" আরে আর বলো না, ছ্যাঃ! ছ্যাঃ! ছ্যাঃ! মানুষ এমনও হয়! "
" আরে হবে না কেন? শিক্ষিতে মানুষ। ও শালা শিক্ষিতে মানষেরা আচ্চয্যি মানুষ হয় তুমি জানো না? সুরেশ মাস্টারের বাবা মরে গেলে এট্টুও হাউমাউ করে কানতি দেখিছ? "
"হাউমাউ? এক ফোঁটা চোকের জল ফেলতি দেকলাম না, আর তুমি হাউমাউ দেকাচ্চ?"
"হ্যাঁ, কান্দিছেল বটে রামু দাস। বাপ মললি সে কি কান্না!" মাথা নাড়তে নাড়তে বলে আদিত্য বড়াল।
" রামু কান্দবে না? ও যে টোটো চালায়ে খায়। ও তো শিক্ষিতে না। তাই বাবারে হারায়ে দুদিন টানা কান্দিছেল।" আদিত্যকে সমর্থন করে ক্ষীরোদ মিস্তিরি।
গ্রামের মাঝ বরাবর স্কুলটা, প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের বাড়িগুলো সব উত্তর পোঁতায়,দক্ষিণে মাঠ।মাঠ শেষ হলেই চায়ের দোকান।তারপর বিশ্বনাথের বাড়ি।মাঝখানে উঠান। গাঁয়ের বেশির ভাগ মানুষ চাষাভুষো। কেউ সই করতে জানে,কেউ টিপ ছাপ দিতে, আবার কেউ কেউ এ স্কুলে টু-থ্রি পর্যন্তও পড়েছে। উপস্থিতের মধ্যে একমাত্র চায়ের দোকানদার বিশ্বনাথ স্কুলের শেষ ধাপে পা রাখতে পেরেছে। কিন্তু অন্য স্কুলে ভর্তি হয়নি। সে দারিদ্রের কারণে হোক বা হাইস্কুল সাড়ে পাঁচ কিমি দূরের জন্য হোক। তার দোকানের কোনো রকম বিতর্কে সে কান দেয় না। কান দিয়ে একবার তার নিজের হাতে কান মলেছিল।তাই ওতে আর সে নেই। জানে,তর্কে অংশ নিলে,মতামত জানালে কারো গোসা হতে পারে --- হয়েও ছিল একবার। তাতে খরিদ্দারও কমে গিয়েছিল মাস দুয়েক। তারপর কোনোমতে জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগী, ক্ষীরোদ মিস্ত্রি, পরিমল সামন্তের হাতে-পায়ে ধরে মিটিয়েছিল। সেই নিজের হাতে কান মলেছে! তারপর থেকে কেউ কোনো মতামত চাইলে শুধু মুচকি মুচকি হাসে কিন্তু মুখ খোলে না।
যাদের নিয়ে আলোচনা তারা এ গ্রামেরই বাসিন্দা --- সজল দে,তার দুই ছেলে ও স্ত্রী। এদের বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে।যেখানে কদমতলা গ্রাম শেষ হয়ে সরকারি ম্যাপে কলাগাছি গ্রাম শুরু হয়েছে, সেই শুরুতেই প্রায় সজল দের বাড়ি। আর্থিক দিক থেকে সজল দে স্বচ্ছল। অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়নি কোনো দিন। গাঁয়ের অন্যান্য মানুষেরা যেখানে দিন আনা দিন খাওয়া না হলেও দারিদ্র্যতার মধ্যে বাস করে, সেখানে সাত কিমি দূরে নেতাজি-বাজারে সজল দের হার্ডওয়্যারের দোকান। প্রতিদিন দু'-দু' চারবার মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন। গাঁয়ের চাষি-মজুরদের সঙ্গে পারত পক্ষে তেমন মেশেন না। সময় পান না বা দরকার পড়ে না বলে। তাই বলে তিনি উন্নাসিক নন। স্ত্রী সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ। সাহিত্য ভালোবাসেন। সেই সঙ্গে একটু-আধটু রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করেন। যদিও কণ্ঠ গানের উপযুক্ত নয়, তবু গানের প্রতি প্রাণের টান আছে। তিনি একটাই আফসোস করেন জীবনে যে, ভগবান তাকে গানের গলা দেননি!
এই জন্য নিজের ইচ্ছা ছেলেদের দিয়ে মেটাতে চান। বড়ো ছেলের কণ্ঠ ভালো, কিন্তু গানের প্রতি তেমন ঝোঁক নেই। বরং অঙ্কের প্রতি ভালোবাসা আছে। সারা দিন নানা ধরনের অঙ্ক কষতে ভালোবাসে। জীবনাচরণ সম্পর্কে মায়ের আদর্শ আছে ছেলের মধ্যে। ছোট ছেলে এখনও ছাত্র। এর গলা ভালো না হলেও খারাপ নয়। গানের প্রতি খুব আগ্রহ বা খুব যে অবহেলা তা নয়। খেয়াল খুশিতে গান করে।
দুই ভাই-ই প্রথম থেকে ভালো স্কুলে পড়ে। ভালো স্কুল মানে তো বেসরকারি স্কুল। সেখানেই। গাঁয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো দিন যায়নি। বছর আড়াই হল বড়ো ছেলে কার্তিক স্কুল মাস্টার হয়ে আঠারো-কুড়ি কিমি দূরের এক স্কুলে যোগদান করেছে। মোটরবাইকে যায়-আসে। একদিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে দেখে মা বুকের যন্ত্রণায় ছটফট করছে। বাবা দোকানে, ভাই টিউশনে। তাড়াতাড়ি বাবাকে ডেকে গাড়িতে করে হসপিটালে নিয়ে গেল। কিন্তু চেষ্টার ফল পেল না।
মাস্টারের মায়ের শ্রাদ্ধের দিন উপস্থিত হলে,গাঁয়ের লোক ভেবেছিল মাতৃশ্রাদ্ধে কার্তিক মাস্টার গাঁয়ের সকলকে নিমন্ত্রণ করবে। কিন্তু ওদিক থেকে যখন কেউ এল না অথচ দিন ঘনিয়ে এল তখন গ্রামবাসী অবাক হলো। পালাপার্বণ, শ্রাদ্ধ, বিয়েতে এই সমাজের মানুষেরা অপেক্ষাকৃত অর্থবানের কাছে নিমন্ত্রণ আশা করে থাকে। সে আশা ভঙ্গ হলে একটু ক্ষোভ জন্মে বইকি!
চৈত্রমাস গ্রাম বাংলার কর্মহীনতার দিন। ধান রোয়ার পর কাজ থাকে না তেমন। সর্ষে পাকতেও দেরি থাকে। তাই এমন দিনে বিশ্বনাথের চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে দিতে সকলে সমালোচনা করতে থাকে।
" শিক্ষিতে হলে কি মনের দয়ামায়া কমে যায় নাকি আদিত্যমামা? " --- আড্ডায় সবচেয়ে অল্প বয়স্ক রাজু হালদার জিজ্ঞেস করল।
" গিরামে দুডো মাস্টার আছে। তুমি বলো ভাগ্নে, বাবা -- যে বাবা কোলেপিঠে,খেয়ে না খেয়ে তোদের মানুষ করল,সেই বাবা-মা মরে গেলে এই দুই মাস্টারের কিডা এক ফোঁটা চোকের জল ফেলিছে ?"
"ইডা তুমি ঠিক বলিছ বিয়াই,না সুরেশ মাস্টার, না কাত্তিক মাস্টার, কেউ এট্টু কান্দলো না! কি পাথর গো ইরা!মানষি কি ইরাম হতি পারে?"-- ক্ষীরোদ মিস্ত্রি বলল বিড়ি টানতে টানতে।
এর মধ্যে মণি হকার এসে তাড়া দিল বিশ্বনাথকে -" কী কী নেবে দাদা তাড়াতাড়ি বলো।" চায়ের দোকান,তাই টাটকা বিস্কুট প্রতিদিন লাগে,সেই কারণে একদিন বাদে বাদে মণি যাবতীয় দ্রব্য সরবরাহ করে। বিশ্বনাথ জানাল কী লাগবে। একে একে মণি দিতে থাকল-- এই নাও পাঁচশ চা, চারশো কাগজকাপ,দু'প্যাকেট ফুল বিস্কুট, দু'প্যাকেট লম্বু, নোনতা দু'প্যাকেট, সুপার চার প্যাকেট, ক্রিম বিস্কুট তিন প্যাকেট,ক্রিমরোল দু'প্যাকেট। এর মধ্যে রাজু হালদার চেঁচিয়ে বললো, কাকা ঝুরিভাজা নিও, ঝুরিভাজা।শুনে মণি ঝুরিভাজা দিল এক প্যাকেট।
মাল দিতে দিতে মণির ক্ষীরোদ মিস্ত্রির কথা কানে এল। সে বড়ো চটপটে ছেলে। এক হাতে কাজ চালাতে চালাতে অপর দিকে মুখ চালাতে পারে। তাই বিশ্বকে ক্রিমরোলের প্যাকেট দিতে দিতে বলল, " তা না হলে আর শিক্ষিত বলেছে কেন? গিয়ে দেখে এসো আমাদের গাঁয়ের পঞ্চায়েত কর্মাধ্যক্ষ বিপুল রায়ের বাড়ি ; এক সপ্তা আগেও ওর মাকে দেখা যেত লাঠি হাতে লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গল্প করতে। এ সপ্তাহে নেই। কেন? না মাকে দেখাশোনার ঝামেলা, তাই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে। পারবে তোমরা? পারবে না। "
"বিদ্ধাচ্ছম? সে আবার কোন ঠাউরের আচ্ছম হে মণি ?" জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগীর কৌতূহল জেগে ওঠে।
"বৃদ্ধাশ্রম ; বৃদ্ধাশ্রম। যেখানে লোকে বাবা-মাকে বুড়ো হয়ে গেলে রেখে আসে --- বিনিময়ে সেখানে মাসে মাসে খাওয়া-থাকার একটা টাকা দিতে হয়। ছ'মাসে-ন'মাসে একবার গিয়ে দেখল কি দেখল না। ওভাবেই থাকতে থাকতে একদিন পটল তোলে --- ল্যাঠা চোকে! "
সকলে আশ্চর্য হয়ে যায় মণির কথায়। এমনও হয় নাকি! বুড়ো হয়ে গেল বলে বাবা-মাকে আশ্রমে রেখে আসতে হবে? কী নিষ্ঠুরতা গো! শিক্ষিত মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয়!
"মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছে, ততই বুনো হচ্ছে দেখছি"। বিশ্ব মন্তব্য করে আস্তে আস্তে।
এখনও বহু দোকানে যেতে হবে। তাই শশব্যস্ত হয়ে টাকার হিসাব বুঝে নিয়ে সাইকেলে চাপে মণি। মুহূর্তে আড়ালে চলে যায়।
চায়ের দোকান আবার কার্তিক মাস্টারকে নিয়ে মশগুল হয়।
"লোকটা মানুষ তো নাকি? " যেন বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করল রবীন গোলদার।
"কমিনিস। কমিনিসরা নাকি ছিরাদ্দ করে না। পুজো করে না। ঠাউর মানে না। কাত্তিক মাস্টার রাজনীতি করে না এখন? "-- রাজু তথ্য দেয়।
"কামিয়ে নিস? সে আবার কোন ধর্ম রে খুকা।" ক্ষীরোদ মিস্ত্রি অবাক হন।
" কমিনিস--- মানে ছিপিএম।" রাজু শুধরে দেয়।
" তা ছিপিএম বললি হয়, কামিয়ে নিস বলার কি দরকার?" আদিত্য বড়াল বলেন। অত ঘোরপ্যাঁচ পছন্দ হয় না।
" সে সব বড়ো মাথার লোকের কথা, আমি কি জানি? শুনিছি তাই বললাম। " রাজু যেন একটু অখুশি হয়।
"ছিরাদ্দ করে না বলছো, ; কিন্তু ছিরাদ্দ যে হইছে শুনলাম। মাস্টারের মা'র ছবি আর কোন ঠাউরির ছবিতে মালা ঝুলোয়ে, ধুপকাঠি দিয়ে,দই মিষ্টি দিয়ে? "
" হ্যাঁ, আমিও তো তাই শুনলাম গুপাল ভাডি। মন্তরও পড়িছে --- ঠিক মন্তর না --- বিরাম্মণ তো ছেল না। কাত্তিক মাস্টার, ওর ভাই আর বাপ মিলে নাকি মন্তর পড়িছে। "
"আহা, মন্তর না রবীনদা, গান। গান গাইছেল। বাপ-বিটা মিলে নাকি গান গাইছিল।"
জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগী আশ্চর্য হন,"বিরাম্মণ,মন্তরের বদলে গান? তা কি গান গো গুপাল? এরাম ছিরাদ্দ তো বাপের জন্মে শুনিনি? গান তো হয় রামায়ণ গান, তা সে সব না! "
" তা হলি তো অশোকমামার দল যাতো গাতি। মামা গেছে? যায়নি। ওরা নিজেরা গান গায়ে ছিরাদ্দ সারিছে। "
"তা কাত্তিক মাস্টার যে গান জানে ইডা তো আমরা জানি না?"
"সব কি আর আমরা জানব? কাত্তিক মাস্টারের মা গান ভালোবাসতো, গানও গাতি পারত শুনলাম। তা আমরা কোনো দিন শুনিছি সে গান? "... গোপাল বলে।
"এ তো আচ্চয্যি ব্যাপার হচ্ছে সব " আদিত্য বড়াল বলে।
"আচ্ছা বিশ্ব তুমি কিছু শুনিচো নাকি ভাই?" ক্ষীরোদ মিস্ত্রি বলেন।
"শুনিচি, কিন্তু আমার বলা কি ঠিক হবে দাদা? "
" কেন হবে না? তুমি যা শুনিছো তা বলো। তোমার সঙ্গে কি কেউ তক্ক বাধাতি যাচ্চে ? কি গো তোমরা কিছু কও না কেন?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ বিশ্ব কও,যা শুনিছো কও। " সমস্বরে অভয় দেয় সকলে।
" দেখো কিন্তু, পরে আবার কেউ গাঁয়ের বাইরে দিয়ে হাঁটো না! "
" আরে না ভাডি না, তুমি কও। তাছাড়া তোমার দুহানে না আসলি প্যাটের ভাত যে হজম হতি চায় না? "
" কাত্তিক মাস্টারগে কোন গুরুদেবের ও তার মা'র ছবি সাজায়ে,চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, মা'র ছবিতে মালা পরায়ে সেই গুরুদেবের পাঁচ-ছয়টা গান গাইছে। ছবি দুডোয় পোনাম করিছে,সবার শেষে ধ্যান করিছে।
ধ্যান করার আগে সগলের হাতে এট্টা করে গুলাপি করবী ফুল দিয়ে জোড়হাত করতি বলিছে। তারপর যারা সেদিন ছেল ওহনি,তাগে নাকি কাঁচাগোল্লা খাতি দেছে। মাস্টারের মা'র নাকি পিরিয়ো খাবার ছেল কাঁচাগোল্লা --- তাই "।
"এ গুরুদেবডা কিডা? অনুকূল ঠাউর? " জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগীর কৌতূহল জাগে।
"না ছাই বাবা? সেই ছাই রঙের এক ঝাঁকড়া চুল?"
রাজু বলে।
"না, ইনি রবিন্দর ঠাকুর।" বিশ্ব জানায়।
এঁরা ঠিকই শুনেছেন। বেঁচে থাকতেই কার্তিক মাস্টারের মা একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন তিনি তার মৃত্যুর পর আড়ম্বরপূর্ণ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হোক তা চান না, বরং সেদিন বাড়ির সকলে মিলে তার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে তাকে যেন স্মরণ করে। তাহলে তিনি শান্তি পাবেন। সেই মতো কোনো ব্রাহ্মণ না ডেকে, আড়ম্বরহীন ভাবে মাস্টারেরা দুই ভাই তাদের মাকে এবং সজল দে তার স্ত্রীকে স্মরণ করেন।
সকলে আশ্চর্য হয় এমন নতুন ঠাকুরের নাম শুনে। একজন জিজ্ঞেস করে " এ আবার কোন ঠাউর গো বিশ্ব? কত ঠাউরির নাম শুনিচি, এ ঠাউরির নাম তো শুনি নাই।"
"কোনো নতুন ঠাউর হবে হয়তো, কিন্তু এ নাম তো শুনা মনে হচ্ছে না। " মাথা নাড়তে নাড়তে ক্ষীরোদ মিস্ত্রিও বলেন।
"এ ঠাকুর বই লেখতো। আমাগে ইস্কুলের সহজপাঠ লিখিছিল,আমরা স্কুলে পড়িছি। এই লম্বা --- আর এক মুখ দাড়ি। বাউলগে মতো জামা গায় দেয়। ঠিক যেন সন্ন্যেসি। শম্ভু মাস্টার বলিছিল জগতের সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার পাইছে উনি বই লেহে। এমন কেউ আর পায়নি আমাগে দেশে।"
"তাহলি তো খুব বড়ো ঠাকুর মানতি হয়।" বিজ্ঞের মতো বলে আদিত্য বড়াল। অনেকেই মাথা দোলায় তার কথায়।
"কিন্তু কাকা, ছিরাদ্দ বলে এট্টা কতা আছে তো, চাল খরচের ব্যাপার থায়ে.... সে সব তো কিছুই কল্ল না.... মনের মধ্যি একটা কিন্তু কিন্তু থায়ে যায় না? "
"ইডা আমারও যে মনে হইনি তা নয়।" সমর বিশ্বাস এতক্ষণে রাজুকে সমর্থন করে বলে। লোকটা এমনিতে চুপচাপ থাকে, কেউ কিছু বললে তার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলে, নিজের থেকে তেমন কিছু বলে না।
"দেহ রাজু, এট্টা মানুষ মরে গেল,আর সেই উদ্দেশ্যে সগলে যায়ে প্যাটভরে খায়ে আসল এডাতেও তো এট্টা কিন্তু কিন্তু করা উচিৎ? আমরা ইডা করি সত্যি, কিন্তু এহানেও অনেকের মনে কিন্তু কিন্তু হয়। আর অত বড় ঠাউররে পুজো দিয়ে যহন ছিরাদ্দ করিছে তহন আমরা আর কী বলতি পারি? " গোপাল বিশ্বাস জানায়।
"তা ঠিক বলিছ গুপাল ভাডি। মাস্টার আমাগে চাইয়ে জ্ঞানী মানুষ, তারও তো মা, সে যা ভালো বুঝিছে তা করিছে, আমাগে এ নিয়ে এত মাথা ঘামানি ঠিক না কি কও? "
"সব মানে নিলাম বিয়াই, কিন্তু মরা বাবা-মা'র জন্যি এট্টু চোকের জল পড়ল না ইডা মানতি পারলাম না।" আদিত্য বড়াল সিদ্ধান্ত জানান।
"মানুষ লিখাপড়া করলি এট্টু ভদ্দর হয়, আর ভদ্দর লোকেরা আমাগে মতো হাউমাউ করে কান্দে না। উরা মনে মনে দুঃখ জানায়। "
"আচ্ছা বিশ্ব, একবার এই ঠাউররে আমাগে গিরামে ডাকলি হয় না? আমরা এট্টু দেকতাম কিরাম ঠাউর? " ক্ষীরোদ মিস্ত্রী বলেন।
"আমরা না হয় ঠাউররে নিয়ে একদিন হরিসভা কত্তাম?" জ্ঞানেন্দ্র বৈরাগী বলেন।
"সিডা তো আমি বলতি পারব না কাকা। তাছাড়া উনি এত বড়ো ঠাউর, আমাগে এহানে কি আসবে? আর আমি জানিই না কহানে থাকে উনি। কাত্তিক মাস্টার বলতি পারবে হয়তো। "
"হ্যাঁ, কাত্তিক মাস্টারই বলতি পারবে। ওগে সাথে যুগাযোগ আছে। ওরা পুজো করে..... " আদিত্য বড়াল বলেন।
"তালি বিশ্ব, তুমি কাত্তিক মাস্টারের সাথে যুগাযোগ করে শুনে নিও? যদি আসতি রাজি হয় আমাগে গিরামে, আর যদি কিছু টাকা-পয়সা দরকার হয়, আমরা না হয় সগলে মিলে চান্দা তুলে দিবানি।"
"হ্যাঁ,সব ঠাকুরই তো টাকার ভক্ত, দরকার হলি আমরা চান্দা দেব।" রাজু হালদার সমর্থন করে ক্ষীরোদ মিস্তিরিকে।
"তাহলি ওই কতা থাকল বিশ্ব, তুমি যুগাযোগ করে নিয়ে আসবা ঠাউররে।" সকলে সিদ্ধান্ত জানায় এক বাক্য।
বিশ্ব চায়ের জলে চিনি ফেলে নাড়তে নাড়তে মনে করতে থাকে সেই রবিন্দর ঠাকুরকে,একমাত্র যাঁর বই সে পড়েছে। মনে পড়ে তার প্রিয় কবিতাটা-
" ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি
আছে আমাদের পাড়াখানি।"