পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

হনুমানজী ২.০: উগ্র হিন্দুত্বের নয়া প্রতীক

  • 27 May, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1125 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ নিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের টিশার্ট এবং গাড়িতে আজ রাগী হনুমানের ছবির অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। হনুমানের এই নতুন চেহারার ন্যায্যতা প্রমাণে কোন স্বল্পশ্রুত পুরানের কথা উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে এটা হনুমানের রূদ্ররূপ। ফ্যাসিবাদে চিহ্ন, প্রতীক,মোটিফের ব্যবহার বহু আলোচিত কারণ মানুষকে উগ্র জাতীয়তাবাদে উদীপ্ত করার লক্ষ্যে এই চিহ্নগুলোকে সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়। হনুমানের এই বিবর্তনকে আমাদের সেই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে।

ছবিটা এখন আমাদের চোখে সয়ে গেছে। মোটর গাড়ির পিছনের উইন্ডো স্ক্রিন হোক বা পাড়ার অটো,স্কুটার হোক বা যুবকের টিশার্ট -- রোষকষায়িত  হনুমানের মুখের ছবি আজ সর্বত্র। এই বঙ্গে আমাদের কৈশোরে হনুমান সেভাবে চর্চিত না হলেও হিন্দিভাষীদের সৌজন্যে হনুমানের দেবত্ব,হনুমান চালিশা পাঠ, আমাদের কাছে অজানা কিছু নয়।কিন্তু হনুমানের সে ছবি ছিল মূলত এক সেবকের। সীতারামের প্রতি নিবেদিত প্রাণ,প্রভুভক্তির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। ক্যালেন্ডারের একটা ছবি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে যেখানে হনুমান বুক চিরে তার হৃদয়ে রাম-সীতার যুগল অধিষ্ঠানের ছবি দেখাচ্ছে। সেই হনুমান আজ অতীত। এই রাগী হনুমান আজ উগ্র হিন্দুত্ববাদের এক প্রতীক।সারা দেশ জুড়ে বিগত সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গেরুয়া ফেট্টি পরিহিত যে মানুষেরা জয় শ্রী রাম ধ্বনি দিতে দিতে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার শপথ নিয়েছেন,সেই প্রত্যেকটি মিছিলে আজ এই ছবির অনিবার্য উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। হনুমানের এই নতুন চেহারার ন্যায্যতা প্রমাণে কোন স্বল্পশ্রুত পুরানের কথা উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে এটা হনুমানের রূদ্ররূপ। ফ্যাসিবাদে চিহ্ন, প্রতীক,মোটিফের ব্যবহার বহু আলোচিত কারণ মানুষকে উগ্র জাতীয়তাবাদে উদীপ্ত করার লক্ষ্যে এই চিহ্নগুলোকে সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়। হনুমানের এই বিবর্তনকে আমাদের সেই প্রেক্ষাপটেই বিচার করতে হবে।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে উনত্রিশ বর্ষীয় ম্যাঙ্গালোরের এক গ্রাফিক্স ডিজাইনার করণ আচার্য এই রাগী হনুমানের ছবিটি তৈরি করেন।করণের বয়ান অনুযায়ী তার পাড়ার ক্লাবের সদস্যরা তাঁকে এক ' অন্যরকম ' হনুমানের ছবি আঁকতে আব্দার করেন। এই অন্যরকমটা ঠিক কি ধরনের তা জানা না গেলেও করণ বলেছেন সদস্যদের দাবি ছিল হনুমানের নম্র,শান্ত মুখের বদলে ' a face with an attitude '। করণ প্রথমে মুখটা আঁকেন ও সদস্যরা সেটা এতটাই পছন্দ করেন যে মুখের ছবিটা মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে যায়। করণের এই আপাত নিরীহ আখ্যানের মধ্যে কিন্তু বিষয়টা সীমায়িত থাকে নি। এক্ষেত্রে ম্যাঙ্গালোর শহর ও উগ্র হিন্দুত্বের মধ্যেকার আন্তঃ সম্পর্কটা বোঝা জরুরি। গোবলয়ের বাইরে সংঘের হিন্দুত্ববাদী পরীক্ষার প্রধান গবেষণাগার ছিল দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক,আরও নির্দিষ্ট করে বললে ম্যাঙ্গালোর শহর। ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করার দায়ে যুবক-যুবতীদের শাস্তিদান,টিপু জয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানে বোমা নিক্ষেপ -- এই শহরের বজরং দল সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন একের পর এক ঘৃণ্য নজির তৈরি করেছে। সেই ম্যাঙ্গালোর থেকেই এই লড়াই উদগ্রীব হনুমানের ছবি সংগঠিত উদ্যোগ ছাড়া গোটা দেশে ছড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। একদম প্রথম থেকেই করণের এই ছবিটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা শুরু হয়। ২০১৮ সালে কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন: 'I want to applaud artist Karan Acharya  whose Hanuman portrait has captured the imagination of people across India.This is a laudable achievement and is the power of his talent and imagination. This is the pride of Mangaluru"।শুধু শিল্পীর প্রশংসা করেই নরেন্দ্র মোদি থেমে থাকেন নি। এই ছবিটি যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে,তা বলার কারণে জাতীয় কংগ্রেসকে মোদি তীব্র আক্রমণ করেন,তার মতে এই ছবির সমালোচকদের একদিনও কর্ণাটক শাসন করার অধিকার নেই। এই নতুন হনুমান যে হিন্দুত্ববাদীদের কল্পনাকে পূরণ করতে সমর্থ হয়েছে তা বোঝা যায় হিন্দুত্ববাদী মিডিয়া পোর্টাল ' HinduismNow.org'  এর ব্যাখ্যায়: " his(Achaya's) poster that has became the rage in the last year(2016) across the country is a perfect symbolism of the attitude new hindu carries: no nonsence and ready for action '।

পৌরাণিক আখ্যান অনুযায়ী বায়ু দেবতা পবন ও অপ্সরা অঞ্জনার সন্তান হলেন হনুমান।ইঞ্জিনিয়ার দেবতা বিশ্বকর্মার কন্যার সঙ্গে পবনদেবের আনুষ্ঠানিক বিবাহ হলেও বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে তার একাধিক সন্তান ছিল।সেই হিসাবে অঞ্জনা পুত্র হনুমান ও কুন্তীপুত্র ভীম বৈমাত্রেয় ভাই।পবনপুত্র হওয়ার কারণে হনুমানের উড়বার ক্ষমতা রয়েছে এবং জন্ম থেকে হনুমানের খিদে এত বেশি যে সে জ্বলন্ত সূর্যকে ফল হিসাবে খেতে উদ্যত হয়।তখন ইন্দ্রদেব সূর্যকে রক্ষার জন্য পবনপুত্রের চোয়ালে বাজ দিয়ে আঘাত করে।মনে করা হয় বজ্রাঘাতে হনু অর্থাৎ চোয়াল আহত হওয়ায় তার নাম হনুমান হয়। ছোটবেলা থেকে পিতামাতার সাহচর্য বঞ্চিত হনুমানের বড় হয়ে ওঠা বানরকূলে,অঙ্গদের অভিভাবকত্বে।রাম- সীতার পরম সেবক হনুমানের প্রভুভক্তি এতই প্রবল যে লক্ষ্মণের চিকিৎসার জন্য রামের আদেশে হনুমান গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনেছিল।তুলসীদাসের রামায়ণে হনুমান চিহ্নিত হয়ে আছেন এক শান্ত,মহাবলী,প্রভুভক্ত হিসাবে যিনি ' জ্ঞান, গুন সাগর' (a sea of wisdom and goodness)। পৌরাণিক আখ্যান থেকে প্রাপ্ত এই হনুমানের বিবর্তনের এক ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল হিন্দুত্বের নয়া ফেরিওয়ালাদের কাছে।

 

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক ঘনিষ্ঠদের দ্বারা মহাত্মা গান্ধীর নৃশংস হত্যার পর বেশ কিছুদিন হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের রাজনৈতিক জীবনে কিছুটা একঘরে হয়ে পরেন।পরবর্তীতে তাদের তথাকথিত ' অরাজনৈতিক সেবামূলক কাজ ' এর মাধ্যমে সংঘের গণভিত্তি যেমন প্রসারিত হয় তেমনি দেশের হিন্দু সমাজকে সংঘবদ্ধ করার জন্য তাদের এক রাজনৈতিক আইকনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের যে ইমেজ ( গোবলয়ে সীতারাম কথাটা বেশি প্রচলিত ছিল) ভারতে প্রচলিত ছিল,তার পরিবর্তনেরও প্রয়োজন হয়।আমরা দেখি রাম জন্মভূমি - বাবরি মসজিদ বিতর্কের আবহে এক লড়াকু সামরিক নায়ক হিসাবে রামের উত্থান। রাম যেহেতু ঐতিহাসিক চরিত্র নন,পৌরাণিক চরিত্র তাই নানান ধরণের কল্পিত আখ্যান তৈরি করতে অসুবিধা হয় না। এস পি উদয়কুমার, সোসাল সায়েন্টিস্ট পত্রিকায় "Historicizing Myth and Mythologizing History " শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন : " The controversy is more mythological than historical, and hence it is a matter more of faith than fact.Since the issue stands on popular culture and not on recrded history, it becomes even more prone to manipulation and politicisation "। এই নতুন ন্যারেটিভে শত্রু হন্তারক রামকে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে এক খলনায়কের প্রয়োজন হয়।সংঘ পরিবারের কল্পিত শত্রুর নাম তাই হয় বাবর।মুসলমানদের বাবরের আওলাদ বলে ডাকা আসলে এই ন্যারেটিভের অংশ।এই কার্যক্রমের চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখতে পাই ১৯৯০ সালে সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যায় রাম রথযাত্রায়।ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক আগ্রাসনের সূচনা বিন্দু ছিল লালকৃষ্ম আদবানির নেতৃত্বে এই রথযাত্রা। এই যাত্রার পুরো পথ জুড়ে যে হিংস্রতা ও রণ উন্মাদনা দেখা যায় তা অভূতপূর্ব। আদবানি,মুরলি মনোহর যোশি,বিজয় সিঙ্ঘলদের নেতৃত্বে করসেবকদের বাবরি মসজিদ ধ্বংস আসলে এক বানরসেনাদের সহযোগিতায় রামের যুদ্ধজয়ের প্রতীক,শুধু রাবণের বদলে নতুন খলনায়ক হলেন বাবরের স্মৃতি। এই সময় থেকেই হিন্দুত্বের এক পুরুষালি ইমেজ নির্মাণের ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাই।

হনুমানের এই বিবর্তন কিন্তু  সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মোড়কে এক ফ্যাসিবাদী হিন্দু রাষ্ট্র গঠন প্রকল্পের অংশ। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুনাল পুরোহিত সম্প্রতি প্রকাশিত " H Pop: The secretive world of Hindutva Pop stars" বইতে দেখিয়েছেন কিভাবে কবি সিংহ,কমল আগ্নেয়, সন্দীপ দেও এর মত  নিম্ন মেধার শিল্পীরা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এক নতুন বাস্তুতন্ত্র তৈরি করছেন পুরুষালি মতাদর্শ, ঘৃণার পাটিগণিতের সাহায্যে। ক্ষুধা, বেকারি,অপুষ্টি, চিকিৎসার সংকট-- এদের কাছে সব সমস্যার কারণ একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় আর নিদান হল আরো বেশি সনাতনী ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা। এই বাস্তুতন্ত্রের উপযোগী আয়ুধ হয়ে উঠেছে গেরুয়া কালো প্রেক্ষাপটে রাগ সর্বস্ব  নতুন হনুমান যাকে হনুমানজী ২.০ বলাই সঙ্গত।

0 Comments

Post Comment