পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আজাদি @৭৫ - মহোৎসব ও বিভীষিকা

  • 04 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1126 view(s)
  • লিখেছেন : সমন্বয় ভট্টাচার্য
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে, সেই ১৯৭২ সালে, প্রখ্যাত সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ছিলেন 'সত্যযুগ' পত্রিকার সম্পাদক। তিনি সেই সময় লিখেছিলেন, "ভারতীয় স্বাধীনতার ২৫ বছর নিশ্চয়ই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং ইতিহাসের বিচারে একটি নূতন পরিচ্ছেদের আরম্ভ। কেননা, যে পঁচিশ বছর আমরা পিছনে ফেলে এলাম, বলা যেতে পারে সেইটি ভারতীয় জনগণের আসল স্বাধীনতার কিংবা জাতীয় মুক্তির ভূমিকা মাত্র। আজকে ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, আমরা কি পাচ্ছি?

আধুনিক ইতিহাসের নির্মাণের অনেকখানি দায় বর্তায় খবরের কাগজের উপরে। সেই ধারণাকে মনে রেখে আজাদি@৭৫: মহোৎসব ও বিভীষিকা বইটি লিখেছেন কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত। বইটির বিষয়ে উল্লেখ করতে হলে প্রথমেই বলতে হয় বইটি আসলে ২০২১ সালের ১৫ অগস্ট থেকে ২০২২ সালের প্রজাতন্ত্র দিবস অব্দি সময় ধরে মোটের ওপরে সংবাদপত্রের রাজনীতির দিশা নির্ধারণ করা হয়েছে। সংবাদপত্রের লেখার পাশাপাশি বাদ পড়েনি বিজ্ঞাপনও। বলা যায়, দ্বিতীয়বার এনডিএ সরকার রাষ্ট্রের সংসদে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে কী ভাবে সংবাদপত্রের খবরের রাজনীতি ও তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

প্রথমেই আসা যাক, সংবাদপত্রের মধ্যে দিয়ে কীভাবে বারবার উঠে আসছে উগ্র জাতীয়তাবাদী আগ্রাসনের কথা। বারবার সোচ্চারে বলা হচ্ছে, ভারত আসলে হিন্দু রাষ্ট্র, এবং এই হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে ঘোষণা করার মধ্যে দিয়ে অহিন্দু সমাজের নাগরিকত্ব নিয়ে একভাবে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এমনকী, তাঁদের নাগরিকত্ব খারিজ করে দেওয়ার হুমকিও প্রকাশ্যে দেওয়া হচ্ছে। সংবাদপত্রে এই নিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আক্ষেপের বিষয় হল, খবরের কাগজের রিপোর্টিং-এ তা নিয়ে কোনও বিশেষ নিন্দা সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে না। বরং, খবরের কাগজের লেখার মধ্যে কোথাও ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করা এবং অহিন্দু বিতাড়নের প্রসঙ্গটিকে বার বার উত্থাপন করে যেন বা এই বিষয়টিকে বৈধতা দিয়ে ফেলা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, হিন্দুত্বের পাশাপাশি খবরের কাগজের নিত্য সংবাদের মধ্যে বারবার ঠাঁই পাচ্ছে কংগ্রেস তথা ভারতের বিগত ৭০ বছরের ইতিহাসকে (অর্থাৎ বিজেপি সরকার গঠন করার আগের সময়) বাতিল করে দেওয়ার প্রবণতা। অথচ, এমন নয় যে, বিগত ৭০ বছরে কেবলমাত্র কংগ্রেস পার্টিই সরকার গড়েছে। অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারও তার মধ্যেই পড়ে। কিন্তু দেখা যাবে, নয়া ইতিহাস তৈরি মোহে বিজেপি দলের স্বাধিকারকেও একভাবে মুছে দিয়ে বারবার আরএসএসের মতাদর্শ চালিত রাজনীতিকে ভারতের সনাতনী সংস্কৃতি ও রাজনীতির মূল বলে প্রচার করা হচ্ছে।

এই দুইয়ের মিশেলে বিভ্রান্তি, নতুন রচনা, নতুন প্রশ্ন ---অর্থাৎ, গান্ধী জাতীয় নেতা ফাদার অফ দ্য নেশন কেন হবে? তাহলে তো গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে জাতীয় ভিলেন করে ফেলতে হয়। বলা হচ্ছে, তাঁকে রাষ্ট্রের মান্য ইতিহাসে এতদিন ভিলেন চরিত্রে বসিয়ে মানুষকে আসলে প্রতারণা করা হয়েছে। আসলে আরএসএস সামগ্রিকভাবে দেশ দখলের নকশা করেছে, একথা বারবার বলা হয়েছে বইটিতে। দক্ষিণপন্থী অন্যান্য দলগুলিকেও সে মিডিয়া ফুটেজ দিতে বেশি আগ্রহী না। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে পাশে সরিয়ে রেখে তার বদলে নরম হিন্দুত্বের ছদ্মবেশ ধরার চেষ্টা করেছে। এই প্রক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও আরএসএস আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। অথচ, রবীন্দ্রনাথের একাধিক প্রবন্ধে বারবার হিন্দু আগ্রাসনবাদী বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিপক্ষে শান্তিকামী মতবাদের কথা বলা আছে।

ইতিহাস ও রাজনীতির পাশাপাশি লখ্যণীয়, বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় এই সময়ের মধ্যে কীভাবে স্বাধীনতা শব্দটির বাণিজ্যিক ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন গয়না, খাবার, গাড়ির বিজ্ঞাপনে ব্যক্তি স্বাধীনতার সঙ্গে সামগ্রিক অর্থাৎ জাতীয় স্বাধীনতার ধারণা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রচ্ছদে পার্থ দাশগুপ্ত বিশেষ উল্লেখ দাবী রাখে। পাশাপাশি আনন্দবাজার, এই সময়, সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল -সহ একাধিক দৈনিক পত্রিকার খবর ও আলোচনা পাওয়া যাবে এই বইটিতে। ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণার জন্য বইটি বিশেষভাবে সাহায্যকারী তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু, সমস্যা হল, বইটি সুনির্দিষ্ট আকারে গোছানো নয়। দৈনিকে প্রকাশিত লেখা ও লেখকের সে বিষয়ে অনুধাবন –এই দুটি প্রায়শই গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। তাও প্রকাশক ঋতবাকের তরফে প্রকাশিত, কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্তের আজকে স্বাধীনতার ৭৫ বছরে, এই পুস্তকটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।

0 Comments

Post Comment