এক
পিসে হারিয়ে যাওয়ার পর আপির ব্যক্তিগত জীবন যাপনে খুব একটা বদল কিছু হয়নি। শুনেছে শুধু একটা প্রিয় বস্তু খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল সেই যুবা বয়সে। আমিষ কিছু খায় না, ছুঁয়েও দেখে না। আপির ন্যাওটা ভাইপোর এতে খুব দুঃখ টুঃখ নেই, কারণ সে ছোটোবেলা থেকেই দেখেছে নিরামিষ আপিকে। আপি এমনকি চা দোক্তাও খায় না, সেদ্ধ ভাত খায়। বুঝদার হওয়ার পর পল্লব আপিকে বলেছে,
--- পিসে তো এসব ধর্মীয় অনুশাসন মানত না, ধর্মই মানত না। তাহলে তুমি কেন?
--- বুঝেছি, এবার বল কী খাবি? পটলের দোলমা, কুমড়োর ছক্কা, ফুলকপির সুগন্ধী, ঝিঙে পোস্ত নাকি বাসন্তী পোলাও?
--- পোলাও তো পোলান্ন, মাংসভাত? খাওয়াবে?
--- খাবি খাবি, সে ব্যাবস্থাও হচ্ছে, বউমা এসে রেঁধে খাওয়াবে।
--- পটলের দোলমা খাওয়াবে আপি?
--- খাওয়াব না কেন, আমিরুদ্দিকে বলে দিলেই বিচরা থেকে উঠিয়ে দেবে।
--- চিংড়ির পুর দিয়ে তো?
--- ছানা দিয়ে করে দেব।
--- তাই দিও। আচ্ছা আপি, বলতো তুমি আর কী কী রান্না করতে পার?
--- পারি তো অনেক কিছুই, তবে বেস্ট খাবার হল সবজিসেদ্ধ ভাত আর খাঁটি গাওয়া ঘি।
--- আর পিঠে পুলি?
--- সেও আছে। তুই যা যা ভালবাসিস। সেদ্ধ পিঠে, কুলি পিঠে অন্নদা, রাঙা আলুর পিঠে,পাত পিঠে, পাটিসাপটা, ছাঁচ, চন্দ্রপুল, দুধপুলি, আর আমাদের পূর্ণচন্দ্র মালপোয়া। ঈশ্বর গুপ্ত বলে গেছেন না, ‘এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশ তবু রঙ্গে ভরা’। পৌষ পার্বনে কত কত পিঠে পুলি,
‘আলু তিল গুড় ক্ষীর নারিকেল
আর। গড়িতেছে পিঠে পুলি অশেষ
প্রকার।‘
‘বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ বা কুটম্বের মেলা হায় হায় দেশাচার, ধন্য তোর খেলা।’
---‘তুমি তো খাও না, তবু বানাও?
--- তোর জন্য বানাই। দাদা বউদি আছে না, প্র্যাকটিস না থাকলে তোর বউকে শেখাবো কী করে? আমিও শিখেছি তোর ঠাম্মার কাছ থেকে। চসি মিষ্টান্ন খাবি? নিজের হাতে বানাবো, আমার বাবা উঠোনের রোদে বসে বানাতো।
--- আমার বাবা এসব করে না।
এই করে করে আপি কিশোর ভাইপোর মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। আপি যখন বেশি কথা বলে তখন পল্লব বুঝতে পারে তার উদ্দেশ্য, তাই আর ফিরে যায় না শুরুর কথায়। নিরীহ গোবেচারা বাবার শাসনে থাকতে থাকতে হজম করতে শিখে ফেলেছে পল্লব, তাই এরকম পরিস্থিতিতে সে আপির কাছে হয় রাজনৈতিক। কথা ঘুরিয়ে বলে,
--- তোমরা তো সম্পন্ন চাষী, পিসেদেরও ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। তাও তোমরা সর্বহারার দুখে দুঃখিত হতে গেলে কেন? কেন জান লড়িয়ে দিলে?
--- আমি কিছু লড়াই করিনি রে, কী রক্ষণশীল পরিবার আমাদের, এককালে তো ঠাকুরদার আমলে ছিল কংগ্রেসি সবাই, জোয়াল কাঁধে জোড়া বলদ। তোর ঠাকুরদা তেভাগা আইন করতে লড়াই করেছিল, জমিদারের লেঠেলদের হাতে মারা গেল।
--- শিবু কাকার বাবা ছিল জমিদার?
--- না না জমিদার গ্রামে থাকত না । শহর থেকে আসত সময়ে সময়ে। তোর বাবা তো সব মুছে দিল। রাজনীতির নাম শুনলেই ভয় পায়। আমাকে শাসনে রাখতে শুরু করে তখন থেকে আর রাখে তোকে।
--- তাও তো তুমি বেরিয়ে গেলে?
--- না রে আমি বেরোই নি তেমন, দাদাকে যে মানতাম।
--- আর পিসে?
--- হ্যাঁ মানতাম। আমাকে যে ধানক্ষেতের রূপান্তর দেখাত, হালিচারা থেকে সবুজ গাছ,সবুজ থেকে সোনা, আর সোনার ফসল। বলত, সোনা ফলায় যারা তাদের কেন দুঃখ দুর্দশা। বলত সোনাহরদা মনসুর মিয়া সন্তোষ বিশ্বাস আশরাফ আলি তারিণী দাদির অবস্থা কেন পালটায় না, দুঃখ ঘুচে না একজীবনে।
--- তাই তোমরা?
--- চুপ চুপ, তোর বাবা শুনলে আর রক্ষে নেই।
--- কেন? বাবা কেন পিসের নাম শুনতে চায় না?
--- জানি না।
--- পিসের কোনো ছবিও নেই বাড়িতে কোনোখানে।
--- আছে।
--- কোথায়? দেখাও নি তো!
--- দেখাব।
পল্লব বায়না করে বলেছে,
--- তোমার ওই রেক্সিনের ব্যাগটায় আছে?
--- না।
--- তাহলে? ওটায় কী আছে?
--- আছে।
--- কী?
--- স্মৃতি।
দুই
অরাজনৈতিক পরিবারের ছেলে কথাও বলে কম। আপি তো তবু প্রথম কথার একটা জবাব দেয় কিন্তু পল্লব কোনো কথারই জবাব দেয় না, শুধু মাথা নাড়ে। তবে ওরা পিসি ভাইপোতে খুব কথা বলে। পল্লব তার একমাত্র পিসিকে ডাকে আপি। তাদের পরিবারও খুব বড়ো নয়। বাবা আর আপি দুই ভাই বোন। পল্লবের জন্মের অনেক আগে তার ঠাকুরদা মারা গেছেন। ঠাকুমাও ছিলেন খুব দাপুটে ও স্নেহপ্রবণ, অরাজনৈতিক ফতোয়া তার উপর খাটাতে পারে নি বাবা। একটা রক্তপাতের স্মৃতি আর ঠাকুমার প্রতিশোধ এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে তার স্মৃতিতে। তখন আর কত বয়স হবে তার, দশ এগারো । বিভূতি মালাকারের ছেলে শিবনাথ পাথর ছুঁড়ে মারে বাবাকে, নাকের নীচে গলগল করে রক্ত ছুটছে, ঠাকুমা নাতির দুর্দশায় কান্নাকাটি করেনি, বড়ো একটি পাথর নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছে শিবনাথের মুখে অব্যর্থ। একবছর পর ঠাকুমাও মরে গেল। পল্লবের নতুন অভিভাবক হয়ে গেল আপি।
আপি সরকারি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা। তারা এক বাড়িতেই থাকে। বাবাই বলেছে থাকতে, এমনকি বলেছে ভাইবোনের সমান অধিকার সম্পত্তির। আপি বলেছে, ভালোই তো। বাবা বলেছে পাকাপাকি দলিল করে নেওয়া ভালো। আপি বলেনি কিছু। শিশু পল্লবকে কাছে টেনে নিয়ে মাথা নেড়েছে। বাবা আপির এই মাথা নাড়ার অর্থ সম্মতি ভেবে দলিল করিয়ে দিয়ে দেয় আপিকে।এবার আপি বলে, আমি তো বলিনি।
আপির বরকে দেখেনি পল্লব, শুনেছে পিসি নাকি পল্লবের নাম বিপ্লব রাখতে চেয়েছিল, মা আপির মত ছিল, বাবা পিসের রাজনীতি করা পছন্দ করত না। এখন কেউ নেই বাবা নেই মা নেই শুধু আপি আছে পল্লবের মাথার উপর। পল্লবের ছেলের ছোটো ঠাম্মি হয়ে। পল্লবের জন্মের পর থেকেই পিসেকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। পিসে ঝাণ্ডা নিয়ে মিটিং মিছিল করত, খেত খামারে ঘুরে বেড়াত, বলত গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলবে। পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। সত্তর দশকে, তারপর তো নেই। ভ্যানিস।
তিন
শিবনাথ মালাকার গ্রামের মাতব্বর। প্রভূত ধন সম্পত্তি, সেই সুবাদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বিধানসভা তপশীলি সমষ্টি হয়ে গেলেই নাকি শাসক দলের ক্যান্ডিডেট এমন কানাঘুষো। শিবনাথ কাকুর সঙ্গে পল্লবদের পরিবারের একটা অম্লমধুর সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই। রক্তারক্তির একটা শিশুকাণ্ড ঘটেছিল বাবার বালক বয়সে। যদিও সেসব চুকে বুকে গেছিল শৈশবেই। সম্পন্ন দুই কৃষক পরিবারের ছেলেরা বন্ধুই ছিল, কিন্তু পিসের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল না শিবনাথ কাকার। শিবনাথ মালাকারের বাড়াভাতে ছাই দিয়ে যে বিয়ে করে ফেলল আপিকে। আসলে পল্লবদের বাড়ি গ্রামে নয়, গ্রামে তাদের খেত খামার আছে কিছু। আর বাড়িও খুব দূরে নয়, শহরের শেষ সীমানায় গাছগাছালি পুকুর উঠোন দেবালয় ঘেরা ভদ্রাসন। বাড়ির উপর টিলায় উঠলেই দেখা যায় শর্ষে খেত শীতের শেষে, চৌকোকাটা ধানের বাগান। এসব ধানী জমি চাষ করে গরীব কৃষকরা, বেশির ভাগই ভাগচাষী, সেই জমিদারি আমলের মতো তিন ভাগের এক, অনেক সময় তাও হয় না, আর মহাজনদের ঋণের টাকাও দেওয়া হয় না। জমির মালিক ছোটো কৃষককে দাদন দেয় শিবনাথ মালাকার, সেই অর্থে সার বীজ কেনে। তাই শহর সীমার বাইরে কৃষিজমির মালিকরা মান্য করে শিবনাথ কাকা কে। গরীব চাষার ভগবান হয়ে তাদের পাশে থাকে। গ্রামের মানুষ ধন্য ধন্য করে, তবে ভয়ে না শ্রদ্ধায় সে তথ্য কৃষকের মুখ দেখে বুঝতে হয়। এই করে করে অনেক কৃষিজমিরও মালিক শিবনাথ মালাকার। পিসে নাকি শিবনাথ কাকাকে বলত জোতদার, শ্বশুর মৃত্যুর জন্য তাদের পরিবারকেই দায়ী করত, শিবনাথ কাকাকে শুনিয়ে শুনি সুকান্তর কবিতা বলত,
‘শোনরে মালিক, শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের হাড়
হিসাব কি দিবি তার?
...
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই
শোনরে মজুতদার
ফসল ফলানো মাটিতে রোপণ
করব তোকে এবার।’
তখন যে জোতদার মজুতদারের মুণ্ড চাই পার্টি করত পিসে, পিসেরই মুণ্ডটা চলে গেল। যদিও ধড়মুণ্ড কিছুই পাওয়া যায় নি।
পিসে উধাও হওয়ার পর, শিবুকাকা আপিকে অনেক রকম সাহায্য করতে চেয়েছে, বিয়েও করতে চেয়েছে। আপি সাহায্য চায় নি, পল্লবের ঠাকুরদার ধন সম্পত্তি কম কিছু নয়। তার উপর বাবাও চাকরি করে আপিও করে। এর মধ্যে আপি দিদিমনির মাথায় পোকা নড়াচড়া করে, গ্রামের ছেলে মেয়েদের বিনা বেতনে পড়িয়ে শিক্ষিত করে তুলবে। বাবার তো সব কিছুতেই ভয়, সব কিছুতে সিঁদুরে মেঘ। ছোটোবোনকে বলে,
--- কী দরকার এসব করে, বরং স্কুলে অ্যাক্সট্রা ক্লাস করে দিস দুটো।
আপি কোনো বাদানুবাদে যায় না কখনও, শুধু শুরুতে একবার প্রতিবাদ দেয় মৃদু। বলে,
--- কেন? কী হবে দাদা?
--- হবে। হতে পারে অনেক কিছুই। দিদিমণির মাস্টারি করতে করতে পঞ্চায়েতি করার ইচ্ছে হতে পারে।
আপি এবার মাথা নেড়েছিল তীব্রভাবে। ছোটো বোনটা তো আদরের তাই বড়ো ভাই হেরে যায়। বলে,
--- কর তোর যা ইচ্ছে।
আপি দিদিমনির মিনি মাগনার স্কুলের খুব সুনাম হয়। আপি ছাত্রদের মুড়ি বাতাসা বাদাম ভাজা খেতে দেয়, চকোলেটও দেয় জন্মদিনে। শিবনাথ মালাকারেরও খুব পছন্দ হয় আপির পাঠশালা, আপিকে বলে ওদের দলে যোগ দিতে। আপি বলে ওদের পরিবার অরাজনৈতিক। শিবনাথ কাকা বলে সে তো ভিন্ন পরিবার। আপি আবার মাথা নাড়ে। শিবনাথ কাকা পল্লবের বাবাকে বলে বোনের বিয়ে দিয়ে দিতে। বলে এসব চাষা ভুষোর বাচ্চা পড়িয়ে কী হবে। ততদিনে বাবাও মাথা নেড়ে জবাব দেওয়া শিখে নিয়েছে। হুঁ বলে সে যাত্রা চলে যায় শিবনাথ মালাকার। বাবা খুব ভয় পায়, বিপ্লবী পিসের বিধবা স্ত্রীকে স্কুল বন্ধ করতে রাজি করায় শাসনের অস্ত্রে।
চার
স্কুল বন্ধ হয়ে গেলেও বাবার আশঙ্কা সত্যে পরিণত হয়। আপি খুব জনপ্রিয় হয়ে যায় আশেপাশের গ্রামগুলিতে। গরীব মানুষরা জেনে গেছে তাদের আল্লা ভগবানকে বিপত্তারণ। পড়ুয়াদের আনাগোনা বন্ধ হলেও তাদের মা বাপের ভেট দিয়ে যাওয়া বন্ধ হয় না, নিজের খেত থেকে উঠিয়ে আনা উরি বাইঙ্গন ঢেড়েশ কয়ফল ভুবি লুকলুকি সফরি কলাটা মুলোটা নিয়ে হাজির হয়। আপি এসব নেয়, টাকার মূল্যে চুকিয়েও দেয় শস্যঋণ। সাহস পেয়ে অনেকে আবার সরাসরি টাকা চায়। আপি দেয় না, বলে তার কাছে দেওয়ার মতো টাকা নেই। আপির এরকম মুখের উপর কড়া কথা বলতে আটকায় না। তাও জেনে নেয় কেন লাগবে টাকা, কেউ বলে বীজধান কিনবে কেউ বলে সার কেউ কীটনাশক কেউ বলল লাঙল কিনবে তো কেউ হালের বলদ। দয়ার শরীর আপি বীজ সারটার কিনে দেয়, একটা মেশিনের ঠেলা দেওয়া লাঙলও কিনে দেয়। বলে, সবার কাজে লাগবে। ফলত শিবনাথ মালাকার বেজায় চটে, তেজারতি ব্যবসায় সাময়িক ভাটা পড়ে। তাতে শিবনাথের কাকার কিছু হয় না, কিন্তু আপির উপর সঞ্চিত রাগ আরও বাড়ে। আসলে মালাকার মহাজন এমনিতে হাসি খুশি মানুষ, খাতকদের কাছে তার খুব নাম ডাক, ভালো মানুষের পরিচিতি। কিন্তু রাগলে পরে সবার যা হয় শিবনাথ মালাকারেরও হয়, রাগেই। তবে যতই রাগুক আপির প্রতি তো একটা দুর্বলতা আছে, তাই সরাসরি আপিকে কিছু বলে না। পল্লবের বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে থ্রেটেনিং দেয়। বাবা তো একটু ভিতু মানুষ, অরাজনৈতিক ভোটার, চাপ নিতে পারে না, একটু তাড়াতাড়ি চলে যায়। ভবের কারবার সাঙ্গ করে চলে যায়। পল্লবের বাড়িতে এখন দুই থেকে তিন কর্তা হয়, মা আপি ও পল্লবের বউ তার অরাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি করে। বাবা কিন্তু যাওয়ার আগে নাতি মুখও দেখে যায়। নাতির নামে ব্যাপারে আর কোনো অমত করে নি, বিপ্লবই রাখা হয় নাম এক প্রজন্ম পরে।
পাঁচ
ভিতুর ডিম পল্লব এখনও তেমনি আছে তার বাবার মতো। সেও রাজনীতির কথা কারবার পছন্দ করে না। আর প্রতাপী মানুষজন কিছু বললে মন দিয়ে শোনে, প্রতিকার করে। শিবনাথ মালাকার যখন তার ছেলে বিপ্লবের চাল চলন নিয়ে বলে তখনও সে মাথা নুইয়ে থাকে, শিবনাথ যখন বলে বিপ্লবের পাল্লায় পড়ে তার ছেলেটাও উচ্ছন্নে যাচ্ছে, তখন সে মাথা উঁচু করে তাকায়, তার নীরব প্রতিবাদ। বিপ্লবের মা ঠাকুমা আর আপি দিদার প্রশ্রয়ে যে গোল্লায় যাচ্ছে ছেলে সে বুঝতে পারে সম্যক আবার শিবনাথের মতো মানুষ যখন নালিশ জানায় তখন সে কথাও মেনে নিতে পারে না।
কানাঘুষায় অনেকদিন থেকেই শুনেছে বিপ্লব ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। বাল্য বন্ধু জগদ্রাম আর সে কলেজের ভিপি আর জিএস। জগদ্রাম আর বিপ্লব শুধু বক্তৃতাই করে না গানটানও তো গায়। আপির ঘরে মহড়া দেয় গানের আর যে সে গান নয়, পুরনো দিনের ধানের গান,
‘হাওয়া চলে সরসর
লাল ঝাণ্ডা উড়ে ফরফর
চলু কিষান চলু মজদুর
নিকালিনা যাব কিরে
লড়াইকে ময়দান।
কিংবা,
‘ওরে জমিদারের চর আইস্যাছে কাড়াইয়া নিতে ধান
ছাড়ইবনা ভাই ঘরের লক্ষ্মী
দ্যাহে থাকতে প্রাণ...
এ ধান দিমু না
এ লক্ষ্মী ছাড়মু না
দ্যাহে থাকতে প্রাণ।‘
সবার শেষে সভা কাঁপিয়ে সুর তুলত,
‘হেই সামালো হেই সামালো
হেই সামালো ধান হো
কাস্তেটা দাও শান হো
জান কবুল আর মান কবুল
আর দেবো না আর দেবো না
রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো’
পল্লব অবাক হয়ে ভাবে জগদ্রামের কথা, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। আপির আস্কারায় বিপ্লবও পল্লবকে পাত্তাই দেয় না, নিষেধ মানে না, সরাসরি কৃষকদের নিয়ে সভাসমিতি করে, জগদ্রাম যদিও কিছুটা কৌশল করে, বাপকে বলে ওদের সঙ্গে থেকে অদের গতিবিধি দেখছে। আপি দিল্লীর অবস্থানরত কৃষকদের জন্য অর্থ সাহায্যও পাঠিয়েছে। পল্লব সিংঘু বর্ডারের অবস্থানরত কৃষকদের জল আলো বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষুণ্ণ হয়েছে ঠিকই কিন্তু সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। রাজনীতি কারবারি নয় সে। সে আপিকে তার অপছন্দের কথাও জানিয়ে দেয়। বলে,
---ভালো হচ্ছে না আপি, তুমি দিচ্ছ দাও, বিপ্লবকে কেন উস্কে দিচ্ছ। রাজরোষে পড়লে কে রক্ষা করবে বল?
--- সেও তো চাষার ছেলে, কৃষকের খেতের ফসল লুট করার চক্রান্ত হলে সে প্রতিবাদ করবে না?
--- করুক, কিন্তু এদেশে রাজ রোষ বড়ো সাংঘাতিক, তার উপর বাঙালি হলে হলে তো রক্ষে নেই, দেশ থেকেই তাড়িয়ে দেবে। এনআরসি, এনপিআর কা থেকে কে রক্ষা করবে? এখন কৃষক দরদি আর দেশদ্রোহী সমার্থক।
আপি এখন আর মাথা নাড়ায় না প্রথম সংলাপের পর। দাদার মুখের উপর বলে,
--- জগদ্রামের বাবাও তো বুঝতে পারছে দাদা। তার ছেলে যে গ্রামে গ্রামে কৃষক খেপিয়ে বেড়াচ্ছে, কৌটো নাড়িয়ে চাঁদা সংগ্রহ করেছে বিপ্লবের সঙ্গে, বলেছে তার বাপ এক লাখ টাকা দেবে, এসব কিছুই কি শিবনাথদার অমতে হচ্ছে।
--- অমতেই তো, আমার কাছে নালিশ করেছে বিপ্লবের নামে।
--- সে কি জানে না তার ছেলে যে দিল্লী যাবে? ইউপি সীমান্ত হরিয়ানা সীমান্তে যাবে গানের দল নিয়ে।
--- আর বিপ্লব?
--- বিপ্লবও যাবে।
--- আপি, বিপ্লব আমার একমাত্র সন্তান।
--- ওরা মিছিল করে যাবে। বলেছে প্লেনে যাবে না। ট্রেনে বাসে অনেকটা হেঁটে যাবে। গ্রামে গ্রামে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতে করতে যাবে। আপি যে থামতেই চাইছে না, বলেই যাচ্ছে ভ্রমণ সূচি। পল্লব এবার আপির মতো মাথা নাড়ে এক এক জায়গায় যেখানে যেখানে ওদের যাত্রাবিরতি।
ছয়
আপির কোনো সন্তানাদি নেই। বড়ো ভাই যখন সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়ার কথা বলে তখন আপি শুধু মাথা নাড়ে। দাদাও বলেছিল সে মাথা নেড়েছিল, মানে রাজি হয়েছিল। সে নাকি হেসেও ছিল। এরপর পল্লবও যখন তার সন্তান নিয়ে আপির সঙ্গে কথা বলল, তখনও আপি হেসেছিল। না হেসে তখন আপির কীইবা করণীয় ছিল। বাপবেটা দুজনেই যে তাকে বুঝতে পারে নি। আপি জমিবাড়ি সম্পত্তি তো চায়নি। বাপের বাড়ি থেকে গেছিল ভাইপোটির টানে। আর বিপ্লব, বিপ্লবকেও যে কেন পল্লব আলাদা করে দিল তার একমাত্র সন্তান বলে। বিপ্লব কি তাহলে তার কেউ নয়। তখনও যেমন দাদার করা দলিল টলিল নেয় নি, এবারও তাই স্নেহের পরশে বিপ্লব থামিয়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না আপির। বিপ্লব আর জগদ্রামের দিল্লী যাওয়ার প্রস্তুতি যখন তুঙ্গে তখন আপি নিরুৎসাহ হয়ে উপায় খুঁজে ওদের আটকে দেওয়ার।
এর মধ্যে পল্লব আপির কাছে এক অভিনব আব্দার নিয়ে উপস্থিত হয়। বলে,
--- তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে আপি?
সত্তরোর্ধ আপি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে ভাইপোকে। বলে, তুইও যাবি? তুই তো অরাজনৈতিক বাপের ছেলে?
--- তোমারও তো ভাইপো আপি।
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েও খুঁত খুঁত করে বলে,
--- যাব যে, খাব কী?
--- চাল ডাল আলু, সেদ্ধ ভাত। হাঁড়ি একটা নিয়ে নেবে।
--- সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু তুই আর নাতি দুটো? ওরা তো মাছ মাংস খায়।
--- পিকনিকে যাচ্ছ নাকি? তুমি যা খাবে তাই।
--- তাহলে তো ভালোই হয়। আমার একটা কল আছে, দেখবি? সেদিন সিংঘু বর্ডারে দেখলাম সর্দারজিদের এক আশ্চর্য রান্নার মেশিন, এক ট্রাক গাড়িতে জল গরম করে, জলের ভাপে দশ হাজার মানুষে ডাল ভাত সবজি রান্না হচ্ছে, মাত্র এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমার যেটা আছে সেটায় লাগে দুঘণ্টা।
--- প্রেশার কুকার নাকি?
--- না রে। পুরির জগন্নাথ মন্দিরে যেমন ভোগ রান্না হয়, নীচে লাকড়ির আগুণ আর উপরে পরপর কুড়িখানা হাড়ি, উপরেরটায় রান্না হয় প্রথম। আমারটাও ওরকম। তুই প্রশ্ন করেছিলি নিরামিষ খাই কেন? তোর পিসে যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরত, ওর সঙ্গে থাকত ওই রেক্সিনের ব্যাগ। সকালে উঠেই এক কৌটোয় চাল ডাল সবজি বসিয়ে দিত, নীচে এক ছোটো উনুন কাঠকয়লার। কোনো বাঁধাধরা সময় নেই, যখনই পেট মেশিনের ডাক পড়ত নামিয়ে খেয়ে নিত গরম গরম। পুলিশ সব কিছু নিয়ে গেছে, এই ব্যাগটাই শুধু নেয় নি। তুই বলেছিলি ভিতরে কী আছে, বলেছিলাম স্মৃতি, এবার কাজে লেগে যাবে স্মৃতি। এক বস্তা কাঠকয়লা আর এক বয়াম ঘিও নিয়ে নেব সঙ্গে।
শালচাপড়া কালিনগর কাতিরাইল কাটিগড়া কালাইন ডুমকর গুমরা গোবিন্দকূপা মিকির পুঞ্জি দামছড়ায় কৃষকসভা হয়, অনেকেই যেতে চায়। সবাইকে তো আর নেওয়া যায় না, দুই দুগুণে চার থেকে দিল্লীগামী সদস্য সংখ্যা হয় কুড়ি। বিপ্লব বলে এবার এর বেশি হবে না। রাতাছড়া থেকে বাসে করে গুয়াহাটি। গুয়াহাটি থেকে রেলগাড়ি। আপির আশ্চর্য মেশিনের খোপে শুধু ভাত, খাওয়া হতো কুড়িজনে হই হই করে। জগদ্রামের ঘি লঙ্কার ভাঁড়ার শেষ হয় দিল্লী সীমান্তে এসে। আপির আনন্দবাজারে খেয়ে জগদ্রামের খুব আনন্দ, নাম দিয়েছে কৃষিজীবী ক্যানটিন। বিপ্লব বলে আপি দিদার ভাতের হাঁড়ি।
দেশের সীমায় হয় বর্ডার, আপি দেশের ভিতর সীমান্ত দেখে রাগে, আবার আন্দোলনরত হাজার হাজার মানুষের উৎসাহ দেখে উদ্বেলিতও হয়। পঞ্চাশ বছর পর আবার পূর্ণ উদ্যমে দেয় স্লোগান, ইনকিলাব।
*****