বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে পশ্চিমবঙ্গবাসী বাঙালি শ্রমিকদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে হেনস্থা-পীড়ন করা, আটক করা, এমনকি একাধিকজনকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধী রাজনীতির পরিসরে একপ্রকার বাঙালি জাগরণের আওয়াজ উঠে গেছে। শুধু রাজনীতির মঞ্চ কেন, সমাজ মাধ্যমেও এই নিয়ে শোরগোল চলছে। রাজ্যের শাসক দল বিষয়টিকে নিয়ে জাতি আস্মিতার আওয়াজ তুলে দিয়েছে, এমনকি ভাষা বাংলা দেখে টার্গেট করার ঘটনাকে ভাষা সন্ত্রাস বলে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। ভাববার বিষয়, বিজেপি কি কালীদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, যে, দলটা এরকম খুল্লমখুলা জাতি-বিদ্বেষী হয়ে পড়ল যখন সামনেই এরাজ্যে বিধানসভা ভোট?
বিজেপি শাসিত অনেক রাজ্যে শহরে ও শহরতলিতে, কোথাও কোথাও শহর থেকে দূরে গঞ্জ এলাকায় বিপুল সংখ্যায় বাঙালি রয়েছে, যাদের মধ্যে একটি ছোট অংশ ব্যবসাসূত্রে দীর্ঘদিনের বাসিন্দা এবং ভারী সংখ্যক পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া অস্থায়ী শ্রমিক। তারা সেখানে গোষ্ঠী অথবা গ্রুপ হিসাবে অবস্থানকারী, যেক্ষেত্রে বাঙালি হিসাবে জাতিগত অবস্থান বিস্তৃত নয়, বরং অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। সেদিক থেকে অপরাপর সম্পর্কে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। বাস্তবিক বিজেপি এই নিয়ে বৃথা কসরৎ শুরু করেনি। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্বের কোন ইতিহাস নেই, এবং বর্তমানে সেরকম দ্বন্দ্বের আভাষটুকুও নেই। সেখানে বিজেপি বাঙালি বিদ্বেষকে দাঁড় করাবে কীসে? বাইরের রাজ্যে বাঙালিদের হেনস্থা-পীড়ন করলেই, বাংলাদেশী বলে দাগিয়ে দিলেই কি এটা সম্ভব?
বিভিন্ন জাতির মধ্যেকার সম্পর্ক স্রেফ ভাবগত বিষয় নয়, যে, দুটি জাতির মধ্যে ক’টা বৈরিতামূলক ঘটনা ঘটিয়েই তাদের বৈরী সম্পর্কে লিপ্ত করা যায়, যার ফলস্বরূপ জাতি সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়। তার জন্য বস্তুগত ভিত্তি থাকতে হবে, অর্থাৎ জাতি-দ্বন্দ্বের বাস্তবতা আগে থেকেই বিদ্যমান থাকতে হবে – সে’ বৈরী বা অবৈরী যেরূপেই থাকুক। কোন রাজনৈতিক দল বা কোন গোষ্ঠী শত চেষ্টা করেও জাতিতে-জাতিতে সংঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না যদি না তার বাস্তব ভিত্তি থাকে। আসামে রাজনীতিতে অসমীয়া জাতিসত্তা রক্ষার আন্দোলনের জেরে কয়েক দশক ধরে প্রধান এজেণ্ডা হয়ে ছিল জাতিপ্রশ্ন। বিজেপি এখন সেটিকে ধরেই হিন্দুত্বের রাজনীতি অনুশীলন করছে, যার একটা প্রতিফলন হল, মিয়া মুসলিমদের (বাংলাভাষী মুসলিমদের) অনুপ্রবেশকারী এবং/অথবা সরকারি জমি জবরদখলকারী বলে উচ্ছেদ করা, সেইসঙ্গে ইদানিং তাদের অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে বলপূর্বক পুশ ব্যাক করা শুরু হয়েছে। বিজেপি শাসিত মণিপুরে ২০২৩ সালে জাতি-দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। তারও এক পটভূমি আছে। সেখানকার মেইতেই জাতি ও সম্মিলিত কুকি-জোমি-নাগা উপজাতির মধ্যেকার মূলত অবৈরী ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে বৈরিতামূলক অভিঘাত সৃষ্টির পরিণতি হল এই জাতি-দাঙ্গা।
অবশ্য কেউ বলছে না, যে, ভিন রাজ্যে বাঙালিদের এহেন বিপদের পিছনে অবাঙালিদের জাতিবৈরিতা কাজ করছে। সবাই বলছে, এটা বিজেপি ও তার সরকারের বিদ্বেষমূলক কাজ। তথাপি এখানে সেই জাতির কথাই এসে যায়। যেখানে জাতি-দ্বন্দ্বের কোন জায়গা নেই, সেক্ষেত্রে বিজেপি কোন্ লাভের আশায় হামলে পড়েছে? বাস্তবিক এরকম প্রচেষ্টায় কোন লাভই নেই। তা হলে বিজেপি আসলে কী করতে চায়?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে প্রাথমিকভাবে আমাদের জাতি প্রসঙ্গকে মুলতুবি রাখতে হবে। সেখান থেকে বের হয়ে হেনস্থা, পীড়ন, বিতাড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের নামগুলি খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে সকল আক্রান্ত ব্যক্তিই মুসলমান। হরিয়ানার গুরুগ্রামের সেক্টর-৬৪-র বাঙালি কলোনির ঘটনা– ভুক্তভোগীদের একজন কোচবিহারের বাসিন্দা হেমন্ত বর্মণ বলেছেন, তাদের পরনের কাপড় খুলে দেখেছে হিন্দু না মুসলমান। অর্থাৎ কোথাও কোন বাঙালি অমুসলিম হেনস্থার শিকার হলে তা ঘটেছে বাঙালি মুসলমান খোঁজার ডামাডোলে। সেক্ষেত্রে হেনস্থার ঘটনাই মাত্র ঘটেছে এবং পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার আগে। মুসলিমদের প্রতি ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে কি বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে? তা নয়। তারজন্য স্থানীয় মুসলমান আছে; এতদিন তো তাদেরই নিশানা করে হিন্দুত্ব বাহিনী নানান তাণ্ডব চালিয়ে এসেছে। এখন তাদের ছেড়ে যারা ওখানে নিতান্ত কায়িক শ্রমের কাজ করতে গেছে, আজ আছে কাল নেই, এদের নিয়ে পড়বে কেন? এও খেয়াল করার, অবাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরা বিপদে পড়েনি। কেন শুধুমাত্র বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে?
মোদি জমানায় প্রবেশ করে বিজেপি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। এবং অনুপ্রবেশ প্রশ্নে তারা অদ্ভূত বিভাজন আনে। তারা বলে, ভারতে অবৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশী মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে আসা হিন্দুরা অনুপ্রবেশকারী নয়, তারা শরণার্থী। বিজেপি দাবি করে আসছে, দুই কোটি বাংলাদেশী মুসলমান পশ্চিমবঙ্গে অবৈধভাবে ঢুকেছে, তাদের একটা অংশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৮-’১৯ সালে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে এসে এবং পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বলে বেড়িয়েছিলেন, তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। অন্যদিকে, তথাকথিত শরণার্থীদের সামনে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAB)-এর খুড়োর কল খাড়া করে বিজেপি। এই দুইয়ের প্রাসঙ্গিকতায় তারা এনআরসি করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে, তার পক্ষে জনমত সংগঠিত করা শুরু করে। এই আবহে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভাল সংখ্যক সাংসদ পেয়ে যায়।
আজ যখন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলমান অনুপ্রবেশ নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে, তখন তাদের পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসার কোন কারণ ঘটেনি। বিজেপি কোন্ দুঃখে হিন্দু অনুপ্রবেশ নিয়ে বিরোধ করতে যাবে, যখন সিএএ-২০১৯ নিয়ে কথা বলার সুযোগ এখনও আছে? এবং হিন্দু শরণার্থী কথাটা তারা শুধু মুখে বলেনি, তাদের আপৎকালীন নিরাপত্তার জন্য গোঁজামিল দেওয়া নিয়ম-নীতিও হাতে রেখেছে। আপৎকালীন নিরাপত্তা বলতে ২০১৫/’১৬ সালে গৃহীত ‘ফরেনার্স (অ্যামেণ্ডমেন্ট) অর্ডার’ এবং ‘পাসপোর্ট (এন্ট্রি ইনটু ইণ্ডিয়া) অ্যামেণ্ডমেন্ট রুল’এর কথা বলতে চাইছি, যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন-পার্সি-খ্রিষ্টান এই ছ’টি সম্প্রদায়ের যে সকল মানুষ ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে অথবা ধর্মীয় নিপীড়নের আশঙ্কায় ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে পাসপোর্ট-ভিসা বা অন্য কোন বৈধ নথিপত্র ছাড়াই অথবা এসবের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাদের এই দুই আইনের কার্যকারিতা থেকে ছাড় দেওয়া হল; অর্থাৎ এই সকল লোকজন আইনত অনুপ্রবেশকারী হলেও এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। এই ছাড় দেওয়ার মধ্যে ফাঁকিবাজি আছে, যাতে ইচ্ছে করলেই তাদের আইনের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। সিএএ আইনটাও একটা ফাঁদ, যাতে ঐ সকল তথাকথিত শরণার্থীদের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব। কিন্তু বিজেপি এখনও শরণার্থী নিয়ে গালভরা কথা বলে, সিএএ নিয়ে আশাবাদ শোনায়, বিশ্বাস করার লোকও জুটে যায়। পাশাপাশি এখনও তারা বাংলাদেশী মুসলমান অনুপ্রবেশের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। এখন ২০১৯ সালের এজেণ্ডাকে তারা পুনর্নবীকরণ করেছে— এখন শুধু বাংলাদেশী মুসলমান অনুপ্রবেশের গল্প-গুজব নয়, হাতেকলমে ব্যাপারটা দেখিয়েও দিচ্ছে বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বলে দাগিয়ে দিয়ে। এর বিপরীতে যথাসময়ে শরণার্থী, সিএএর পসরা সেজে উঠবে।
এদিকে অদ্ভুতভাবে বিজেপি বিরোধী পরিসরে ভ্রান্তি-বিলাস উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ভিন রাজ্যে অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা, ধরপাকড় ও বিতাড়িত করা হচ্ছে, বাঙালি মুসলমান বলে, বিরোধীদের ভাবনা যেমন, বাঙালি অথবা বাংলাভাষী বলে নয়। খেয়াল করার বিষয়, যে সকল বাঙালি মুসলিম পশ্চিমবঙ্গ থেকে গিয়ে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, তাদের নিশানা করা হচ্ছে না। বিজেপির উদ্দেশ্য বাংলাদেশী মুসলমান অনুপ্রবেশ বিষয়টাকে শক্ত জমিতে দাঁড় করানো, এই নিয়ে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি করা। সেজন্য আন্তঃরাজ্য শ্রম-পরিযান সাপেক্ষে বহিরাগত ও অসংগঠিত মুসলিম শ্রমিকরা তাদের সফ্ট টার্গেট। সেই জায়গায় তার বিরোধিতায় ‘বাঙালি মুসলমান’ থেকে ‘মুসলমান’ উহ্য থেকে গেলে সমস্যাটি ভিন্ন মাত্রা পেয়ে যায়— তা জাতিগত সঙ্কটে প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়, যার সমসাময়িক প্রাসঙ্গিকতা শূন্য। এবং এখনকার জরুরি প্রশ্ন— বিজেপির অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে মিথ্যাচার, সেটা জনমনে সত্যে পরিণত হওয়ার রাস্তা খুলে যায়। এমনকি শরণার্থী ও সিএএ নিয়ে প্রতারণার বাড়তি রসদ বিজেপি হাতে পেয়ে যাবে। যেভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ম-নীতি ও বাস্তবতার তোয়াক্কা না করে অনুপ্রবেশকারী বদনাম দেওয়া হচ্ছে, তাতে তারা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাঙালি অস্মিতা বা ভাষা সন্ত্রাসের মতো রাজনৈতিক ভাষ্যে এই নিয়ে উদ্বেগের কোন জায়গা নেই।
আজকের এই সমস্যায় ভাষা সন্ত্রাস ও বাঙালি অস্মিতায় কিংবা শুধুই বাঙালিত্বে বাঙালি জাতিসত্তাকে খুঁজে লাভ নেই। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির সামনে বিপদ নেমেছে মুসলমান অনুপ্রবেশের প্রাসঙ্গিকতায়। মুসলমান অনুপ্রবেশের গিমিকে বাঙালি সমাজে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মালমশলা রয়েছে। এটা আরও বেশি সত্য বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ হিন্দুদের ক্ষেত্রে, যারা দেশভাগের বলি এবং যাদের মধ্যে একাংশ পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পীড়নের শিকার, যা ছিল পাকিস্তানপন্থী রাজাকার গোষ্ঠী ও পাকসেনার মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অভিযানের পরিণাম। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই নিয়ে বিজেপির ধর্মীয় বিভাজনের প্রচেষ্টা ভোটবাক্সে ফলপ্রসূ হয়েছিল। বিভাজন শুধু হিন্দু-মুসলমানেই আটকে থাকবে না; তথাকথিত শরণার্থী ও সিএএ-এর আশ্বাসে যে বাঙালি অমুসলিমরা সাত বছর ধরে প্রতারিত, বিজেপি তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পুষিয়ে নিয়ে অথবা সময়ে তা পূরণ না হলে এই দুইয়ের মায়াজাল গুটিয়ে নেবে এই লক্ষ লক্ষ বাঙালি অমুসলিমদের আতান্তরে ফেলে দিয়ে। এভাবে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভাজন, নাগরিক ও তথাকথিত শরণার্থীদের মধ্যে বিভাজন বাঙালি জাতিসত্তায় দুরারোগ্য ব্যাধির চেহারা নেবে। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, একই ঠাঁই, অথচ জীবনযুদ্ধে বিসদৃশ বাস্তবতায় নিমজ্জিত, পরিচিতি ও অস্তিত্ব নিয়ে বিপরীত স্বার্থের সংঘাত। এভাবে একটি জাতি নিজেই পরিচিতি সঙ্কটে পড়ে। তখনই হিন্দু জাতীয়তাবাদ বাঙালির সংস্কৃতিতে থাবা উঁচিয়ে নামবে, ভাষা আক্রান্ত হবে হিন্দি-হিন্দু আগ্রাসনে।
অবশ্যই ভিন রাজ্যে বাঙালি মুসলিমদের উপর পীড়ন নিয়ে উদ্বেগকে বাঙালি জাতি সম্পর্কে উদ্বেগ পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, কিন্তু তার পরিপ্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে নয়। “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি”— তা অনেক আগেই টের পেয়েছে বিভেদকামী শক্তি। একদিকে হিন্দুত্বের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ, যার ভিত্তি ব্রাহ্মণ্যবাদ, অন্যদিকে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থানে সম্পৃক্ত ও সংহত বাঙালি জাতিসত্তা। ফলে দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের অনিবার্যতায় দ্বন্দ্ব হিন্দুত্বের শুরু থেকে শুরু হয়ে ধারাবাহিক। উপরন্তু হিন্দুত্ববাদীদের তূণে সেই তীর নেই, যা বাঙালি জাতিসত্তার দিকে সজাসুজি নিক্ষেপ করতে পারে। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য এই যে, হিন্দু মহাসভা থেকে জনসঙ্ঘ হয়ে বিজেপি— ছয় দশকের পরিক্রমায় হিন্দুত্বের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে ব্রাত্যই থেকেছিল। সবেমাত্র দেড় দশকে বাংলার রাজনীতিতে বাম ধারার দুর্বলতা ও গণতন্ত্রের ম্রিয়মাণতার পরিবেশে এবং বিপুল সংখ্যক বহিরাগত বাঙালি হিন্দুর ভারতীয় নাগরিকত্বের বাস্তবসম্মত নিষ্পত্তি না হওয়ার উদ্বেগের সুযোগে বিজেপি তার গ্রহণযোগ্যতা প্রতিপন্ন করতে পারলেও দেশব্যাপী গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জন অধিকারের সঙ্কটকালে বিজেপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতি সম্পর্কে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সজাগ হয়ে উঠেছিল। এখান থেকে বিজেপি শিক্ষা নিয়েছে, এখন তারা অনেক বেশি কৌশলী। বিজেপি বাঙালি জাতির প্রতিকূলে রাজনীতিকে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছে। সমগ্রে বাঙালির এই বিপদের সূচনা ঘটানো হয়েছে বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর দিয়ে। বাস্তবত, এখনকার কার্যকলাপের নিরিখে তার জাতি-বিদ্বেষ অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। সেখানে যদি গোড়া ছেড়ে আগা ধরে টানাটানি করা হয়, তাতে শাখা-প্রশাখা কিছু খসে পড়তে পারে, মূলের কিছু যাবে-আসবে না। বিষবৃক্ষ সময়ে ঠিকই পল্লবিত হয়ে উঠবে।
২.
সম্প্রদায় বা জাতি বিরোধী রাজনীতিতে সাধারণভাবে শ্রেণি-প্রশ্ন এমনভাবে সম্পৃক্ত থাকে, যে, তা আপাতভাবে অনুপস্থিত বলে মনে হতে পারে। এখন ভিন রাজ্যে বাঙালি মুসলিমদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় শ্রেণির দিকটি অনেকটাই স্পষ্ট। আক্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকরা অসংগঠিত এবং বিদেশ-বিভূঁইয়ে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো কোন সংগঠন নেই। ফলে তাদের সফ্ট টার্গেট বানাতে সুবিধা। এটি কারণ হিসাবে আনুষঙ্গিক। মূল কারণ শ্রম-সম্পর্কের এক কপট রূপের দিকে নির্দেশ করে। শ্রম-পরিযানের মূল কারণ হল, নিজভূমে কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, দ্বিতীয় কারণ হল, কম মজুরি। কর্মস্থল থেকে বিতাড়িত হয়ে কিংবা দমন-পীড়নের ভয়ে পালিয়ে এসে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঠাঁই হবে নিজভূমেই। নিজভূমে কর্মসংস্থান বিমুখ বাস্তবতায় অনিশ্চিত জীবিকা আঁকড়ে পড়ে না থেকে তারা স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সন্ধানে পা বাড়াতে বাধ্য হবে। ফলে সস্তা শ্রমের বাজার স্ফীত হবে। আর মুনাফা শিকারী পুঁজিপতিকুল সেখানে অনুকম্পার ডালি নিয়ে উপস্থিত হবে।
এই হল উচ্ছিন্ন বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের বিতাড়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি। সস্তা শ্রমের প্রত্যাশী পুঁজিপতিদের এতখানি স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপার; সেখানে তারা কি কেবলই তীর্থের কাক? তা তো হবার নয়। এখানে হিন্দুত্ব ও পুঁজি যৌথ স্বার্থে মিলিত। পুঁজির হিন্দুত্ব না থাকুক, হিন্দুত্বের রঙে রঞ্জিত হতে বাধা নাই। পুঁজি ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ মন্ত্রে দীক্ষিত। হিন্দুত্ব পুঁজির বলে বলিয়ান। তাই পুঁজির পাহারাদার।
বিজেপির বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিক পীড়ন ও বিতাড়ন দিয়ে শুরু করা রাজনীতির লক্ষ্য দূরপ্রসারী। যেখানে তার অভিমুখ একটি জাতির দিকে নিশানা করা, যাতে পুঁজির স্বার্থকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে, তা এমনকি অতি দক্ষিণপন্থী অভিধাতে ব্যাখ্যাত হতে পারে না, তার ব্যাখ্যা একমাত্র ফ্যাসিবাদের অভিধাতেই সম্ভব। ফলে তার বিরোধিতা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার ব্যাপার নয়, স্রেফ জাতি-আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়, এমনকি তাকে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েই সাঙ্গ হবার নয়; বিরোধিতাকে হতে হবে মূর্ত ও সংহত।