আলামত তখনও হুক হুক করে কোদাল দিয়ে আল কুপিয়েই যাচ্ছে। তার বাবলা ছালের মতো কুচকুচে কালো শরীরটা ঘাম লেপ্টে তেল চুকচুক করছে। এই ঘামকে আলামত বলে, ‘গতর খাটা পানি’। এ ঘামজল জমির মাটির সঙ্গে মিশে মাটিকে গেরস্তর নুন খাওয়ায়। যাতে করে জমি গেরস্তর সঙ্গে নেমখারামি না করে। এ জমি সত্যি সত্যি আলামতের নুন খেয়ে তার গুন গায়। সে গুন নাকি আলামত শুনতে পায়। জমির আলে যখন হাঁটু পেড়ে কেবলামুখী হয়ে নামাজ কায়েম করে তখন নাকি আল্লাহর ফিরিস্তা তার কানে কানে সে গুনের বেহেশতি সুর শুনিয়ে যায়। আলামত সে সুরে নিজেও ঠোঁট মেলায়। শারাফনকেও ঠোঁট মেলাতে বলে। শারাফন তখন কথা ঠেসে বলে, ‘মিনষের ঢং দেখে পারি নে! এত যখন মনে রঙ ধরেছে তখন ঢেলা-কাদাতেই গা ঢলো গা না ক্যানে?‘ আলামত তখন মাথার ফেজ টুপিটা খুলে তাতে দোয়া-কালমার ফুঁ দিয়ে বলে, ‘এ রঙ দুই জমিনেই লাগে গ। এ ঢেলা-কাদার জমিন যেমন আমার আবাদে জমিন তেমনি তোমার গা-গতরখানাও যে আমার বাতালে জমিন? ঢেলা-কাদার জমিনে যেমন ধান পাট ফলে তেমনি তোমার গা-গতরের জমিনে ব্যাটা বিটি বংশ পিরি ফলে। মনের এ রঙ মাখো বলেই তো তুমি কেয়ামতের দিনে আমার হাত ধরে বেহেশতে যাবে?‘ তারপর মুখের সুন্নত দাঁড়িতে ফজিলতের হাত বুলিয়ে আল্লাহর খুদবা পড়ে আলামত। আল্লাহ রসুলের কথা না বলে আলামত যদি এক্ষেত্রে দুনিয়াদারীর কথা বলত তাহলে তার পান খাওয়া বিড়ি খাওয়া লাল হলুদ পুকড়ে দাঁতগুলো খি খি করে উঠত।
শুধু জলের ঘড়া আর ভাত তরকারির পুঁটুলি নয় সঙ্গে একটা ধিকধিক করে জ্বলা গোবরের উকলিও(নুদা) এনেছে শারাফন। আলামত জমিতে পাই তুলবে আর পাই তোলা শেষে সে কালো খস্টে রঙের উকলির ধিকধিকে আগুনে বিড়ির মুখ ঠেকিয়ে সুৎ করে হাওয়া টেনে আগুন ধরিয়ে সুখটান দেবে। উকলিও শেষ আলামতের সে দিনকার মতো কাজও শেষ। উকলি পোড়া ছাই থেকে কষ্টে গন্ধের সুতলির মতো ফ্যানফেনে সাদা ধোঁয়াটা শাওয়া ঘাসের শিষ ছুঁয়ে কার্তিকের খরানিতে তাতা হাওয়াতে গা মেলে শারাফনের কদম পাতার মতো মুখটায় গা ঢলছে। সে গা ঢলনিতে আলামতের হিলহিলে শরীরটার ঘ্রাণ পাচ্ছে শারাফন। এ ঘ্রাণ শারাফনকে বড্ড টানে। তাকে চুল্লু খাওয়া তাড়ি খাওয়া পাগলি করে তোলে। এই দেড় কুড়ি বছরের সংসার জীবনে কি পাক কি নাপাক সব আলামতেই স্বামীর খিদমত পেয়েছে শারাফন। তার পা সাংকেল পাখির মতো খিলখিলে হোক, পেট শুকনো কুমড়ো খোলের মতো চামটা হোক বুকের ঝোড় লোম আর বাহুর কব্জিতে হালাল কামনা খরিয়েই থাকে। সেখানে একাই তিন পাইয়ের(সারি) মুনিশ আলামত। শরীরের এই খিদমতেই তো তার সাড়ে তিন জোড়া বিটি। বউকে ছেলে বন্ধ করা অপারেশন করতে দেয়নি আলামত। সে কুফরি কাজ করলে নাকি সাতগুষ্ঠি দোযখে যাবে!
ঘড়ার জল চোখে মুখে দিল আলামত। তিনবার ফুঁৎ ফুঁৎ করে কুলি ফেলে দোয়া পড়ল। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে পিতল রঙের সূর্যটার অবস্থান দেখল। বাবলা গাছের মটকা ডালটার আন্দাজ দিয়ে সময় পরিমাপ করল। নাহ, জোহরের(দুপুরের নামাজ) ওয়াক্ত আসতে এখনও দেরি আছে। খলিল সেখের বিলের ধারের বাতাল করা সরিষার খেতে এক ঝাঁক সাদা বক আর দুটো সাংকেল পাখি উড়ছে আর বসছে। চষা মাটির ফাঁকফোকর দিয়ে বেরোনো পোকামাকড় খাচ্ছে তারা। পেটে তখন ছুঁচো দোড়চ্ছে আলামতের। সেটা বোঝা গেল যখন গায়ের ঘামে ভেজা স্যান্ডো গেঞ্জিটা পড়পড় করে খুলল। চামটা পেট যেন তক্তপোশের পেরেক দিয়ে পিঠের হাড়ের সঙ্গে সেটে আছে। তা দেখে শারাফান ঠেস মারল, “কতদিন বুন্নু, দুইট্যে মুড়ি গামছায় বেন্ধি লিয়ি যাও গ। ভাত খাতে খাতে সেই ব্যালা গড়ি যায়। মিনসে কথাই শুনবে না। য্যাখুন খিদির লেগি প্যাটে খিল লেগি যাবে ত্যাখুন ঠাপ বুঝবে।“
“আমাধের রুজা করা শরিল। খিদি প্যাটে কামুর বসান্যের হিম্মত পাবে? উসব ধৈযয্য ধরার সিয়াম করা আচে।“ মুখে জলের কুলিটা ঘড়ঘড় করে ফেলে বলল আলামত। শারাফন খোঁচা মারল, “প্যাটের খিদির ধৈযয্য তো ভালোই ধত্তে পারো, শরিলের খিদির ধৈযয্য ধত্তে ক্যানে পারো না? ত্যাখুন বুঝি শয়তানকে ভাগারু ল্যাও?”
“তওবা তওবা, অ্যা তুমি কি কুফরি কথাবাত্তা বুলচ! স্বামী ইস্ত্রির পবিত্র সঙ্গমে শয়তানকে ভাগ বসালা! জাহান্নামে যাবা। ওজু করি না-পাক শরিল পাক করি ল্যাও। শয়তানে তুমাকে মুরিদ করি ফেলিচে।“
শারাফন জমিনের মানুষটাকে অত ভয় না করলেও আসমানের খোদাকে ভয় করে। সে ভয় তার চোখ কান ফুঁড়ে ঢুকে মনকে স্বামীর সব খিদে মেটানোর খিদমতি করে তোলে। আলামত সে মনে ঢুকে যতটা না মনের তার ঢের বেশি শরীরের মরদ হয়ে ওঠে। কি ঘর কি মাঠ, কি আগার কি পগার সব জায়গায় কালমা পড়া দোয়া পড়া হক আদায় করে। আর সে নেক ইচ্ছে হাসিল করার আগে আলামত তার বিড়ি খাওয়া লাল কালো ঠোঁট দিয়ে একটা মিহি করে শিস দেয়। শারাফন সে শিস শুনে বুঝতে পারে এবার তাকে সমুদ্রের গহিন খাতে ডুবতে হবে। সে স্বামীর এই ইচ্ছেটাকে কোনভাবেই খাটো করে না। স্বামীর এই ইচ্ছেকে অস্বীকার করলে নাকি আল্লাহ অখুশি হন। ‘নাদান অরত’এর ওপর গজব নেমে আসে। তাই শারাফন শয়তানের সে খপ্পরে পড়ে না।
গামলায় ভাত। গরম ভাপ উঠছে। সে ভাতে ঠেসে বসানো তরকারির বাটি। আলের ওপর লেটা মেরে বসল আলামত। হাঁটুতে ধুলো কাদা গদগদে করে লেগে আছে। ফেজ টুপির তলা দিয়ে যে কটা কাঁচাপাকা চুল পেঁয়াজের শেকড়ের মতো আউলঝাউল হয়ে আছে তাতেও ফেঁসো হয়ে আছে ধুলো। গামছার বাঁধনটা খুলেই আলামতের মনটা খুশিতে নেচে উঠল। শারাফন আজ তার প্রিয় সবজিটা রেঁধেছে। ছোলার ডাল দিয়ে পুঁই চচ্চড়ি। জান ভরে খেল আলামত। শারাফন মোটা ঢেলাটার ওপর দ হয়ে বসে আলামতের সে গবগবে খাওয়া দেখল। এঁটো থালা সুন্নত করে চেঁচেমুছে খেয়ে শেষে আল্লাহকে শুকরিয়া আদায় করল আলামত। তার মাঝে শারাফনের দিকে একবার তাকিয়ে ঠোঁটে মিস্টি হাসি এনে বলল, “আহা! পুঁই চচ্চড়িডা কি ভালো রান্ধো তুমি! অ্যাকিবারে ফেরেস্তার হাত।“ শারাফন মুখ টিপে হাসল। মাথার ঘোমটাটাকে চোখ পর্যন্ত নামিয়ে বলল, “আমার কুনডা আবার খারাপ। সবই তো চেটিপুটি খাও।“ আলামত বউয়ের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। ঢগঢগ করে জল পান করে একটা লম্বা ঢেঁকুর তুলল। তার চামটা পেটটা তখন ফুলে ভুঁইয়ের তরমুজ হয়ে উঠেছে। আলামত সে পেটে একবার হাত বোলাল। আলে লেটা মেরে বসে শারাফনকে বলল, “খুশি তো হাঁটতে শিখি লিলো। ইব্যের কী ভাবচ।“
“আর লিবো না। খুশিতেই খতম করি দ্যাও। আমার কোল ঝুলে ঝিল্লি হয়ী গ্যালো।”
“জাইত বংশে একটা ব্যাটা না থাইকলে হয়? বাপ দাদোর বংশডা তো বাঁচি থুতে হবে? ব্যাটা হল কি না বংশের ঝাড়।” দাঁতে খিলেন দেয় আলামত। আবারও একটা ঢেঁকুর তুলে বলে, “তাছাড়া বিটিরা তো সব পরের বাড়ি চলি যাবে। বুড়হে কালে বালা মুসিবতে আমাদের কে দেখবে?”
“ক্যানে, তুমার আল্লা?” আল্লার খোঁটা দেয় শারাফন। এবার আর আসমানের খোদাকে ভয় পায় না। এখানে যেন সে আল্লাহ খোদার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একজন যোদ্ধা। আল্লাহর কাছে কাণায় গন্ডায় হিসেব চায়, আল্লাহর অত বড় রহমতের ঝোলাতে আমাদের জন্যে কি একটা বেটাও ছিল না? একটা কানা পুকড়েও তো দিতে পারতেন? শরীরের রসকষ হাড়মাংস নিংড়ে নিংড়ে বিটি মানুষ করে আমরা কোন বেহেশতে যাব?
“আল্লা কি আমাধের ছেলি হওয়ার লাড়ি কেটি দিয়চে নাকি? অ্যাখুনও শরিলে ফুল আচে। ফল লিলেই ল্যাওয়া হবে।“ আর যায় কোথায়। শারাফন স্বামীর ওপরে একেবারে হামলে পড়ল, “আরও পাঁচটা বিহি করো গা। দিয়ি আরও দশটা ব্যাটা বিটি ল্যাও গা। তুমার গা থেকি গোস্ত ঝরি পল্লেও লাড়ি থেকি রসকষ ফুরাবে না!“
“আমি ভাবছুনু খিজমতের কথাডা।“ ফিস করে বলল আলামত। কথাটা ফিস করা হলেও তেতে থাকা শারাফনকে ফোঁস করে ছোবল মারল। তার লাল চোখ ঘোলা হয়ে এল। আসমানের খোদার ওপর টন হয়ে থাকা রাগ জমিনের এক মানুষের ওপর পড়ল। সে মানুষ তার দেওর খিজমত। দাঁত খিটিয়ে শারাফন বলল, “অ আল বিল ডুমনি ডহর খাওয়া হারামি লোককে বেঁচি থাইকত্যে আমি অর ফন্দি সফল হতে দিব না।“
“সে জন্যিই তো বুলছুনু, আর্যাকবার যদি চেষ্টাচুষ্টি করা যাতোক।“ নিশপিশ নিশপিশ করল আলামত। শারাফন চোখ নাচিয়ে উঠল, “চেষ্টাচুষ্টি কি শুদু অ্যাকটা জিনিসেই কল্লে হবে? দুনিয়ায় কি আর অন্য কুনু পথ রাস্তা নাই?”
আলামতের মুখটা ঢেলাতে ঢাকা ঘাসের মতো পানসে হলুদ হয়ে উঠল। খুঁটল চোখগুলো ঘা খেয়ে আরও খুঁটলে ঢুকে যেতে লাগল। আসলে শারাফনের কোন দোষ নেই। সেইই বা আবার কতবার পোয়াতি হবে? বয়সও তো একটা ব্যাপার। এমনিতেই মাজা পড়ে খোল হলো বলে। আর দু এক ঝাঁকান নিলেই মাজাটা কট করে পড়ে ধনুক হয়ে যাবে। এই তেল পুড়া নুন পুড়া শাকপাতা খাওয়া গতরটা দুনিয়ার কম তো ঠেলা নিল না? সাতবার প্রসব হয়ে এখনও আলামতকে টানে। কিন্তু খিজমত আলির মতলব তার হাড়ে সয় না। খিজমত আলামতের ছোটভাই। সে আবার চার বেটার বাপ। ফলে বংশে তার লাঠির জোর বেশি। সে ধান্দায় আছে, আলামত মরলেই আলামতের জমির একটা ভাগ পাবে সে। ইসলামি শরিয়তের এটাই দস্তুর। যে ভাইয়ের ছেলে সন্তান নেই তার জমিজমার একটা অংশের ওয়ারিশ তার ভাইয়েরা হবে। আর এখানেই সবচেয়ে বেশি ভয় শারাফনের। আলামতের দেখভালে খামতি রাখে না। অসুখবিসুখ হলেই ডাক্তার দেখায়। নিয়ম করে ওষুধ খাওয়ায়। মজাক করে গায়ে জ্বর হলেই হাসপাতাল ছুটে। যেন মরণের ফিরিস্তা আজরাইল জান কবজ করতে আসলেই তাকে রে রে করে তাড়াবে। কিন্তু সে আর ক-দিন? খিজমতের চেয়ে বয়সে আলামত দশ বছরের বড়। আল্লাহ এমন কিছু না করলে গড় আয়ু অনুযায়ী খিজমতের মরার দশ বছর আগেই আলামতের ইন্তেকাল হবে। তখন শরিয়ত অনুযায়ী আলামতের সম্পত্তির একটা অংশের ওয়ারিশ হয়ে যাবে খিজমত। পরোক্ষভাবে যার মালিকানা যাবে খিজমতের বেটাদের অধীনে। যা কোনভাবেই মেনে নিতে পারবে না শারাফন। আলামতরা তিন ভাই। আলামত বড়। মেজ রহমত কবেই ইন্তেকাল করেছে। সে আলামতের পরে মরলে সেও আলামতের জমির একটা অংশের ওয়ারিশ হত। এই বেটা না থাকা বাপের জমির ওয়ারিশ কোনভাবেই ভাই চাচাদেরকে হতে দেবে না শারাফন। এ নিয়ে সে শরিয়তের এই নিয়ম নীতিকে গালমন্দও করে। আল্লাহ রসুলের ফরমানকে খাটো করে।
আলামতের কথাতে যতই খচুক শারাফন, দেওর খিজমতের কথাটা উঠতেই তার নাড়িতে অন্য জেদ পাক মেরে উঠল। সে জেদ বেটার মা হওয়ার জেদ। সে জেদ বংশের খুঁটি পোঁতার। এবার ফিক করে হাসল শারাফন। বলল, “জানো, খুশির বাপ, আমি গ্যালো রাইতে খোয়াব দেখিচি, আমাধের একটা ফুটফুটে ব্যাটা হয়িচে। তুমাকে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বুলি ডাকচে।“
“ওই দ্যাখো, আল্লা ইব্যের মুখ তুলি তাকিচে। তুমার ই খোয়াব সত্যি হবে। আল্লা আর কত ধৈয্যের ইমতেহান লিবে!“ আলামতের পানসে হলুদ মুখটা পাকা ধানের শিষের মতো আচানক খিলখিল করে উঠল। সে পাকা ধান কার্তিকের মিস্টি হিম রোদ পড়লে যেমন সোনার হাসি হেসে ওঠে আলামতের মুখে তেমনই খিলখিলে হাসি। আলামত এবার তার এক মুখ দাঁড়ির মুখটা উপরের দিকে তুলে মিনমিন করে দোয়া পড়ল। যেন আলামত তার ইবাদতের দৃষ্টি দিয়ে আসমানের খোদার সঙ্গে মিনমিন করে কথা বলছে। আসমানের খোদা তাকে বলছেন, ‘শোন আলামত, তুই আমার নেক বান্দা। এই দ্বীন দুনিয়ার মুকলুকাতের সমস্ত জীবের রুজির মালিক আমি। কে দানাপানি পাবে আর কে দানাপানি পাবে না তা সবই ঠিক করি আমি। অদৃশ্য জীব থেকে জ্বিন ইনসান সবাইকে রিজিক দিই আমি। তুই খামোখা কেন সন্তানের পেটের খাবারের কথা ভাবছিস? যতদিন শরীরে বীজ আছে ততদিন ফল নিয়ে নে। তুই তো জানিস, ও বীজ কুফরি কাজে নষ্ট করলে আমি তাকে গোনাহ দিই। তার জন্যে বরাদ্দ করি দোযখের বিছানা। নিয়ে নে আলামত। নিয়ে নে।‘
“তাইলে লিয়েই লি।“ আমলরত মুখ থেকে আনখেয়ালে কথাটা বের হয়ে এল আলামতের। এবার আর দাঁত খেঁকিয়ে উঠল না শারাফন। বিড়বিড় করে আলামতকে গালিও দিল না। উল্টে ঠোঁটের ফাঁকে একটা দুষ্টু হাসি হাসল। আলামত সে হাসির রহস্য বোঝে। এবার বেটা পয়দা করতে চাই আলামত। ভাই খিজমতের বাসনা যেন কোনদিনই সফল না হয়। তার মুখে যেন সপাটে একটা থাপ্পড় দিতে পারে। কোলকুঁজো হয়ে এঁটো গামলা বাটিগুলোকে গামছা দিয়ে বাঁধার সময় হেমন্তের উত্তরে হাওয়ায় মাথার চুলগুলো ফিনফিন করে উড়ছে শারাফনের। শারাফনের সেই এলোকেশি গায়ে পড়ছে কার্তিকের ডাগর রোদ। সে রোদ খিলখিল করছে। শারাফনকে তখন মনে হচ্ছে ঝেপে ওঠা ফসল। আলামত তো এই ফসলেরও হালাল হকদার। আলামতের মনে কে যেন আলতো করে ধাক্কা দিল। আল থেকে পা তুলল আলামত। সূর্যটা তখন কার্তিকের আকাশটাকে মিঠে রোদ দিয়ে ঘষে বটগাছটার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে। আলামত তার খুঁটল চোখ দিয়ে বাবলা গাছটার মগডালটার দিকে তাকাল। ঠাহর করল, জোহরের ওয়াক্ত হল বলে। আজ নামাজটা কাজা হয়ে যাবে। না-পাক শরীরের নামাজ জায়েজ নয়। পাপে ঢেকে যাবে শরীর। ধানের জমি সরিষার জমি আলুর জমি আগার পগার আল বিল জুড়ে বেহেশতের ফুল ছিটাতে শুরু করে দিয়েছে ফিরিস্তারা। সে ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে আলামত। আর সে ঘ্রাণের মধ্যে শুনতে পাচ্ছে, একটা ফুটফুটে বেটা তাকে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকছে।