[এক]
বাংলা গানের এক অন্যতম বিস্ময়কর তথা বৈপ্লবিক গীতিকার ও সুরকার হলেন সলিল চৌধুরী। সলিল চৌধুরীর গানের কম্পোজিশন সম্পর্কে যা-ই আলোচনা করা হোক না কেন, তা সম্পূর্ণ হবে না। কারণ, সলিল চৌধুরী সঙ্গীতের প্রকাশভঙ্গির কাঠামোর মধ্যেই এক বৈচিত্র্যময় এবং বহুমুখী পরিবর্তন সাধিত করেছিলেন।
ভারতের আধুনিক গানের জগতে তাঁর স্থান ধ্রুবতারার মত। অন্তত পাঁচ দশক ধরে তিনি বাংলা আর হিন্দি গানের জগতে গীত রচনা, সুর সংযোজন এবং সঙ্গীত পরিচালনার ক্ষেত্রে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসাবে কাজ করে গিয়েছেন। আর বাংলা গানের ক্ষেত্রে বলা যায় তিনি এক অনবদ্য বিপ্লব ঘটিয়েছেন। একথা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে সঙ্গীতের সমস্ত ক্ষেত্রে এমন একটা শূন্যস্থান তিনি রেখে গেছেন, যা আজ পর্যন্ত কেউ ভরাট করে তুলতে পারেননি। তাই তাঁর মৃত্যুর তিন দশক পরেও কি সিনেমার গান কি গণসঙ্গীত, যা নিয়ে কিছু আলোচনা করতে যাই, “সলিল চৌধুরী” এই নামটি ঘুরে ঘুরে উঠে আসে। কেন, তাই নিয়েই আজকের এই সংক্ষিপ্ত সালতামামি।
তাঁর জন্ম ১৯২৩ (মতান্তরে ১৯২২ বা ১৯২৫) সালের ১৯শে নভেম্বর বর্তমান দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার গাজীপুর গ্রামে (যা এখন রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার অন্তর্গত)। অনেকের মতে, তিনি জন্মগ্রহণ করেন কোদালিয়ায় অবস্থিত তাঁর মাতুলালয়ে। এই কোদালিয়া, হরিনাভি এবং চাংড়িপোতা (যা বর্তমানে সুভাষগ্রাম নামে পরিচিত) অঞ্চলেই তিনি বড় হয়েছেন, লেখাপড়া করেছেন। কার্যত কোদালিয়া হরিনাভিই তাঁর পিত্রালয়। তাঁর পিতার নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ, মাতার নাম বিভাবতী। সলিল চৌধুরীর তিন ভাই ও চার বোন ছিল। ভাইদের নাম সুনীল, সমীর, সুহাস; আর বোনেদের নাম লিলি, হাসি, কাজল ও মিন্টু। তাঁর পিতা পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং কর্মজীবনের একটা বড় অংশ আসামের একটি চা বাগানে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পিতা চা বাগানের কুলি এবং স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের সাথে নাটক মঞ্চস্থ করতেন আর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত করতেন। সলিলের শৈশব ও বাল্যকালের একটা অংশ পিতার কর্মস্থলে কেটেছে। সেখানে তাঁর পিতা জ্ঞানেন্দ্রনাথ এবং তাঁর আইরিশ সহকর্মী বন্ধু ডক্টর ম্যালোনির সংগ্রহে থাকা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় লোকসঙ্গীতের রেকর্ড শুনতেন। পিয়ানো, এস্রাজ আর বাঁশিতে সেখানেই তাঁর হাতেখড়ি হয়। তার পরে তাঁর পিতা বাংলায় ফিরে এলে সলিলের পড়াশুনা আরম্ভ হয় তাঁর মাতুলালয়ের সন্নিকটে অবস্থিত হরিনাভি দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ অ্যাংলো সংস্কৃত হাই স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি ১৯৩৮ সালে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে এন্ট্রান্স পাস করেন। এই স্কুলটি মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মাতামহ দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের দ্বারা ১৮৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এম. এন. রায় স্বয়ং এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এর পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আই. এ. পাস করেন এবং সেখান থেকে স্নাতক হয়েছিলেন।
কলেজে পড়ার সময়েই তিনি মার্ক্সবাদীদের সান্নিধ্যে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট ১৯৪৩ সালে বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়ে সলিল চৌধুরী অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপ-সংলগ্ন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সেখানে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, সেগুলোই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিল তাঁর অনেক কালজয়ী সংগ্রামী গানের ভিত্তি।
[দুই]
১৯৪৩ সালে মুম্বাইতে গঠিত হয় প্রগতিশীল নাট্য ও সঙ্গীত শিল্পীদের সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ বা IPTA (Indian Peoples' Theater Association)। সারা ভারতের একগুচ্ছ প্রসিদ্ধ নাট্যকার সাহিত্যিক সঙ্গীত শিল্পী অভিনেতা এই একটি মঞ্চে সমবেত হয়ে নিজেদের শৈল্পিক ক্ষমতা প্রদর্শনের আয়োজন করতে থাকেন। ১৯৪৪ সালেই বাংলায় গণনাট্য সঙ্ঘের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন সলিল চৌধুরী। এই সময়ে গণসঙ্গীতের মাধ্যমে একজন দক্ষ গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন “বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা”, “হেই সামালো ধান হো”, “ও মোদের দেশবাসী রে” এবং “ও আলোর পথযাত্রী”-র মতো কয়েকটি বিশিষ্ট গণসঙ্গীতের মাধ্যমে। সেদিন থেকে শুরু করে আজ অবধি এই গানগুলির জনপ্রিয়তা বাংলার সঙ্গীতপ্রিয় শোতাদের কাছে এতটুকু ক্ষুণ্ণ হয়নি। ভারত স্বাধীন হওয়ার কিছু দিন পরে, ১৯৪৮ সালে তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দেবার ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে যায়। অন্য অনেকের সঙ্গে সলিল চৌধুরীও দীর্ঘদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোষণা ছেড়ে সংসদীয় রাজনীতিতে যুক্ত হলে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তখন তিনি আবার সঙ্গীত জগতে ফিরে আসেন “গাঁয়ের বধূ” গানের হাত ধরে। প্রথমত, এই গান সলিল চৌধুরীকে আপামর বাঙালীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল; দ্বিতীয়ত, এই গানের হাত ধরেই তৈরি হয়ে গেল সলিল চৌধুরী এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘস্থায়ী জুটি (যে জুটি বাঙালীকে দুই দশকের বেশি সময় ধরে উপহার দিয়ে গেছে “অবাক পৃথিবী”, “বিদ্রোহ আজ”, “রানার”, “পালকির গান”, “ঠিকানা”, “মনের জানালা ধরে”, “শোনো কোনো একদিন”, “পথে এবার নামো সাথী”, “দুরন্ত ঘুর্ণীর এই লেগেছে পাক” বা “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা”-র মতো কালজয়ী গান); তৃতীয়ত, এই গানের মধ্যে থেকে সলিল চৌধুরীর সাঙ্গীতিক শৈলীতেও পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেল। এর পর থেকেই সলিল চৌধুরীর গানের মধ্যে ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকল রেনেসাঁ-উত্তরকালের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের হার্মোনি, কাউন্টারপয়েন্ট, ট্রান্সপোজ়িশন, ক্রোম্যাটিক প্রোগ্রেশন বা অ্যাটোনাল অর্কেস্ট্রেশনের মতো বৈশিষ্ট্যসমূহ। উনি সাধারণত কখনও একটা গান পুরোপুরি শেষ করতেন না। অর্ধেক করে রেখে দিয়ে অন্য গানে চলে যেতেন বা কবিতা লিখতে বসে যেতেন। যখন রেকর্ডিংয়ের জন্য শিল্পী গানটা শিখতে আসতেন, তখন বাকি গানটা লিখে দিতেন।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, গানের স্কেলের টোনালিটি নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সলিল চৌধুরীর ছিল ব্যাতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি। “এই জীবন এমনি করে আর তো সয় না”, “যা গেছে তা যাক”, “যাক, ধুয়ে যাক, মুছে যাক” বা “আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম”-এর মতো গানে যার অনবদ্য প্রকাশ। গানগুলোর বাণী পাঠ করলে সাধারণত করুণ রসের উদ্রেক হবে, কিন্তু সলিল চৌধুরী যেন সেই করুণ রসকে উপেক্ষা করতে চান। দুঃখের নাগপাশে আটকে পড়ে থাকা তাঁর সঙ্গীতবোধের ধাতে সয় না। তাই দুঃখের পাশাপাশি তিনি মোহভঙ্গের আনন্দকে প্রকাশ করতে চান। সেই বোধের ভিত্তিতে তাঁর গানের প্রিলিউড হয়ে উঠল স্বতন্ত্র এবং নৃত্যশীল। তাঁর সঙ্গীত শুনে বাঙালীর কান রাগ-রাগিনী আর লোকসঙ্গীতের সুরের পাশাপাশি সোনাটা (Sonata), সিম্ফোনি (Symphony), স্যুইট (Suite), কোয়ার্টেট (Quartet) বা কনচের্তো (Concerto)-র সুর শোনার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল। তাঁর কথায় ও সুরে, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া “ঐ যে সবুজ বনবীথিকা” গানের ইন্টারলিউডে বিঠোফেনের ষষ্ঠ সিম্ফোনির ছোঁইয়া রয়েছে, ‘ছায়া’ সিনেমার থিম মিউজ়িকে বিঠোফেনের “Für Elise”-এর প্রভাব আছে এবং ঐ সিনেমারই কালজয়ী গান “ইতনা না মুঝসে তু পেয়ার বাঢ়া”-তে রয়েছে মোৎজ়ার্টের ৪০তম সিম্ফোনির প্রথম মুভমেন্টের সুরের স্পর্শ। দেশজ মেলোডির ওপর পলিফোনিক অর্কেস্ট্রেশনের যে কাজ শুরু হয়েছিল কয়েক দশক আগে থেকে পঙ্কজ কুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, অনুপম ঘটক, শচীনদেব বর্মণ বা কমল দাশগুপ্তর হাত ধরে, সেই কাজ আরও বহু দিক থেকে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল সলিল চৌধুরীর গানে। শুধু তাই নয়, '৬০-এর দশক পেরোতে না পেরোতেই তাঁর বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় এসে যুক্ত হতে লাগল বেস গীটার, ইলেক্ট্রিক গীটার, ইলেকট্রনিক কীবোর্ড, ড্রামস্, বঙ্গো বা কোঙ্গা। বাংলা তো বটেই, সমগ্র উপমহাদেশের গান তাঁরই হাত ধরে পূর্ণাঙ্গভাবে সাম্বা (Samba), সালসা (Salsa), বাচাতা (Bachata), ক্যালিপ্সো (Calypso) আর জ্যাজ়্ (Jazz)-এর স্বাদ পেল। তাঁরই তৈরি করা পথে পা বাড়িয়েছেন রাহুলদেব বর্মণ, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর, ইলাইয়ারাজা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি মিশ্র বা কবীর সুমনের মতো দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞরা। আধুনিক গানের ক্ষেত্রে পল্লীগীতি এবং রাগসঙ্গীতের ওপর কীভাবে পাশ্চাত্যের পলিফোনিক অর্কেস্ট্রেশন প্রয়োগ করতে হবে, তা নিয়ে তিনি বহু গবেষণাধর্মী বক্তৃতা দিয়েছেন। আধুনিক গান এবং গণসঙ্গীতের মধ্যে তিনি দার্শনিক মেলবন্ধন স্থাপন করেছেন সফলভাবে যার নিদর্শন হল “প্রান্তরের গান আমার”, “আজ নয় গুণগুণ গুঞ্জন প্রেমের” বা “নৌকা বাওয়ার গান”-এর মত কালজয়ী গান।
সলিল চৌধুরির সম্পর্কে একটা কাহিনী লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে। শোনা যায়, আমেরিকার লস এঞ্জেলেস শহরের একটি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের দোকানে একদিন এক ভারতীয় ভদ্রলোক এসে সেতার দেখতে চাইলেন। দোকানের এক কর্মচারী তাকে বহু সেতার দেখাতে লাগলেন। বিভিন্ন সেতার দেখতে দেখতে যুবকটি উঁচু তাকের ওপরে যত্নে সাজানো একটা বিশেষ সেতার দেখতে চাইলেন। একে তো অনেক উঁচু শেলফের ওপর রাখা, নামানো ঝামেলা, তার ওপর অত্যন্ত দামী সেতার। দোকানের সেই কর্মচারী রাজী হলেন না। কিন্তু লোকটির তখন শুধুমাত্র ঐ সেতারটির দিকেই নজর। অবশেষে দোকানের মালিক এগিয়ে এলেন। তাঁর নির্দেশে সেতার নামানো হল। সেই কর্মচারী অবহেলাভরে জানালেন যে এই বিশেষ ধরণের সেতারের নাম Boss সেতার — যেকোনো সেতারবাদকের পক্ষে এ সেতার বাজানো সম্ভব নয়। খুব বড় বড় সঙ্গীতানুষ্ঠানেই এই ধরণের সেতার ব্যবহার করা হয়।
ভারতীয় ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, “আপনারা একে Boss নামে জানতে পারেন, ভারতে এই সেতারকে সুরবাহার বলা হয়। আচ্ছা, আমি কি এটা একবার বাজিয়ে দেখতে পারি?”
দোকানের মালিক সেই ভারতীয় ভদ্রলোকের অনুরোধ রাখলেন। সেতারের তার বাঁধা হল। টিউন করা হল। ভদ্রলোক সেতার বাজানো শেষ করে তাকিয়ে দেখলেন চারপাশের সকলেই নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। ধীরে ধীরে হাততালিতে ভরে উঠল জায়গাটা। ভদ্রলোক সেতারটা কিনতে চাইলে স্বয়ং মালিক ডেভিড তাঁর কাছে এসে বললেন, “আমি রবিশঙ্করের সেতার শুনেছি। কিন্তু। তুমি রবিশঙ্করের চেয়ে কোন অংশে কম নও। আমি তোমাকে বিক্রি করতে পারব না। এই সেতার আমি তোমাকে উপহার দিলাম।”
সেই সেতারটা ভারতে নিয়ে এসে তিনি কম্পোজ় করলেন “না যেওনা”, যা লতার কণ্ঠে আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত প্রসঙ্গে আর একটা বৈশিষ্ট্যের কথাও তুলে ধরতে চাই। তাঁর সৃষ্ট গান সবসময়েই নৃত্যশীলতাকে ধারণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর গানের প্রিলিউড এবং ইন্টারলিউড ছন্দকে অবলম্বন করে বিভিন্ন সূক্ষ্ম কারুকার্যকে প্রকাশ করে। “দুরন্ত ঘুর্ণির এই লেগেছে পাক”, “আহা ঐ আঁকাবাঁকা যে পথ”, “পল্লবীনি গো সঞ্চারীনি”, “কী যে করি, দূরে যেতে হয়” বা “ধিতাং ধিতাং বোলে”-র মতো গানগুলোর প্রিলিউড আর ইন্টারলিউড এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত-ভাবনার আরেক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক দিক হল, দেশীয় রাগসঙ্গীতে কর্ড, হার্মোনি এবং অর্কেস্ট্রেশন প্রয়োগ করা নন্দনতত্ত্ব-সমর্থিত কিনা, তা বিচার করা। সলিল চৌধুরী রাগ সঙ্গীতের মেলোডিকে কাউন্টারপয়েন্ট এবং কর্ডের সাহায্য নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ওপর সিম্ফোনির আদলে অর্কেস্ট্রেশন করার সম্ভব এবং তা অবশ্যই নন্দনতাত্ত্বিকভাবে নির্ভুল। প্রমাণস্বরূপ, তিনি একবার একটি আলচোনা সভায় ভারতের জাতীয়সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রেশন প্রয়োগ করে শুনিয়েছিলেন জনসমক্ষে। ঐ অনবদ্য এবং অভিনব উপস্থাপনা উদ্যোক্তা আর শ্রোতাদের কাছে সাদরে এবং সানন্দে গৃহীত হয়েছিল।
প্রতিভা থাকলেই তা শত মুখে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। আমরা অচিরেই দেখি, চলচ্চিত্রের গান এবং আবহসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও সলিল চৌধুরী নিজের অভিনবত্ব দেখিয়ে গেছেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে আবির্ভূত হন ১৯৪৯ সালে 'পরিবর্তন' সিনেমায়। তারপর, ‘বরযাত্রী’, ‘পাশের বাড়ি’ এবং ‘বাঁশের কেল্লা’ সিনেমায় বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় সুর উপহার দিয়েছেন। পরবর্তী কালে ‘রিকশাওয়ালা’, ‘রাতভোর’, ‘একদিন রাতে’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘গঙ্গা’, ‘রায় বাহাদুর’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘মর্জিনা আবদুল্লা’, ‘কবিতা’ বা ‘সিস্টার’-এর মতো সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। হিন্দি ছবিতে তাঁর আগমন হয় ‘দো বিঘা জ়মিন্’ সিনেমার মাধ্যমে। হিন্দিতে ‘বিরাজ বহু’, ‘জাগতে রহো’, ‘মধুমতি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছায়া’, ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পরখ’, ‘চান্দ্ অর সুরজ্’, ‘আনন্দ্’ বা ‘অন্নদাতা’ তাঁর সঙ্গীত পরিচালনার অন্যতম নিদর্শন। ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছি’-র পরিচালক এবং ‘পরখ’ সিনেমার গল্পকার ছিলেন স্বয়ং সলিল চৌধুরী। ‘কানুন’ সিনেমায় কোনো গান না থাকলেও, তাঁর সৃষ্ট আবহসঙ্গীত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ১৯৬৫ সালে ‘চেম্মীন’ সিনেমার মাধ্যমে তিনি পদার্পণ করেন মালয়ালম ছবির জগতে। এরপর ‘রাসলীলা’, ‘থমাসলীহা’, ‘প্রতীকশা’, ‘দেবদাসী’ বা ‘থুম্বোলি কাদপ্পুরম’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার হিসাবে অভিনব নিদর্শন তৈরি করেছেন। এছাড়াও, বহু ওড়িয়া, অসমীয়া, মারাঠি, তামিল কন্নড় ও তেলুগু ছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কৃতিত্বের নিদর্শন রেখে গেছেন। এই ভাবেই এক বঙ্গসন্তান আপন প্রতিভা বলে সর্বভারতীয় সঙ্গীতকার হয়ে উঠেছেন। এরকম উদাহরণ তাঁর পরে আর খুব বেশি তৈরি হয়নি।
[তিন]
আধুনিক এবং চলচ্চিত্রের গান মিলিয়ে প্রায় সারা ভারতের বিভিন্ন প্রজন্মের বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পী তাঁর সুরে গান গেয়েছেন বা প্লেব্যাক করেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, কিশোর কুমার, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সৈকত মিত্র, হৈমন্তী শুক্লা, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, গায়ত্রী বসু, অরুন্ধতী হোম-চৌধুরী, হেমলতা, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রীতি বন্দ্যোপাধ্যায়, সিকান্দার আলম, পঙ্কজ মিত্র, গুরুদাস পাল, উষা মঙ্গেশকর, অমিত কুমার, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পি. সুশীলা, এস. পি. বালসুব্রহ্মনিয়ম, কে. জে. যেশুদাস, এস. জানকী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মহম্মদ রফি, মহেন্দ্র কাপুর, অনুরাধা পড়োয়াল, কৃষ্ণা কাল্লে, বাণী ঘোষাল, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, মুকেশ, নীতীন মুকেশ, লতা মঙ্গেশকর, পি. জয়চন্দ্রন, আশা ভোঁসলে, পূর্ণদাস বাউল, অন্তরা চৌধুরী, সবিতা চৌধুরী, সুবীর সেন, সাগর সেন, পি. লীলা, বনশ্রী সেনগুপ্ত, রানু মুখোপাধ্যায়, সুপর্ণা গুহ, শচীন গুপ্ত, কে. এস. চিত্রা, দেবব্রত বিশ্বাস, সুনন্দা মুখোপাধ্যায়, হরিহরণ, নির্মলেন্দু চৌধুরী, হীরালাল সরখেল, বাণী জয়রাম, অনুপ জালোটা, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সুরেশ ওয়াড়েকর, অনুপ ঘোষাল, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সোনু নিগম, উষা উত্থুপ, আরতি মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য্য প্রমুখ প্রথিতযশা গায়ক-গায়িকারা। “এই রোকো পৃথিবীর গাড়িটা থামাও” তাঁর স্বকন্ঠে গাওয়া একমাত্র সোলো গান। আক্ষরিক অর্থেই তিনি জনপ্রিয় সঙ্গীতের সর্বভারতীয় মুখ হয়ে ওঠেন। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে।
সলিল চৌধুরীর গানের প্রধান আকর্ষণ সুরের জটিল বিন্যাসে। গান তৈরি করার সময় সলিল একই সুরের ওপরে তিনটে আলাদা অ্যারেঞ্জমেন্ট করতেন। ধরা যাক, মূল বাংলা গানের সুরে যদি গায়কীতে লোকসঙ্গীতের ছোঁয়া থাকে, সেই একই গানের হিন্দি রূপান্তরে থাকবে লাস্যের ভাব। আবার সেই সুর যখন দাক্ষিণাত্যের ছবিতে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে মিশে যায় কর্ণাটকী সঙ্গীতের উপাদান।
গণনাট্য সঙ্ঘের গোড়ার যুগে, সুরের ঠিক এই রকম প্রয়োগ নিয়ে বাংলার আর এক প্রখ্যাত গণসঙ্গীত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে সলিল চৌধুরীর এক বিখ্যাত তর্ক হয়েছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছিলেন যে গণসঙ্গীত যারা শুনবে, শুনে উদ্বুদ্ধ হবে, তারা হচ্ছে মাটির কাছের মানুষ। তাদের কাছে দেশজ সুরের মাধ্যমে মেসেজ পৌঁছবে তাড়াতাড়ি। সলিল নির্মিত গানের সুরের এই পশ্চিমি চলন তাঁর একেবারেই না-পসন্দ ছিল। পাশাপাশি, সলিল চৌধুরীর বক্তব্য ছিল যে তাঁরা সঙ্গীতের মঞ্চে যাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তারা ফর্মের দিক থেকে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে রয়েছেন। যেমন আধুনিক কামান-বন্দুকের মতন যুদ্ধাস্ত্রের বিরুদ্ধে লাঠি টাঙি বল্লম জাতীয় দেশজ অস্ত্র দিয়ে লড়াই চালান যায় না, তেমনি গানের লড়াইও করতে হবে যেখানে যেরকম আধুনিক উপায় আছে — সে সব ব্যবহার করে। পশ্চিমি চলনে বাঁধা গান সুন্দরবনের প্রত্যন্তে মানুষ শুনছেন, উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তাছাড়া লোকসঙ্গীত তো আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমাদের গানের ইমারত শুধু সেখানেই আটকে থাকবে?
সলিল চৌধুরীর শিল্পীসত্তা শুধু সঙ্গীতের জগতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কথা সাহিত্যিক হিসাবেও তিনি তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ‘এক গুচ্ছ চাবি’, ‘ইউলিসিস’, ‘ফাঁদ’, ‘কবিতা’, ‘শৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলা’, ‘বয়স’ বা ‘শপথ’-এর মতো কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন বাস্তবতা, জীবনবোধ, মতাদর্শ এবং নৈতিকতার কথা। তাঁর লেখা ‘ড্রেসিং টেবিল’ বা ‘রিকশাওয়ালা’-র মতো ছোটোগল্প আজও পাঠকের মনকে আন্দোলিত করে দেয়। সত্যটা হল, ‘সুরকার’ সলিল চৌধুরীর প্রতিভার দীর্ঘ ছায়ায় বারবার ঢাকা পড়ে যান কবি সলিল, গল্পকার সলিল, চিত্রনাট্যকার সলিল। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার বলছিলেন, “আমরা তো অনেক রঙিন বিপ্লবের কবিতা লিখেছি। কিন্তু শুধু মাত্র ‘শপথ’ লিখে সলিল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কত বড় মাপের কবি…” অথচ বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্যের আলোচনায় আজও তেমন করে তাঁর নাম উচ্চারণ করা হয় না!
বিমল রায় বলতেন, “সলিলের সুর তো ছবি আঁকে।”
সেই সময় বিমল রায়ের সহকারী ছিলেন গুলজার। তিনি এক সময় বলেছেন, সলিলদার লেখা বড়ই সিনেম্যাটিক। আসলে গল্প বলার একটা অসামান্য দক্ষতা ছিল ওঁর। কখনও তার প্রকাশ হত গানের কথায়, আবার কখনও বা গল্পে, কবিতায়। এ ব্যাপারে সলিল চৌধুরী নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “আমি জানি না, কোনটা নিয়ে চলব: কবিতা, গল্প লেখা, অর্কেস্ট্রেশন, না ফিল্মের গান কম্পোজ় করা। ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই আমার কাজ। যখন যেটা সেই মুহূর্তটায় বা আমার মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খায়, সেটা নিয়ে কাজ করি।”
এই ক্রিয়েটিভিটির একটা চমৎকার উদাহরণ সলিল চৌধুরীর স্বকন্ঠে রেকর্ড করা একমাত্র গান “এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও”। গানটার ভিত্তি হল জ্যাজ়্ (Jazz) এবং স্কেল ট্রান্সপোজ়িশন। এই গানে সলিল চৌধুরী ব্যবহার করেছেন ইলেক্ট্রিক গিটার এবং সেই গিটারের অ্যানালগ প্রসেসরে তৈরি করেছেন ক্রাঞ্চ টোন (Crunch tone); ব্যবহার করেছেন ইলেক্ট্রিক অর্গান, ধাতব বাঁশি দিয়ে কর্ড বাজিয়ে সলিলবাবু ফুটিয়ে তুলেছেন ট্রেনের হুইসেলের ধ্বনি।
[চার]
সলিল চৌধুরী ১৯৫২ সালে চিত্রশিল্পী জ্যোতি ভট্টাচার্য্যের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন কন্যাসন্তান ছিল — অলকা, তুলিকা এবং লিপিকা। পরবর্তী কালে তিনি সবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিবাহ করেন। সলিল ও সবিতার চার সন্তান — সুকান্ত, সঞ্জয়, অন্তরা এবং সঞ্চারী। এঁদের মধ্যে সঞ্জয় চৌধুরী বর্তমানে চলচ্চিত্র জগতে আবহসঙ্গীত নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিচিত মুখ আর অন্তরা চৌধুরী একজন জনপ্রিয় গায়িকা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ কর্মজীবনে সলিল চৌধুরীর সম্ভারে রয়েছে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক, বি.এফ.জে.এ. পুরস্কার, আলাউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, মহারাষ্ট্র গৌরব পুরস্কার। ২০১৩ সালে ভারত সরকার তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।
এতো প্রতিভা এতো অবদান, কিন্তু যদি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা বলি, তবে সেটা বলতে গেলে তিনি একটা জিনিস পাননি, সেটা হল তাঁর নিজের রাজ্য থেকে কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। এই পুরষ্কার না পাওয়ার ব্যথা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, “আমার কোনো খেদ নেই জানো। গান আমাকে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসা পাইয়ে দিয়েছে। কতো কিছুই পাইনি, শেষে সব ভুলে যাই যখন কেউ আমার গান শুনে বলে আপনি চোখে জল এনেছেন। আমি কোথাকার কে ভাই, ঈশ্বরের যিনি বরপুত্র, সেই মোৎজ়ার্ট সারা জীবনে কী পেয়েছিলেন — বঞ্চনা, বঞ্চনা আর বঞ্চনা।”
১৯৯৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর সলিল চৌধুরী প্রয়াত হন। কিন্তু অসংখ্য সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি আজও আমাদের হৃদয়ের কন্দরে বেঁচে আছেন।
সঙ্গীতের ছাত্র এবং তাঁর একজন গুণমুগ্ধ হিসাবে তাঁর জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।