সময় ব্যাংকের খাতায় জমা হওয়া পয়সাগুলোকেও ধরে ট্রান্সফার করে দেয়। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয়েছিল দুর্ভাবনা। শিয়ালদা স্টেশনের টয়লেট থেকে বেরিয়েই। দশ টাকার জ্যালজেলে নোটটাকে চালানোর মতলবেই ঢুকেছিল। সেটা হয়েছে। কিন্তু ফেরতের সঙ্গে পকেটে ঢুকেছে ছোট কয়েনটা।
কলকাতায় গেলে কেউ না কেউ ঠিক গছিয়েই দেবে জিনিসটা। না নিয়ে উপায়ও থাকে না। ওসব ট্যাঁ-ফোঁ চলে না ওখানে। কিন্তু মফস্বলে খুব মুখ চেনা দোকান না হলে নিতে চায় না ছোট এক টাকা। আগে আগে তাই ট্রেনেই সদ্গতি করে আসত। হট ফেভারিটই ছিল মিষ্টি বাদাম। কিন্তু হালে চিনি থেকেও দূরেই থাকতে হচ্ছে।
কয়েনখানা পকেটে নিয়েই ফিরতে হয়েছে অগত্যা।
তারপর থেকেই শুরু হয়েছে অশান্তি।
খাচ্ছে দাচ্ছে। ঘুরছে ফিরছে বাজার দোকানে। কিন্তু পকেটে থাকা কয়েনখানাই শান্তি দিচ্ছে না কিছুতে। এখন মনে হচ্ছে এর চাইতে নোটটা থাকাই ছিল ভাল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও দেখছে আলফাল স্বপ্ন। ডেবিট কার্ড পাঞ্চ করতেই মেশিন থেকে বেরিয়ে আসছে হাজার হাজার ছোট কয়েন। তারপর আধুলি। সিকি। ক্রমে ক্রমে ছেলেবেলায় দেখা সেই বিভিন্ন আকারের কুড়ি, দশ, পাঁচ, তিন, দুই আর এক পয়সায় ভরে উঠল ঘরটা। লক্ষ লক্ষ অচল পয়সার চোরাবালিতে তলিয়ে যেতে লাগল সুকৃতী। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আতঙ্কে। পরদিন সকালেই খুঁজে খুঁজে বের করেছিল ঘরে থাকা যত খুচরো কয়েন। সব মিলিয়ে দশ টাকা খুচরোয় সাজিয়ে নিয়ে ছুটেছিল বাজারে। মাছওয়ালাকে গছানোর চেষ্টা করেছে। আনাজওয়ালাকে। শেষে দুধের দোকানে। কোত্থাও নেয়নি। মরিয়া হয়ে উঠছিল সুকৃতী। কী মনে হতে বাজারফেরতা ঢুকেছিল গোল্ডেন মেডিকেয়ারে। প্রেশারটা মাঝেমধ্যে নজরে রাখতে বলেছিল ডাক্তার। গিয়ে দেখে যা ভেবেছে ঠিক তাই। তলারটা মগডালে চেপে বসে আছে কোন ফাঁকে। আশি পাওয়ারের টেলমিস্টেরন চলার পরও।
অদিতির কাছে চেপে যেতে হয়েছে বেমালুম।
ঝাড় খেতে হত একচোট।
তা-ও চিন্তাটা সরেনি মাথা থেকে।
ভাবতে ভাবতেই একটা গভীর বিষয় টের পেয়েছে শেষ অবধি।
কেন চালাতে পারছে না কয়েনখানাকে।
যেহেতু যে লোকগুলোর কাছে যেতে হচ্ছে ইদানীং, বেশিদিনের পরিচিত নয় কেউই। আলগা মুখ চেনা হয়তো আছে। কিন্তু পিরিত জমতে পারেনি এখনও সেভাবে। যেমন আজকাল মাছ নিচ্ছে সাধনা টাওয়ারের লাগোয়া ফুটপাথে পলিথিন পেতে বসা লোকটার কাছ থেকে। কোনও কোনওদিন আর-একটু হেঁটে বিজয়া ভবন অবধি যায়। চারাপোনা আর মাঝেমধ্যে মুখ পালটাতে ছোট মাছের বাইরে হালে আর বিশেষ কিছুই খাওয়ার নেই যেহেতু। পাচন গেলা মুখ করে নিয়ে আসতে হয় সেসবই। যেটুকু কথা না বললেই নয়, সেটুকুই হয় মেছোদের সঙ্গে। ওভাবে কি ঘনিষ্ঠতা জমে? হ্যালো পয়েন্টের পাশে ছাতা নিয়ে বসা শম্ভুর কাছ থেকে যেখানে পাবদা, বোয়াল, আড় বা ইলিশ কাটাতে কাটাতে মোদি থেকে মোহনবাগান সবই চলত। রেওয়াজি খাসির সামনের পা টুকরো করতে করতে যোগেশ ডায়লগ ছাড়ত, দাদার চেহারাটা কিন্তু দিন দিনই ঋষি কাপুরের মতন হচ্ছে...
হবেই, গম্ভীর মুখে বলেছে সুকৃতীও, আমায় পেটে নিয়েই বদলতে রিস্তে দেখতে গিয়েছিল মা।
হা হা করে হেসে উঠেছে যোগেশ।
ওখানেই না থেমে অ্যাক্সিলারেটরে আরও মোচড় দিয়েছে, তাছাড়া আমার আর ঋষি কাপুরের পছন্দও সিমিলার। সিঙ্গল মল্ট...
গুরু গুরু, তারিফ করে উঠেছে যোগেশ, এক ঘর দিলে পুরো।
হাত চালাও ভাই, দু’জনার গুলতানিতে বিরক্ত হয়েছে লাইনের পেছনের লোকজন, মুখ খানিক কম চালিয়ে...
দেড় কিলো মাল আছে কাকা, ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে যোগেশ, দাঁড়াতে হবে একটু। কিছু করার নেই...
পয়সা মিটিয়ে ভারী ব্যাগটা হাতে থপথপিয়ে বেরিয়ে আসার আগে একবার পেছনের অপেক্ষমান ভিড়টার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়েছে ঘুরে। চিমসেপানা চেহারা সব। চোয়াড়ে টাইপের থোবড়া এক-একজনের। এরা আবার নাকি দেয় আওয়াজ! মাসে একদিন সাড়ে তিনশো মাংস নিতে এসে মাথা কিনে নিয়েছে সব! শাল্লা...
সেসব দিন এখন অতীত।
রাজার মতো বাজার করেছে এই সেদিনও। বড় নাইলনের ব্যাগ উপচে পড়ত। আজকাল ছোট থলি নিয়ে যায় চোরের মতো গুটিগুটি। যেদিন চিকেন নেয় তা-ও একটু ভারী হয় থলেটা। নয়তো ওই ক’টা শাকসবজি আর মাছের পিশ পুরনো ব্যাগটার তলায় পড়ে থাকত। নিজেরই হাসি পায় ভাবলে। লোকজনের হাসির খোরাক আর হতে চায়নি সুকৃতী। একেই শরীর অর্ধেক হয়ে গিয়েছে এই মাসদেড়েকেই। সেই ভরাট মুখ নেই আর। কেউ কেউ বলছে বটে স্লিম লাগছে বেশ। কিন্তু আয়নায় নিজের ফচকে চেহারাটার দিকে তাকালে এক-একবার নিজেরই কান্না পায়। কী যে সাইজ জিরোর ফ্যাশন হয়েছে কচু আজকাল। দু’ চক্ষে দেখতে পারে না সুকৃতী। চেহারায় একটা ভারিক্কি ভাব থাকলে তবেই না ব্যক্তিত্ব। তা এমনি কপাল, তার সঙ্গেই কিনা ঘটতে হল দুর্ঘটনাটা! নাইলনের ব্যাগটাকেও কেমন যেন বেমানান লাগে নিজের নতুন চেহারাখানার সঙ্গে। তাছাড়াও সংসারের বাকি তিনটি প্রাণীর আর কত খাওয়াদাওয়া? মা-বাবার বয়স হয়েছে। অদিতিরও খাওয়া অল্পই। নিজের জন্যই ব্যাগ ভরে বাজার করত সুকৃতী।
জগত্তারিণী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, স্টেশন রোডের মালের দোকানটা বা ওই যোগেশের কাছে গেলেই হয়তো এখনই একটা গতি হয়ে যেত কয়েনটার। কিন্তু...
কোথাও শুনেছে সুকৃতী, মফস্সলে ছোট কয়েন না চলার পেছনের রহস্যটা। এ তল্লাটের দোকানগুলো থেকে নাকি ব্যাপক পাচার হয় খুচরোর। চলে যায় ব্লেড বানানোর কারখানায়। কিছু বেশি দাম দিয়েই নিয়ে যায় দালালরা। পুরনো এক টাকার কয়েন থেকে নাকি গোটা পাঁচেক ব্লেড হয়ে যেত। পুষিয়ে যেত খরচায়। শোনা কথা। কিন্তু নতুন কয়েন গলিয়ে যেটুকু ধাতু মেলে, তাতে পোষায় না পরতায়। সেই কারণেই এদের দাম নেই দালালদের কাছে। খুব মুখ চেনা না হলে তাই মফস্সলের দোকানে নিতে চায় না ছোট কয়েন।
অনেক ভেবেচিন্তেই পাওয়ার হাউস মোড়ের গুমটিটায় এসেছিল আজ সুকৃতী।
দুটো ভাইটাল পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছিল ভাবতে ভাবতে।
একটা শারীরিক।
আর-একটা অর্থনৈতিক।
একে তো মনে হয়েছিল মদ, মিষ্টি বা খাসির মাংসের চাইতে শরীরের উপর একটা সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব কিছুটা হলেও কমই হবে। যেহেতু সবটা ধোঁয়া ফুসফুসে টেনে না নিলেও চলে এখানে। যা বাকি তিনটি উপকরণের বেলায় সম্ভব নয়। ছানার জিলিপি আধখানা বা মাংসের সিকিভাগ ফেলে দেয় না কেউ। স্কচেরও তলানি রাখা যায় না।
তাছাড়াও বেশ মনে পড়ছিল আগে দু’-একবার মুখ বুজেই ছোট কয়েন নিয়ে নিয়েছিল লোকটা।
যদিও এখন বুঝতে পারছে, মাসদেড়েকের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে পুরনো পিরিত চটে গিয়েছে একদমই।
এসব ভাবতে ভাবতেই আচমকাই চোখ পড়ে লোকটার মাথার পেছনে গুমটির এক কোনায়।
এই তো।
পুরনো রিস্তা যখন চটেই গিয়েছে, দু’ তরফ থেকেই চটুক।
এতগুলো খুচরো দিয়ে উপকার করার কোনও মানে হয় না এখানে।
ফোন বের করে সুকৃতী, ওটা রেখেছেন বলবেন তো। অনলাইনেই দিয়ে দিচ্ছি তাহলে...
পাওয়ার হাউস মোড় থেকে পুবে দেশবন্ধু পল্লি। আদহাটা রোডের উপর পরপর ওষুধের দোকান হালে এই এলাকায়। লোকনাথ, আরোগ্য বা মল্লিকের মতো দিশি নাম তো কবে থেকেই ছিল। এই ক’ বছরে বিলিতি নামের বড়সড় ফার্মেসিরাও ব্রাঞ্চ খুলতে শুরু করেছে পটাপট। এসব জায়গায় কার্ড করা যায়। কমিশন বেশি। হোম ডেলিভারির সুবিধা আছে। লোকাল দোকানদের একচেটিয়া কারবার আর উন্নাসিক ব্যবহারে ঘা পড়তে লেগেছে। যদিও যা দিনকাল, টুকটাক চলেই যাচ্ছে এ ব্যবসায় সক্কলেরই। আশুবিশ্বাস পল্লির দিকটায় সন্ধ্যার দিকে হাঁটতে যায় সুকৃতী। শহরের একদম পূর্ব কোনা। এই দু’ হাজার চব্বিশেও কলোনির মতো পরিবেশ। খোলা নর্দমা। নেহাত গাড়িঘোড়ার উৎপাত নেই বলেই ওদিকটায় যাওয়া। তা সেখানেও পাড়াঘরের মধ্যে গজিয়ে ওঠা নতুন ওষুধের দোকান চোখে পড়ল সেদিন।
মাসের শুরুতে প্রেশারের ওষুধটা তিনের জায়গায় দু’ পাতা দিয়েছিল হোম ডেলিভারিতে।
এক পাতা স্টকে ছিল না নাকি।
নিয়ে নিতে হত মেডিসিনটা। মনে পড়তেই মোটর সাইকেল থামিয়ে কাচের পাল্লা ঠেলে ঢুকে পড়ল সুকৃতী। দাঁড়াতে হল না। টেকো লোকটা বেরিয়ে যেতেই ভুরু নাচাল, সেই যে, মনে আছে তো? তখন দিতে পারোনি। নিতে এলাম বাকি পাতাটা...
হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার। পরের দিনই এসে গেছে, ভদ্রতার হাসি সবুজ ইউনিফর্ম পরা ছেলেটার ঠোঁটের কোনায়, আপনার আসার আবার কী দরকার ছিল? ফোন করে দিলেই তো পারতেন...
বিনয়ের অবতার একেবারে!
ঘটঘট করে প্রিন্টার থেকে ছেপে বেরোচ্ছিল বিলটা। কী মনে হতেই ছোট কয়েনটা বের করে সুকৃতী, চলবে এটা?
দিয়ে দিন, হাসে ছেলেটা, আমাদের সব চলে। তাছাড়া রেগুলার কাস্টোমার আপনি...
প্রেশারের মেডিসিনই প্রেশার কমায় তাহলে।
মনে মনে হাসে সুকৃতী।