পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এক উদীয়মান গৈরিক ভারত

  • 17 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1502 view(s)
  • লিখেছেন : অভিষেক রায়
দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটা ভেঙে দিতে পারলে আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি পঙ্গু করে দেওয়া যায় এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত আনা যায়। গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সার্বভৌম সংবিধান বহাল থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা সম্ভব নয়।

২০১৫-র সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পনেরো মাসের মধ্যেই তার উৎস সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ একটি জাতীয় স্তরের কোওর্ডিনেশন মিটিংয়ের ডাক দেয় দিল্লীতে। সেই মিটিঙে যোগ দিয়েছিল সঙ্ঘের বেশ কিছু সমগোত্রীয় সংগঠন। মিটিঙের উদ্দেশ্য ছিল বহু উল্লেখযোগ্য ও বিতর্কিত লোকনীতি বা পাব্লিক পলিসি বিষয়ে বিশদে আলোচনা। সঙ্ঘে এই কোওর্ডিনেশন মিটিং খুব প্রচলিত কিন্তু। ২০১৫-র মিটিংয়ের বিশেষ তাৎপর্যটি হল— এক. যে বহু বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দেওয়া হত এই সব মিটিঙে তা রাখা হয়েছিল; দুই. সংগঠকরা খোলাখুলি ভাবে মিডিয়ার সঙ্গে মিটিং বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী ছিল; তিন. মিটিঙে সমগোত্রীয় দলগুলির বিবাদও প্রকাশ্যে আনা হয়েছিল। মনে করা হয়, অটলবিহারী বাজপেয়ীর এনডিএ সরকারের চাইতে নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ সরকারের সঙ্ঘের সঙ্গে যোগসূত্র অনেকটাই খোলাখুলি ও স্পষ্ট। এই বৃহত্তর আলোচনার পরেই নাকি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রাচীন পলিসির অনেকটা রদবদল ঘটে। বিজেপি এবার আটঘাট বেঁধেই আসরে নেমেছে।

একটু পিছনে ফেরা যাক।

এম এস গোলয়ালকর তার ‘চিন্তন গঙ্গা’ বইতে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। সঙ্ঘের ‘অখণ্ড ভারত’ বহুল প্রচলিত। বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টি গোলয়ালকরের সেই ইচ্ছা অনেকটাই পূরণ করল।

কি ভাবে! এই যুক্তরাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কাঠামো ভেঙে ফেলার অভিনব পন্থা হিসেবে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স অর্থাৎ জিএসটি প্রণয়ন। জনতাকে বোঝানো হল এতকাল নির্দিষ্ট কোন পণ্য ও সার্ভিসের জন্যে বিভিন্ন ধরণের ট্যাক্স আলাদা ভাবে দিতে হত। কিন্তু এখন ভারত সরকার একটিই ট্যাক্স আনল যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকল বাকী সব ট্যাক্স। খুব ঘটা করে মধ্য রাতে সাংসদে ঘোষণা করে দেখানো হল জিএসটি হল এক উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সংস্কার। যেমন ২০১৬-য় মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে জিএসটি-র মাধ্যমে রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা নিমেষে ছিনিয়ে নেওয়া হল। রাজ্যগুলি তাদের বরাদ্দের ন্যুনতম ভাগ থেকে বঞ্চিত হয়ে কেন্দ্রের কাছে নিত্য দ্বারস্থ হচ্ছে। তবে এই বৃহত্তর সংস্কারগুলো চটজলদি ঘটানো গেল কারণ গত তিন দশকে অর্থনৈতিক সংস্কারের পরে ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থানে এক বিপুল পরিবর্তন এসেছে।

এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে দিলে আমাদের সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য দিকটি পঙ্গু করে দেওয়া যায়। এবং অত্যন্ত সন্তর্পণে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত আনা যায়। এতে অবশ্য খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই। গণতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সার্বভৌম সংবিধান বহাল থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র প্রক্রিয়া প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। এই অপেক্ষা তাদের একশো বছরের! যার সূচনা হয়েছে গোলয়ালকর এবং তারও আগে কে বি হেডগেয়ারের হাত দিয়ে। পদক্ষেপ অবশ্য অনেকগুলোই। একটা গোটা রাষ্ট্র ক্ষমতাকে করায়ত্ত করতে হলে কয়েকটি পদক্ষেপে কাজ হওয়া সম্ভবপরও নয়। আসলে সব কিছু হতে হয় ধাপে ধাপে।

তাই আরেকটি জোরদার পদক্ষেপ হল হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া। এই সবগুলোই তাদের মূল ভারতীয় বহুত্ববাদের বিরোধিতা করে এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, এক জাতি, এক নেতার সার্থক রুপায়ন ঘটানো।

শিক্ষা ক্ষেত্রেও গল্পটা আরো ভয়ঙ্কর। ইতিহাস এবং শিক্ষা এই দুটি ক্ষেত্রে আরএসএসের সুপ্রাচীন কাল থেকে আগ্রহ ও উৎসাহ। কিছু গড়তে গেলে নরম মাটিই তো প্রয়োজন। পাঠ্যপুস্তকগুলো এ ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার। সেখানে নিজেদের এজেন্ডার ইতিহাস ভরপুর করে দিলে কাজটা মসৃণ হয়। এই ইতিহাস পরিবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্যই হল মুসলমান শাসকদের ভারতীয় ভূখণ্ডের শোষক রূপে দেখানো। গোলয়ালকরের তত্ত্ব অনুযায়ী মুসলমান, খৃস্টান এবং কমিউনিস্টরা হল দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু, যারা নাকী বিদেশী শাসকদের থেকেও ভয়ঙ্কর।

সাম্প্রতিক একটি সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ষষ্ট শ্রেণির ইতিহাস ইতে লেখা হয়েছে ‘টিপু সুলতান ফরাসীদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের যুদ্ধে পরাস্ত করেছিল’। কিন্তু টিপু সুলতানের সময়ে যে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছিল যেমন— গুটি পোকা চাষের সূচনা, ভূমি সংস্কার, কৃষি ঋণ, টাঁকশাল ব্যবস্থা ইত্যাদি বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রায় তিনশো বছর ভারত শাসন করা মুঘলদের বহিঃশত্রু রূপে দেখাতেও তারা মরিয়া।

সিবিএসসি বোর্ডের ইতিহাস বইয়ে মেলে তার নানা নমুনা। যেমন কর্ণাটক সরকারের অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের একটি চ্যাপ্টার Rise of New Religion (নূতন ধর্মের আবির্ভাব), যেখানে ঐতিহাসিক ভাবেই বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মকে নূতন ধর্ম হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ওই ধর্মকে হিন্দু ধর্মের দুটি শাখা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের ওপর এই রাগের কারণ কি?

আসলে বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ ধর্ম ভারতে চতুর্বর্ণ প্রথা নিষিদ্ধ করেছিল। আরএসএস হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্ণে বিশ্বাসী।

স্কুলপাঠ্য বই সংশোধন প্রক্রিয়াটি হালের। কারণ এর আগে নিজেদের শাখার বাইরে তারা এসব বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়নি। এতদিন এগুলো ছিল অলংকরণ (Rhetoric)। এখন অনুশীলন (Praxis)।

তবে এসবের চেষ্টা শুরু হয়েছে বিজেপির আগের জমানার সরকার থেকেই। ১৯৯৮ সালে বিজেপি যখন প্রথমবারের জন্যে ক্ষমতায় এলো তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী ‘পৌরহিত্য’ এবং ‘আচার-অনুষ্ঠান’ স্কুল পঠন পাঠনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে জ্যোতির্বিদ্যার বদলে জ্যোতিষবিদ্যা পড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। যদিও তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। এই সব ভিত্তিহীন বিষয় কিশোর মনকে মূর্খতার দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করে না। গেরুয়া শিবিরের গুরু গোলয়ালকর চাইতেন না কিশোর মনের বিকাশ। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের মুখ্য প্রতিনিধি বিজেপি সরকার ২০১৪ থেকে প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেন্দ্রে ক্ষমতায় থেকে সেই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করছে। এখন এই প্রক্রিয়াগুলো খোলাখুলি ভাবেই করে তারা। বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ এখন দেশের বৃহত্তম ছাত্র দল।

সম্প্রতি সিবিএসসি ক্লাস টেনের পাঠ্যসূচি থেকে বেশ কিছু বিষয় বাদ গেছে যেমন গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, কৃষিতে বিশ্বায়নের প্রভাব, গণ আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িকতা। গেরুয়া শিবিরের শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস সাম্প্রতিক কালে প্রভাবশালী। ২০১৪-য় বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যেই গুজরাত সরকার একটি সার্কুলার দ্বারা আরএসএস পরিচালিত বিদ্যাভারতী স্কুল কমিটির মুখ্য সচিব দীননাথ বাত্রার লেখা ছটি বই স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০২-র গুজরাত দাঙ্গার মতো অনেক গুলো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না করতে এনসিইআরটি-র ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

তাদের কৌশল এখানেই। ২০২১-এ উত্তর প্রদেশের স্কুল পাঠ্য বইয়ে বাদ পড়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের লেখা। ওই সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী চৌধুরী চরণ সিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের পাঠ্যক্রমে ঢোকানো হয়েছে বাবা রামদেবের নিবন্ধ এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের একটি বইকে করা হয়েছে অবশ্য পাঠ্য।

আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীবাঈ ফুলে, বেগম রোকেয়া, বাবাসাহেব আম্বেদকর ও আরো বহু ইতিহাস ও লেখা যাঁদের যৌথ প্রয়াসে আজকের ভারতের সার্বিক রূপ নির্মিত হয়েছে। ইতিহাসের ভাষায় আমরা যাকে the idea of India বলি। পালটে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসও। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে না জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা ভাবাদর্শের বহু সংগ্রামীদের কথা যাদের রক্তের সংগ্রামে আজ দেশ স্বাধীন।

আরো কত ভাবে বিকৃত হবে দেশের ইতিহাস আর লেখা হবে তাদের বানানো মনমত ইতিহাস, আমরা সত্যিই জানিনা!

অদূর ভবিষ্যতে হয়ত দেখা যাবে হেডগেয়ারকে হবেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক এবং দামোদর সাভারকর জাতীয় নায়ক— যাকে অনেক কালই ‘বীর’ ভূষণে ভূষিত করা হয়েছে। যিনি আদপে আটবার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন এবং গান্ধী হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। যদিও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পান। অসহযোগ থেকে ভারত ছাড়ো প্রায় সব ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের খোলাখুলি বিরোধিতা করেছেন তিনি।

স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যগগনে গোলয়ালকরের বক্তব্য ছিল ‘হিন্দুগণ, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বৃথা শ্রমব্যয় করো না। নিজ শক্তি বাঁচিয়ে রাখো অভ্যন্তরীণ শত্রু মুসলমান, খৃষ্টান ও বামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে।’ সর্বশেষে, নাথুরাম গডসেই বা বাদ যাবে কেন! হয়ত ইতিহাসে লেখা হবে, তার জন্যেই রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয় হিন্দুরা!

এই গৈরিকীকরণের শেষ কোথায়?

0 Comments

Post Comment