পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মাটিকুটুম

  • 28 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1072 view(s)
  • লিখেছেন : নী হা রু ল ই স লা ম
মাঠের মধ্যে একটা ছোট স্টেশন। সেখানে একটা ট্রেন বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। কীসের দাবিতে কোথায় অবরোধ চলছে, তার জের। স্টেশনের মাইকে সেকথা ঘোষণা করা হচ্ছে বার বার। আবার কখন ট্রেণ চলাচল শুরু হবে, কেউ জানে না। সবাই অপেক্ষা করছে।

আজকাল এসব নিত্য ঘটনা। আসগর এতদিন খবরে শুনেছে, টিভিতে দেখেছে। আজ নিজেই পড়েছে খপ্পরেআর এই খপ্পর যে কী যন্ত্রণার, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেণে বসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল সেবাধ্য হয়ে তাই জানালার বাইরে উঁকিঝুকি মারছিলহঠাৎ তখনই তার চোখ পড়ল স্টেশনের নাম লেখা বোর্ডটার ওপরপীরতলা। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিতে। আর কী আশ্চর্য, তার কানের মধ্যে রিনরিন করে বেজে উঠল সেই মেয়েটির কন্ঠস্বর, ‘যহন কুটুম হইলেন, সুমায় পাইলে কুনুদিন যাইয়েন হাঁরঘের বাড়ি। পীরতলায় নেম্যা কহিবেন সোহিমের বাড়ি যাবো’ কতদিন আগে শুনেছিল, হঠাৎ সেই কন্ঠ আবার রিনরিন করে বেজে উঠলশুধু বেজেই উঠল না, মেয়েটিকেও তার মনে পড়ল পর্যন্ততাই বোধহয় সে আর ট্রেণে বসে থাকতে পারল না, ট্রেণ থেকে নেমে পড়ল

প্যাসেঞ্জারের ভিড়, সেই সঙ্গে হকারদের চিৎকারে প্লাটফর্মটা একটা মেঠো হাটের চেহারা পেয়েছে তাই দেখে এতক্ষণের বিরক্তি, রাগ, হা-হুতাশ নিমেষেই সব কোথায় হারিয়ে যায় আসগরের। বদলে শুধু সেই মেয়েটিকেই তার মনে পড়েমেয়েটির কন্ঠস্বর বাজে তার কানে

সেই কতদিন আগে কলকাতা যাওয়ার পথে একদিন ট্রেনে দেখা হয়েছিল। একেবারে আটপৌরে সাধারণ গ্রাম্য একটি মেয়ে ট্রেনে চড়ে লালবাগ হাসপাতাল যাচ্ছিলসঙ্গে ছিল অসুস্থ স্বামীকিন্তু স্বামীর দিকে তার কোনও খেয়াল ছিল নাসঙ্গী যাত্রীদের উদ্দেশে একটানা বকবক করে যাচ্ছিল। সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে তার বকবক ছিল না। রীতিমতো ভারিক্কি সব কথাবার্তা। মানুষ নাকি নিজের কারণে এই দুনিয়া থেকে একদিন বিলিন হয়ে যাবে। আর বিলিন হয়ে গেলে মানুষ আর কোনও দিনই ফিরে আসবে না। যেভাবে গাছ কেটে, মাটি পুড়িয়ে, জল নষ্ট করে এই দুনিয়ার ওপর মানুষ অত্যাচার করছে। দুনিয়া তা সহ্য করবে না। বদলা নিবেই নিবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। যা শুনে খুব অবাক হয়েছিল আসগর। আর যেচে আলাপ করেছিল মেয়েটির সঙ্গে। তারপর গরীব-বড়লোকের প্রসঙ্গে এককথা, দু’কথা আলোচনা হতে না হতে মেয়েটি তাকে একেবারে ‘দাদা’ সম্বোধন করে বসেছিল,হামি কী কোহিবো দাদা- খোদা কোহ্যাছে নিজের লেগ্যা একবেলার খাবার রেইখ্যা বাকি সব খয়রাত করে দিও যারা খেতে পায় না, তাদের দিওকিন্তুক খোদার কথা কে শুনিছে? নিজের তো নিজের, চোদ্দ গুষ্টির খাবার জোগাড় কর‍্যাও মানুষের জোগাড়ের নেশা কমিছে না। তাহলে হামাদের মুতোন মানুষেরা খাবে কী?’

‘কী রকম সেটা?’ সে জানতে চেয়েছিল।

‘ওই যে বুম্বাই না মুম্বাইয়ে কে আদানী আছে! সংসারে মুটেই পাঁচটা মানুষ, তার লেগে নাকি বাড়িতে পাঁচশোটা ঘর! আল্লারে আল্লা! আবার সেই বাড়ির মাসে কারেন্টের বিল আসে নাকি সহত্তর লাখ টাকা!’

মেয়েটির মুখে আম্বানীর বাড়ির খবরটা শুনে আসগর খুব অবাক হয়। কিছুদিন আগে ব্যাপারটা সে নিজেও খবরের কাগজে পড়েছে। কিন্তু একটি সাধারণ মেয়ে এত সব জানল কী করে?

আসগর তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘বহিন- তুমি এত সব জানলে কোথায়?’

‘কেনে টিভিতে দেখাইছিল যে একদিন!’

আসগর ভুলে গিয়েছিল টিভি নামক সবজান্তা বস্তুটাকে। বাড়ি বাড়ি, ঘরে ঘরে যার উপস্থিতি। বাড়ি, ঘর, সংসারের একমাত্র নিয়ামক। নিত্য জীবনে যার ভূমিকা আজ খোদার চেয়েও বড়।

ততক্ষণে মেয়েটি বলতে শুরু করেছিল, ‘জানেন দাদা- হাঁরঘের গাঁয়ের একটা লোক, যার নাম ছিল কলিমুল্লা। পাইট খেটে বেড়াইতো। তারপর কী কর‍্যা দু’তিন বিঘা জমির মালিক হতেই অর নাম হইল কলিমুদ্দিনওই নামে বিহাশাদী করলে। বেটা জন্মাইলেবেটার নাম রাখলে রহমান। সেই বেটা বড় হুই এখুন দু’নম্বরী কারবারে যুক্ত। এখুন অর মেলা পয়সা, মেলা বিষয়-সম্পত্তিরতিন-তিন খ্যানটা ইটভাটার মালিক। যে মাটি শাহাদানা উবজায়, সেই মাটি পুড়িয়ে বিক্রি করে। আর এখুন অর নাম হইয়াছে কলিমুদ্দিন বিশ্বাস। দু’দিন পরে হয়ত হজ করে আসিবে, লোকে তখুন হাজী কহিবে! কিন্তু এখুন সে আপন মুনে যে ছড়াটা সবসুমায় আওড়ায় তা কেমুন শুনবেন?’

আসগর বলেছিল, ‘বল- শুনি।’

‘প্রথমে ছিনু মুল্লা- কলিমুল্লা

পরে হনু মুদ্দিন- কলিমুদ্দিন

বেটা রহমান জন্মালে যেদিন

হামার কপাল ফিরল সেদিন,

###

লোকে এখুন হামাকে বিশ্বাস কহিছে

হামার কথায় দুনিয়া চলিছে ...’

আসগর মেয়েটিকে যত দেখছিল-যতই তার কথা শুনছিল ততই অবাক হচ্ছিল। কিছুই মিথ্যা বলছিল না মেয়েটি। সত্যি এখন কলিমুদ্দিন বিশ্বাসদের মতো মানুষদেরই রাজত্ব দেশদুনিয়া জুড়ে। মেয়েটি হয়ত আরও কিছু কথা বলত, সে শুনত! কিন্তু ট্রেণটা তখন লালবাগ স্টেশনে ঢুকে পড়েছিল। আর মেয়েটি তার অসুস্থ স্বামীকে সঙ্গে করে নেমে গিয়েছিল এই কথা বলে, ‘যহন কুটুম হইলেন, সুমায় পাইলে কুনুদিন যাইয়েন হারঘের বাড়ি। পীরতলায় নেমে কহিবেন সোহিমের বাড়ি যাবো।’

ওইটুকু সময়ে সে মেয়েটির কেমন কুটুম হয়েছিল আর সোহিমটাই বা কে, সেদিন তার জানা হয়নি। তবে সেদিনের ওইটুকু সময়ের সেইসব কথা মনে করে আসগর সিদ্ধান্ত নেয় আজ সে সোহিমের বাড়ি যাবে। মেয়েটির সঙ্গে দেখা করবে। মেয়েটির কাছে আরও কিছু কথা শুনবে। কিন্তু সোহিমের বাড়ির কথা এই ভিড়ে কাকে জিজ্ঞেস করবে? প্লাটফর্মে যে অনেক লোক! সব প্যাসেঞ্জার নাকি স্থানীয়ও আছে এই ভিড়ে? যদি থাকে তাহলে তাদের চিনবে কী করে?

এমন ভাবনার মধ্যে আসগর প্লাটফর্মের নীচেই মাঠের মধ্যে একটা চালা ঘর দেখতে পায়তার সামনের ফাঁকা জায়গাটায় সাইকেল, মোটরসাইকেলের ছড়াছড়িএকটা-দুটো লাদেন ভ্যানের সঙ্গে কয়েকখানা টুকটুক রিক্সাও দাঁড়িয়ে আছে। যদিও দোকানটার চারপাশে হলুদ ফুল ফুটে থাকা সরিষা খেত। তার ভেতর দিয়ে একটা লাল মোড়ামের রাস্তা। দুপাশে অসংখ্য ইটভাটা ছাড়িয়ে গিয়ে উঠেছে দূরে পাকা রাস্তায়। যেখানে নক্ষত্র-যানের মতো একটা-দুটো বাস-লরি এদিক ওদিক করছে।

আসগর বুঝতে পারে, সেখানে নয়, ওই চালাঘরের কাছে গেলেই সোহিমের বাড়ির হদিশ পাবে সে। মেয়েটির সঙ্গে হয়ত সাক্ষাৎ হবে তার!

আসগর প্লাটফর্ম ছেড়ে নেমে সটান আলপথ ধরে চালাঘরটির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করে। হঠাৎ পেছন থেকে ডাক ভেসে আসে, ও জী ভাই- কুন্ঠে যাবেন?

আসগর পেছন ফিরে দেখে আলপথের ধারে সরিষা খেতের ভেতর একজনকে। লোকটি একহাতে নিজের পিঠে ঝোলানো বস্তা ধরে আছে, অন্য হাতে ধরে আছে একটা নিড়ানি। নিশ্চয় সরিষা খেতে ঘাস সংগ্রহ করছিলকিন্তু হঠাৎ তাকে ডেকে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করার কারণ বুঝতে পারে না আসগরঅগত্যা সে ঘুরে দাঁড়ায়। লোকটি এগিয়ে আসে তার কাছে। আবার জিজ্ঞেস করে, কুন্ঠে যাবেন?

এখানে সোহিম কে আছে, তার বাড়ি যাব

লোকটি যেন লাফিয়ে ওঠে, ঠিক ধর‍্যাছি হামি! আপনার চলনই সেকথা কহিছে। ট্রেণে মাজেদার সুথে আপনার সাক্ষাৎ হইয়্যাছিল, আর সে-ই আপনাকে জিয়াফৎ দিয়াছে! তাই লয় খো, বুলেন?

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

আসগর একথা বলতেই লোকটি বলে উঠল, তাহলে আর দাঁড়িয়ে কেনে? চলেন! হামি লিয়ে যেছি আপনাকে মাজেদার কাছে

মেয়েটির নাম তাহলে মাজেদা। সেদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করা হয়নি। কখন লালবাগ স্টেশন চলে এসেছিল, তাও টের পায়নি। মেয়েটি তার অসুস্থ স্বামীকে সঙ্গে করে ট্রেণ থেকে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু এই লোকটি কে? মেয়েটির সঙ্গে ট্রেণে দেখা হয়েছে, মেয়েটি যে তাকে জিয়াফৎ দিয়েছে, লোকটি এতসব জানল কী করে?

আসগর কিছুই বুঝতে পারে না। সরিষা খেতের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেমন আজ পর্যন্ত বুঝতে পারে না সবুজ সরিষা গাছে হলুদ ফুল ফোটে কীভাবে? সেই ফুল আবার কীভাবে লালচে দানা দানা সরিষার জন্ম দেয়? লালচে দানা দানা সরিষা আবার কীভাবে নিজের বুকের মধ্যে ঝাঁঝালো তেল জমিয়ে রাখে?

তাকে ছাড়িয়ে বেশ অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়েছিল লোকটি, আসগর খেয়াল করেনি। লোকটি আবার তাকে ডাকতে খেয়াল করে, আর সে লোকটির পিছু ধরে।

কাছাকাছি আসতেই লোকটি ফিসফিস করে বলে, ওই চায়ের দোকানের দিকে তাকায়েন না। ওখ্যান থেক্যা কেহু কিছু কহিলে কুনু উত্তর করিয়েন না খো। শালারা সব হারামির হদ্দকাম নাই-কাজ নাই, দিনোমান চায়ের দোকানে বস্যা খালি গুলতানি মারে। রাস্তায় নতুন লোক দেখলে দগ্ধায়আবার রাইত নামলে চুরি-ছিনতাই করে না হয় দুনম্বরি কারবারে নাম লেখায়।

লোকটিকে কেমন রহস্যময় লাগে আসগরের। যদিও সে লোকটির কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করে

চালাঘরটা যে সত্যিই একটা জমজমাট আস্ত একটা চায়ের দোকান, পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে তাকাতেই টের পায় আসগর। কিন্তু সেখান থেকে যে সব শব্দধ্বনি ছুটে আসে তার কানে, শুনে পা নড়াতে পারে না সেরাস্তার লাল ধুলো তার পা যেন আঁকড়ে ধরে

দ্যাখ্ বে, শালা সোহিম আজ আবার কাকে সুথে করে লিয়ে যেছে!

হবে কুনু পাগল-ছাগল!

আসগর চমকে ওঠে! পাগল-ছাগল বলার কারণে সে চমকে ওঠে না। আজকাল যে কেউ যে কাউকে যা খুশি বলতে পারে! যে কোনও তকমায় ভূষিত করতে পারে! এটাই এখন দেশদুনিয়ার দস্তুর। আসলে সে চমকে ওঠে তার সঙ্গের লোকটিই যে সোহিম, এটা জানতে পেরে। মেয়েটি তাহলে এই লোকটির নাম নিয়েছিল সেদিন। কিন্তু এই লোকটি মেয়েটির কে লাগে? স্বামী? এই স্বামীকেই কি সেদিন হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছিল মেয়েটি? কিন্তু কই চিনতে পারছে না তো! লোকটিকে সেকথা জিজ্ঞেস করবে, তার আগে ছুটে আসা শব্দধ্বনি আরও কিছু কথা বলে, আসগর শুনতে পায়।

{মাটিকুটুম : }

দেখার কী আছে? অ্যা আর নতুন কী! রোজকার ব্যাপার। রোজহি শালা কাহুকে না কাহুকে সুথে লিয়ে যায়। কী ছিঁড়া গেলছে তাতে? এখুন তাস খেলছিস তাস খেল তো! উসব দেখে হাঁরঘের কী কাম?

কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগলেও চায়ের দোকানটিকে ঘিরে কৌতুহল তৈরী হয় আসগরের। চায়ের দোকানটিকে ভাল করে দেখার ইচ্ছা হয় তার লোকটির সাবধানবাণী ভুলে তাই সরাসরি দোকানটির দিকে তাকায় সে।

পেছন দিক থেকে চালাঘর মনে হলেও সামনের দিকে রীতিমতো জমাটি চায়ের দোকান একটা। ভেতরে বেশ কয়েক জায়গায় তাসের আসর বসেছেএকটা ক্যারাম বোর্ডও আছে। খট খট আওয়াজ উঠছে সেই বোর্ড থেকে। একপাশে একটা টিভিও চলছে। হিট বাংলা সিনেমার ডায়ালগ ভেসে আসছে কানে, ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে।’

দাঁড়িয়ে রহিলেন যে! চল্যা আইসেন।

আসগর লোকটির ডাক শুনতে পায়। কিন্তু কী করে যাবে, বুঝতে পারে না। তার পা সত্যিই রাস্তার ধুলোয় আটকে আছে। লোকটি হয়ত সেটা টের পায়, তাই ছুটে আসে তার কাছে, তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারে। আর রাস্তার ধুলোয় আটকে থাকা তার পা আলগা হয়, সে আবার হাঁটতে শুরু করে।

রাস্তা বলতে সেই লাল মোড়ামের রাস্তা। সরকার রাজ্য থেকে সব লাল মুছে দিতে চাইলেও বিবাহিত মহিলার সিঁথি আর গ্রামবাংলার রাস্তায় এই লাল রঙ এখনও রয়ে গেছে। ব্যাপারটা ভাবনাতে আসতেই একটু যেন খুশি হয় একসময়ের বামপন্থী রাজনীতি করা আসগর। বুকে বল পায়। কোথা থেকে যেন তার শরীরে হাঁটার শক্তি ফিরে আসে। সে জোরে, আরও জোরে হাঁটতে শুরু করে। সঙ্গের লোকটিকে মনে থাকে না, তার লক্ষ্য হয়ে ওঠে দূরের ওই পাকা রাস্তা। যেখানে নক্ষত্র-যানের মতো একটা-দুটো বাস-লরি এদিক ওদিক করছেএকটু পরেই যে সূর্য পাটে বসবে, তার সেই খেয়াল থাকে না।

লোকটির কিন্তু খেয়াল থাকেসে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওই ধারে কুন্ঠে যেছেন জী ভাই?

আসগর দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘুরে দেখে, লোকটি তাকে হাতের ঈশারায় কাছে ডাকছে। এক্ষুনি যে অন্ধকার নেমে আসবে, এতক্ষণে বুঝতে পারেআর অন্ধকার নেমে এলে লোকটিকে আর দেখা যাবে না। আর লোকটিকে না দেখা গেলে সে মাজেদা নামের সেই মেয়েটির কাছে পৌঁছতে পারবে না।

দেরী করে না আসগর, ফিরে লোকটির দিকে হাঁটতে শুরু করে। লোকটির কাছে পৌঁছে জিজ্ঞেস করে, কী হল?

ওই ধারে কুন্ঠে যেছিলেন আপনি? ওই ধারে মাজেদার বাড়ি নাকি!

তবে কোন ধারে? আসগর জিজ্ঞেস করে।

হাঁর সুথে আইসেন।

বলে লোকটি লাল মোড়ামের রাস্তা ছেড়ে আবার আলপথ ধরে। দেখাদেখি সেও।

দুপাশে সারি সারি ইটভাটাবড় বড় চিমনিগুলি আকাশ ছুঁয়ে আছেগলগল করে কালো ধোঁয়া উগরাচ্ছে তাতেই আকাশে বিষ বাস্পের আস্তরণ। ভাটা লাগোয়া জমিতে ফসলের জায়গায় কোথাও কাঁচা ইট বিছানো, কোথাও আবার শুকনো ইট-পোড়ানো ইটের খামাল দাঁড় করানো কোথাও ভাটা শ্রমিকদের ছোট ছোট ঝুপড়ি তো কোথাও ছোট ছোট মাটির পাহাড়, তার ওপর বুনো হলুদ ফুল ফুটে থাকা কাঁটা ঝোপের জঙ্গল। আর আছে বাতাসে মাটি পোড়ার গন্ধ। এসব দেখে মন খারাপ হয়ে ওঠার কথা, কিন্তু আসগরের মন খারাপ হয় না, তার মনে রীতিমতো ভয়ভাব জাগে! মাজেদা নামে একটি মেয়ের ডাকে এই বিদেশবিভুঁইয়ে এসে শেষপর্যন্ত তার কী গতি হয়, কে জানে!

এমন ভাবনা থেকে লোকটিকে আরেকবার ভাল করে দেখে আসগর। পিঠে বস্তা নিয়ে লোকটি তার আগে আগে হেঁটে চলেছে নির্বিকার।

কিন্তু কোন গন্তব্যের উদ্দেশে হেঁটে চলেছে লোকটি? দৃষ্টি প্রসারিত করে কোথাও কোনও গ্রাম কিংবা কোনও জনবসতি চোখে পড়ছে না। কে জানে সত্যিই ভুল লোকের পাল্লায় পড়ল কিনা! আসগরের সন্দেহ হয় কিছু জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবে! কিন্তু লোকটিকে দেখে তেমন মনে হয় না, সেদিন ট্রেণে একটু দেখা আর আজকে চায়ের দোকানে শোনা কথা মতো এই লোকটিই যে মাজেদার স্বামী, এই লোকটির নামই যে সোহিম, এতে কোনও সন্দেহ থাকে না তার সেই ভরসায় আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। লোকটির পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।

দু’পাশে সারি সারি ইটভাটা মধ্যে সরু আল পথ। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেকক্ষণ পর বেশ খানিকটা দূরে ডাঙা মতো একটা জায়গা দেখতে পায় আসগর। সূর্য পাটে বসলেও তখনও অন্ধকার ঘনায় নিতার চোখে সবকিছু স্পষ্ট একেবারে নানারকম গাছপালায় ভর্তি একটা সবুজ ডাঙা। তার মধ্যে মাটির পাঁচিল ঘেরা বাড়ির মতো একটা কী! সুন্দর নিকানো, গুছানো! একেবারে ছবির মতো।

ঘোরের মধ্যে আসগর পাঁচিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। টাটির ঝাঁপের একটা দরজাও দেখতে পায়। বিস্ময় কাটে না তার। ধূসর মাঠের মধ্যে এরকম একটা সবুজ ডাঙা! আবার এরকম একটা মাটির বাড়ি! এমন জায়গায় কার বাড়ি এটা? কে থাকে এই বাড়িতে? আসগর ভাবতেই আছে, সঙ্গের লোকটি বলে উঠল, এই দ্যাখেন এইটাই মাজেদার বাড়ি! এই বাড়িতেই মাজেদা থাকে। যান, ভিতরে যান আপনি! দ্যাখেন গা মাজেদা আপনার লেগ্যা ইন্তেজার করছে!

মাজেদা তার জন্যে ইন্তেজার করছে! কেন ইন্তেজার করছে? তাছাড়া মাজেদা কী করে জানল যে সে আসছে? আসগর কিছুই বুঝতে পারে না। শুনশান বাড়িটার টাটির ঝাঁপের দরজার সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গের লোকটি আবার বলে ওঠে, কী হইল দাঁড়িয়ে রহিলেন যে? ভিতরে যান!

আসগরের ভয় করে। আবার কৌতূহলও জাগেতাই সে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে না, টাটির ঝাঁপ খুলে ভেতরে প্রবেশ করে কিন্তু কোথায় মাজেদা? বাড়িটায় কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন খুঁজে পায় না। বদলে আঙিনায় শুকনো পাতায় ঢাকা এঁটেল মাটি নিকানো ঢিপির মতো একটা কিছু দেখতে পায়।

কী এটা? লোকটি মাজেদার কাছে নিয়ে যাচ্ছি বলে তাকে এইখানে নিয়ে এল কেন? লোকটি কি তাহলে সোহিম নয়? তাহলে যে ওই চায়ের দোকানে ওরা বলাবলি করছিল, ‘দ্যাখ্ বে, শালা সোহিম আজ আবার কাকে সুথে করে লিয়ে যেছে ...’!

পেছন ফিরে সঙ্গের লোকটিকে খোঁজে আসগর। দেখতে পায় না। এবারে ভয় বা কৌতুহল নয়, রীতিমতো আতঙ্ক ঘিরে ধরে তাকে। শেষপর্যন্ত নিজের জান নিয়ে টানাটানিতে না পড়তে হয়!

কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না আসগর ঠিক তখনই হঠাৎ ঢিপিটার ভেতর থেকে রিনরিন কণ্ঠে কে যেন বলে ওঠে, এতদিনে আইলেন দাদা? বড্ড দেরি কর‍্যা আইলেন! আপনার বহিন আর আপনাদের ইট-কাঠের দুনিয়াতে নাই

আসগর এবারে যেন সত্যিকারের ভয় পায়। ভাববার শক্তি হারিয়ে যায় তার। সে আর বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পায় না। সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করেআর টাটির ঝাঁপের কাছে সোহিম নামের লোকটিকে বসে থাকতে দেখতে পায়। লোকটি কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এই ডাঙার মাটি কাটতে বাধা দিয়াছিল বুলে মাটি-মাফিয়ারা হামার মাজেদাকে খুন কর‍্যা এখানে পুঁতে রেখ্যাছে দাদা। হামার মাজেদা কবরের ভিতর বিচারের লেগে তড়প্যাছে। কেহু অকে বিচার দিছে না ...

0 Comments

Post Comment