রুনাইয়ের বাবা ঋষভবাবু তাই আগেভাগেই একটা বেশ দামী স্কুলব্যাগ নিয়ে এসেছেন রুনাইয়ের জন্য। কিন্তু ব্যাগটা একদম পছন্দ হয়নি রুনাইয়ের। রুনাইয়ের গোলাপী রঙ খুব প্রিয়। কিন্তু যে ব্যাগটা বাবা নিয়ে এসেছেন তাতে কোথাও গোলাপী রঙের একটা ছিটে ফোঁটাও নেই। রুনাইয়ের ধারণা গোলাপী রঙটা তার লাকি রঙ, সেটা খুব পয়া। রুনাইয়ের ঘরের দেওয়ালও গোলাপী রঙের। কিন্তু এই ব্যাগটাতে সেই রঙ নেই। তাছাড়া রুনাই তার মামাতো দাদা বনির কাছে একটা স্কুলব্যাগ দেখেছে যেখানে ডোরেমনের ছবি রয়েছে। ডোরেমন রুনাইয়েরও খুব প্রিয়। কিন্তু বাবার আনা এই ব্যাগটায় ডোরেমন দুরস্থ কোনও কার্টুনেরই ছবি নেই। এইরকম ব্যাগ ক্লাস নাইন-টেনের বড় বড় দাদা-দিদিরা নিয়ে আসে। যারা সারাদিন পরীক্ষা আর কেরিয়ারের টেনশন করে আর চশমা চোখে এঁটে কেমন একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ চেহারার নিয়ে নীচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দেখে। এই দাদা-দিদিগুলোকে একদম ভালো লাগে না রুনাইয়ের। তাই তাদের ব্যাগের মত দেখতে স্কুলব্যাগও একদমই পছন্দ নয় রুনাইয়ের। সেকথা রুনাই তার মাকেও জানিয়েছে। কিন্তু রুনাইয়ের মা তো জানেন যে তার বাবা কত টাকা দাম দিয়ে ওই ব্যাগ কিনেছেন আর ব্যাগের কোয়ালিটিটাও দারুণ। তাই তিনি রুনাইকে বুঝিয়েছেন যে এখন কিছুদিন পর স্কুল খুললে রুনাই যেন কিছুদিন এই ব্যাগটাই ব্যবহার করে। পরে নয় রুনাই তার বাবার সাথে গিয়ে নিজে পছন্দ করে গোলাপী রঙের একটা স্কুলব্যাগ কিনে আনবে। সেকথায় রুনাইয়ের জেদ কিছুটা কমলেও তার এই অপছন্দের স্কুলব্যাগটা কিভাবে তাড়াতাড়ি বিদায় করা যায় সেই চিন্তাতেই এখন মগ্ন রুনাই।
রুনাইকে তার স্কুলব্যাগের দিকে ওইভাবে ব্যাজার মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হচ্ছিল টুকটুকি। ঝলমলে একটা স্কুলব্যাগ। রংটা একটু ছাইছাই হলে কি হবে, বেশ ঝলমলে। এইরকম স্কুলব্যাগের কথা টুকটুকি কল্পনাও করতে পারে না। টুকটুকি রুনাইদের বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করা মিনতি মাসির মেয়ে। বয়সে সে রুনাইয়ের থেকে কিছুটা ছোট। অবাক করা বড় বড় চোখ নিয়ে রুনাইকে দেখছিল টুকটুকি। টুকটুকির বাবা তার জন্মের সাথে সাথেই তাকে আর তার মা’কে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। যেন মেয়ে হয়ে টুকটুকির জন্মানোটাই একটা অপরাধ। টুকটুকির মা সেই থেকে অনেক কষ্ট, অনেক যাতনা সহ্য করে টুকটুকিকে মানুষ করার চেষ্টা করছেন। টুকটুকির বাবা আবার বিয়ে করেছে। টুকটুকি আর তার মায়ের কোনও দায়িত্বই সে লোক নেয়নি। তাও মিনতি মাসি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন একমাত্র মেয়েকে মানুষ করার। টুকটুকি এই ছোট বয়সেই সে তার মায়ের কষ্টটা বেশ বুঝতে পারে। জন্ম থেকে সে শুধু কষ্টটাই তো দেখেছে। মিনতি মেয়েকে স্কুলেও ভর্তি করেছেন। তবে অবশ্যই সে স্কুল রুনাই যে স্কুলে পড়ে সেই স্কুলের মত ইংরাজী মাধ্যম বেসরকারী চটকদার স্কুল নয়, কিন্তু লোকের বাড়িতে গতর খাটিয়ে যতটা সম্ভব মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন মিনতি।
টুকটুকি যে রুনাইয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার কান্ড দেখছে সেটা খেয়ালই করেনি রুনাই। এমনিতে স্কুল বন্ধ থাকায় টুকটুকিকে পাশের বাড়ির এক মাসিমার কাছে রেখেই কাজে আসেন মিনতি। কিন্তু গতকাল থেকে সেই মাসিমার আবার জ্বর হয়েছে। পাড়ার ভলেন্টিয়াররা এসে তাকে টেস্ট করানোর জন্য নিয়ে গেছে। এই ছেলেছোকরাগুলো সবসময় তৈরি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এদের বেশীরভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। একদিন টুকটুকিও এদের মতই হবে সেই স্বপ্নই দেখেন মিনতি। নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে সে সমাজের কাজেও আসবে, সেভাবেই টুকটুকিকে মানুষ করা মিনতির লক্ষ্য। তাই আজ একরকম বাধ্য হয়েছে মিনতি টুকটুকিকে সঙ্গে করে তাকে কাজের বাড়িগুলোতে নিয়ে আসতে। এমনিতেই সম্পূর্ণ লক-ডাউনের সময় দু’বাড়ির কাজ হারিয়েছে সে। লক-ডাউন ওঠার পরেও সেই বাড়িগুলো থেকে আর ডাক আসেনি মিনতির।
টুকটুকি এমনিতে শান্ত মেয়ে। কোনওরকম দাবী ঝামেলা তার নেই। তার মা যে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে করতে সকাল থেকে তাকে কিছু খাওয়ার দিতেই ভুলে গেছে সেই নিয়েও কোনও অভিযোগ নেই টুকটুকির। অতি ছোটবেলা থেকেই খিদে সহ্য করতে শিখেছে বলেই না টুকটুকি এখনও টিকে রয়েছে। তাই খিদের কথা সারাদিনে মুখেও আনেনি টুকটুকি।
রুনাইদের বাড়িই শেষ বাড়ি। এই বাড়ির কাজ শেষ করেই টুকটুকিকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন মিনতি। টুকটুকি যখন হাঁ করে রুনাইকে দেখছে তখন মিনতি ঘর মুছতে মুছতে সেইখানে এসে উপস্থিত হলেন। রুনাইয়ের ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখে মিনতি বলে উঠলেন, ‘ওমা, রুনাইদিদির কি সুন্দর ব্যাগ, দেখেছিস টুকটুকি। এই ব্যাগ নিয়ে রুনাইদিদি যখন স্কুলে যাবে ওকে কি সুন্দর লাগবে’।
রুনাই মিনতি মাসির কথা শুনে মুখটা ভেঙচিয়ে বলল, ‘এটা মোটেও সুন্দর ব্যাগ নয়, ডাল ব্যাগ, বাবার জানো তো চয়েস নেই, আমি তাই বাবাকে কাল খুব করে বকে দিয়েছি’।
রুনাইয়ের কথাশুনে মিনতি আর টুকটুকি দুজনেই বেজায় অবাক হল।
ঠিক এইসময়েই রুনাইয়ের মা রুমাদেবী ওই ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে মিনতি আবদারের ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘বৌদি একটা কথা বলব, বলছি কি তুমি তো জানোই আমার অবস্থা। টুকটুকির একটা পুরনো ব্যাগ ছিল। স্কুল থেকেই দিয়েছিল। তা সে ব্যাগটা না একদম ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। আমাদের যা অবস্থা মা-মেয়ের দুবেলা ভাতের যোগাড় করতেই নাভিশ্বাস ওঠে। তার ওপর এখন আবার স্কুল খুলতে চলেছে। মেয়েটার জন্য যদি একটা স্কুলব্যাগ পাওয়া যেত গো খুব ভালো হত। তাই বলছিলাম কি দাদা তো রুনাইয়ের জন্য একটা নতুন স্কুলব্যাগ এনেই দিয়েছেন তাই বৌদি যদি আমাকে রুনাইয়ের পুরনো স্কুলব্যাগটা দাও তাহলে খুব উপকার হয় গো’।
রুনাইয়ের মা রুমাদেবী এগিয়ে গিয়ে ঘরের এককোণে অযত্নে পড়ে থাকা পুরনো গোলাপী স্কুলব্যাগটা এনে টুকটুকির হাতে দিলেন। টুকটুকি ব্যাগটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। তার চোখদুটো বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রুনাইয়ের নজরও গেল টুকটুকির হাতে থাকা তার পুরনো গোলাপী ব্যাগটার দিকে। ব্যাগটা তার প্রিয় ব্যাগ, ব্যাগের রঙটা তার ভীষণ পয়া। এই ব্যাগ হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। পুরনো হলেও না। রুনাই একলাফে বিছানা থেকে নেমে টুকটুকির হাত থেকে গোলাপী ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘না এটা তোমাকে দেব না, এটা আমার লাকি ব্যাগ’, তারপর খাটে থাকা নতুন ছাই রঙের স্কুলব্যাগটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে রুনাই তার মাকে বলল, ‘তুমি বরং ওই ব্যাগটা ওকে দিয়ে দাও, ওই ব্যাগটা আমার একটুও পছন্দ না’।
রুমাদেবী রুনাইয়ের কথা শুনে ইতস্তত করতে লাগলেন। একে নতুন ব্যাগ তার ওপর বেশ দামী। যতই মেয়ের অপছন্দ হোক তার কথায় বাড়ির কাজের লোকের মেয়েকে সেই ব্যাগ কি দিয়ে দেওয়া যায়? রুমাদেবীর মুখটা ছোট হয়ে আসছি। তার বিড়ম্বনা সহজ করে দিল টুকটুকি। সে রুনাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না গো দিদি, ওই ব্যাগটা আমার লাগবে না। তুমি তো আমার থেকে উঁচু ক্লাসে পড়, তাই তোমার বড় ব্যাগ লাগবে। আমার যে ব্যাগটা বাড়িতে আছে সেটা মা একটু সেলাই করে দিলেই আমি আবার সেটা নিয়ে স্কুলে যেতে পারব’। তারপরই সে মিনতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ব্যাগটা তুমি সেলাই করে দিতে পারবে না মা? ওই ব্যাগটা কিন্তু খুব ভালো’।
মিনতি নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘পারব মা, আমি আজই সেলাই করে দেব, তবে ওটা আর তোকে খুব বেশীদিন নিতে হবে না। স্কুল খুললে ক’টা দিন অপেক্ষা কর মা। কয়েকটা দিন পুরনো ব্যাগ দিয়ে চালিয়ে নে। আমি আজ থেকেই কিছু কিছু করে টাকা জমাতে শুরু করছি, আমি তোকে রুনাইদিদির মত ওইরকম গোলাপী রঙের একটা স্কুলব্যাগ কিনে দেব।
রুনাইদের বাড়ির কাজ শেষ করে স্টেশনে এসে টুকটুকিকে নিয়ে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরলেন মিনতি। ট্রেনটা বেশ ফাঁকাই। টুকটুকি বসেছে জানালার ধারে। তার পাশে মিনতি। টুকটুকির মলিন জামাকাপড়, চেহারাও শুকিয়ে আসা। কিন্তু চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে আসা হাওয়ায় টুকটুকির অবিন্যস্ত চুল উড়েছে। নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত গর্ব হল মিনতির। মনে মনে ঠিক করলেন আর এভাবে কিছুর জন্য কারও কাছে হাত পাতবেন না। টুকটুকির স্কুলব্যাগ থেকে শুরু করে সবকিছুর ব্যবস্থা তিনি নিজেই করবেন। অধিকার বোধ ভিক্ষার থেকে বহুগুণ ভালো। ভিক্ষার দান দিয়ে ভবিষ্যৎ গঠন হয় না। টুকটুকির কথা আজ তার মনে অধিকার বোধের গুরুত্ব, কোনও কিছু অর্জন করার গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। মেয়েকে মনে মনে অনেক আশীর্বাদ করলেন মিনতি। ট্রেনের জানালার ধারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনমনেই অনাবিল এক হাসি ফুটল টুকটুকির মলিন মিষ্টি মুখে।