আমরা যাঁরা ঘড়ির কাঁটার উল্টো ও সোজা, দুটো দিকই সমান জরুরি মনে করেছিলাম, যাঁরা প্রবল হাওয়ার মধ্যেও সিগারেট ধরিয়েছি, যাঁরা শ্লোগান দিয়েছিলাম, মেয়েদের পোষাকে পকেট থাকুক, তাঁরাই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র কাছাকাছি এসেছি। সে এক অন্য কলকাতা। তখন চায়ের দোকানগুলি আমাদের কাছে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়! গড়িয়া থেকে বরাহনগর পর্যন্ত চায়ের দোকান। সকাল থেকে দুপুর, বিপুল আড্ডা সেই চায়ের দোকানে। সেখানেই খবর আসতো, কারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছেন। আজ আর সেই চায়ের দোকান নেই, পাল্টে যাওয়া কলকাতায় আমরা এখন মিসফিট। শপিংমলের কলকাতায়, কফিশপের কলকাতায়, ডিজিটাল কলকাতায় আমরা হারিয়ে গেছি।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সেই সময়ের প্রতিবিম্ব। তাঁদের গানে গানে কলকাতা হয়ে উঠেছিল লিভারপুল। আমরা আবিষ্কার করেছিলাম আরেকরকম বিটলসদের। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র বিপুল তৎপরতায়। কলকাতার মধ্যে জেগে উঠেছিল, অন্য এক কলকাতা। এই গানের দলেই ছিল তাপস দাস, আমরা বাপি নামেই ডাকতাম।
আমি বাপিকে প্রথম দেখি গৌতমদার বাড়িতে, নাকতলায়। ওঁকে দেখলে মনে হতো, ‘পথের পাঁচালি’র অপু। কখনো মনে হতো ‘শেষের কবিতা’র অমিত। কেন মনে হতো জানি না, কিন্তু মনে হতো। পাকা গমের মতো গায়ের রঙ। চোখ যেন শীতের রোদ্দুর। স্বর্গ থেকে আগত দেবদূত যেন। গৌতম চট্টোপাধ্যায়, অর্থাৎ মণিদা ছিলেন বাপির মেন্টর। অভিভাবক ও বন্ধু। এই ভাবেই বাপির হয়ে ওঠা।
বাপির সুরেলা কন্ঠে গৌতম চট্টোপাধ্যায় দানা দিলেন। গানের লজিক এসেছে প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে। সেই অর্থে বাপি, প্রশিক্ষিত শিল্পী। আমার মনে হয়, বাপির কন্ঠে শ্রেষ্ঠ গান ঃ যখন দেখি ওঁরা কাজ করে মাঠে প্রান্তরে--- ফসল ফলায় ঘাম ঝরায়…। এই গানের আগের স্তবক অন্যরকম। কাশবন ভালোলাগে। ভালোলাগে রবিশঙ্কর শুনতে--- দান্তের কবিতাও ভালোলাগে, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের কথা মনে পড়লে, সব নান্দনিক সৌন্দর্য অকস্মাৎ হারিয়ে যায়। এখানেই গান বার্তাবাহক হয়ে ওঠে। মহীনের গানগুলি, বার্তাবাহক নাগরিক এবং সর্ব অর্থেই আধুনিক।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ রাজনৈতিক মেধা ও মনস্বিতায় সমৃদ্ধ গানের স্কোয়াড। যদিও প্রথাগত ও চির পরিচিত রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা ছিল না সেই গানে, তাও তাঁরা নতুন ভাষ্য নির্মাণ করেছিলেন। বিনির্মাণও ছিল, বয়ানের মধ্যে অন্তর্বয়ান ছিল, প্রতিটি গানের কথায়। এইভাবেই সময় ছাড়িয়ে অন্য ও অনন্য হয়ে উঠেছিল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। বাপি যাত্রাপথের যাত্রী। কৈশোর থেকে যৌবন পর্যন্ত ছিল গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু।
আজ যেন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। চারিদিকে অন্ধকার। ঠিক এই মূহুর্তে বাপি অর্থাৎ তাপস চলে গেল না ফেরার দেশে। বাপির কথাতেই বলতে ইচ্ছে করছে--- কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা, এ কেমন কথা, হায় কি ব্যথা। বলতে ইচ্ছে করছে, বাপি, তুমি ঘুমিয়ে থাকো, আমরা জেগে থাকবো তোমার পাশে।