পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তাবিজ

  • 31 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1953 view(s)
  • লিখেছেন : মেঘমালা দে মহন্ত
বাপের জম্মে ব্যবসা এত মন্দা যায়নি নিতাই দাসের। অজ পাড়া গাঁ হাটবারে মাঠের মধ্যে বট গাছের নীচে দোকানের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ব্যবসা করে নিতাই। এই ভরা বর্ষায় মরশুমে এভাবে অস্থায়ী দোকান বসাতে খুব অসুবিধে হয় ঠিকই কিন্তু অন্যান্য বছর খদ্দের থাকে এই সময়টাতেই। কত গ্রামের লোকের কত সমস্যা। সব সমস্যার সমাধানই মজুত নিতাই দাসের কাছে। এভাবে গ্রামে গ্রামে হাটবারে দোকান খুলে বসলেও পলার পার গ্রামের গোবিন হালাইয়ের চা স্টলেই নিতাইয়ের মূল ঘাঁটি।

একটা পিচ বোর্ডের উপরে আলতা দিয়ে ‘সর্ব বিপদ রোগ সমস্যা সমাধান’ লিখে টাঙিয়ে দিয়েছে চা-স্টলের সামনের তরজার বেড়ার ডানপাশে। পলিথিনের শিট আর বাঁশের তরজায় তৈরি গোবিনের ঘুপচি চায়ের দোকানের ভেতর আসবাব বলতে তিনটে কাঠের বেঞ্চ, একটা টেবিল, কাচের বোতল কিছু সস্তা বিস্কুট আর একটা কাঠের নড়বড়ে চেয়ার যেটাতে বসে থাকে গোবিন। দিনের বেলাতেও দোকানের ভেতর আলো আসে না ঠিকঠাক। আর বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। তখন টেবিলের ওপর জ্বালিয়ে রাখা লণ্ঠন ছাড়াও একটা কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে দেয় গোবিন দিনের বেলাতেও। চা-স্টলের ভেতরের এই অন্ধকারের দৈন্য অনেকটাই ঢেকে দিয়েছে দোকানের সামনে চায়ের স্টোভটার পাশে দড়িতে ঝোলানো নানা রঙের চকচকে চিপসের প্যাকেট। আজকাল গ্রামের লোকেরা চায়ের সঙ্গে ওই সস্তা বিস্কুট থেকে পাঁচ টাকার রঙিন পাকেটের বিলাসিতায় বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

ভরা বর্ষার বেশিরভাগ দিনই ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করতে পারে না নিতাই। গোবিনের চায়ের দোকানেই বসে থাকতে হয়। এই চায়ের দোকানেই এই গ্রামের ছেলে-বুড়োদের সমস্ত দিনের গালগল্পের ঘাঁটি। বিকেলের দিকে হাটবার ছাড়াও একটা ছোটোখাটো বাজারে বসে এখানেই। দোকানের সামনে তিনটে মোটা বাঁশ জোড়া দিয়ে একটা বসার জায়গা করে দিয়েছে গোবিন। গ্রামের লোকেরা আসে, বসে, সুখ-দুঃখের কথা বলে। তখন নিতাই নিজে থেকেই কখনও কখনও তাদের আলোচনায় যোগ দেয়। সমস্যা বুঝে তার টিনের ছোটো বাক্সটা খুলে বের করে দেয়
তাবিজ। সমাধানী তাবিজ। কেউ কেউ আবার সোজা নিতাইয়ের খোঁজেই দোকানে আসে। কত বিচিত্র সব সমস্যার সমাধান বন্দি রয়েছে নিতাইয়ের ওই টিনের বাক্সে। ভূতের ভয়, সন্তানহীন, বিবাহযোগ, বৈধব্যযোগ, স্বাস্থ্যহীনতা, দুর্বলতা, স্বপ্নদোষ, বৈরাগ্যযোগ, আগুনে ভয়, জলে পড়ার যোগ, দুর্ঘটনা, রক্তপাত, পাগলামি, আরও কত কী?

এসব ছাড়াও নিতাইয়ের কাছে বাণ মারা, বশীকরণ, গর্ভপাত এসবেরও তাবিজ রয়েছে যেগুলো সে প্রকাশ্যে বিক্রি করে না। চা-স্টলে নিতাইয়ের খোঁজে আসে যারা তারা জেনেই আসে তার ভাঁড়ারের খবর। তাই এখানে বসলে সে আর মুখে মুখে খদ্দের ডাকে না। কিন্তু অন্য গ্রামে যখন মাদুর পেতে বসে তখন মুখে মুখে সুর করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খদ্দের ডাকে নিতাই দাস। কিন্তু ক-দিন থেকে কী যে মন্দা যাচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারে না নিতাই। আগে যেখানে দুটো লোক একসঙ্গে বসলেই শুরু হয়ে যেত বিচিত্র সব বিপদ-আপদ আর পরনিন্দা-পরচর্চার সাতকাহন সেখানে আজকাল প্রতিটি মানুষ যেন এক অদ্ভুত বিষাদগ্রস্ততায় ডুবে গেছে। একই সমস্যা-শব্দ শুনতে পায় নিতাই-এনআরসি। কী এই এনআরসি? ভূত? অসুখ? বদ-বাতাস? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। নিতাইয়ের মতো গ্রামের লোকগুলোও জানে না এই নতুন সমস্যাটা আসলে কী! কত উড়ো কথা বাতাসে ভাসে। নিতাই রোজ শোনে। এই তো সেদিন কত কথা হচ্ছিল এখানেই।

—এনআরসি আমাদের সবাইকে বাংলাদেশে পাঠাবে। ওস্তাদি করার স্বভাবটা সুবলের বরাবর। সব সময়ই এরকম বুঝে না বুঝে সোজাসাপটা কথা বলে। এই মাতব্বরির জন্য গ্রামের মুরব্বিরা অনেকেই তাকে ঘোর অপছন্দ করে। —আরে ধুর... জানো না কিছু। এনআরসি পাঠাবে না। এনআরসি না থাকলে পাঠাবে।

প্রায় ধমকের সুরেই সুবলকে লক্ষ্য করে বলে বিলাস। বিরক্তির ছায়া অন্যদের মুখেও স্পষ্ট। এমনিতেই দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে আছে মানুষগুলো, তার ওপর সুবলের এই পাকামো অনেকেরই অসহ্য লাগছিল। তাছাড়া বিলাস কিছুটা হলেও লেখাপড়া শিখেছে। ওর কথার ওজন আছে। কিন্তু ওই সুবল? ধর্মের ষাঁড়ের মতো ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তো কোনো কর্মের নয়। বাপ-ঠাকুরদার জমিজমা আছে সামান্য — ভাতের চিন্তা নেই। লঘুগুরু জ্ঞান নেই আর বিড়ি টানবে সবার সামনে—এখন পাশের গ্রামে পঞ্চায়েত মেম্বার হয়েছে ওর জামাইবাবু, দু-পয়সা আসছে হাতে, বিড়ি ছেড়ে সিগারেট ধরেছে। সুযোগ পেয়ে বিলাসের সঙ্গে যোগ দেয় সুদামও।

—সুবলের কথা ছাড়ো, ও কী জানে? ওই ফটো দেওয়া কার্ডটাই তো এনআরসি, তাই না?
—না, না, ওই যে কাগজে আমাদের সব ঠিকুজি কুষ্ঠি লিখে ফরম ভরে দিলাম। ওটাই এনআরসি।

অনেকক্ষণ থেকে চুপ করে বসে সব শুনছিল শিবু। সবার কথা মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ হাউ হাউ করে ভেঙে পড়ে। —আমার যে কিছুই নেই দাদা, ওইসব ছবি... কাৰ্ড... আমার পরিবারের কারোর

শিবুর সশব্দ বিপন্নতার প্রকাশে একটু থমকে যায় সবাই। অসহায় যন্ত্রণার একটা আক্রোশ সবার চোখে মুখে। নীরবতা ভাঙেন জীবন কাকা,

—আরে না, কাউকে কোথাও পাঠাবে না। এনআরসি শুধুমাত্র ওই বিলের ধারের আগাছাগুলোকে তাড়াচ্ছে। ওদের বাংলাদেশে পাঠাবে। ঠিক হবে। আমরা হচ্ছি গাঁয়ের বটগাছ। ভূমিপুত্র। বাপ-ঠাকুরদা চোদ্দো পুরুষের ভিটে আমাদের। এনআরসি-ফেনার্সি কী আবার?

জীবনকাকার কথায় আশ্বস্ত হয় অনেকেই। এই মানুষটাই তো এখন পর্যন্ত গ্রামের লোকের আপদবিপদের ভরসা। নামী, গুণী মানুষ। পালা কীর্তনের জন্য ডাক আসে কত দূর দূর গ্রাম থেকে। পরাণ, গোপাল, বিষ্ণু এদের নিয়ে কীর্তনের দল জীবনকাকার। প্রায় দিনই সন্ধের পর পাঠশালার বারান্দায় লণ্ঠনের আলোয় চলে তাদের পালাগানের মহড়া। সেই কাকার ভরসা পায় অনেকেই।

—ঠিক ঠিক। হক কথা। অনেকগুলো কণ্ঠ এবার বুঝে না বুঝেই সায় দেয়, মাথা দোলায়। আমরা ভূমিপুত্র। আমাদের ভয় কী!
এ যেন নিজেদের অসহায় বিপন্নতাকে নিজেরাই জড়িয়ে ভরসার উত্তাপ জোগানো। কিন্তু নিতাইয়ের ধোঁয়াশা কাটে না। একটা না-জানা না-বোঝার অস্বস্তি ক্রমশ অস্থির করে নিতাইকে। মানুষের আপদবিপদ প্রাণ দিয়ে অনুভব করে তাবিজ বানায় সে। সমস্ত গ্রাম ছেয়ে আছে এক অদেখা-অজানা আশঙ্কায় কিন্তু কেউই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছে না কী এই এনআরসি। নাহ্। জানতেই হবে—বুঝতেই হবে নিতাইকে।

গ্রামে স্কুল বলতে একটাই পাঠশালা। শিক্ষকও একজন। সমস্ত গ্রামের মানুষ যাকে মাস্টারবাবু বলে জানে। আসলে নাম খুব কম মানুষই জানে, আর জানলেও ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না কখনও। নিতাই সেই মাস্টারবাবুর বাড়ির পথে হাঁটে। মাস্টারবাবুর অনেকক্ষণ ধরে বোঝানো কথা থেকে নিতাই এইটুকুই বুঝতে পারে, এনআরসি-র জটিল মারপ্যাঁচ বোঝা তার অথবা এই গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোর কারোর কর্ম নয়। মোদ্দা কথা এটুকু—ভূমিপুত্র-হাওয়াপুত্র কারোরই অবস্থান সুরক্ষিত নয় এই রাজ্যে। শুধু ওই বিলের ধারের লোকগুলোরই না বাংলাদেশ নাকি তাদেরও দেশ করে দেওয়া হতে পারে যখন তখন। জোর করে তুলে নিয়ে পুরে দেবে ক্যাম্পে, তারপর যেদিন খুশি ঠেলে দেবে বাঙালির দেশ বাংলাদেশে।

—তাই আবার হয় নাকি মাস্টারবাবু। যদি বাঙালি হলেই বাংলাদেশের হতে হয়
তবে এটা কার দেশ? আমাদের এত পুরুষের বসতবাড়ি...

কথা শেষ হয় না।

—কেন রতীশের কথা, বুলু শব্দকরের কথা জান না? বছরভর ক্যাম্পে পচে

মরেই গেল বুলু শব্দকর।

–কে বুলু শব্দকর?

—তোমার আমার মতোই এক সাধারণ বুড়ো মানুষ, যাকে বিদেশি বলে জোর
করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পে, সেখানেই মারা গেছে কিছুদিন আগে।

হঠাৎ চুপ করে যান মাস্টারবাবু। হয়তো নিজের আবেগের উচ্ছ্বাস ঢাকতেই। কোনো শব্দ জোগায় না নিতাইয়ের মুখেও। চুপ করে বাড়ির পথ ধরে। মনে মনে বুলু শব্দকরের একটা চেহারা কল্পনা করার চেষ্টা করে। নতুন কোনো চেহারা তৈরি করতে পারে না নিতাই। ঘুরে ফিরে গ্রামের অসহায় চেহারাগুলোই মাথায় আসে।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে গ্রামের সরু অভ্যস্ত পথে সামান্য হেঁটেই একটা অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করে। মাথা থেকে কিছুতেই তাড়াতে পারে না ‘বুলু শব্দকর' শব্দটা। সেইসঙ্গে গ্রামের মানুষগুলোর অসহায় চেহারাগুলো।

আজ এখানকার হাটবার। গোবিনের চায়ের স্টলের পাশেই বসে বাজার।
গতকাল সমস্ত রাত ঘুমোয়নি নিতাই। চুপ করে বসে আছে চায়ের দোকানের বাইরের বাঁশের মাচার ওপর। দু-একজনের আসছে বসছে আবার চলে যাচ্ছে। আসর জমে উঠছে না আগের মতো। বুলু শব্দকরের কথাটা অনেকেই শুনেছে। চাপা একটা আতঙ্ক সবার মুখেই যেন দেখতে পায় নিতাই।
— ও বাবা নিতাই।

সাধন জেঠা। নিতাইয়ের বহু পুরোনো খদ্দের। বুড়োর জীবনের সমস্যার অন্ত নেই। আর সমস্ত কিছুর জন্যই বুড়ো ছুটে ছুটে আসে নিতাইয়ের কাছে। সমাধান তাবিজের জন্য। বুড়োর পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্যের হাতে, গলায়, নয় তো কোমরে ঝুলছে নিতাইয়ের দেওয়া তাবিজ। সাধন জ্যাঠা এসে বসে নিতাইয়ের কাছে,

–ও বাবা নিতাই... বড়ো ভয় লাগে রে বাবা...

—কীসের ভয় পাও জেঠা?

কিছু বলে না সাধন জেঠা। চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। নিতাই মুখ
দেখতে পায় না জেঠার কিন্তু কেন জানি মনে হয় বুড়োর দু-চোখ ছাপিয়ে নেমেছে জলের ধারা। নিতাই খুব মন দিয়ে সাধন জেঠার পায়ের নীচের শুকনো টানটান মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, ঠিক কতটা দ্রুততায় এই মাটি শুষে নিতে পারবে বুড়োর চোখের বিন্দু বিন্দু জল।

—কী হল জেঠা—বলো, সমস্যাটা কী বলো।

—বাবা, আমি যে ঠাকুরদার কোলে চড়েই এ দেশে এসেছিলাম। প্রায় চার কুড়ি বছর আগে বাবা। কিন্তু এই গ্রামই আমাদের দেশ-বিদেশ সব। আর কিছু তো জানি না বাবা। এখন যদি এই শেষকালে আমাকেও এনআরসি ধরে বেঁধে ভিটে ছাড়া করে।

নিতাইয়ের ধারণা এক বর্ণও ভুল নয়। সাধন জেঠার দুচোখে ভরা শ্রাবণের

—ও বাবা, আমি কী ভাবছি জান? ভাবছি তার থেকে ত্রিপুরার কমলপুরে চলে যাই বড়ো মেয়ের কাছে। ওখানেই যে-কটা দিন বাঁচি... কান্নার দমকে কথা আটকে যায় সাধন জেঠার।

—শুনেছি ওদের নাকি এনআরসি কিছু করে না। কিন্তু ছেলে-বউ-নাতি-ভিটে তোমাদের ছেড়ে যাই কী করে বাবা...

সাধন জেঠাকে কোনো সমাধান দিতে পারে না নিতাই। তবু জেঠাকে কিছু

হালকা করতে বলে, —শোনো জেঠা, অত ভেব না। সবাই তো আছি গো আমরা। এ তো তোমার একার সমস্যা নয়।

নিতাইয়ের হঠাৎ মনে হয় বুলু শব্দকরের চেহারাটা নিশ্চয়ই এই সাধন জেঠার মতোই ছিল।

সারাদিন একটাও তাবিজ বিক্রি হয় না নিতাইয়ের এই হাটের দিনেও। হঠাৎ করেই যেন বদলে গেছে গ্রামের সবগুলো মানুষ। বদলে গেছে তাদের এতদিনের সুখ-দুঃখ, সমস্যা, চিন্তা-ভাবনা। লোকগুলো নিজেদের স্বাস্থ্য ভুলে গেছে, মেয়ের বিয়ের বয়স ভুলে গেছে, তুচ্ছ বিষয়ে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে ভুলে গেছে। কত দিন স্কুলের বারান্দা থেকে পালাগানের সুর ভাসে না গ্রামটায়। সুবলটাও যেন আর আগের মতো সিগারেট হাতে ওস্তাদি করে বেড়ায় না আজকাল। মানুষগুলো ভূত-প্রেত, সাপ, আগুন, জল পড়ার ভয়, সমস্ত কিছু জয় করে নিয়েছে শুধুমাত্র ওই এনআরসি ভীতিতে। ভাবতে ভাবতে নিতাই আবিষ্কার করে, আসলে এই এনআরসি মানুষগুলোকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে ভুলিয়ে দিয়েছে। নিতাইয়ের খুব ইচ্ছে হয় লোকগুলোকে তাদের আগের রোগবালাই, ঝগড়া, বিবাদ, সমস্যা-জর্জরিত দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। যেসব সমস্যার সমাধান তার ওই টিনের বাক্সে মজুত রয়েছে। টিনের বাক্সটা খুলে দেখে নিতাই। সার সার তাবিজগুলো মরার
মতো পড়ে আছে। কতদিন হয়ে গেল একটাও তাবিজ বিক্রি হয়নি। তা হলে কি
নিতাইয়ের মন্ত্রগুণই জোর হারাল? তা-ই বা কী করে সম্ভব? এই তাবিজগুলোই তো
গ্রামের কত লোকের কত সমস্যার সমাধান করেছে এ যাবত। তাবিজ ব্যর্থ হতে
পারে না নিতাইয়ের। লোকগুলোই ভুলে গেছে তাদের রোগবালাই। নিতাই মনে
প্রাণে বিশ্বাস করে গ্রামের সমস্ত আপদবিপদ আগলে রাখার দায় তারই।
এনআরসি-র তাড়া কি নিতাইয়ের নেই? যে কাগজপত্রের কথা সবাই বলে কিছুই
তো নেই তার। তবু কী আশ্চর্য, নিতাইয়ের একবারও মনে হয় না তার নিজস্ব সংকট মুক্তির কথা। যেন গ্রামের লোকগুলির নিশ্চিন্ত জীবনেই মিশে আছে নিতাইয়ের প্রাণ ভোমরাটি।

সে চোখের সামনে ভেঙে পড়তে দেখেছে সাধন জেঠা, জীবনকাকাদের।
হতাশা বিষাদ আর দুশ্চিন্তার আতঙ্কে ক্লান্ত মানুষগুলো ভালো করে কথাও বলে না
আজকাল। কোনো কাজে উৎসাহ নেই। ডিটেনশন ক্যাম্প নামের সেই
অদেখা-অজানা নরকের বাসিন্দা হবার আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটায় গোটা গ্রাম। বুলু শব্দকরের অন্তিম পরিণতি কল্পনা করে কেঁপে ওঠে আমূল। মানুষগুলোর ভরসার সঞ্চয় নিতাইয়ের অফুরান, কিন্তু তাদের নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার হদিস তো জানে না নিতাই। লোকগুলো কি জানে, না বোঝে, না দেখেছে তাদের সমস্ত ভয় ভীতির মূল
এই এনআরসি আসলে কী? কেমন দেখতে বা কী করে ঠেলে ভিটেমাটি ছাড়া করে? ভূত-প্রেত-জিন-পরি থেকে তা হলে খুব একটা আলাদা কিছু নয় তাদের কাছে এই নতুন আপদটি! তাহলে কেন পারবে না নিতাই। নিশ্চয়ই পারবে। পারতেই হবে তাকে।

সপ্তাহভর নিতাই শুধু শোনে। একাত্ম হয়ে শোনে ডিটেনশন ক্যাম্পের কাল্পনিক অত্যাচারের কথা, বুলু শব্দকরের লাঞ্ছিত মৃতদেহের কথা, ভিটে মাটি ছাড়ার যন্ত্রণার কথা। অস্থির নিতাই রাতের পর রাত জাগে। সহজ-সরল সাধারণ মানুষগুলোর করুণ অবস্থা, সমস্যা সমস্ত পুঞ্জীভূত করে স্থির বিশ্বাসে নিতাই নিজের মধ্যে, তারপর তার সমস্ত ভরসার পুঁজি উজাড় করে দেয় তার নতুন তাবিজের মধ্যে পরম আত্মবিশ্বাসে।

পরের হাট বারে নিতাই আর চায়ের স্টলের ভিতরে বসে না। বাইরের বাঁশের মাচাটার সামনে মাদুর পেতে বসে তার টিনের বাক্স নিয়ে। বেড়ার গায়ে ঝোলানো আলতা দিয়ে লেখা পিচ বোর্ডের সাইনবোর্ডে জুড়ে দেয় আরেকটা লাইন—
‘এখানে এনার্সি তাবিজ পাওয়া যায়।

0 Comments

Post Comment