কয়েক কিউবিক সেন্টিমিটার স্টিম, সেফ্টি ভালভের ছোট্ট ছেঁদার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে অর্কেস্ট্রার মতো শব্দ করে তিন কিলোমিটার দূরে বিজনের কানে মিনিট পাঁচেক ধরে কাঁচা খিস্তি করে বাতাসে মিশে ভুটানের দিকে চলে যায়।
বিজন বিছানাতে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত দেখছিল, আর সিমির হাজারো বকবকানি শুনছিল।
—বাবা তুমি আজকে অফিসে কী কাজ করেছ?
—ট্রান্সফর্মার সারিয়েছি।
—ট্রান্সফর্মার সারালে নোবেল পুরস্কার দেয়?
তাপু খাবার বাড়তে বাড়তে বলল— তোমার বাবাকে দেবে। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সকাল আটটায় বেরিয়ে রাত ন’টায় ফিরলে পাওয়া তো উচিত।
আজ সন্ধ্যায় শ্রমিক মঙ্গল কেন্দ্রে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার অনুষ্ঠান ছিল। যেতে না পারার জন্য তাপু সন্ধে থেকেই ফুটছিল। বিজন বলল— তুমি একটা রিকশা ধরেই চলে যেতে পারতে।
—খরগোশের গর্তের মধ্যে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাজে কথা বোলো না তো। এক মাস আগে থেকে তোমার জানা আছে।
—মা, তুমি মানুষ না খরগোশ?
—চোপ। রাগে চেঁচিয়ে উঠে তাপুর হাতাটা ভাতের হাঁড়িকে পিটিয়ে দেয়।
—আমি খরগোশের পা খাই। বুক খাই। আমি তোমাকে খাব।
—তুমি আমার গোটাটাই খেয়ে ফেলেছ। আর বাকি কী রেখেছ। সিজার হবার পর থেকেই তো আমার শরীরের বারোটা। বসলে উঠতে পারি না। আমাকে অনেক খেয়েছ, এবার তোমরা দুজনে আমাকে একটু শান্তি দাও।
সারাদিন শান্তিতে ফাইল ওয়ার্ক করে বাড়ি ফেরার ঠিক মুখে টু-টোয়েন্টির লাইটিং বাস্-টাতে গোলমাল। কেউ কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে তাকে এসে ধরল। ডিপার্টমেন্টাল হেড রায়দা বললেন— তুই দেখে দিয়ে আয়। আমার একটা কাজ আছে, এগোচ্ছি।
বিজন খুঁজতে থাকে।
কে যেন তার কানে ফিসফিসিয়ে দুষ্টুমি করে বলে— আমার ন্যাংটোপুটোতে কী হয়েছে তা একটু দেখে দেবে?
বিজন কি অন্যমনস্ক ছিল? কিছু দিন আগে সিমি তাকে এই কথাটা বলেছিল। যতই নিজের সন্তান হোক একটা মেয়ের যৌনাঙ্গে কী হয়েছে তা দেখতে একটা ছেলে হিসেবে তার অস্বস্তি হয়। সে বলেছিল— যাও, মায়ের কাছে যাও।
সিমি জেদি গলায় বলেছিল— না, আমি মাকে দেখাব না। খুব কুটকুট করছে, তুমি চুলকে দাও।
বাধ্য হয়ে প্যান্ট খুলে দেখেছিল। ছোটখাটো কোনো ইনফেকশান। ডাক্তার দেখিয়ে ক্রিমও লাগিয়ে দিয়েছিল। প্ল্যান্টে এখন কথাটা কে বলবে? সে অবাক চোখে একবার পাশে দাঁড়ানো বণিকবাবুর দিকে তাকায়। তখনই কে যেন আধো-আধো গলায় আবার বলল— আমার প্যান্টটা খুলে একবার দেখে দাও না।
কী মনে হতে বিজন টেকনিশিয়ানের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে তার সামনে পড়ে থাকা তারের ইনসুলেশান খুলে ফেলে। ভেতরে তারটা ভেঙে দু'টুকরো। গম্ভীর হয়ে তারটা জুড়ে দিয়ে ব্ল্যাক টেপের কাপড় পরিয়ে দিতে সব ঠিকঠাক। তার টেকনিশিয়ানরা আড়ালে বলাবলি করে— দেখলি কেমন কাজ জানা লোক! একবার সবটা দেখে ঠিক যেখানে ভাঙা তার আধ ইঞ্চি আগে পরে কেটে বের করে দিলেন।
সেফটির শব্দটা শুনে বিজন বলল— শালা, আবার কোনটা ট্রিপ করল কে জানে?
—কী ট্রিপ করল বাবা?
—তিন নম্বর ইউনিট।
—তিন নম্বর ইউনিট ট্রিপ করলে খুব জোরে শব্দ হয়?
—সব ইউনিট ট্রিপ করলে শব্দ হয়। ট্রিপ করলে বয়লারের প্রেসার বেড়ে যায়। তখন সেই বেশি প্রেসারের স্টিম সেফ্টি ভালভ দিয়ে বাতাসে মিশে গেলে প্রেসার আবার কমে আসে।
—প্রেসার বেড়ে গেলে বয়লার দাদুভাইয়ের মতো প্রেসারের ওষুধ খায় না কেন বাবা? দাদুভাই তো স্টিম ছাড়ে না।
তাপু বলে—পাকা পাকা কথা বলা বন্ধ করে খাবে এসো। তিন বছরের মেয়ে, অথচ দেখো চব্বিশ ঘণ্টা কথার খই ফুটছে।
—আমি কী পাকা কথা বলেছি, শালা?
তাপু প্রচণ্ড রাগে সিমির গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। —কতবার তোকে বলেছি ওইসব বাজে কথা বলবি না।
—শালা। শালা। সিমি বিজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে— শালা।
—তোমার জন্যে মেয়েটা নষ্ট হবে। তাপু সেফ্টি ভালভের চেয়ে জোরে ফেটে পড়ে।
—কতবার তোমাকে বলেছি কারখানার কথা, কোনো আজেবাজে শব্দ মেয়ের সামনে বলবে না।
সকালে কাজ কিছু কম ছিল। মোটামুটি আড্ডার পরিবেশ। মেনটেনেন্স ডিপার্টমেন্টের এই একটা সুবিধা। যখন কাজ নেই তখন তুমি কী করলে দেখার কেউ নেই। যদিও কোনো কিছু বিগড়ালে সবাই মিলে হামলে পড়বে। তখন কাজ কী ভাবে তাড়াতাড়ি হবে তার চেয়ে আগে যে প্রশ্ন উঠবে তা হল কার জন্য এমন হল। একটাকে শিখণ্ডী খাড়া করতে পারলে নিশ্চিন্ত। বেটাকে পাকড়াও করে বল কেন এমন হল। সে যদি অন্যের ঘাড়ে দোষ ঝেড়ে ফেলতে পারে তাহলে ভাল, নইলে তার কাজ কেন এমন হল, তার ব্যাখ্যা দেওয়া। বোবা যন্ত্রগুলোর ঘাড়ে দোষ ঝেড়ে ফেলতে পারলে সবার মঙ্গল, নইলে যন্ত্রযুগের নিয়ম মতো শোকজ, সাসপেন্ড, অর্ধেক মাইনে, চাকরি নিয়েও টানাটানি লাগতে পারে।
এই রকম ফাঁকা সকালে সবাই লম্বু অসিতের পেছনে লাগে। সুযোগ পেলে শুয়ে পড়ার অভ্যাসের জন্য তার নামই হয়ে যায় হরাইজেন্টাল অসিত।
সমরেশ বলে— অসিতদা তোমার সেই বিখ্যাত কাজ না করার থিয়োরিটা আমাদের একবার বলো না।
—কী যে বলিস সাহেবের সামনে। অসিতের মুখ দেখে মনে হয় যেন সে অস্বস্তিতে পড়েছে।
যদিও বিজনের সাথে সবার সম্পর্ক ঠিক অফিসার কর্মীর নয়, অনেকটা ভাই-বন্ধুর মতো। তবুও অসিত লজ্জা পায়, নিজের কাজ জানা বসকে সম্মান জানায়। বিজন হেসে বলেছিল— আমাকে কি আপনার সাহেব বলে মনে হয়? দুর্গাপুজোর চাঁদা যিনি চাইতে গেছিলেন তাঁর কিন্তু মনে হয়নি।
ওই পুজোর সেক্রেটারি হিসেবে অসিত আবার লজ্জা পায়। আসলে বেঁটেখাটো রোগা চেহারার বিজন-সাহেবকে খালি গায়ে দেখে মন্টু বলেছিল— সাহেবকে ডেকে দাও।
উনি বলেন— আমিই সাহেব।
মন্টু বলেছিল— ইয়ার্কি মারার জায়গা পাচ্ছ না।
ওর বিশ্বাসই হয়নি কারণ সাহেবের আর এক অভ্যেস দমে বিড়ি খাওয়া। শুনে সাহেব ঘরে ঢুকে জামাপ্যান্ট পড়ে এসে বলেছিলেন— এবার বলুন কী বলছিলেন। সে এক কেলেঙ্কারি। যাই হোক, পরে মন্টু আর অসিত ক্ষমা চেয়ে এসেছিল। সাহেবের কথা শুনে অসিত মাথাটা মাটির দিকে নিচু করে লাজুক হেসে বলে— এটা স্যার আমার সারা জীবনের লজ্জা হয়ে গেল।
—আরে না না, এটা কোনো ঘটনাই নয়। বিজন হেসে ফেলে —বাজারে পর্যন্ত আমাকে ঠিকঠাক পাত্তা দেয় না। কি করে আর একটু সাহেব হওয়া যায় সেটা আমাকে এবার শিখে ফেলতে হবে। নইলে পদে পদে এত সব বিদঘুটে ব্রেকডাউন হচ্ছে, আর পারা যায় না। সে যাক। আপনার গল্পটা শুনি।
—এটা বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখন আমি সি-এন-আই ডিপার্টমেন্টে। বোস-সাহেব, আমি আর অচিন্ত্য কাজে গেছি ফাইভ বাই ওয়ান কোল ফিডারে। তখন ইউনিটগুলো নতুন এসেছে। কেউ কিছু জানি না। অচিন্ত্য বলল— বোসদা এটা করে দেব? বোস-সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন— কি অসিতবাবু, করবে? আমি আর কী বলি, বললাম— আপনি সাহেব, আপনি যদি বলেন করবে। বোস-সাহেব তখন বললেন— যা হবার হবে, করে দাও অচিন্ত্য। অচিন্ত্য যেই হাত দিয়েছে, বাম্ করে ড্রাইভারটা খুলে গেছে। মোটরে আগুন লেগে গেছে। ভয়ে অচিন্ত্য ছ’নম্বরের দিক থেকে ঘুরে ছুট, পেছনে পেছনে আমিও। কোনো রকমে ঘরে এসে দেখি বোস-সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। মানে আমাদের আগে ছুট দিয়েছে! তখন এম-ডি বটুকেশ্বর সাহেবের খুব দাপট— একে চার্জশিট দিচ্ছে, ওকে ধমক। বোসসাহেব তো ভয়ে কাঁপছে। আর কপাল এমন যে ঠিক সেই সময়ে এম-ডি সাহেব প্ল্যান্টে ঢুকেছেন। জি-এম ফোন করেছেন শিফটচার্জকে। দত্ত-সাহেবও বলে দিয়েছেন, স্যার ওখানে ইনস্ট্রুমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কাজ করছিল। সবাই খোঁজ খোঁজ করে আমাদের পেছনেই পড়ে আছে। বোস-সাহেব তখন কেঁদে ফেলেছে। বলছে— কী হবে অসিতবাবু? আমি আর কী বলব, আমি বললাম— আপনি সাহেব, আপনি যদি কিছু না জেনে কাজ করেন তাহলে এরকমই হবে। বোস-সাহেব তখন কাঁদতে কাঁদতে বলছে— আমি ওই মোটরের দাম দিয়ে দেব। কত দাম হবে বলুন তো, হাজার তিরিশেক? তত ক্ষণে সবাই জেনে গেছে কোন তিনজন ছিল। এম-ডি বললেন ডাকো ওদের তিনজনকে। আমি বললাম— আপনারা সাহেব। পেটেও কিছু বিদ্যে আছে। একটা চাকরি চলে গেলে আর একটা জুটিয়ে দিতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু এই পুজোর ঠিক আগে আমার যদি চাকরি যায় তবে আমি কী করব বলুন তো? বাড়িতে মুখ দেখাতে পারব না। সে এক ফ্যাসাদ। তত ক্ষণে ডিপার্টমেন্টে ছোটাছুটি পড়ে গেছে। ব্যানার্জি-সাহেব এসে বললেন— আপনারা আমার ঘরে বসুন। আমি দেখছি কী করা যায়। বোস সাহেব কাঁদছে আর বলছে— আমি মোটরের দাম দিয়ে দেব। কিছু ক্ষণ পর ব্যানার্জি-সাহেব এসে বললেন ভয়ের কিছু নেই, আমি ম্যানেজ করে দিয়েছি। সেই থেকে আমি বলি, দেখ ভাই কাজ করতে না পারো ঠিক আছে। বলবে পেটে ব্যথা হয়েছে স্যার, উঠতে পারছি না। কিন্তু কখনো ভুল কাজ করবে না। চুপচাপ বসে থাকো, কেউ তোমায় কিছু বলবে না। কাজ করেছ কি মরেছ।
বিজন বলে—এই জন্যই তো এত রকম স্কিম। গোল্ডেন হ্যান্ডশেক প্লাটিনাম রিটায়ারমেন্ট, প্রাইভেটাইজেশন, গ্লোবালাইজেশন। কাজ করতেই হবে। না হলে যেভাবে বয়লার মেনটেনেন্স ডিপার্টমেন্ট তুলে দিয়ে কন্ট্রাক্টরকে অ্যানুয়াল মেনটেনেন্স কন্ট্রাক্ট বা এএমসি দেওয়া হয়েছে তেমনি আমাদেরটাও উঠে যাবে। কাজ সবাই পাব, কন্ট্রাক্টরের আন্ডারে। মাইনে ইচ্ছা হলে দেবে, না পোষালে বাড়ি যাও।
সমরেশ বলে—কাজ না করার জন্য যদি কোনো দিন নোবেল পুরস্কার চালু হয়, অসিতদাই প্রথম পাবে।
কেউ বলে— এখন তাহলে অসিতদাকে একটা ভাল লকার বানাতে হবে। কবে আবার চুরি হয়ে যাবে কিছু বলা তো যায় না।
—অসিতদা ওই নিয়ে চিন্তা করে মনখারাপ করে লাভ নেই। এখন চাইলে রেপ্লিকা পাওয়া যায়।
তবে যতই বিশ্বায়নের কথা বলুক, বিজন ভাবে অসিতবাবুর থিয়োরি মতো ও কি কাজ করে মরল? তার যাবতীয় সুনাম এই কাজকে ঘিরে। অন্যদের মতো সে তার কাজের প্রচার সেভাবে করতে পারল না। নিজের ডিপার্টমেন্টের ভেতর সবাই জানলেও সেভাবে তার নাম ওপর দিকে আলোচনায় উঠে আসে না। কাজ না করে কত জন শুধু প্রচার দিয়ে তরতরিয়ে উঠছে। কাজ করেও সে বয়লারের মতো এক জায়গাতে শেকড় গেড়ে বসে আছে।
অ্যাভোমিটার আর স্ক্রু-ড্রাইভার এর বাইরে সে আর কিছুই করতে পারল না। তারের ভেতর দিয়ে ছুটে চলা অদৃশ্য বিদ্যুৎকেই সে ভাল বোঝে। রিলে প্যানেলগুলোর পেছনে কাজ করতে করতে হঠাৎ একদিন শোনে—এই যে, আমি এখানে।
পাশে কাজ করতে থাকা সমরেশকে জিজ্ঞেস করে— তুমি কিছু শুনতে পেলে সমরেশ?
—৭২০ কুড়ি নম্বর রিলেটা অপরেট করল বিজনদা।
বিজন প্যানেলগুলোর চার দিকটা দেখে আসে। গলাটা সিমির মতো। বিজনকে চিন্তিত দেখে সমরেশ বলে— আপনার কি শরীর খারাপ, বিজনদা? আপনি যান না, বিশ্রাম নিন। আমি ততক্ষণ চেষ্টা করে দেখছি। আপনি যেভাবে এগোচ্ছেন, এভাবেই।
সকাল থেকে ব্রেকডাউনটা নিয়ে সে লড়ছে। সমস্যাটা ধরতে না পারার জন্য তার ভেতরে ভেতরে রাগী জেদ তৈরি হচ্ছিল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সে শুধু বলল— হুঁ।
সে বাড়িতে ফোন করে। তাপু অবাক উদ্বেগে প্রশ্ন করে— কী ব্যাপার! তুমি ভাল আছ তো? দুপুরের খাবার পৌঁছায়নি?
কোনো কারণ ছাড়া ফোন করেছে শুনে তাপু আনন্দে চিৎকার করে ওঠে— সিমি? বাবা।
সিমি কার্টুন নেটওয়ার্ক ছেড়ে তার সাথে অনেক ক্ষণ গল্প করে। সে বলে— বাবা আমি ঘুম থেকে উঠে বেতাল দেখছি।
—কোন বেতাল সিমিসোনা?
—তুমি দেখনি? কার্টুন নেটওয়ার্কে দেখায়। লম্বা ধোঁয়ার লেজ আছে। উড়ে উড়ে আকাশ দিয়ে যায়।
ফোনটা নামিয়ে রাখার আগে সিমি বলে— বাবা আজকে তুমি মনে করে আমার জন্যে একটা জিনিস নিয়ে আসবে? তুমি শুধু ভুলে যাও।
—আজকে আর ভুলব না। কী জিনিস গো? একটা সুন্দর পুতুল?
—না। পুতুল আমি নেব না। আমি একটা ট্রান্সফর্মার নেব।
বিজন এমন অদ্ভুত বায়নাতে হেসে ফেলে— ট্রান্সফর্মার নিয়ে কী হবে?
—আমি খেলব। একটা দাও না বাবা।
সিমিকে বুঝিয়ে ফোন রেখে সে প্যানেলের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। কোনো অস্বাভাবিক শব্দ নেই। সিমির কথা তার অবচেতন মনে পড়েছিল ভেবে যেই এগোতে যাবে তখনই আবার কে লুকোচুরি খেলার মতো বলল— টুক্। আমাকে দেখতে পায়নি। আমি এখানে।
বিজন প্যানেলের চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে। তার খোঁজার ধরন দেখে সমরেশ জিজ্ঞেস করে— বিজনদা আপনার কিছু কি হারিয়ে গেছে?
বিজন অন্যমনস্কের মতো জবাব দেয়— না, দেখছি।
দিনরাত প্ল্যান্ট প্ল্যান্ট করে মাথাটা গেছে ভেবে সমরেশ ঘাঁটায় না। সোনা বা টিএনটি, যা খোঁজে খুঁজুক। ক্ষেপা পরশপাথরও খুঁজে পেতে পারে।
যন্ত্রপাতি ছেড়ে বিজন প্যানেলের চারদিকে শুধু কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে করে যায়। সন্ধের কিছু আগে সে কিছু যেন খুঁজে পায়। ব্রেকডাউনটাও ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মেরামত করে ফেলে। সেদিন থেকে যন্ত্রপাতিগুলোর সাথে বিজনের ভাব গাঢ় হয়। একটু মনোযোগ দিয়ে খুঁজলে তারা সাড়া দেয়। খেয়ালখুশি মতো দুষ্টুমি করলে তার মতো এতো ভালভাবে কেউ বুঝিয়েসুঝিয়ে শান্ত করতে পারে না। বিদ্যুতের এই ছোট ছোট দুষ্টুমি তার ভীষণ ভাল লাগে, যেমন ভাল লাগে বাড়ি ফিরে সিমির মিঠেকড়া ব্যবহার।
ওই ঘটনার পর ডিপার্টমেন্টের বাইরেও কাজের লোক বলে আর অল্পবিস্তর পরিচিত জোটে। ফলে বাড়িতে ফিরতে তার রোজ একটু একটু করে দেরি হয়ে যায়। সন্ধে হয়, রাত হয়। দিন দিন সে বাড়ির বাইরের লোক হয়ে যায়। প্রথম ছেড়েছিল বাজার করা। তাপু হাসিমুখেই বাজার করে নিয়ে আসে। তাছাড়া মাসিক চুক্তিতে লোক রাখা আছে যে রোজ বিকেলে এসে খোঁজ নিয়ে যায়। সিগারেট, শাকসবজি থেকে শুরু করে টুকটাক যা লাগে কিনে দিয়ে যায়। এরপর বন্ধ হয় রবিবার আশপাশের ছোটখাটো রেস্তোরাঁতে খেয়ে আসা। ক্রমশ বন্ধ হয়ে যায় মেয়ের জন্য সময় দেওয়া। তবে অফিসে সে এই প্রতিযোগিতার মধ্যে দু-একটা প্রোমোশন পেয়ে গেছে। বিশ্বায়ন, স্বেচ্ছাবসরের এই সময়ে তার মত কমবয়সি চটপটে যোগ্য অফিসাররা প্ল্যান্টে বেশ দ্রুত প্রোমোশন পেয়ে যাচ্ছে। অফিসে ছাঁটাই হবার ভয়ে সে বাড়ি থেকে ক্রমশ ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে।
সিমিকে মারলে ও নিজে ভীষণ আহত হয়। কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে মেয়েটা অভিমানে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বিজন হেরে যাবার মতো অসহায় বোধ করে। আগে তাপু সিমিকে বকলে বিজন চাপা রাগে গরগর করতে করতে তিন দিন কথা বলা বন্ধ রাখত। এখন সে কিছু বললে তাপু চেঁচিয়ে ওঠে—মেয়েকে তুমি পাঁচ মিনিট দেখার সময় পাও? চব্বিশ ঘণ্টার কতক্ষণ তুমি বাড়িতে থাক? মেয়ের খাওয়া, পরা, পড়ানো, ঘুম পাড়ানো এর কোনোটাতেই তোমাকে পাওয়া যাবে না, শুধু শাসন করলে তোমার মাথাব্যথা বেড়ে ওঠে।
সিমি এসব না জেনে কাঁদতে কাঁদতে বলে— মাকে তুমি বকে দাও তো বাবা।
সিক্স কেভি সার্কিট ব্রেকার ফুস করে বন্ধ হবার মতো বিজন হালকা স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে— চোপ্। তুমি কেন মেরেছ সিমিকে?
—বাবা, তুমি জোরে বকো। মা তো শুনতেই পায়নি।
তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। বিজন বেঁচে যায়। সিমি ছুটতে শুরু করে— আমি আগে ফোন ধরব।
তাপু ভাত ঠান্ডা করতে দিয়ে সিমির দিকে তাকায়। —হ্যালো।...। আমি সিমি বলছি।...। বাবা! বাবা মাকে বকছে।...। এখন আমি বাবাকে ফোন দেব না।...। তুমি ধরে থাকো। আগে ভালো করে বকে নিক, তারপরে দেব।
তাপু দূর থেকে চোখ পাকিয়ে উচ্চারণ করে— সিমি।
সিমি রিসিভারটাকে ছুড়ে ফেলে। তাপু ছুটে এসে সিমির কান টেনে ধরে বলে— এটা কী হল? তোলো, ফোনটা তুলে জায়গামতো রাখো।
সিমি কাঁদতে কাঁদতে রিসিভারটা তুলে রাখে। বিজন রাগে গরগর করে— শালা এটা বাড়ি না বাজার বোঝা যায় না।
—এটা বাড়ি নয়, হোটেল। সারাদিন চরে বেড়িয়ে যখন মনে হবে এবার সেবা পাওয়া দরকার, বাধা কাজের লোকটা তো আছে, তখন ফেরার কথা মনে পড়ে। কথা না বলে ফোনটা ধরো।
কথা আবার কথা, কথা ফের কথা, কথা বারবার কথা, এভাবে মারামারি করতে বিজনের ভাল লাগে না। রাগে অপমানে বিজন গুম হয়ে ডিসিংক্রোনাইজড টারবাইনের মতো গোঁ গোঁ করে থেমে যায় শুধু সেফ্টি ভালভ থেকে স্টিম বের হবার মতো বিজনের পা-টা রাগে মেয়ের সাইকেলে লাথি মারতে গিয়ে বেঁকে গিয়ে ঠিক কাছে পড়ে থাকা মগে ধাক্কা লাগে। মগটা ছিটকে ঘরের অন্য প্রান্তে গিয়ে টিভির ওপর পড়ে। তাপু একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। বিজন ফোনটা ধরে। —হ্যাঁ বলছি।...। ট্রিপ করেছে তা আমি কী করব?...। অন্য বিএফপি চালান।...। ইউনিটের পাওয়ার দেওয়া যাচ্ছে না? পাঁচের ট্রান্সফর্মারের অটোমেটিক ভোল্টেজ বাড়াকমা হচ্ছে না সেই কথাটা বলুন। ফালতু কেন ফেনাচ্ছেন?
বিজন ওর বসকে মোবাইলে ধরে।—রায়দা, পাঁচের ট্রান্সফর্মারের ট্যাপ চেঞ্জিংয়ে নাকি প্রবলেম হচ্ছে। আইডি, এফডি, বিএফপি সব নাকি ট্রিপ করে গেছে। ইউনিট বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
—শ্রমিক মঙ্গল কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সবে শেষ হল। এখন বাড়িতে গিয়ে খেতে হবে। তুই ফোরম্যান দত্তকে সঙ্গে নিয়ে যা। কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাস। যেতে হলে বলিস। জি-এমকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। ঠিক আছে?
বিজন কিছু না বলে বলে ফোনটা নামিয়ে রাখে। শালা চিরদিন ক্ষীর খেয়ে গেল। কোনো দিন একটা স্ক্রু ড্রাইভারে হাত না ঠেকিয়েও ওপরে উঠে চলেছে। স্পেয়ার কেনা বা ইনস্পেকশন সব নিজের হাতে। মাল সব ওখানে। উনি ছাড়া আর কেউ নাকি কন্ট্রাক্টর বা সাপ্লায়ারদের ঠিকমতো টাইট দিতে পারবে না। কিছু বললে ওঁর একটাই কথা, দেখ ভাই এখানে আসা মাল কামানো, জমানো আর ভোগ করার জন্য। সেই কাজ ঠিকমতো গুছিয়ে করতে হবে। তোরা তোদের কাজ কর। বাকিটা আমি দেখছি।
টেকনিক্যাল কোনো সমস্যা নিয়ে ওঁর কাছে গেলে ওঁর একটাই কথা— তোরা ফ্রন্টলাইনের লোক। তোরাই ওইসব খুচরো জিনিসগুলো ভাল বুঝিস। কোনো স্পেয়ার লাগবে কিনা বল, আমি ম্যানেজ করছি।
ওই সব কাজ কোনোরকম টেন্ডার ছাড়াই উনি ম্যানেজ করতে পারেন। এমনকি তাদের প্রত্যেকের বাড়িটাও উনি ম্যানেজ করে ফেলেছেন। সিমির জন্য চাইনিজ ড্যান্সিং পুতুল থেকে মাউথ অগার্ন সব কিছুই যে কোনো তুচ্ছ উপলক্ষে উপহার দেন। সেগুলো কোনো কন্ট্রাক্টরের কাছ থেকে ম্যানেজ করা কিনা বিজন বুঝতে পারে না। তাই বাড়িতেও মালটাকে বিশেষ গালাগালি দেওয়া যায় না।
প্ল্যান্টের জিপ তার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
সিমি বলে—বাবা তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
—আচ্ছা আসব।
—অফিসে গিয়েই তুমি আবার বেতালের মতো উড়ে উড়ে চলে আসবে।
আচ্ছা, আমি আসব। তুমি শুয়ে পড়ো। গুডনাইট।
গাড়িতে ওঠার পর বিজনের অল্প মনখারাপ হয়। সে একটা বিড়ি ধরায়। তবে প্ল্যান্টে পৌঁছাবার পর সে বাড়ির কথা ভুলে যায়। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই সে ট্রান্সফর্মারটাকে সারিয়ে তোলে।
ইউনিটের নিজস্ব ট্রান্সফর্মারের কিছু দূরে ইলেভেন কেভি লাইনের কারেন্ট মাপার ট্রান্সফর্মার সি.টি.-টার ঘুম আসছিল না। সারা দিন রোদ্দুরে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা চার দিকের কারখানা দেখেছে, পাশের সি.টি.-টার সাথে খুনসুটি করেছে। চেঁচিয়ে বড়দা একশ বত্রিশ কেভি সি.টি.-কে ভেংচি কেটেছে। এখন সবাই নিঝুম হয়ে যেতে তার আর সময় কাটছিল না। এখন কাছাকাছি বিজনকে দেখে তার ভীষণ কোলে উঠতে ইচ্ছা করে। বিজন তাকে কোনো রকম পাত্তা না দিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে চুপচাপ বিজনকে লক্ষ্য করে সে পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সি.টি.-র ধাক্কায় বিজন মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। সি.টি.টা তার পিঠের ওপর আনন্দে লাফাতে থাকে।
কিছু দিন আগেও সিমি তার পিঠের ওপর এমনি করে দুষ্টুমি করত। বিজন মাঝে মাঝে তাকে শিখিয়ে দিত— যাও, মাকে বলে এসো এক কাপ চা দিতে।
তাপু চেঁচাত—সন্ধে থেকে তিন বার চা খাওয়া হয়ে গেছে। আর করা যাবে না।
বিজন ফিসফিসিয়ে কিছু বলার পর সিমি বলত—আর এক কাপ দাও না, প্লিজ।
এই অবস্থায় বিজনের ভীষণভাবে সিমির কথা মনে পড়ে। মেয়েটা আজ সন্ধে থেকেই কাঁদছে। সে যদি এক বার একটু সময় পেত এমনি করে শুয়ে পড়ার! এই ছুটির দিনে। সারা দিনটা অন্য রকম হতে পারত। যন্ত্রগুলোর লাফালাফি তার আর ভালো লাগে না। সিমির কথা মনে পড়তে সে বেতালের মতো উড়তে শুরু করে। সুইচ ইয়ার্ড ছাড়িয়ে কন্ট্রোলরুম, বয়লার, চিমনির মাথার ওপর দিয়ে।
মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে তাদের কোয়াটার্স। সেখান থেকে বেতালের লম্বা ধোঁয়ার লেজ দেখা যায়।
গল্পকার পরিচিতি :
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এসে কেড়ে নিয়ে গেল আমাদের প্রিয় আখ্যানকার আশোক তাঁতী-কে। না-ফেরার সেই দেশ থেকে অশোকদা আর ফিরে আসবেন না কখনও, একথা ভাবতেই কেমন দিশেহারা লাগছে। কার্যত আমাদের চারি দিকে এখন মৃত্যু মিছিল।
অশোক তাঁতীর জন্ম কলকাতায় ১৯৬৮র এপ্রিলে। আদতে সোনারপুরের বাসিন্দা। প্রথমে বিজ্ঞান, পরে প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র। চাকরি সূত্রে থাকতেন শিল্পশহর দুর্গাপুরে। সেখানে রাঢ়বঙ্গের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলেন। আক্ষরিক অর্থে তিনি ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। প্রথাবর্হিভূত অন্যধারার শক্তিশালী এই আখ্যানকারের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ঝড় ও ষাঁড় (২০১০) শীর্ষক একটি গল্পগ্রন্থ। তিনটি উপন্যাস। দালির বালিঘড়ি (২০১৯) পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক একটি সুর-রিয়ালিস্টিক উপন্যাস। পরবর্তী উপন্যাস দ্বিতীয় জন্ম । বিগত কয়েক বছর মেতেছিলেন অনলাইন ম্যাগাজিনে। আখ্যানের শৈলী ও প্রকাশরীতি নিয়ে যেমন তিনি নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, তেমনি তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের প্রকাশ মাধ্যমটাও আমূল বদলে যাবে। ব্লগজিনে লিখতেন অণুগল্প। অশোকদা যাকে বলতেন ‘ঝুরোগল্প’। কালিমাটি ওয়েবজিনে তাঁর এরকম কত ‘ঝুরোগল্প’ প্রকাশিত হয়েছে। এই অণুগল্পের সংকলন নিয়ে গড়ে উঠবে ঘর নামক বইটি।
নিমসাহিত্যের আখ্যানকারদের মতো অশোক তাঁতীরও পক্ষপাত ছিল অবিকৃত অভিজ্ঞতার প্রকাশের ওপর। নির্দিষ্ট ক্রমের কথনরীতি বা প্রথাগত আখ্যানবিন্যাস থেকে সরে এসে শিল্প-কলকারখানা, আমাদের যন্ত্রজীবনের সংকট ও তার দ্বান্দ্বিক সমগ্রতাকে নিজস্ব ভাষা-শৈলীতে আশোকদা ধরতে চেয়েছেন তাঁর কথা-সাহিত্যে। রাঢ়বঙ্গের মাটি-মানুষ, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ক্রমশ নিবিড় হয়ে উঠেছিল। সেই দায়বদ্ধতা থেকে তিনি লিখেছিলেন রাঢ় বাংলার কারখানার গল্প: বিষয়চেতনা ও নির্মাণ ( ২০০৬) শীর্ষক গবেষণাধর্মী একটি প্রবন্ধের বই। বেশ কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্মাননাসহ ব্যতিক্রমী এই আখ্যানকার পেয়েছেন তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামাঙ্কিত ‘রাইকোমল পুরস্কার’ (২০১৯)। বড়ো অকালে তাঁকে আমরা হারালাম।
বরেন্দু মণ্ডল