এরাজ্যে এতদিন বাম আন্দোলনের বড়কর্তা ছিল সিপিএম। কিন্তু নির্বিকল্প ভীমরতির কারণে তারা দুর্দশার চরম সীমানায় এসে পৌঁছেছে। ভোটের ফলে আকস্মিক 'শক'-এ কয়েকটা দিন হতবুদ্ধি ভাবটা থাকলেও পরে তা কেটে গিয়ে এখন আবার যথারীতি সেই চেনা ফর্মে ফিরে এসেছে। ভাবখানা যেন, ভোটে তো হার জিত আছেই, সুতরাং এ আর এমন কী? 'হারা' বিষয়টিকে এরা এমনই আত্মস্থ করে ফেলেছে যে এমন নজিরবিহীন হারেও এদের বিশেষ হেলদোল নেই। দলে আলোচনা হল, হারের নানাবিধ কারণ নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করলেন, কিন্তু ওই পর্যন্তই। ভোটের নীতি বা কৌশলে যে বড় ভুল ছিল, সেকথা খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হল কি? রাজ্যদলের তিন মাথা বিমান, সূর্য ও সেলিম বহাল তবিয়তেই নেতৃত্বে আসীন রইলেন, ভুলের কোনও মাশুল দেবার বালাই নেই। এরা যেন সেই অতীত ইউরোপের খ্রিস্টধর্মীয় যাজকদের মতো, একবার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হলেই বাকি জীবন আসন পাকা। মমতা একদা বলেছিলেন, ওনারা দেহত্যাগের আগে পদত্যাগ করেন না। এটা যে কতখানি সত্যকথন ছিল, তা কিন্তু আগে এভাবে বোঝা যায়নি।
সিপিএমের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও পরিণামের কারণে বাম আন্দোলনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। ফলে বামমনস্ক মানুষ হতাশ হলেও বিকল্প বাম নেতৃত্বের সন্ধান চলবেই। কারণ, সিপিএম যে ভবিষ্যতে শোধরাতে পারে, এমন আশাবাদীর সংখ্যাটাও প্রায় শূন্য। সিপিএম নেতৃত্ব বামশক্তির ঠিকাদারিতেই অভ্যস্ত, যৌথ নেতৃত্বের ভাগিদারিতে নয়। ফলে অবশ্যম্ভাবী রূপে নতুন কোনও নেতৃত্বের উঠে আসার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল। বামমনস্ক মানুষ চায়, বামেরা তাদের শক্তিকে সংহত করুক, ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়ুক, অতঃপর প্রয়োজনে ভিন্ন কোনও শক্তির সঙ্গে কোনরকম সমঝোতা করা জরুরি কিনা, ভাববে। কিন্তু সিপিএম এখন সার্বিক বাম ঐক্যে বিশ্বাসী বা আগ্রহী নয়, শর্টকাট পন্থায় বিশ্বাসী এবং তারই প্রতিফলন আমরা দেখছি পরপর ভোটের নীতি ও কৌশলে। কিন্তু বামমনস্ক মানুষ তো আজীবন সিপিএমের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকবেনা, বাধ্য হয়েই বিকল্পের সন্ধান করবে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটে জেতা জরুরি। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন জনসমাজে প্রভাব বৃদ্ধি। আর সে জন্য প্রয়োজন সংগঠন। সংগঠন গড়তে চাই লড়াই আন্দোলন এবং প্রয়োজনে সমমনোভাবাপন্ন সংঘঠনের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক জোট বাঁধা। ভারতবর্ষে সংসদীয় গণতন্ত্রের শেকড় অতি গভীরে। মানুষ তার ভোটাধিকারকে এক অতি পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে শুধু নয়, সরকার নির্বাচনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে যথেষ্ট গর্ববোধও করে। সুতরাং লড়াই সংগ্রামের পাশাপাশি ভোটের লড়াইও ফেলনা নয়। তবে ভোটে সুফল পেতে হলে সারা বছর ধরে লড়াই চালাতে হবে মানুষের স্বার্থে, তাদের দাবিদাওয়ার লড়াইকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করে। সফল আন্দোলনের মাধ্যমেই সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে, সবপক্ষের সমীহ আদায়ে সক্ষম হয়। ভোট থেকে লড়াই আন্দোলন, সর্বত্রই সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম।
Like our Facebook Page
সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির সমাবেশের লক্ষ্যে এক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তোলা জরুরি, সেখানে কোনও একক দলের মৌরসিপাট্টা কাম্য নয়। এধরণের মঞ্চ সফল হয় সঠিক ও দ্রুত কোনও সামাজিক বিষয়কে সামনে রেখে প্রতিবাদে বা দাবি আদায়ে পথে নামার মধ্য দিয়ে। সারা বছর ধরে সামাজিক নানা জরুরি বিষয়কে সামনে রেখে পথে নামতে পারলে জনসমাজে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এভাবেই মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হলে সংগঠন বৃদ্ধি হবে। প্রভাব বাড়বে বৃহত্তর জনসমাজে নেতৃত্বের গুণে ও সঠিক আচরণে। যে কোনও সফল আন্দোলনের পিছনে নেতৃত্বের ভুমিকাটিও জরুরি। নেতৃত্বের জন আকর্ষণী ক্ষমতার উপর আন্দোলনের সফলতাও অনেকখানি নির্ভরশীল।
নির্বাচনকালে পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এই সিদ্ধান্তে ভুলচুক হলে দলের সঙ্গে দেশেরও চরম ক্ষতি হবার সম্ভাবনা প্রবল। এই নির্বাচনের পূর্বে অমর্ত্য সেন সহ বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞজনেরা এবং অন্য কিছু বামদলের গুরুত্বপূর্ন নেতারা বারংবার সিপিএম নেতৃত্বের কাছে আবেদন করেছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মমতা নয়, বিজেপিকেই প্রধান শত্রুরূপে গণ্য করা উচিত। কিন্তু সিপিএমের কর্তা এবং বৃহদাংশের কর্মীরা সেকথায় কর্ণপাতই করেননি। তাদের মন তখন মশগুল ছিল বিজেপির হাতে মমতা নিধনের সুখস্বপ্নে। সিপিএমের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভুল ও তার পরিণাম সব দলের কাছেই অবশ্য শিক্ষণীয়।
ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, কোন শুন্য স্থানই অপূর্ন থাকে না। ফলে বিকল্প বাম সন্ধান হয়তো আগামীদিনে দিশা পাবে কোন পরিচিত উজ্জ্বল নেতৃত্বের হাত ধরেই যার সফলতা এরাজ্যে সেভাবে না হলেও পার্শ্ববর্তী রাজ্যে যথেষ্ট সফল ও সম্ভ্রম আদায়ে সক্ষম হয়েছে। রাজ্যের বামমনস্ক মানুষ তাই যথেষ্ট আশাবাদী।
0 Comments
Post Comment