সামনে বিদ্যাসাগরের জন্মদিন ওদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়কের প্রবেশ এবং ধুন্ধুমার । তাই নিয়েই হুতোমের নকশা।
বিদ্যাসাগরমশায়ের জন্মদিনে এবার শুনচি বেজায় ধুমধাম হবে। বাবুদের বাড়ি এদানী বর্ণপরিচয় ঢোকে না, তবে বড় মানুষের জন্মদিন বলে কথা, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ না কল্লে মান থাকে না।
মনীষীদের নিয়ে বাবুদের আহ্লাদের অন্ত নেই। কলকেতা জুড়ে মনীষীদের ছবি লেগেচে, মূর্তি লেগেচে। নিন্দুকে বলচেন সিমলেপাড়ার যে নরেন দত্ত সাধু হয়েচিল তার মূর্তিগুলি এ যুগের কোন পালোয়ানের মতন হয়েচে। মনোহর আইচ না কী যেন নাম। আবার দেবেন ঠাকুরের বিখ্যাত কনিষ্ঠ পুত্রের মূর্তি যাত্রার বাল্মীকির মতন লাগচে। বিদ্যাসাগরমশায়ের এক মূর্তি দেকে ছোট খাটো মানুষটি স্বয়ং বলেচেন বাঙালি তেনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় তেনাকে লম্বা চওড়া বানিয়ে দিয়েচে।
এ সওয়ায় বাবুরা কদিন হল যে মনীষীটির জন্যে আবেগের হরির লুট দিয়েচেন তিনি হলেন দক্ষিণ কলকেতার সুভাষচন্দ্র, যিনি সায়েব খ্যাদানোয় নিজের জীবনটি পয্যন্ত দিয়ে নেতাজি বলে বিখ্যাত হয়েচেন। লোকটি কেমন ছিলেন, হাওয়া হয়ে যাবার আগে কী কী করেচিলেন বাবুদের তাতে উৎসাহ কম। কিন্তুক যুদ্ধের বাজারে বিমান দুর্ঘটনায় মরেচিলেন কি মরেননি তা নিয়ে প্রায় আশি বচ্ছর যাবৎ চায়ের পেয়ালায় সাইক্লোন, টাইফুন, টর্নেডো তুলচেন। এ বালক সে বালককে নেতাজি বলার দিন গিয়েচে বচ্ছর কুড়ি হল। এ মরসুমে বেমক্কা বারোইয়ারি পূজার আগে হুজুগ উঠেচে নতুন নেতাজি খোঁজার। বাবুদের আদরের আঁতেল ছিলিমখোর ফিল্মমেকারটি দায়িত্ব নিয়েচেন মরে ভূত এক ভূঁইফোড় সাধুকে নতুন নেতাজি বানাবেন। ফিল্মমেকারের কপাল মন্দ হওয়ায় সুভাষের নাতি সম্পর্ক বোসজা ইতিহাসের মাস্টার। তেনার সাথে পড়াশুনো না করে তক্ক কত্তে গিয়ে সেদিন টিভিতে নাহক বেইজ্জত হলেন, গালমন্দ বৈ মুখে কথা সরল না। ভদ্দরলোক হলে সেইদিনই ফিল্মটি গুটিয়ে নিতেন, তবে কিনা কাঞ্চনের বাড়া ধম্ম নেই আর দিন কে রাত, রাত কে দিন না কল্লে টু পাইস হয় না। তাই মেকারবাবু স্থানান্তরে হিরোবাবুকে দিয়ে বলিয়েচেন আমরা সকলে কী বিশ্বাস করি সেইটিই বড় কথা। অর্থাৎ কিনা তথ্যপ্রমাণ বিপদের কারণ হলে ফেলে দেয়াই উচিৎ হয়।
ভাবচি এই ফিল্মবাবুদের স্বপ্নে দ্যাকা দিয়ে বলব একালে এমন স্টারের টুকরো নেতা থাকতে খামোকা সেকালের নেতাজিকে নিয়ে টানাটানি কেন?
সেকালের সায়েব খ্যাদানো লোকেরা মিলে যে কালেজটি খুলেচিল সেটি কালে কালে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েচে শুনলুম। তা সেইখানে একালের নেতাকে ঘিরে হল্লা হচ্চে শুনে ইউ জি আর্টস বিল্ডিংয়ের টঙে গিয়ে বসলুম।
সম্পাদক আমায় বলেচিল বটে নেতাটি নীচু দরের গায়ক এবং ব্যর্থ নায়ক, তবে দেকলুম ইনি খলনায়ক হলে দিব্য পসার হত। মেয়ের বয়সী মেয়েদের যেমন দাপটে বল্লেন ঘরে এলেই দেকিয়ে দেবেন তিনি লোকটি কেমন, তাতে শুনলুম একজন ছাত্রী বলচেন “এ কে রে? প্রেম চোপড়া নাকি?” অনুসন্ধানে জানলুম উক্ত চোপড়াবাবু সিনেমায় মেয়ে, বউদের লাঞ্চ্ছনা করে বিস্তর ধনী হয়েচেন।
বিল্ডিংয়ের টঙে বসে পা দোলাচ্চি আর একপাল ছেলেমেয়ের মাঝে পড়ে নেতাবাবু কেমন খাবি খাচ্চেন দেকচি, এমনি সময় খেয়াল হল তিনি যে স্টুডেন্টদের বরণ কত্তে এসেচেন তাদেরও খবর নেয়া কর্তব্য হয়। তা গেলুম দেকতে।
সে মস্ত কাণ্ড। আপনাদের হুতোম স্টুডেন্ট খুঁজে হয়রান, যেদিকে তাকাচ্চি সকলি পাকা গোঁফ, দাড়ি, টাকওলা বাবু আর মা জননী। উপায়ান্তর না দেখে তেনাদেরই একজনকে শুধোলুম। তিনি চোখ পাকিয়ে বল্লেন শেখার কোন বয়স নাই। যে শিখতে চায় সে-ই স্টুডেন্ট। বেদে তাই লেকা আচে। বাবুরো দলে ভারী, তাই বেদ নিয়ে তক্ক জুড়তে ভরসা পেলুম না। ভূতকে যে লিঞ্চ করা চলে না সেকথা হুতোম জানেন, চিরকুমার স্টুডেন্টরা কি জানেন?
মানে মানে সরে পড়ে নেতাবাবুর কাচে ফেরত এসে দেখি তিনি সমুদ্দুরের বালুতে কাঁকড়ার মতন গাড়ির বনেটে শুয়ে আচেন আর কচি ছেলেমেয়েদের স্লোগানের বদলে আপনমনে কত কি বলে যাচ্চেন। ভাবলুম বুজি নেশা করেচেন। নইলে মুখে অমন নাড়ুগোপাল ভাবটি কেন? রসকলিটি থাকলেই যেন নবদ্বীপের গোস্বামী। হুতোমের মনের ভাবটি টেলিপ্যাথিতে জানতে পেরে স্বর্গ থেকে সুভাষচন্দ্র বল্লে “বৈষ্ণব না হাতি। একটু আগে ইউনিভার্সিটির ভি সি কে তড়পাচ্ছিল ওকে রিসিভ করতে আসেনি বলে। নেতাটার কপাল ভাল আমি ভি সি নই। নিজের পায়ে বাড়ি ফিরতে হত না বাছাধনকে। আমার কালে ওর গুরুদেবদের টের পাইয়েছিলাম আমি কেমন লোক।”
নেতাবাবু অবিশ্যি নিজের পায়ে ফিরতে পাল্লেন না শেষ অবধি, রিসিভ কত্তে উপাচার্য আসেননি সেই দুখখু দূর কত্তে আচায্যিমশায় এসে পল্লেন, নিজের গাড়িতে তুলে নিলেন, তবে নেতাবাবুর যাওয়া হল।
আচায্যি যে উপাচার্যের চেয়ে এক কাঠি সরেশ সেকথাও দিব্য বোঝা গেল। উপাচার্যের কচিকাঁচা স্টুডেন্টরা গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান দিয়েচিলেন, নেতাবাবুর নিরিমিষ সাঙ্গোপাঙ্গদের বন্দুক দেখে জামা, চশমা ইত্যাদি আক্রমণ করেচিলেন। আচায্যিমশায়ের চিরকুমার বাহিনী দোকান জ্বালালেন, গেট ভাঙলেন, ইউনিয়ন রুমে ঢুকে চেয়ার টেবিল এটা সেটা ভাঙলেন। এ সওয়ায় দেয়ালে বড় বড় করে নিজেদের নাম লিখলেন।
হুজ্জত মিটে যাবার পর সম্পাদকের আপিসে যাব বলে ইউনিভার্সিটি থেকে বিদেয় হচ্চি, দেখি উপাচার্যের এক স্টুডেন্টের মাথাটি ফেটেচে বলে সঙ্গী সাথী তেনার সেবা কচ্ছেন, এদিকে তিনি বদ্ধ পাগলের মতন হেসে গড়িয়ে পড়চেন। এক সঙ্গী রেগে শুধোলেন রক্তারক্তির মধ্যখানে এমনি ছোটলোকের মতন হাসির কারণ কী? তা তিনি বল্লেন “সেই যে… হিহিহি… এক পণ্ডিত মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বাড়ি গেছিল তাকে মূর্খ প্রমাণ করতে… হিহিহি… মোল্লা বাড়িতে থাকেনি… হিহিহি… পণ্ডিত রেগে আগুন হয়ে দরজার উপর লিখে গেছিল “মূর্খ”… হিহিহি… মোল্লা ফিরে এসে দেখেই পণ্ডিতের বাড়ি ছুট… হিহিহি… বলে ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। আপনি আসবেন খেয়াল ছিল না। বাড়ি ফিরেই দরজার উপর আপনি নিজের নাম লিখে এসেছেন দেখে খেয়াল হল… হিহিহি…”
শুনে উপাচার্যের স্টুডেন্টরা সকলি হেসে গড়িয়ে পল্লেন, আমিও হাসতে হাসতে রওনা দিলুম।